আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে এই মাওলানা!!! পর্ব- ৯

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা মাওলান চুপ করে আছেন। এ চুপ থাকা রহস্যময়। কিছু রহস্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। ১৯৬৩ সাল থেকে ৬৮ পর্যন্ত খ্রীষ্টান পাদ্রীদের লক্ষ্যস্থল ছিল বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল। গরীব ও ভুখানাঙ্গা মানুষগুলোকে সামান্য অন্ন কিংবা বৈদেশী সামগ্রী তুলে দিয়ে মন জয়ের চেষ্টায় রত গীর্জার লোকজন।

ত্রাণ বিতরণ এবং চট্টগ্রামে শান্তির দ্বীপ স্থাপনের নামে তারা আসছে। মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে। খৃষ্টধর্ম প্রচারের নতুন যুগের সূচনা করতে চাইছে এরা। পত্রপত্রিকায় এসব সংবাদ পড়ে মাওলানা চিন্তিত। তিনি জরুরী পরামর্শ সভা ডাকলেন।

তার বিশিষ্ট কয়েকজন সহচরকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিলেন। মাওলানা নিজেও লিখে ফেললেন চারটি বই। ‘পাদ্রীদের গোমর ফাঁক’, আল্লাহর প্রেরিত ইঞ্জিল কোথায়?’, ‘শত্র“ থেকে হুশিয়ার থাক’ ‘চার ইঞ্জিল’। এ বইগুলো মানুষের মধ্যে বিতরণ করে তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে সজাগ করার আহবান জানালেন দেশের সচেতন সমাজকে। মাওলানার শরীর ভালো নেই।

তবুও তিনি এখানে ওখানে যাচ্ছেন। পাদ্রীদের কূটকৌশল সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করছেন। ইসলামের পয়গাম তুলে ধরছেন মানুষের কানে কানে। সুদূর নদীপথ পেরিয়ে ভোলা কিংবা পাহাড়ী অঞ্চলের রাঙামাটি, যেখান থেকে ডাক এসেছে, তিনি ছুটে গেছেন। তার ওয়াজ শুনে পথ খুঁজে পেত পথহারা মানুষগুলো।

কেন? কারণ তিনি শুধু কঠিন কঠিন হুকুম শোনাতেন না। তিনি শোনাতেন ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। মুসলমান পরিচয়ে গর্ব করা শেখাতেন। সেজন্যই মানুষ তার ওয়াজ শুনে মুগ্ধ হত। শুধু কি তাই? ওয়াজের পর কেউ হাদিয়া বা নজরানা নিয়ে এলে তিনি হাসিমুখে তাকে সান্তনা দিতেন।

- দেখো ভাই! আমাদের তো উচিত ছিল নিজের পয়সায় এসে তোমাদেরকে ইসলাম শেখানো। তেমন সাধ্য নেই বলে শুধু পথখরচ নিয়েছি। সেটুকু নিতেও মনে দ্বিধা লেগেছে। পথখরচের বাইরে আমি এক পয়সাও নিব না। আপনারা রাখুন এসব।

মাওলানার মুখে নির্মোহ আর সরল হাসি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেত মানুষগুলোর। ......................................... ১৯৬৪ সালের কোন এক বিকাল। রাজশাহীর সাহেব বাজার মসজিদ। মসজিদের সামনে খোলা মাঠ। আজ এখানে বিশাল জনসভা।

মাওলানা ভাষণ দিবেন। দুপুরের পর থেকে লোকজন আসছে। সাধারণ মানুষ এবং আলেমরাও। মাওলানা তার বয়ানে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। তিনি তার তেজস্বী গলায় বলে চলেছেন,.... ‘আমি পুরা দুনিয়ার তামাম পাদ্রীদেরকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, তাদের কাছে আল্লাহর নাযিল করা ইঞ্জিল নাই।

সেই ইঞ্জিলের এক কপিও তারা দেখাতে পারবে না। আমরা কুরআনের লক্ষ লক্ষ হাফেয দেখাতে পারবো। আল্লাহর পাঠানো ইঞ্জিল আজ আর অক্ষত নেই। পাদ্রীরা সেখানে সব বদলে দিয়েছে। আসল ইঞ্জিল দুনিয়ার কোথাও নেই।

’ মাওলানার চ্যালেঞ্জ শুনে মাঠভর্তি মানুষগুলো নড়ে চড়ে বসল। সমস্বরে তারা নারায়ে তাকবীর শ্লোগান দিচ্ছে। মাওলানা তার ঘাম মুছছেন রুমাল দিয়ে। মাওলানার চ্যালেঞ্জ এর খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বাংলা অঞ্চলের গীর্জাগুলোতে পাদ্রীরা চিন্তিত।

এ কি নতুন ঝামেলা!! ............................................ ১৯৬৪ সালের জুন মাস। মধ্যদুপুর। লালবাগ মাদ্রাসার সামনে কিছুক্ষণ ধরে হাটাহাটি করছেন একজন ভদ্রলোক। বেশভূষায় তাকে অন্যধর্মের মনে হচ্ছে। ছাত্ররা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকে নিয়ে ফিসফিস করছে।

- কিরে, এই লোকটি কে? কেমন দেখায় তারে, দেখ - হিন্দু তো না। এইটা হিন্দুদের পোষাক না। বৌদ্ধ নাকি? - ধূর যা! তোমরা দেখি বেকুব। এই লোক পাদ্রী। তার পোষাক পাদ্রীদের মতো।

হয়তো মাওলানার কাছে এসেছে। খাদেমরা এসে খবর দিল। - হুজুর, একজন পাদ্রী এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান। মাওলানা তখনও কিতাব পড়ছেন।

তিনি মাথা ঘুরিয়ে বললেন, প্রথমেই আমার কাছে কেন? তোমরা তার সাথে একটু কথা বল। যুক্তি তর্ক শিখো। - মাওলানা! আমি কি আসতে পারি? - জ্বী জ্বী আসুন। বসুন। আপনার পরিচয়... - আমি একজন ফাদার।

খ্রীষ্টধর্মের নগন্য খাদেম। আমাদের গীর্জা নারায়ণগঞ্জের চাড়ার খোপে। আপনার কথা অনেক শুনেছি। আজ প্রথম দেখলাম। - ভালো ভালো।

তা আপনার আসার কারণ? - আপনার কর্মীদের প্রচারণায় আমরা বিব্রত বোধ করি। মহান খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ রাখার মিনতি নিয়ে এসেছি। - আপনারাও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করুন। মুসলমানদেরকে খ্রীষ্টান বানানো বন্ধ করুন। আমিও কিছু বলবো না।

আর আমার চ্যালেঞ্জ শুনেছেন তো? আসল ইঞ্জিল থাকলে নিয়ে আসবেন। আমি দেখতে চাই। - মাওলানা! আসল ইঞ্জিল আছে। রোমের ভ্যাটিক্যানে আছে। কিছু সময় লাগবে।

মাস তিনেক। আমি আপনার কাছে নিয়ে আসবো। - দেখা যাক। আনেন। আমি অপেক্ষায় রইলাম।

............................... ততদিনে মাওলানার বইপত্র মানুষের হাতে হাতে। তারা যেখানে সেখানে পাদ্রীদেরকে পেলেই মাওলানার লেখা প্রশ্নগুলো করে বসে। পাদ্রীরা লুকিয়ে থাকেন। তারা বড়ই বিব্রত এবং বিরক্ত। তারা অপেক্ষা করছেন রোম থেকে আসল ইঞ্জিলের।

সেটি এলে মাওলানাকে দেখাবেন তারা। তাতে হয়তো তার মুখ বন্ধ হবে। তার কর্মীরাও থামবে। ........................................ তিনমাস পর। পাদ্রী আবার এসেছেন।

লালবাগে মাওলানাকে দেখাতে হবে। তার বগলতলে আসল ইঞ্জিল কিতাব। পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তিনি তাতে চুমো দিচ্ছেন চোখ বুঁজে। মাওলানা তাকে ডেকে নিলেন। - এই যে দেখুন! আসল ইঞ্জিল।

আল্লাহর পাঠানো অবিকৃত গ্রন্থ। আপানাকে দেখাতে পেরে আমরা আনন্দিত। মাওলানা তা হাতে নিলেন। কয়েকপাতা উল্টাচ্ছেন। পাদ্রীর চেহারায় খুশীর আলো।

মুখে মুচকী হাসি। মাওলানা কিছুক্ষণ পর কিতাবখানা বন্ধ করে তার হাতে তুলে দিলেন। - পাদ্রী সাহেব! এটাতো আসল ইঞ্জিল নয়। - কেন কেন? কী বলছেন আপনি? রোম থেকে নিয়ে এসেছি। আমরা কি মিথ্যা বলছি?? - আহা! শুনুন তো আগে! এই ইঞ্জিল তো হিব্র“ ভাষায় লেখা।

আসল ইঞ্জিল কিতাব নাযিল হয়েছিল সুরয়ানী ভাষায়। আমি তো সুরয়ানী ভাষার সেই পবিত্র ইঞ্জিল দেখতে চাই। অন্য ভাষার বাকী যা আছে, সবই তো নকল। পাদ্রীর মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন মুখে হাসিহাসি ভাব ফুটিয়ে রাখতে।

যেন কিছুই হয়নি। - কিন্তু মাওলানা সাহেব! আমাদের কাছে এটিই আছে। এই ইঞ্জিলকেই আমরা আসল কিতাব বলে মানি। - মানা না মানা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু এমন নকল ইঞ্জিল কিতাব দিয়ে মুসলমানকে ধোঁকা দেয়া চলবেনা।

আপনি আমার অতিথি, হালকা খাবারের আয়োজন হয়েছে। বসুন, কিছু খেয়ে যান। পাদ্রীর মুখে আর কথা নেই। আড়চোখে তিনি মাওলানার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাওলানা চকি আর ছোট্ট একখানা টেবিল, এমন আন্ধারঘেরা রুমে বসে মাওলানা এত বই লিখেছেন! আমাদের বিরুদ্ধেও তো তিনি লিখেছেন চারটি বই।

পাদ্রীর মনে নানা কথা আসছে। তিনি চুপচাপ পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালেন। তাকে এখনই চলে যেতে হবে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ভালো মনে হচ্ছে না। মাওলানার এক খাদেম এসব দেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

পাদ্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর তার বিস্ময়ভরা কৌতুহল। - হুজুর! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? - হু, করো। - আপনি কি হিব্র“ বা সুরয়ানী ভাষা জানেন? - না তো। - তাহলে আপনি কি করে বুঝলেন, পাদ্রীর সাথে আনা ইঞ্জিল হিব্র“ ভাষায় লেখা? ওটা সুরয়ানী ভাষা নয়? মাওলান চুপ করে আছেন। এ চুপ থাকা রহস্যময়।

কিছু রহস্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। .................................................. মাওলানা এখন গহরডাঙায়। গ্রামজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসছেন। স্থানীয় মাতব্বর আর নেতারাও আসছেন।

সবার মনে খায়েশ, মাওলানার সাথে কিছু সময় কাটানো। জীবনভর যে মাওলানা ঢাকায় থেকেও খালি হাতে ফিরে এসেছেন, কত মন্ত্রী গর্ভণরকে যে মাওলানা ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই মাওলানা এখন নিজের গ্রামে এসেছেন। আপনজনদের কোলে ফিরে এসেছেন। মাওলানাকেও আনন্দিত মনে হচ্ছে। মাওলানার শরীর ভাল নেই।

তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। শুয়ে শুয়েই কথা বলেন। উপদেশ দেন। সতর্ক করেন। সান্তনা দেন।

মাওলানার দান করা জায়গায় মাদরাসা হয়েছে। ছাত্র শিক্ষকরা দিনরাত পড়াশোনায় ব্যস্ত। মাওলানাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে তারাও উজ্জীবিত। পড়ালেখার ফাঁকে যেটুকু অবসর, তারা মাওলানার চকি ঘিরে বসে থাকেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই।

মাওলানা চোখ খুলেছেন। মাথা কাত করে এদিক ওদিক তাকালেন। মাদরাসার পরিচালক কোথায়? তাকে একটু আসতে বলো। - জ্বী হুজুর! আমি আছি। - দেখো বাবা, জীবনভর খোদার কালামের মহব্বত ছাড়তে পারি নাই, মরার পরও ছাড়তে পারব না।

তুমি কি একটু জায়গা আমাকে ভিক্ষা দিবা? মাদরাসার হেফযখানার পাশে, যেখানে ছেলেরা সবসময় কুরআন মুখস্ত করে, আমাকে একটু জায়গা ব্যবস্থা করে দিও বাবা। আমি কবরে শুয়ে শুয়ে আল্লাহর কুরআন শুনতে চাই। এই মহব্বত আমি ছাড়তে পারব না। - হুজুর! কি যে বলেন!! আপনার দান করা জায়গায় আপনার বানানো মাদরাসা!! অনুমতি কিসের? আপনি মাদরাসার পাশে শুয়ে থাকলে তো আমাদেরই আনন্দ। আপনি অবশ্যই হেফযখানার পাশে জায়গায় কবর পাবেন।

অনুমতির প্রশ্ন নাই। মাওলানার চোখ ছলছল করছে। দু চোখের পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। তার চেহারায় কোন দুশ্চিন্তা নেই। তিনি তবুও বললেন, এখন তো জায়গা মাদরাসার।

আপনাদের সম্মতি দরকার। সম্মতি পেলে আমাকে হেফযখানার দক্ষিণপাশে একটু জায়গা দিবেন। ওখানেই যেন আমার দাফনটা হয়। ইয়া আল্লাহ! তুমি কবুল করো। দুই কাঁধে ঝোলানো রুমালে চোখ মুছছেন মাদরাসার পরিচালক।

মুখখানা তার মলিন হয়ে আছে। হৃদয়ে তার উত্থাল পাতাল বইছে। আহা! জায়গা দান করেছেন তিনি, মাদরাসাকে আজকের পর্যায়ে তিনিই এনেছেন। তার কারণেই এ গ্রামে কুরআনের বাতি জ্বলছে, সেই তিনি কেমন করে হাতজোড় করলেন একটুখানি জায়গার জন্য!! এমনও কি মানুষ হয়!! আগের ৮ টি পর্ব পড়ার জন্য...... আগামী পর্বে শেষ হবে এ ধারাবাহিক। আশা করি আপনাদের ভালো লেগছে।

পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।