আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঙ্গীতের এক রাজপুত্রের কথা

সুখীমানুষ টেলিভিশনে একটা বিজ্ঞাপন দেখে কানটা চট করে আগ্রহী হয়ে ওঠলো। “দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবারে বন্ধুরে কবে আইবারে / তুমি চলে যাইবারে”। এত ক্ল্যাসিক্যাল সুরে মাটির গন্ধ মাখা শব্দ কথা কে বলে গেল? কানে মধুর মত কেন লাগলো! ইউটিউবে দূর কোন পরবাসে লিখে সার্চ দিয়েই মুচকি হাসি দিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। গানের রাজকুমার শচীন কর্তার গান।

আহারে কী সুন্দর সুর, আহারে কী সুন্দর কথা। “এ পোড়া কপাল সোনার কাকন হানি / ফাগুন আমার হইবে বিফল জানি”। ভারত বর্ষের সঙ্গীতের এই রাজকুমার আমাদের কুমিল্লায় জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর। নাম শচীন দেব বর্মণ। কেউ কেউ এস. ডি. বর্মণ বলেন।

কেউ কেউ শচীন কর্তা, কেউ বা শুধু কর্তা। বাস্তব জীবনেও তিনি রাজকুমার ছিলেন। ত্রিপুরার (বর্তমান কুমিল্লা) রাজপরিবারে নবদ্বীপ চন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র তিনি। মা নিরুপমা দেবী মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে। শচীনকর্তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত পাগল মানুষ।

নিজে তিনি সেতার বাজাতেন এবং ধ্র“পদাঙ্গ গানে ছিলো অসাধারণ কণ্ঠ। শচীন কর্তার প্রথম সঙ্গীতগুরু বলতে তাঁর নিজের পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র। আর লোকগানের গুরু বলতে তিনি তার জীবনীতে উল্লেখ করেছেন তাদের বাড়ীর দুই জন ভৃত্যের নাম। তাদের নাম মাধব ও আনোয়ার। মাধবের রামায়ন পড়ার সুরেলা কণ্ঠ আর আনোয়ারের দু’তারার সাথে ভাটিয়ালী গান শিশু শচীনের মন কেড়ে নিতো।

পড়াশোনায় মন বসতো না এই গানের টানে। শচীন কর্তা যখন বড় হলেন তখন বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম এমন কোন নদী নাই যেখানে তিনি লোকসঙ্গীতের সন্ধানে ঘুরে বেড়াননি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে বাংলার মাটির কথা, মাটির সুর, মাটির শব্দ এমন ভাবে একাকার করলেন যার মধুতে ভেসে গেল কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়। শচীন কর্তার গান নিয়মের ঘারানায় বন্দী ছিলো না বরং ছিলো বাহিরানায় ছড়ানো। সঙ্গীত কে জমিদারের ঠুমরীর চার দেয়াল থেকে যেন বের করে পুষ্পকুড়ির মত ছড়িয়ে দিলেন আকাশে।

রাজপরিবারের ছেলে শচীন গানের জন্য মরিয়া হয়ে মিশলেন চাষা, জেলে, সন্ন্যাসী, বৈষ্টমী সবার সাথে। সঙ্গীতের সতীর্থ হিসাবে পেয়েছিলেন তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে, পেয়েছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্তকে। তখনকার স্বর্ণালী সময়ের প্রায় সকল অমর সঙ্গীতপ্রেমীদের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো এই রাজকুমারের। নজরুল কুমিল্লায় গেলে বেশ কিছুদিন থাকবেন। কুমিল্লার তালপুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটি ঘরে।

রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য কুমিল্লাকে গড়ে তুলেছিলেন শিল্পের চারণভূমিতে। দিল খোলা নজরুলের অট্রহাসি, গান কুমিল্লার পড়তে পড়তে শুনা যেত। সঙ্গী ছিলেন শচীন কর্তাও। দুই বন্ধুর কত মধুর গীত না জানি এখনো কুমিল্লার ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে। ১৯২৫ সালে শচীন দেব তার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সঙ্গীতের টানে চলে আসলেন কলকাতায়।

ভাড়া করা ছোট একটি বাসায় ওঠলেন ত্রিপুরার রাজকুমার। বড় বড় ওস্তাদের কাছে শিখলেন গান। এইচ এম ভি তে অডিশন দিলেন। কিন্তু ফেল করলেন। কারন হিসাবে দেখানো হলো কর্তার নাকিস্বর (আনুনাসিক)।

ভাবতে অবাক লাগে এই নাকিস্বরটাই কিনা পরে পাগল করে দিলো কোটি মানুষের মন। বর্তমানের হিমেশ রেশমিয়া যে নাকিস্বরে গান করেন তা কিন্তু শচীন কর্তাকে সম্মান করেই! ক্রিকেটর শচীন টেন্ডুলকারের নামও কিন্তু তারা বাবা রমেশ টেন্ডুলকার রেখেছিলেন এই শচীন কর্তার গানের পাগল হয়েই! বিয়ে করেছিলেন মীরা বেদ বর্মণকে। বাংলা ভাষায় যে কয়জন অমর গীতিকার আছেন তার মধ্যে মীরা দেব অনন্যা। শোন গো দক্ষিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি, বিরহ বড় ভালো লাগে, কে যাস রে ভাটির গাঙ্গ বাইয়ার মত অসাধারণ অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে শচীন কর্তা যখন জন্মভূমির জন্য উতলা হয়ে আছেন তখন মীরা দেব লিখলেন - তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল।

গানের মাঝের কয়টা লাইন হলো ‘বাংলা জনম দিলা আমারে/তোমার পরান আমার পরান/এক নাড়ীতে বাঁধারে/মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই/সব ভুলে যাই তাও ভুলি না/বাংলা মায়ের কোল’। আমরা বাংলা ভাষার মানুষরা কি একটাবার ভেবে দেখি এমন মায়াময় কথাগুলো! দেশের সাথে সম্পর্কটা কে মা-পুতের সম্পর্ক বলার মত সহজ সরল কথা আর কে বলেছেন? শচীন কর্তার একমাত্র ছেলে রাহুর দেব বর্মণ। ভারতরে সঙ্গীতের ইতিহাসে বাবা শচীন ও ছেলে রাহুল যত জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন আর কেউ তা পেরেছে বলে দাবি ওঠেনি। কেউ কেউ বলেন বাবাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো ছেলে রাহুলের অবদান। শচীন কর্তা একদিন বাড়ী ফিরছিলেন, রাস্তায় কতগুলো ছেলে বল্লো ঐ দেখ পঞ্চমের বাবা।

রাহুলকে সবাই আদর করে পঞ্চম নাম দিয়েছিলো। সেই দিন কর্তা নাকি বাসায় ফিরে হাসতে হাতে ভেঙ্গে পড়ছিলেন। ছেলের পরিচয়ে একজন বাবা পরিচিত হতে পারা যে কতটা ভাগ্যের, কতটা সুখের তা সেদিন কর্তা অনুভব করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে তিনি প্যারালেটিক ষ্ট্রোক করেন। দীর্ঘ পাঁটি মাস ছিলেন কোমায়।

তখন তার স্ত্রী মীর আর ছেলে রাহুল শচীক কর্তাকে কেবল কুমিল্লার গল্প বলতেন, কলকাতার গল্প বলতেন। যদি গল্প শুনে কর্তার নির্দয় ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু না, ঘুম চিরতরের ঘুম হয়ে গেল ৩১ অক্টোবর ১৯৭৫ এ। শিল্পী কিশোর কুমারকে শচীন কর্তা নিজ হাতে কিশোর কুমার করে তুলেছিলেন। ভারতীয় সিনেমার গানে নানান ঢঙ্গে আধুনিকতা ঢেলে দিয়েছিলেন শচীন কর্তা।

এর ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এর চেয়েও ভালো গান দিয়েছিলেন তার ছেলে রাহুল দেব বর্মণ। রাহুলের কোন সন্তান নেই। রাহুলের মৃত্যুতে বর্মণ পরিবার থেকে নতুন কিছু পাবার শেষ প্রদীপটাও নিভে গেল। শচীন কর্তার মত এত বড় জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ ভারতবর্ষে যে নেই তা সবাই সম্মানের সাথে স্বীকার করেন। খুব দুঃখ লাগে যখন দেখি এত বড় মানুষটার জন্মভূমি কুমিল্লায় তাকে মানুষজন তেমন মনে করেন না।

শচীন কর্তার বাড়ীটাকে প্রথমে বানানো হলো মিলিটারী গুদাম পরে করা হলো হাঁস মুরগীর খামার। এখন সেই বাড়ীর সামনেও বিল্ডিং ওঠে আড়াল করা হয়েছে এই বাড়ীকে। আফসোস নিজেরাই বুঝলাম না কি রতœ ধারণ করেছিলো এই বাড়ী। আমাদের এ পোড়া কপালে সোনার কাকন ঠিকই এসেছিলো আমরা তাকে তামার দামও দিলাম না। বাংলাদেশের লোকজন টাকা খরচ করে ভারতে গিয়ে তাজমহল দেখে আসেন কিন্তু বাড়ীর কাছের সঙ্গীতের তাজমহলটাকে করে রেখেছেন হাঁস মুরগীর পরিত্যাক্ত খামাড়! শচীন কর্তা সারা জীবন গেয়েছেন মাটির মানুষের গান।

মাটির মানুষেরা তাঁকে আজও প্রবল ভালবাসে। কিন্তু মাটির মানুষদের এত বেশী ক্ষমতা নাই যে তার স্মৃতিটুকু ধারণ করে রাখে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মত মানুষ আমাদের দেশে জন্মেছিলেন আমরা তাঁর স্মৃতিও ধরে রাখিনি। জনপ্রিয়তার বাধ ভাঙ্গা শচীন কর্তার স্মৃতিও ধরে রাখিনি। হায়রে অভাগা জাতি।

হায়। হায়। হায়! প্রতি বছর শচীন কর্তার জন্ম ও মৃত্যু দিনে যে বাড়ী মুখরিত হবার কথা ছিলো শচীন মেলায়। যে বাড়ী সারা বছর জুড়ে শচীন ভক্তদের জাদুঘর হয়ে কোটি মানুষে সরগমে ভরপুর থাকতো সেই বাড়ীকে আমরা পরিত্যাক্ত হাঁস মুরগীর খামাড় করেছি। ১ কোটি ৪৪ লক্ষ বর্গ কিলেমিটারের এই ভূখন্ডে সামান্য একটু জায়গা আমরা শচীন কর্তার সম্মানে আলাদা করে সংরক্ষণ করতে পারলাম না! এতই অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা।

যারা ক্ষমতা রাখেন শচীন কর্তার বাড়ীটিকে জাদুঘর করতে, যারা ক্ষমতা রাখেন প্রতি বছর শচীন মেলার বিশাল সঙ্গীতের আসর জমাতে তারা কি কেউ শচীন কর্তার মায়াবী সুরের ভক্ত নন! তাদের কঠিন মনে কি সঙ্গীতের ঠাঁই নাই? জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ আইটি প্রধান, বৈশাখী টেলিভিশন ০১৫৫২৩০৩৬৯৬ লধযধহমরৎধৎঁহ@মসধরষ.পড়স ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.