আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈদ আইতাছে! আমি ও এই রকম টাকার মেশিন চাই!! ; আর নইলে তানভীরের মতো জালিয়াতি করতে চাই ।

মানবিক দায় ও বোধহীন শিক্ষা মানুষকে প্রশিক্ষিত কুকুরে পরিণত করে....আইস্ট্যাইন। রাজধানীতে এক প্রবাসীর বাড়িতে আবিষ্কার হয়েছে শতকোটি টাকার জাল নোট তৈরির কারখানা। চারতলা ভবনের চারতলায় একটি ইউনিটজুড়ে শুধু জাল টাকা তৈরির নানা উপকরণ। এ বাড়িটির মালিক বিদেশে থাকলেও তার ছোট ভাই দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। তারা জানেন না মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকার ভাড়া দেয়া বাসায় কোটি কোটি টাকার অবৈধ কারবার হচ্ছে।

এ বাড়ির ভেতরে জাল টাকা তৈরির কারখানা আছে, আর তা সন্ধানের জন্য বড়মাপের ক্রেতা সেজে যাওয়া হয় সেখানে। তারপর জাল টাকা তৈরির তিন বন্ধু সিন্ডিকেটের এক সদস্য নিচে নেমে আসে। বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে ফ্রিজ থেকে বের করে দেয়া হল ঠাণ্ডা পানি। এরপর সবুজ রংয়ের সোফাসেটে বসে আলোচনা। তখন সবক’টি রুমের দরজা-জানালা বন্ধ।

কোটি টাকার ক্রেতা সেজে যাওয়া এ প্রতিবেদককে দরবার শেষ করতে হবে আধা ঘণ্টার মধ্যে। কারণ সিন্ডিকেটের এক সদস্য যাবেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। সেখানে একটা বড় ধরনের লেনদেন আছে তাদের। তারা কোরবানির হাটে বরাবরই জাল টাকা ছড়াছড়ির অন্যতম বাহক হিসেবে কাজ করে থাকে। এবার দরদাম হল।

এককোটি টাকায় ফিফটি ফিফটি অফার। লেনদেনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। টাকা লেনদেন এ বাসায় হবে না। সরাসরি তা অন্য কোথাও হবে। রোববার যুগান্তরের এ প্রতিবেদক সরাসরি ওই বাসায় যান।

গিয়ে ইমন, বাবু ও সুমন তিন বন্ধুর সিন্ডিকেটের তথ্য পান। তাদের দু’জন রাত-দিন খেটে তিন মাসে ৬০ কোটি টাকা ছাপিয়েছে। এক বন্ধু বাজারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। হাল সময়ে ২০ কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে তারা। তবে এগুলোর বিপরীতে সব আসল টাকা এখনও হাতে আসেনি।

এ জন্য একটি টালি খাতা দেখায় তারা। ‘দেখুন আমাদের লেনদেনে কতটা স্বচ্ছÑ টালি খাতায় সবার নাম আছে, অনেকে এখনও আসেনি, দু-চারদিনের মধ্যে আসবে। সব টাকার যোগান দেয়ার জন্যই প্রস্তুত করা রয়েছে। ’ বাবু জানায়, এ টাকাগুলো আপনারা কোন বাজারে ছাড়তে চান? কারণ ইতিমধ্যে গাবতলী গরুর হাটের জন্য তাদের বড় একটা টিম সক্রিয় রয়েছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে ইমন।

এক ঘণ্টা ধরে বাবুর সঙ্গে অনেক কথা হয়। তার পুরো নাম মমিনুল ইসলাম বাবু। বিক্রমপুরের হালিম শেখের সন্তান তিনি। তার সঙ্গে অনেক কথা খণ্ড খণ্ড তুলে ধরা হল। এ সিন্ডিকেটে জড়িত আছে আরও অনেকে।

যাদের অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। কোথায় বাড়িটি : রাজধানীর উত্তরা থানার দেয়াল ঘেঁষে যে রাস্তাটি দক্ষিণখানের দিকে চলে গেল সেখান থেকে যেতে হবে আজমপুরে। তারপর পূর্ব পাশে রেললাইনের পাশ দিয়ে যেতে হবে জামতলা মসজিদ। এখানকার ১৯৭ নম্বর বাসার চারতলায় চলছে এ কারবার। বাড়িটির মালিক আখতার হোসেন।

তিনি সৌদি আরবে থাকেন। আর বাসা দেখাশোনা করে রফিকুল ইসলাম। মাত্র তিন মাস ছয় দিন আগে এ বাসাটি ভাড়া নেয় জাল টাকার সিন্ডিকেট চক্র। গাড়ি ব্যবসা আছে এ কথা বলে বাসাটি ভাড়া নেয়া হয়। দরবার : জাল নোট তৈরিকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা দরবারে আধা ঘণ্টা সময় দিলেও কথা হয় এক ঘণ্টা ধরে।

দর-দামে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তারপর এত টাকা কীভাবে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে, তারা পৌঁছে দেবে কিনা সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথার ফাঁকে ইমন বলে ওঠে, আজ অন্তত আপনাকে কিছু টাকা বায়না দিয়ে যেতে হবে। দরবারের দিন বাকিটা দিতে হবে। ক্রেতার কাছে মোটা দাগের টাকা নেই, তাই কিছু টাকা দিতে পারলেও সেটা সামনে কোন এটিএম বুথ থেকে তুলে দিবে হবে।

এ কথার পর ইমন জানায়, হ্যাঁ কিছু হলেও চলবে। সঙ্গে সে নিজেই যাবে। বুথে গিয়ে কাহিনী : বায়নার কিছু টাকা গ্রহণ করতে বাবু নিজেই এ প্রতিবেদকের ওই বাসা থেকে নিচে নেমে আসে। তারপর বাসার খানিক দূরে একটা বুথ দেখা যায়। বুথের বাইরে থেকে বাবুকে ভেতরে নেয়া হয়।

যাতে করে সেখানে সিসি ক্যামেরায় তার চেহারাটা ধরা পড়ে। এরপর প্রতিবেদক টাকা তুলতে এটিএম কার্ড বুথে প্রবেশ করান। কিন্তু তিন তিনবার কার্ড পান্স করে ইচ্ছে করে ভুল পাসওয়ার্ড প্রবেশ করান। এতে করে বুথের ভেতর কার্ডটি ক্যাপচার করে নেয়। বিষয়টি বাবু নিজেই দেখতে পান।

এরপর আজ অথবা কাল কোন এক সময় কিছু টাকা পৌঁছে দিতে বলেন। কারখানার ভেতরে কিছুক্ষণ : সিন্ডিকেটের অন্যতম মাস্টার বাবু। তিনি জাল টাকা তৈরির প্রধান কারিগর। সে কয়েক ধরনের জাল নোট দেখায়। এ সময় সে কয়েকজন কারিগরের উদাহরণ তুলে ধরে বলে, তাদের তৈরি জাল নোট বাজারে ধরা পড়ার আশংকা থাকে।

কিন্তু তারা যে জাল টাকা তৈরি করে সেটা ধরা পড়া খুব মুশকিল। কারণ তারা সবচেয়ে দামি উপকরণ ব্যবহার করেন। অভিযানের আগে : জাল টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় কোন সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে বাবু জানায়, না না। একদম না। এ বাসায় আসার কোন সুযোগ নেই।

এখনও কেউ জানে না। কারণ এর আগে দু’দফা বাসা বদলানোর অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে সে বলে, গত বছর কোরবানি ঈদের সময় একবার সে ধরা পড়েছিল। চার মাস জেল খেটে বের হয়েছে। এখানে এ পর্যন্ত কোন অভিযান হয়নি। তবে কিছু টাউট আছে বেঈমানি করে।

তাদের অবশ্য সিন্ডিকেট থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ইমন ও সুমন কাহিনী : বাবুর কাছে জিজ্ঞেস করা হয় ইমন এবং সুমন কোথায়। তাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এ সময় বাবু জানায়, মাত্র একমাস আগে ইমন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখন একটু সাবধানে আছে।

তার গাড়ি ব্যবসাও আছে। খুলনা-বাগেরহাট রুটে কয়েকটি গাড়ি আছে। সুমন গাড়ির ব্যবসার কিছু দেখাশোনা করলেও আসল ব্যবসা এটিই। বাবু জানায়, ওয়াহেদ নামে আরও একজন আছে। চাইলে তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিছু টাকা দিতে পারেন।

সে এখন কোথায় জানতে চাইলে সে জানায়, আমার বাংলালিংক নাম্বার নিয়ে সে আপনাদের কাছে যাবে। কিন্তু বাবু তার ব্যবহার করা ০১৯৬৪২২৮৯৩৯ নাম্বারটি দিলেও একদফা কথা বলার পরে তা বন্ধ পাওয়া যায়। বিসিকের চাকরি থেকে : বাবু জাল টাকা তৈরির মূল কারিগর। ৫-৭ বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছে। এর আগে সে গাজীপুরে বিসিকে চাকরি করত।

সেখানে চাকরি অবস্থায় ব্লকের কাজ, স্ক্রিন প্রিন্টের কাজ শিখেছে। তারও আগে খুলনা-বাগেরহাট রোডে গাড়িচালকের চাকরি করত। তাদের আরেক সিন্ডিকেট হুমায়ুন এবং আনসার আলী জাল টাকাসহ গ্রেফতারের পর কিছু মালামাল তারা নিয়ে যায়। সেগুলো দিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন তাদের টার্গেট অনেক বড়। যা দেখা গেল : বাড়িটির চারতলার ওপরে একটি ইউনিটে চারটি রুম।

এখানে তিনটি রুমে জাল নোট তৈরি করা হয়। একটি রুমে থাকে বাবু। যুগান্তরের অনুসন্ধানকালে সেখানে পরিচয় হয় রুবেল হাওলাদার, সুজন ও শাহীনের সঙ্গে। একটু ভণিতা করে বাবুকে বলা হয়Ñ ওরা কারা? ‘ফিস ফিস করে কানে কানে বাবু বলে ওদের দু’জন মাঠ পর্যায়ে কাজ করে। খুচরা কিছু ‘মাল’ (জাল টাকা) তারা বাজারে চালায়।

বেশ কিছু দিন থেকে তারা জড়িত। রুমের ভেতর প্রিন্টার্স মেশিন, ঈগল মার্কা বিশেষ ধরনের কাগজ, আসুস ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, কিছু কম্পিউটারের খোলা যন্ত্র, আইকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের জলছাপ, বঙ্গবন্ধুর ছবির জলছাপ এবং ৫শ’ ও এক হাজার টাকার নোট দেখা যায়। প্রস্তুত ৬০ কোটি : বাজারে গত তিন মাসে তারা কিছু খুচরা টাকা ছেড়েছে বলে জানায়। সেই টালি খাতা দেখায় বাবু। ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার খুব ভালো তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন কোটি টাকার চালানটা নেয়া হয়।

নইলে আরেক পার্টি আছে। তারা যেকোন সময় চলে আসবে। খোকন হাওলাদার অবশ্য ওই পার্টি ধরে দিয়েছে ইমনকে। টাকা তৈরির রুমে দেখা যায়, কিছু সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। কারণ ক’দিন থেকে জোরেসোরে কাজ হচ্ছে।

কোরবানির ঈদের বাজার ধরতে ইতিমধ্যে ৬০ কোটি টাকা ছাপিয়েছে। এগুলোর কিছু কাজ বাকি আছে। প্রায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা এরই মধ্যে বাইরে চলে গেছে বলে স্বীকার করে বাবু। বাসার মালিক জানে না : দক্ষিখানের ওই বাসার মালিক আখতার হোসেন বিদেশে থাকলেও তার ভাই রফিকুল ইসলাম বাসাটি দেখাশোনা করেন। কিন্তু ওই বাসায় থাকা অবস্থায় যুগান্তরের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলা হয়নি।

মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ইমন নামে এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে বাসাটি ভাড়া নেয়। সে গাড়ি ব্যবসার পাশাপশি স্টিল মিলে চাকরি করে। পরিবারসহ থাকার কথা বলে ভাড়া নিলেও তারা যে এ কাজ করে সেটা জানা ছিল না। জাল নোট প্রতিরোধে ব্যবস্থা : প্রতিবছর ঈদকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল নোট সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের দৌরাÍ্য প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নিয়েছে।

সারাদেশের পশুর হাটে নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনসহ বুথ স্থাপন ও বিনা খরচে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। গোয়েন্দারা যা বললেন : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোল্লা নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানিয়েছেন, কিছু চক্র সক্রিয় হয়েছে তাদের গ্রেফতারে মাঠে কাজ চলছে। তিনি বলেন, জাল নোট তৈরিকারী চক্র নানা কৌশলে বাজারে নোট ছাড়ছে।

গোয়েন্দারাও কৌশল অবলম্বন করছে। ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মশিউর রহমান জানান, গত কয়েক মাসে জাল নোট তৈরি চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে তিনি গ্রেফতার করেছেন। তাদের কাছ থেকে বিপুল অংকের জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকায় একটি বিরাট চক্র এখন সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

অভিযান : জানা গেছে, গত কয়েক মাসে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে জাল নোট তৈরি চক্রকে গ্রেফতার করা হলেও তারা দমছে না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি মশিউর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকটি বড় বড় অভিযানে জাল নোটের কারখানা আবিষ্কার হয়। তাদের কাছ থেকে গোয়েন্দারা কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়, যা এসব সিন্ডিকেটকে শনাক্তে বেশ ভূমিকা রাখে। ডিবির একজন উপ-কমিশনার জানান, জাল নোট চক্রের সঙ্গে এখন অনেকে জড়িত। কিন্তু অনেক স্পর্শকাতর তথ্য তারা বাইরে দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাসগুপ্ত অসীম কুমার যুগান্তরকে জানান, জাল নোট প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তাদের কঠোরভাবে জাল নোট প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, সর্বশেষ রোববারও এ ধরনের বৈঠক হয়, যেখানে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনরা উপস্থিত ছিলেন। দাসগুপ্ত অসীম কুমার বলেন, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে চক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের দমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় তা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, গোয়েন্দরা এ বিষয়ে সফল হলে এ বছরও তাদের সফলতার জন্য স্বীকৃতি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। View this link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।