আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আদিবাসী দিবস

একটু পেছনের কথা দিয়েই শুরু করছি। এই বছরের শুরুর দিকে মার্চ মাসের ১১ তারিখ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের সকল সরকারী কার্যালয়কে আদিবাসী দিবস পালন না করা এবং আদিবাসী দিবসে কোন ধরনের সহযোগিতা প্রদান না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে অনেক কথার সাথে এটিও বলা হয়েছিল ‘আগস্ট মাস জাতীয়ভাবে স্বীকৃত শোকের মাস, এ মাসে আদিবাসী দিবসের নামে অপ্রয়োজনীয় আনন্দ অনুষ্ঠান পরিহার বাঞ্চনীয়’। জানিনা এই শোকের মাসে যারা জন্মগ্রহণ করেছে তারা দুঃখের সাথে নাকি আনন্দের সাথে জন্মদিন পালন করেছে। কেউ হয়ত বিয়েও করেনি এ মাসে।

কিন্তু আমি নিশ্চিত বিয়ে, জন্মদিন, পার্টিছাড়াও মানুষ হৈ হুল্লোড় করেই এ মাসে দিন পার করেছে। আবার যথারীতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকও পালন করেছে। কিন্তু কি নির্মম এই পৃথিবী আদিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা কম বলে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি করার দাম্ভিকতা সরকার দেখিয়েছে। এই খবর প্রকাশের পর আদিবাসীরা আতঙ্কিত হয়েছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জন্ম হয়েছে, এই বছর আদিবাসী দিবস পালন করা যাবেতো? তারপরেও আদিবাসীরা অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে আদিবাসী দিবস পালন করেছে।

আমি নিজে ৯ আগস্ট তারিখে ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আদিবাসী দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ৯ তারিখের আগেই খবর পেয়েছিলাম জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আয়োজনে জয়পুরহাটে আদিবাসী দিবস পালনে স্থানীয় প্রশাসন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। তবে সেখানকার আদিবাসীরা প্রস্তুত ছিল প্রশাসন যদি বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তবুও তারা এক পা পিছু হটবেননা। আদিবাসী দিবস পালনে বাধা আসতে পারে সবার এই শঙ্কাকে সত্যি করে দিয়েই যেন আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম আমাকে মোবাইল করে জানালো জয়পুরহাটে আদিবাসীদের মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়েছে এবং আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিংকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পরে জানতে পারলাম হরেন্দ্রনাথ সিংকে এক ঘন্টা পর পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।

এদিকে আদিবাসী ফোরামের জনসভায় এই খবর পৌঁছাতেই সকলে তাদের বক্তব্যে সরকারের তীব্র সমালোচনা করলেন। সেখানে উপস্থিত উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নেতা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন জয়পুরহাটে হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক ঝাঁঝালো বক্তব্য দেন। সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হানাসুল হক ইনু এমপিসহ উপস্থিত সকল বক্তাই উক্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। আদিবাসী ফোরামের এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারনে তিনি উপস্থিত হননি। আমি জানিনা সত্যিই তিনি অসুস্থ ছিলেন নাকি কোন মহলের চাপে আসতে পারেননি।

ঐ দিনই বিকালের দিকে আরো জানতে পারলাম শুধু জয়পুরহাটেই নয় খাগড়াছড়ি সদর ও পানছড়ি উপজেলাতেও পুলিশ আদিবাসী দিবস পালনে বাধা সৃষ্টি করেছে। আদিবাসী জীবনে যে সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন অনবরত চলছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রই যে মূল উৎসাহ দানকারী হিসেবে কাজ করছে আদিবাসী দিবসের এই ঘটনাই সেটি প্রমাণ করে। কিন্তু আদিবাসীরাতো কখনো থেমে থাকেনি। পৃথিবীর কোন নিপীড়িত মানুষই থেমে থাকেনি। ১৮৫৫-৫৬ সালে বৃটিশদের ভীত কাাঁপিয়ে দিয়ে সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-ফুলমতি’রা থেমে থাকেননি।

জীবন দিয়ে শোষণহীন সুন্দর সমাজ গড়ার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। ভগবান বিরসা মুন্ডাও স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, আলফ্রেড সরেন, চলেশ রিছিলও থেমে থাকেননি। ঠিক তাদের দেখানো পথেই জয়পুরহাটের আদিবাসীরাও থেমে থাকেননি। পুলিশের শত বাধা উপেক্ষা করে আদিবাসী দিবসের মিছিলে তারা অংশ নিয়েছিলেন।

পুলিশের রাইফেলের বাঁটের গুতা খেয়ে ছাত্র নেতা লালমোহন এক্কার কন্ঠে শোনা গিয়েছিল আদিবাসী দিবস সফল হোক, সফল হোক শ্লোগান। আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং আবারো ছত্রভঙ্গ মিছিলে শ্লোগান ধরেছিলেন। আদিবাসী ছাত্র নেতা বিভূতিভূষন মাহাতো, কার্তিক কেরকেটা, বাবলু টপ্য, চুন্ডা হেমব্রম, পরেশ পাহান, সৌরভ সিংসহ আরো অনেকে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েও সেখান থেকে পালিয়ে যাননি। বিভূতি যখন তার মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো ফেইসবুকে আপলোড করেছিল তখন দেখেছিলাম আদিবাসী দিবসের ব্যানার কেড়ে নেওয়ার দৃশ্য। নির্লজ্জ, নপুংশক এই প্রশাসন তবুও রুখতে পারেনি আদিবাসীদের।

পরে শহরের খঞ্জনপুরে গিয়ে ঠিকই আদিবাসীরা সমাবেশ করেছিল। আমার মনটা খুশিতে ভরে গিয়েছিল যখন লালমোহন এর সাথে মোবাইলে কথা বলছিলাম। সে বলছিল দাদা! আর বলেন না। শালা পুলিশের ওসিকে দিয়েছি এক ঘুসি। তারপরেই এক পুলিশ আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কোমরে আঘাত করে।

দাদা, প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। এখন অনেক ব্যাথা লাগছে। তার সাথে এই কথোপকথনের সময় তার জন্য খুব গর্ব হচ্ছিল। মনে মনে তখনই সেখানকার ছাত্র নেতাদেরসহ সমাবেশে উপস্থিত সকলকে স্যালুট জানিয়েছিলাম। আমি জানি এই রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার, প্রশাসন, ভূমি লুন্ঠনকারী, ধর্ষণকারী, হত্যাকারী সবাই এক কাতারের।

এদের একে অপরের সাথে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যার কারনে আজ আদিবাসীদের উপর এতো নির্যাতন-নিপীড়ণ চলছে। কিন্তু আমি প্রেরণা পাই লালমোহন এক্কা, হরেন্দ্রনাথ সিং এর কাছ থেকে, পৃথিবীর সমস্ত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কাছ থেকে। আজকে হোক কালকে হোক আর পরশু হোক আদিবাসীরা তাদের অধিকার নিয়েই ছাড়বে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.