আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেড ইন বাংলাদেশ: পোশাকশিল্পের অবয়ব

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এই একটি স্লোগান সামনে রেখে সারা দেশে পোশাকশিল্পের এত উদ্যোক্তা, শ্রমজীবী মানুষ, শত শত কারখানা-প্রতিষ্ঠান, ৩৩ বছরের পরিশ্রমের পথপরিক্রমা। এত এত সফল উদ্যোক্তা আর সাফল্যের ইতিহাস বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে শিল্পসংশ্লিষ্ট কিছু দুর্ঘটনা আর সংকটের ঘেরাটোপে। নিরন্তর যেন এই পথচলা। শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্বাস, একটি সময় স্বস্তির বাতাস বইবেই। কিন্তু কেন যেন অস্থিরতার ঝড় থামছেই না।


১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা খাতটিতে ৪০ লাখ শ্রমিকের সিংহভাগ গ্রামীণ নারী। বর্তমানে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা চার হাজার ৮৮২টি। এর মধ্যে দুই হাজার ৯২টি কারখানা সরাসরি রপ্তানি করে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির কারখানা দুই হাজার ৭৯০টি, যার মধ্যে কিছু বন্ধ বা অচল আর কিছুর অস্তিত্বই নেই। বিকেএমইএর সদস্য কারখানা এক হাজার ৮৭০টির মধ্যে সরাসরি রপ্তানি করে ৯০০টি।

বাকি অর্ধেকের অবস্থা বন্ধ, অচল বা অস্তিত্বহীন। বন্ধ ও অস্তিত্বহীন কারখানাগুলো মূলত দেশের রাজনৈতিক কোলাহলের নিষ্ঠুর শিকার।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। স্পেকট্রাম, তাজরীন, রানা প্লাজার ধস। এত অসহায়-নির্মম মৃত্যু! এসব দুর্ঘটনায় সাধারণ নাগরিক এবং উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা অপরাধবোধ আর অনুতাপে ক্লান্ত।

ক্ষমা চাওয়ার সাহসও হারিয়ে ফেলেছি। ফলে দেশ-সমাজ, এমনকি নিজ বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও যেন বৈরিতার দেয়াল উঠছে।
শুধু ৪০ লাখ শ্রমিক, পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা বা ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি দিয়ে পোশাকশিল্পকে বোঝা যায় না, মূল্যায়ন তো নয়ই। এই খাতকে বুঝতে হলে এর শিকড় অর্থনীতির কত গভীরে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। জাতীয় অর্থনীতিতে (জিডিপি) এ খাতের সরাসরি অবদান ১০-১১ শতাংশ।

সম্পূরক অন্য শিল্প মিলে ১৪-১৫ শতাংশের কম নয়। পোশাক খাতে রপ্তানি হয় আনুমানিক এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আমদানি হয় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যবর্তী পণ্য। নিট পোশাকে মূল্য সংযোজন প্রায় ৯০ শতাংশ আর ওভেনে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।
২.৭ ঃ ১ শ্রমিক মেশিন অনুপাতে (৪৫ মেশিনে লাইন ভিত্তিতে) দেশে প্রায় ৩২ হাজার লাইন পোশাক কারখানা স্থাপিত হয়েছে।

বিনিয়োগ হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। কারখানায় একজন শ্রমিকের কাজের জন্য গড়ে আদর্শ জায়গা প্রয়োজন সর্বোচ্চ ৫০ বর্গফুট। কারখানাগুলো যদি শ্রমিকপ্রতি ৩৫ বর্গফুট করেও জায়গা দেয়, তাহলে শুধু কারখানা গড়তে হয়েছে ১৪ কোটি বর্গফুট। প্রতি বর্গফুট জায়গা গড়তে গড়ে এক হাজার টাকা ব্যয় হলেও, শুধু কারখানা নির্মাণ খাতে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রতি বর্গফুটের ভাড়া গড়ে সাত টাকা ধরা হলে প্রতি মাসে জায়গার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৯৮ কোটি টাকা।


বিভিন্ন খাতে এ শিল্পের প্রভাবের আরেকটু গভীরে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন সাত হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার পোশাকশিল্পের পণ্য পরিবহনে নিযুক্ত। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৩ জেটির আটটি পোশাক খাতের পণ্য ওঠা-নামায় ব্যস্ত থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২ সালে মোট কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়েছে এক হাজার ২০৫টি।

এর মধ্যে পোশাকশিল্পের জন্য ব্যবহূত হয়েছে ৮৪৫টি। আর ১৩ লাখ ৪৩ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ২০০০-০১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় ছিল ৪৭৭ কোটি টাকা। ২০১১-১২ সালে সেই আয় এক হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। এর প্রধান অংশ এ শিল্পের বদৌলতে।

যদি একজন শ্রমিক মাসে গড়ে ওভারটাইমসহ (ওভেন, নিট, সোয়েটার) ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন, তাহলে উদ্যোক্তাদের বেতন গুনতে হয় মাসে দুই হাজার কোটি টাকা, বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
পোশাকশিল্পকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ছোট-বড় কারখানা। যেমন কম মূল্যের কসমেটিকস, জামাকাপড়, লুঙ্গি, টয়লেট্রিজ, স্যান্ডেল, ফিতা-চুড়ি, লিপস্টিক, টিফিন ক্যারিয়ার, ছাতা, নারকেল তেল, আয়না, হোটেল, দোকানপাট ইত্যাদি।
কারখানার শ্রমিক বোনেরা পায়ের স্যান্ডেল, লিপস্টিক, পাউডার, তেল, সাবান ইত্যাদিতে বছরে যদি মাত্র ৪০০ টাকা খরচ করেন, তাহলে বছরে ১৬০ কোটি টাকা এই খাতে যায়। ৩০ লাখ নারী শ্রমিক যদি বছরে ২৫০ টাকা করে চারটি শাড়ি বা কামিজ কেনেন, ঈদ-পার্বণ বা আত্মীয়স্বজনসহ, তাহলে বছরে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয় শুধু এই বাবদ।

১০ লাখ পুরুষ শ্রমিক যদি বছরে দুটি করে লুঙ্গি, শার্ট কেনেন, তাহলে বছরে ৭০ কোটি টাকা যায় এগুলো কিনতে। কত কারখানা গড়ে উঠেছে ছাতা-টিফিন ক্যারিয়ার বানাতে।
সম্পূরক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে টেক্সটাইল, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, এমব্রয়ডারি, প্লাস্টিক, প্যাকেজিং, এক্সেসরিজসহ অনেক শিল্প। ১৯৮৫-৯০ সালে প্রায় হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা থেকে আজ স্থাপিত হয়েছে ৭১১টি টেক্সটাইল (৩০ হাজার ৭৫০ লুম), ৩৮৫টি স্পিনিং (৮৭ দশমিক ৮ লাখ স্পিন্ডেল), ২৩৩টি ডায়িং ফিনিশিং কারখানা। বিনিয়োগ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।

কারখানা গড়া হয়েছে পাঁচ কোটি ১০ লাখ বর্গফুটের মতো। নির্মাণ করতে লেগেছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এক্সেসরিজ শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স খাতে আয়
পোশাকশিল্পের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পোশাক টেক্সটাইল, উইভিং এক্সেসরিজ কারখানা স্থাপনে ঋণ নেওয়া হয় এক লাখ কোটি টাকার ওপর। ব্যাংক ইন্টারেস্ট ১২-১৮ শতাংশ, পাঁচ থেকে সাত বছর মেয়াদি।

তারপর প্রতিদিনের আমদানি-রপ্তানি। শুধু পোশাক ও সহযোগী শিল্পের আমদানি-রপ্তানি বছরে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এই টার্নওভারের ওপর নানা চার্জ, কমিশন আয় করে ব্যাংক-বিমা কোম্পানিগুলো। জোর দিয়ে বলতে পারি, দেশের বেশ কটি বড় ব্যাংক এবং বিমার অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে পোশাকশিল্পের ওপর।
পোশাকশিল্প সরাসরি অবদান রাখছে অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রে।

দুই দিন হরতাল থাকলে হোটেলগুলোতে ক্রেতা বা অতিথির সংখ্যা অর্ধেকে দাঁড়িয়ে যায়। ছোট-বড় আরও অনেক খাত আছে, যা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্যবিমোচন এই দুটি সূচকে পোশাক খাতের অবদান গবেষণার দাবি রাখে। গ্রামীণ নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্যবিমোচনকে সমানভাবে উতরাতে পেরেছে। পোশাক খাত না থাকলে জনসংখ্যা সবশেষ শুমারির তুলনায় কমপক্ষে আরও দুই কোটি বেশি থাকত বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন।


পোশাকশিল্প যেমন অর্থনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে, তেমনি গড়ে তুলেছে একটি নতুন উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, যারা পোশাক দিয়ে শুরু করেছিল, এখন অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ করছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পোশাক ও এর আনুষঙ্গিক শিল্প ছাড়া অন্য কোনো বৃহৎ খাত পরিপক্বতা পায়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা দুঃখজনক। পোশাকশিল্পের বদৌলতেই বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে ‘নেক্সট চায়না’ বলে আখ্যা দিচ্ছে।
একই সঙ্গে এ-ও বলতে হবে যে এই ৪০ লাখ শ্রমিক ছাড়া আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকত না।

তাঁদের ন্যূনতম বেতন বাড়ানো, নিরাপত্তা নিয়ে যেমনি অনেক কিছু করার আছে, তেমনি বেশি উৎপাদনের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। কম্বোডিয়ায় সর্বমোট ৩০৯টি পোশাক কারখানায় কর্মরত তিন লাখ ৩৫ হাজার ৪৩২ জন শ্রমিক ২০১১ সালে রপ্তানি করেছে ৪ দশমিক শূন্য ৪৭ বিলিয়ন ডলার, যাতে করে মাথাপিছু শ্রমিকের রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭০ ডলারে। (উৎস: কম্বোডিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কেন লু, সেক্রেটারি জেনারেল, গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, কম্বোডিয়া) অন্যদিকে বাংলাদেশে ৪০ লাখ শ্রমিক রপ্তানি করে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা মাথাপিছু পাঁচ হাজার ডলার হয়। কম্বোডিয়ার শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ৭৪ ডলার। আমাদের শ্রমিক ন্যূনতম তিন হাজার টাকা হিসাবে মাসে পান চার হাজার ৫০০ টাকার কাছাকাছি।

মোট শ্রমিকের শতকরা ১৫-১৮ ভাগ ন্যূনতম বেতনে চাকরি করেন। দুই দেশের উৎপাদন ক্ষমতায় আকাশ-পাতাল তফাত। এদিকটায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
তাজরীন ও সাভার দুর্ঘটনা সমগ্র পোশাকশিল্পকে বিশাল নাড়া দিয়েছে। সারা জাতি, বিশ্বের ক্রেতা-ভোক্তারা শঙ্কিত।

এই দুর্ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজজীবনের শিরা-উপশিরায় যে শিল্প বহমান, তাকে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এর অতিক্রমে প্রয়োজন সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করা।
আনিসুল হক: চেয়ারম্যান, মোহাম্মদী গ্রুপ, সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই ও সার্ক চেম্বার। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।