আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি তুষার কবির : নিজ স্বরের কবিতা

সাইফ শাহজাহান শুচি সৈয়দ কবিতার রকমফের অনেক। হাটের কবিতা, ঘাটের কবিতা, মাঠের কবিতা, নগরী ইট-কাঠের কবিতাÑ কবিতার শেষ নেই। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’Ñ ঊষার এই আবাহন থেকে সায়াহ্নের এই আবাহনÑ ‘মরনরে তুঁহু মম শ্যামও সমান’Ñ পর্যন্ত জীবনের পর্বে পর্বে কবিতা আমাদেরকে ছুঁয়ে-ছেনে যায়। সেই ছুঁয়ে-ছেনে যাওয়া কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতাকে বর্ণনার জন্যই তরুণ কবি তুষার কবিরের কবিতার পাঠপ্রতিক্রিয়া এই ছোট্ট নিবন্ধ। অসংখ্য রকমের কবিতার ভেতর তুষার কবিরের কবিতা কোন রকমের? মোটা দাগে বলতে পারি, নাগরিক বোধের।

এ পর্যন্ত তুষারের ছয়টি কবিতার বই বেরিয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ ১. বাগদেবী আমার দরোজায় ২. মেঘের পিয়ানো ৩. ছাপচিত্রে প্রজাপতি ৪. যোগিনীর ডেরা ৫. উড়ে যাচ্ছে প্রেম পাণ্ডুলিপি এবং সর্বশেষ ৬. কুহক বেহালা। লিখতে লিখতে তারুণ্য পেরিয়ে যাচ্ছে তুষার। ওকে নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছে ওর প্রথম কাব্য বেরুবার পরই কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনিÑ প্লাটফর্মের সম্পাদক আরেক তরুণ কবি হেলাল উদ্দিন হƒদয় এ সংখ্যার জন্য লিখতে বললে আমি আমার সেই অপূর্ণ ইচ্ছাটি পূরণের সুযোগ নিলামÑ তুষারের কবিতা নিয়ে লেখার। সংবাদপত্রের সঙ্গে পেশাগতভাবে জড়িত থাকা এবং নিজেও কবিতা লেখার কারণে প্রায়সই নবীন-প্রবীণ কবিদের কবিতার বই হাতে পাবার সৌভাগ্য হয়।

আমার ভীষণ ইচ্ছে করে প্রতিটি বই সম্পর্কে অন্তত ১ পৃষ্ঠা হলেও পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখি কিন্তু সেই পাঠপ্রতিক্রিয়া আর লেখা হয়ে ওঠেনাÑ কষ্ট করে লিখতেও হয়না; মনের মধ্যে অপরাধ বোধের একটু একটু স্তূপ জমলেও ভালো লাগে এজন্য যে, চারপাশে এত আগাছার উদ্গম দেখি, তাতে ১ পৃষ্ঠার পাঠপ্রতিক্রিয়াও যে সে আবর্জনা বিবেচিত হতো সেই নিয়তি থেকে রেহাই পাবার তৃপ্তিতে। লেখালেখির শুরু থেকেই তুষারকে দেখছি তুষারের নিজস্ব চারিত্র্যে। ‘চারিত্র্য’ শব্দটি লিখছি জেনেবুঝে তুষার সম্পর্কে। তুষার কবিতা লিখছে তুষারের নিজস্ব জীবনযাপনের ভেতর থেকে অব্যাহত নিরন্তর। ছাত্র থেকে ও যেমন ধীরে ধীরে নিজের পেশায় প্রতিষ্ঠিত একই সঙ্গে কবিতায়ও, তার কাব্যযাত্রায়ও সে সমান সমান্তরাল পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত।

কোনও ফাঁকিজুকি নেই তার উভয় জীবনে। না-কোনও এক্সট্রা ফেবার বসদের কাছ থেকে, না-কোনও সুযোগসন্ধান কাব্যাঙ্গনের বড় লর্ড, ছোট লর্ডদের কাছেÑ না-কোনও তরুণ দলে জড়ো হয়ে আন্দোলন, আলোড়ন। তুষার নিবেদিত পুরোপুরি কবিতায়। সবচেয়ে তুষারের যে বিষয়টি আমার পছন্দ তা হচ্ছে নিজের সম্পর্কে তার নীরবতা। যখন অন্য তরুণেরা কানে পালক লাগিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দুদ্দাড় শাহবাগে, আজিজের বারান্দায় তখন তুষার আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও টের পাবেন না।

তুষার বিনয়ী। বিনয় আমাদের সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে অহমের গরমে। আবার বিনয়ী হবার অর্থ পদদলিত হওয়াও, তবু তুষার মিতভাষী, বিনয়ী। কবিতা এখন এই দেশে তরুণদের আÍ-বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড। তুষার সে দলের নন।

তুষার কবির জানেন সে দৌড়ের মাহাÍ্য। ‘‘যে কোন মুহূর্তেই ধসে পড়বে ওটা; নড়বড়ে সাঁকোটা; অথচ ওটাতেই দৌড়াতে বলছো তুমি আমাকে! আমি সাঁতারও জানিনা আর আমার জীবন বীমাও করা নেই, তারপরও ওটার ওপরই আমাকে দৌড়াতে বলছো? জয়’দা; ‘দূরত্ব দৌড়াচ্ছে, তার পা দেখা যাচ্ছে না’। (দৌড়। ছাপচিত্রে প্রজাপতি। তুষার কবির।

পৃ-৩১) তুষার লক্ষ করে স্মৃতির শহর থেকে স্মৃতিরা উধাও হয়ে যায়। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় কালের কষাঘাতেÑ রাহমান ভাই, কই কোনো বাতিঅলা তো দেখছিনা! যার জন্যে মাউথ অর্গান হাতে আপনি ছুটে আসতেন, ঘুরতেন আরমানিটোলার পথে পথে, হাঁটতেন প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে। রাহমান ভাই, কই কোনো আতশবাজির জ্যোতি তো দেখছি না! অই তো ওখানে বসে আছে জবুথবু এক বাতিল বৃদ্ধ; আধ খাওয়া বাকরখানি যার হাতে, একটু পর পর সে চিকন একটা বিড়ির শলাকায় টান দিচ্ছে, বাতিটা কি সে ইচ্ছে করেই নিভিয়ে রেখেছে? রাহমান ভাই, মাউথ অর্গান হাতে কাইকে ছুটে আসতে তো দেখছি না! (বাতিঅলা। ছাপচিত্রে প্রজাপতি। তুষার কবির।

পৃ-২৯) শুধু এই শহরের স্মৃতি থেকে নয়, হয়তোবা দেশের স্মৃতি থেকেও বাতিঅলা বুড়োÑবাতিল বৃদ্ধ আর মাউথ অর্গান বাজানো স্বপ্নময় কিশোর পরিত্যক্ত অস্তিত্বের স্মারক হয়ে গেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’ বইয়ে জানিয়েছেনÑ‘‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি। কবিÑ কেননা তাদের হƒদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে। ’’ (কবিতার কথা।

পৃ-৭) কবি আরও লিখেছেনÑ‘‘কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই রকম উৎসারণ’’Ñ(কবিতার কথা। পৃ-১১) জীবনানন্দ দাশের দাবিÑ‘‘কবিতার অস্থি-র ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। ’’ (কবিতার কথা। উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য। পৃ-২৬) কবি জীবনানন্দ দাশের অনুসরণে স্লোগান তোলা যায়Ñ সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক! যিনি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা কল্পনায় কবির কবিতাকে উপলব্ধি করায় প্রয়াস পান।

আর কবিতা ও জীবন, কালজ্ঞান ও কবিতাÑ সেটা কবি-পাঠক দুজনেরই ঐতিহাসিক এবং অনিবার্য নিয়তির অবস্থানও বটে। তুষার কবির তার কলমে তার স্ব-কালের বার্তা তুলে ধরে পাঠক সমীপেÑ ‘‘কিছুই ধোয়াটে নয়, সকল রহস্য আজ একে একে খুলে যাচ্ছে গোয়েন্দা কাহিনীর শেষ অনুচ্ছেদের মতোন। তোমার খোঁপার মাঝে যে কয়টি আমলকি ছিল একে একে তারা খসে পড়ছে নাইট ক্লাবের দরোজায়। বক্ষ বন্ধনীটা আর কিছুতেই ফিতে বাঁধা নয়; উপসচিবের সম্ভ্রান্ত স্ত্রীগণ তা খুলে দিচ্ছে টান টান মদের বোতলে। কিছুই আরাধ্য নয়; চুম্বনে-চুম্বকে আর কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছেনা উš§াতাল টিনেজ কিশোরীদের।

শীতাতপ শয্যাকক্ষে তারা ওঠানামা করতে চাইছে আস্তাবলের অবাধ্য ঘোড়ার মতো। কিছুই প্রতীকী নয়; মুঠোভর্তি আনকোরা নোটে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে সকালের তরতাজা প্রেসরিলিজগুলো। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব রমণীদের সেক্স-অ্যাপাটাইট বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন আজ দৌড়ে যাচ্ছে আপাদমস্তক বেশ্যায়নে। কবির বুক পকেট থেকে জমাট জোনাকি গুলো পালিয়ে ঢুকে পড়ছে সব কর্পোরেট আশ্রমে।

(বার্তা। কুহক বেহালা। তুষার কবির। পৃ-২৯) গত বারের নোবেল বিজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার-এর মতে, ‘‘কবিতা এক সক্রিয় শক্তি যা মানুষকে ভিন্নভাবে জাগায়। হাঙ্গেরির এক কবিকে তিনি ১৯৭৭ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, দদচড়বসং ধৎব ধপঃরাব সবফরঃধঃরড়হং; ঃযবু ধিহঃ ঃড় ধিশব ঁং ঁঢ়, হড়ঃ ঢ়ঁঃ ঁং ঃড় ংষববঢ়''. হ্যাঁ, কবিতা আমাদের জাগায়, ঘুমিয়ে যেতে দেয়না।

কারণ কবিতায় বিধৃত কবির অভিজ্ঞান এবং পাঠকের অভিজ্ঞান উভয়ের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতা হয়ে ওঠে অন্যমাত্রার সেতু, হয়ে ওঠে সর্বজনীন বোধি। সেই বোধি থেকে তুষারের আবিষ্কারÑ ‘‘খোঁজাই জীবন; পাওয়া নয়’Ñ এই কথা ভেবে ভেবে সুমিত্রাদি কাটিয়ে দিলেন তার সারাটি জীবন। এখনও এই বার্ধক্যে এসেও খুঁজে চলেছেন তার সেই কাক্সিক্ষত পুরুষটিকে যাকে কায়মনোবাক্যেই তিনি ভালোবাসতে পারবেন! ওদিকে নায়িকার ছবির মতোন প্রেমিকাকে হারিয়ে শরৎ দা প্যান্ডেলের নিচে দাঁড়িয়েই পার করে দিলেন কয়েকটা যুগ; মনে হচ্ছে আমৃত্যুই তিনি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন! এইভাবে খুঁজে খুঁজে আর না পেয়ে না পেয়ে সুদীর্ঘ এক দাম্পত্য জীবন কেটে গেল শ্রীমতি সুমিত্রা বিশ্বাস আর শ্রীমান শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের! (দাম্পত্য। ছাপচিত্রে প্রজাপতি। তুষার কবির।

পৃ-২৩) তুষার আমাকে দেওয়া ওর বইয়ে লিখেছেÑ ‘‘কবি শুুচি সৈয়দ/ প্রিয় শব্দতীর্থযাত্রী/ তুষার কবির’’Ñ ওকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ওর এই বাক্যবন্ধটি খেয়াল করছি। এখানেই ওর স্বাতন্ত্র্যÑযখন ওর দশকের কবিরা নিজেদেরকে ‘শূন্য দশকের’ কবি বলে মোহরাঙ্কিত করেছে সগর্বে তখন তুষারের আÍপরিচিতিতে নিজেকে লিখছেÑপ্রথম দশকের কবি হিসেবে। কবির কাছে শব্দ শুধু শব্দ নয়, শব্দব্রক্ষ্মা বলে কথা। আর তাই শূন্যতাকে কি করে পরিপূর্ণতায় উপলব্ধি করতে হয় তা জানেন কবি তুষার কবিরÑ হিমবাহের টুকরো দেখেছ? সমুদ্রে হঠাৎ ভেসে ওঠে প্রমোদতরীর ত্রিকোণ গ্রীবার পাশ ঘেঁষে; আর জমাট শিলাস্তম্ভগুলো আস্তে আস্তে জেগে ওঠে শব্দহীন শূন্য স্তব্ধতায়! যাকে তুমি গ্লেসিয়ার বলে ভাবো আর যার কথা কবিতায় তুমি বারবার লিখেছ। ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ দেখতে দেখতে আমি যখন সুতনুকা দ্বীপকন্যার তরবারির মতোন ধারালো শরীর দেখি; সে যখন মেলে ধরে তার নগ্ন বক্ষশোভা অই দ্বীপটির প্রবাল প্রাচীরে, ঝাঁপ দ্যায় পাথরের ওপর থেকে সমুদ্রের নীল জলে, চনমনে কিছু শব্দ এসে আমার শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে হঠাৎ বিকল করে দ্যায়! এমনকি যখন তুমি ঠাণ্ডা শরবত বানাও, হালকা বরফ ঢেলে দাও গ্লাসে, অই গ্লাসে বরফ পড়ার শব্দে মনে হয় হিমবাহটা এইমাত্র ডুবে গেল সমুদ্রের অথই অতলে! অথবা সুনীলদা’র রূপালি মানবীর মতো যখন চায়ের চামচ নাড়াতে থাকো; কাঁচঘেরা এক মিউজিকরুম থেকে কোন কুমারীর আনকোরা শীৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসে! কখনো বা বহুজাতিক বিজ্ঞাপনের মতো বারান্দায় আমাকে বর্ষার কিঙ্করী শোনাও অথবা অই সেলফোনেই পাগলীর মতো চুমো খেতে থাকো; মনে হয় মিউজিকরুমটাতে কোনো বাদ্যযন্ত্রই নেই, হাওয়ায় একটানা তোমার চুমোর শব্দ, মিউজিকরুমটা স্তব্ধ ফাঁকা শূন্য! (শূন্য মিউজিকরুম।

ছাপচিত্রে প্রজাপতি। তুষার কবির। পৃ-১২) কবির কবিতা আর পাঠকের কবিতা যখন একই সমতলে আসে তখন তা হয়ে ওঠে মহার্ঘ। কবি তুষার কবির নিবরে নিভৃতে সেই মহার্ঘ কবিতার জনক হয়ে উঠেছেন। কবিতার অভিযাত্রায় সেখানেই কবির সাফল্য।

তুষার আমাদের কাব্যাঙ্গনে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর নিয়ে হাজির হয়েছেন। কাল তাকে সেভাবেই সনাক্ত করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুষারের কলম অব্যাহত থাকুক পাঠক হিসেবে এটুকুই আমার আন্তরিক চাওয়া। ঢাকা, ২ ও ৩ অক্টোবর ২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।