আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চা-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোটা সুবিধা বরাদ্দ করা

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়াশোনা করছি। বাংলাদেশের ১৬৭ টি চা বাগান থেকে আমি-ই প্রথম কোন চা-শ্রমিক সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করছি। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাটক, লেখালেখি ইত্যাদির সাথে যুক্ত আছি। চা-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোটা সুবিধা বরাদ্দ করা হোক -মোহন রবিদাস বাংলাদেশের চা জনগোষ্ঠী বহুকালধরে নিরক্ষরতা,নিপীড়ন,অত্যাচার,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চণার মতো ভয়াবহ অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। তারা চা-বাগানের লেবার লাইনে এমনভাবে বসবাস করে যেন মূল বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের বাসিন্দা।

অশিক্ষিত এই চা-জনগোষ্ঠী চা-বাগানের বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে ভীত। তাই তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, হয় না উচ্চ কণ্ঠ। সে কারণে তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিঁজে,খালি পায়ে, জোঁক, মশা, সাপসহ বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের কামড় খেয়ে মাত্র ৫৫ (মাস খানেক আগে ছিল ৪৮ টাকা) টাকার বিনিময়ে সকাল থেকে সন্ধা অবধি কাজ করে। আর এই ৫৫ টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা তো দূরের কথা টিকে থাকাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মা-বাবার সাথে ছেলেমেয়েদেরও চা-বাগানেই কাজ করতে হয়।

যে কারণে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষাও তাদের ভাগ্যে জুটে না। আর উচ্চ শিক্ষাতো কল্পনাতীত। বেনিয়া ইংরেজ অতি কূটকৌশলের মাধ্যমে কম দামে শ্রম কিনে যাতে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায় সেই লক্ষ্যে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ,উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু,তেলেগু, লোহার,রবিদাস,গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে । যাদের প্রত্যেকের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, পূজা-উৎসব, বিবাহপ্রথা,সমাজ কাঠামো দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নৃ-তাত্ত্বিক সংজ্ঞানুসারে চা জনগোষ্ঠীর কেউ প্রাক-দ্রাবিড়ীয়,কেউ আদি অষ্ট্রালয়েড, কেউবা মঙ্গোলীয় আদিবাসীর অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত তো দে-ই নি, এমনকি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তালিকায়ও এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেনি,যে কারণে এরা কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বরঞ্চ এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করলে এরা দেশের সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও চাকুরী ক্ষেত্রে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারতো এবং নিজেদের দুরাবস্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারতো। দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় চা জনগোষ্ঠী সবদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরক্ষরতা। দেশে বাজেটের একটা বিরাট অংশ যেখানে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা খাতে সেখানে চা-বাগানের শিক্ষার হার অতি নগণ্য।

চা-বাগানগুলোতে কলেজ, উচ্চবিদ্যালয় তো নেই-ই এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি। ভাষাগত সমস্যার কারণে চা-শ্রমিক সন্তানরা বাঙ্গালী অধ্যুষিত স্কুল-কলেজে পড়তে গিয়ে ঠাট্টা-মশকরা আর বৈষম্যের শিকার হয় বলে এদের অধিকাংশই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১ জন এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৪ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চা বাগানের ছাত্র-ছাত্রীদের তেমন উপস্থিতি নেই। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকুরী ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন কোটা সুবিধা রয়েছে, চা-জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কোন বিশেষ কোটা ব্যবস্থা নেই।

অথচ চা-জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকুরী ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন কোটা সুবিধা রয়েছে, চা-জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কোন বিশেষ কোটা ব্যবস্থা নেই। অথচ চা-জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট আমাদের এই চা-জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা যেখানে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্থ হয়,সেখানে তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের আকাংখাকে অনেকে বাস্তবজ্ঞান করতে চান না; এমনকি বিদ্রপও করেন। এতো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও আমাদের কিছু স্বপ্নবান চা-শ্রমিক সন্তান মাধ্যমিক ও উচ্চ- মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে;যা হয়তো প্রচলিত অর্থে মেধা যাচাইয়ের মান দণ্ডে উপযুক্ত নয়।

তথাপি ৮/১২ ফুট মাপের ছোট্ট একটি ঘরে ৩ প্রজন্মের অন্তত ১২/১৩ জন মানুষ যেখানে গাদাগাদি করে বাস করে, সেখানে পড়ালেখা করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার স্বপ্ন দেখছে তাদেরকে কি মেধাবী বলা যায় না? এই স্বপ্নবান চা-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা এমন আক্তি পরিস্থিতির শিকার; যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত কোন ধরণের বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আর এর কারণ লুকিয়ে আছে সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক চর্চা আর আর নীতি-নির্ধারণী মহলের এই জনগোষ্ঠীর প্রতি অমনোযোগিতার মধ্যে। এই অবস্থায় উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে চা-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করা এখন সময়ের দাবী। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।