আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুসনুলের বাবা

আমি আমার আনন্দে লিখি!!! আমার সাথে আলী হোসেনের দেখা এনাম মেডিকেলে। আলী হোসেন বৃদ্ধ মানুষ, সব কিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না, আমি কাছে গিয়ে জিগেস করলাম, চাচা-কিছু খুঁজেন? বৃদ্ধ খানিক অসহায় চোখে বলেন -বাবা, কইতাম পারিনা কি খুঁজি। আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলি, যদি কইতে না পারেন কি খুজেন তাইলে আজাইরা ঘুরতেছেন ক্যান? দেখতেছেন না, সবাই ব্যস্ত? উত্তরে আলী হোসেন বলেন বাবা, সকাল বেলা দুর্ঘটনার খবর শুইনা আইসা পড়ছি, আমার পোলা হুসনুল ঐ গার্মেন্স এ চাকুরী করত, বিল্ডিং ধইসা পড়ার পর থিকা পোলাডার মোবাইল বন্ধ, সারাদিন অনেক খুজছি, বুঝতাছিনা বাইচা আছে না মইরা গেছে! পাইনাই হুসনুল রে, এহন লাশের মইধ্যে খুজুম। কিন্তু লাশ কোনডা দিয়া শুরু করুম বুঝতাছিনা। সাহস অয় না! চাচা, হুসনুলের বয়স কত হবে? এইতো ধর তুমার মত, লম্বায় তুমার চেয়ে এট্টু খাডো, গায়ের রঙ তুমার মতই… -পরনে কি ছিল? -চেক শার্ট, কালো ফুল প্যান্ট।

-চলেন চাচা একসাথে খুজি, একটা একটা করে লাশ দেখব, আমি আছি-আপনে আছেন, চাচা-ভাতিজায় একটা জুইত হইব। -বাবা-এহন পর্যন্ত কত লাশ আইছে? -১৩০ জনের মত চাচা, তয় আমার মনে হয় চাচা হুসনুল বাইচাঁ আছে, আপনে বুকে সাহস রাখেন। -কি জানিরে বাবা, ক্যাম্নে কই, তোমার কি মনে হয়? ১৩০টা লাশ ক্যাম্নে দেখুম বাপ? একটা একটা লাশের মুখের কাপড় সরাইবা? -চাচা, উপায় নাই, বুকে সাহস বান্ধেন, আপনে পারবেন, তয় আমার মনে হয় হুসনুল বাইচাঁ আছে, আপনে সাহস রাখেন, মেয়ে ছেলের লাশ আলাদা রাখা হইছে, চলেন স্টোমাক ওয়াশ রুমের দিকে আগাই, ওইখানে কিছু লাশ আছে, শুরু করি। সময় নাই…অনেক কাজ… -চাচা, কারু কারু শরীর, কারু কারু মুখ থেতঁলায়ে গেছে, চেহারার মাঝে কোন কাটা দাগ ছিল?কিংবা অন্য কিছু? -হুসনুলের ডাইন হাতের কনুইতে কাটা দাগ আছে, বুঝলা বাবা, বড় ঘাড় ত্যাড়া ছিল আমার হুসনুল, গাও গেরামে মারামারি কইরা বেড়াইত, কত নিষেধ করছি… -চাচা, আমি মুখের কাপড় সরাইতেছি, আপনে দেখেন, মিলে গেলে মন শক্ত করবেন, আর যদি না মিলে আল্লাহর কাছে শুক্রিয়া আদায় করবেন, বুকে সাহস বাধবেন, আপনার হুসনুল হয়ত বাইচাঁ আছে, আমরা হয়ত ফাও ফাও কস্ট করতেছি… -হ, আমিও শুনলাম, ভিতরে কিছু মানুষ এহনো জিন্দা আটকা পইড়া রইছে…একটা মাত্র পোলা আমার, বড্ড খামখেয়ালী ছিল,বুঝলা বাবা… -আল্লাহর ইচ্ছা,চাচা, বিসমিল্লাহ বলে শুরু করি চলেন… ভীতপায়ে আলী হোসেন ফ্লোরে শুইয়ে রাখা লাশের পানে আগ বাড়ান, আমি আস্তে করে প্রথম লাশের পলিথিন সরাই… -না, বাবা, হুসনুল না এইডা, হুসনুলের চোখ দুইটা আরো সুন্দর, নাকটা খাড়া… দ্বিতীয় লাশের দিকে আগাই -এহ হে, এর তো দেখি মুখটা বোঝা যায়না ভালমত…পলিথিনডা এট্টু সরায়ে দেহ তো বাবা ডাইন হাতের কনুইয়ে কোন কাটা দাগ আছে নাকি? -নাহ কাকা নাই -এত লাশ বাবা, আমি বুড়া মানুষ… -চাচা, উপায় নাই, এমনেই দেখতে হইব। আল্লাহ রে ডাকেন, আল্লাহ মালিক, হয়ত হুসনুল বেচে আছে, আটকা পড়ে আছে… -তাই হইব… তৃতীয় লাশটার দিকে আগাই আমরা -নারে বাবা, এইডাও হুসনুল না, হুসনুলের গায়ের রঙ আরো ময়লা, খালি রোইদে ঘুইড়া বেড়াইত, এক্কেরে ময়লা হয়ে গেছিল, তুমার মতন গায়ের রঙ…তুমিও কি খালি রইদে ঘুইড়া বেড়াও? এভাবে আমরা আগাতে থাকি, আলী হোসেন একে একে ডিনাই করতে থাকেন, এটা তার হুসনুল নয়, আমিও তাকে বলি আশায় বুক বাধঁতে, হয়ত হুসনুল বেচে আছে! -বাবাজী, এরা লাশের গায়ে পলিথিন দিছে ক্যা? কাপড় নাই? -চাচা, হঠাত করে এত লাশ, সময় পায় নাই… -কারো দিলে রহম নাই বাবা, আমার হুসনুলে একটা বিলাইর বাচ্চা ধইরা নিয়া আইছিল কই থিকা জানি, শীতকালে ঐটারে কম্বলের নীচে নিয়া শুইত, কইত আব্বা, বিলাইডার শীত করে তো!কত পাগল পুলা চিন্তা কর! -চাচা, দেখেন তো এইটা হুসনুল নাকি? ৬১ নাম্বার লাশের পলিথিন সরাইছি, চেহারা আন্দাজ করতে করতে মনের মাঝে একটা চেহারা সাজিয়েছিলাম, ময়লা গায়ের রঙ, সুন্দর চোখ, খাড়া নাক… -আব্বারে… শুধু এইটুকু বলে লাশের মাথা টি কোলে তুলে নেন আলী হোসেন, পৃথিবীর সবচে ভারী বোঝা, পিতার কোলে পুত্রের লাশ…দুই চোখ দিয়ে টপ টপ অশ্রু ঝরছিল আলী হোসেনের, চুমু খাচ্ছিলেন আদরের নয়নমনির কপালে, তার হুসনুলের কপালে, হুসনুল নির্বাক, চোখ বোজা, পরনে চেক ফুল হাতা শার্ট, কালো প্যান্ট।

মিলে গেছে সেই খাড়া নাক, সুন্দর চোখ, শ্যামলা গায়ের রঙ। আলী হোসেন শক্ত মানুষ, ক্রমাগত ৬০টি লাশ দেখেছেন, বিকার হয়নি, প্রতিটি লাশের সামনে আমরা দাড়িঁয়েছি, প্রতিবার লাশের মুখ থেকে পলিথিন সরানোর আগে তিনি বিড়বিড় করে দোয়া পড়তেন, ৬১ নাম্বার লাশের বেলায় তার দোয়া কবুল হয়নি, হুসনুল কে পাওয়া গেছে, ৬১ নাম্বার লাশ, পলিথিনে মোড়ানো শব। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.