আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ঈদ উৎসবের গল্প

!! এ শিকল ছিড়ব আমি কেমন করে!! “সোনার অক্ষরে লেখা ভুলে যাওয়া নাম। মনের আঁধারে আমি লুকিয়ে নিলাম। দাগ মুছে যায় ধীরে ধীরে দিন যত চলে যায়। বেদনার পাখি এসে বাসা বাঁধে মনের ছায়ায়”। আমার ছেলেবেলার বাপ্পী লাহেরির সুপারহিট এই গানটি গাইতে গাইতে নস্টালজিক হয়ে গেলাম।

এই গানটি ছেলেবেলায় কতবার যে গেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সামনে ঈদ, ফেলা আসা সেই দিনগুলির কথাগুলো মনে পড়তেই, মনের আয়নায় ভেসে উঠল আমার ছেলেবেলার ঈদ উৎসবের দিনগুলো। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে আমি শেষের দ্বিতীয়। আর আমার পর একটি মাত্র ছোট্ট বোন। আমরা সবাই কেউ স্কুলে আবার কেউ কলেজের শিক্ষার্থি।

আমি এবং আমার ছোট বোনটি সবেমাত্র প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বড়ভাই সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। এমন একটি পরিবারের বাবা একজন সাধারণ সরকারী চাকুরীজীবী। যে কয়টি টাকা বেতন পান তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলিয়ে নেন। মাসের শেষে বাবা বেতনের টাকাটা এনে মায়ের হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার সংসারের খরচ।

আমরা জানতাম বাবা কত টাকা বেতন পান এবং সে টাকা কোন খাতে, কীভাবে খরচ হয়। তাই শত ইচ্ছা থাকলেও নিজেদের অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলোর কথা কখনও বাবা মাকে বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। বরং এমনভাবে চলেছি যেন আমাদের ব্যবহারে বাবা-মা কখনই কোন কষ্ট না পান। আমরা যেমন আমাদের অসংখ্য অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলো জলাঞ্জলি দিয়েছি তেমনি আমার বাবা-মাও সেইজন্য কখনও কখনও নিজেদেরকে অসহায় ভেবে মনটা খারাপও করে ফেলতেন। কিন্তু আমরা যখন বাবা-মাকে জড়িয়ে বলতাম, এই অপ্রাপ্তিতে আমাদের কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই।

দেখো একদিন আমরাও অনেক অনেক টাকার মালিক হব। বাবা আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন। আমাদের টাকার দরকার নেই বাবা, তোমরা মানুষের মত মানুষ হও। তাহলেই আমরা সুখী হব। আজ আমি অনেক বড় হয়েছি।

অনেক ভাল একটি দেশে আরাম আয়েশ করে থাকি। এমন উৎসব আমেজের এই বিশেষ দিনে বাবা-মাকে খুউব বেশী বেশী মনে পরে। বাবাকে সুখী দেখব বলে বাবার নীতির সাথে সখ্যতা করে হাজার হাজার মাইল পারি দিয়ে জীবন সাজিয়েছি। বাবার মুখে হাসি দেখব বলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। কিন্তু যার জন্য এত কিছু সেই বাবা এখন আর বেঁচে নেই।

আমার সুখ দেখার অনেক আগেই এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি যে সততার জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাঁর জন্য নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ উনাকে পুরস্কৃত করবেন, জান্নাত দান করবেন। আমার দেখা এমন একজন নীতিবান, সৎ, নম্র, ভদ্র মানুষ আমি নিজের চোখে আর দ্বিতীয়জন দেখেছি বলে মনে হয় না। নিজের বাবা বলে নয়। তিনি অন্যান্যদের চোখেও একজন নম্র, ভদ্র, অমায়িক ও সৎ লোক বলেই শ্রদ্ধেয় ছিলেন।

একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার বাবার সততায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি নিজেও কিছুটা সৎ হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। সততার মাঝে যে কত সুখ তা কেবল একজন সৎ লোকই জানবেন। এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি। এমন একজন পিতার সন্তান হতে পেরেছি বলে শির উঁচু করে গর্ববোধ করতে পারি। কিন্তু কখনও কখনও মনের কোণে জমে উঠা দুঃখগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে এই ভেবে যে, তিনি আমার জীবনের সফলতা দেখে যেতে পারেন নি।

আর মা? তিনিও আছেন হাজার হাজার মাইল দূরের, সেই সোনার বাংলাদেশে। ইচ্ছে থাকলেও প্রতি বছর মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারিনা। আমার মনে আছে ছেলেবেলায় দুই ঈদে যে দুটি নতুন জামা পেতাম। সেই জামাগুলোই সারা বছরের জন্য ভাল কাপড় হিসেবে বিবেচিত হত। ঈদ চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই নতুন জামাকাপড় পাওয়ার আশায় আবার কবে ঈদ আসবে সেই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম।

মনে পরে, ঈদের দিন সকাল পর্যন্তই ঈদের জামাকাপড় কাউকে দেখতে দিতাম না। এমন কি নিজের ভাই বোনরাও কেউ কারো ঈদের জামাকাপড় দেখাতে দিত না। এ যেন একটি মহা গোপনীয়তার ব্যাপার ছিল আরকি। ঈদের জামা কেনার দিন থেকে শুরু করে, ঈদের দিন পর্যন্ত, জামাকাপড় নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখতাম। এমন কি কখনও কখনও নিজের মাকেও বিশ্বাস করতে চাইতাম না।

তিনি যদি ভুল করে কাওকে দেখিয়ে দেন। তাহলে যে সর্বনাশ, আমার ঈদ আর হবে না। কারণ ঈদের জন্য নতুন আরও একটি জামা কেনার সামর্থ্যও তো বাবার নেই। সেই যে আমাদের ছেলেবেলার ঈদ উৎসব, আর বর্তমান প্রজন্মের ঈদ উৎসব, তাকি একই রকম? বিশেষ করে আমরা যারা বিদেশ-বিভূঁইয়ে থাকি তাঁদের সন্তানদের ঈদ উৎযাপন কেমন? আমার ছেলেবেলায় বিনোদন বলতে তেমন কিছু ছিল না। এখন এমন ডিজিটাল যুগে বিনোদনের কত্তো কিছুতে যে ভরপুর আমার সব জানা নেই।

ঈদের আগের দিন, আমাদের চাঁদ দেখা নিয়ে কি যে উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটত বুঝানো যাবেনা। চাঁদ রাতের যে উৎসব উৎসব আমেজ। সেটা কি এরা পাচ্ছে? রোজার ঈদ হলে চাঁদ দেখার সাথে সাথে রেডিওতে 'রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশীর ঈদ' গানে আর সূরের মূর্ছনায় চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠত। আর কুরবানি ঈদে তো অন্য রকম মজা। পশু কুরবানি হবে, তাই গরু অথবা ছাগলের ব্যবস্থা হলে দিনরাত ওটা নিয়েই থাকতাম।

ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে আমরা আনন্দ মিছিল বের করতাম। এমন আনন্দ মিছিল এখন হয়ত সমাজের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পাড়া মহল্লার সকল সম বয়সী ছেলে-মেয়েরা মিলে আনন্দ মিছিলে মুখোর হয়ে থাকতাম। সারারাত জেগে মেয়েরা হাতে মেহেদী আর ছেলেরা আড্ডায় ব্যস্ত থাকত। ওদিকে মা হয়ত ঈদের দিন কি রান্না-বান্না হবে তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন।

এখন আমার ছেলেদের জন্য বছরে কত যে নতুন জামা কেনা হয়, কত খেলনা কেনা হয়, ইয়ত্তা নেই। কোন কিছু চাওয়ার আগেই তো সব পেয়ে যায়। কিন্তু আমরা যেভাবে আত্মতৃপ্তিতে আর মনের আনন্দে ঈদ করেছি। ওঁরা কি তা করতে পারছে? হয়ত ওদের মত করে ডিজিটাল আনন্দ করছে। তবে আমাদের ছেলেবেলার ঈদের সেই যে দুটি নতুন জামার এনালগ আনন্দ, তাঁরা কি এতগুলো জামাকাপড়, খেলনা প্ল্যাস্টেশন থ্রি, উইয়ী, এক্সবক্স ইত্যাদি পেয়েও কি সেই আনন্দ পাচ্ছে? এইতো এইমাত্র কুরবানির টাকা এক বুচারকে দিয়ে এলাম।

বুচার বলেছে ঈদের দুই-তিন দিন পর মাংস দিয়ে যাবে। এখানে এই তো এমনই ডিজিটাল ঈদ করছি। আজ সকালে আমার ছয় বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা কুরবানির ঈদ কি জান? ওঁ বলল, না বাবা জানিনা। ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। তারপর নিজেই ক্ষান্ত দিয়ে মনে মনে বললাম, বড় হলে জেনে নেবে।

আমার এই ঈদ উৎসব শেয়ার করার কারণটা কিন্তু ভিন্ন। আমাদের জীবনের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে, আমরা অনেকেই আমাদের অতীতকে ভুলে যাই। কখনো কখনো ইচ্ছে করে ভুলে যাই। আবার কখনো কখনো অনিচ্ছায় ভুলে যাই। নিজের সম্মানটুকু ধরে রাখার জন্য কত রকম কতভাবে হিসেব নিকাশ করি।

এইটা বললে যদি সমাজে আমার মাথা হেট হয়ে যায়। অথবা ঐটা বললে মানুষ আমাকে কি বলবে। এই ধরনের মানসিক চিন্তা অথবা হীনমন্যতা থেকে আমরা অনেকেই আমাদের অতীত জীবনের ছন্দময় স্মৃতিগুলো অন্যের সাথে শেয়ার করি না। এমন কি নিজের পরিবার ও সন্তানদের সাথেও আমাদের অতীত নিয়ে আলোচনা করিনা। একসময় বাবা হয়ত খুব সাধারণ মানের চাকুরী করতেন।

সেই কথা এখন কীভাবে বলি, কীভাবে স্বীকার করি যে বাবা একজন স্কুল শিক্ষক অথবা কৃষক ছিলেন। অথবা পাড়া প্রতিবেশীকে কীভাবে বলি যে আমাকে যুদ্ধ করে বড় হতে হয়েছে। আজ আমার অবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে। আজ আমি সমাজে যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। আজ যে আমার অনেক নাম-ধাম হয়েছে।

কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার অতীত এমন ছিলনা। আমি আমার অতীত কারো সাথে শেয়ার করতে চাইনা, জানাতে চাইনা। কিন্তু আমার জীবনের ঘটনাগুলি যদি অন্যের সাথে শেয়ার করি। আমার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি যদি অন্যকে বলি। তাহলে সমাজে এর একটি চমৎকার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আমার দৃঢ়তর কথা শুনে, আমার সততার কথা শুনে কেউ হয়ত সৎ জীবনে ফিরে আসতে পারে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা কথা শুনে একজন মানুষের জীবন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এভাবে কি কখনও ভেবে দেখি? আমার যেমন আমার বাবার সততার কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করে। যখনই সুযোগ আসে মাথা উঁচু করে বলেও ফেলি, আমি কোন দুর্নীতিবাজ, ঘুষ-খোরের সন্তান নই। আমি একজন নিষ্ঠাবান খেঁটে খাওয়া সৎ বাবার সন্তান।

তেমনি আমাদের প্রজন্মদেরও সেই রকম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা উচিত। তা নাহলে এই সমাজ ধীরে ধীরে আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। আমার বাবার মত সৎ ও নিষ্ঠাবান মেহনতি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এই ঈদ হোক সকল সৎ ও মেহনতি মানুষের। এমনই একটি ইচ্ছায় মন রাঙিয়ে সবাইকে আগামী ঈদের শুভেচ্ছা জানাই।

সবার ঈদ আনন্দময় ও মঙ্গলময় হোক। এই কামনায় “ঈদ মোবারক”  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।