আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"নীল" [গল্প]

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে একে দেব পদচিহ্ন/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোকতাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন ফয়সাল বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টিটা যেহেতু বাইরের আকাশে অসীমে মিলিয়েছে তাই ঠিকমত তার চোখ দু’টো দেখা যাচ্ছে না। দেখতে পেলে দেখা যেত, তার চোখে খানিকটা বিস্ময় ভর করে আছে। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসা জলকণাগুলোকে তার কেন যেন আজকে একটু বেশিই নীল মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে বেগুনী।

মনে হচ্ছে, মেঘের সাথে খানিকটা রক্ত মিশে আছে। যখনই সেটা জলের সাথে নিচে নেমে আসছে, তখন নীল জল বেগুনী হয়ে যাচ্ছে। ফয়সালের মুখ কঠিন হয়ে আসল। হাস্যকর চিন্তা ভাবনা এটা। একটা সময় ছিল যখন হাস্যকর চিন্তা ভাবনা করতে ভাল লাগত।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত এইসব হাস্যকর চিন্তা ভাবনা করে। এখন আর ভাল লাগে না। অসহ্য লাগে। তবুও, অবচেতন মন এই অসুস্থ চিন্তাগুলো জোর করে চেতনার মাঝে ঠেলে দেয়। ফয়সাল চেষ্টা করছে, চিন্তাগুলোকে আবার অবচেতনায় ফেরত পাঠাতে।

পারছে না। এক মুহূর্ত বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। বুঝল একটা ভুল করছিল। অবচেতনায় ফেরত পাঠালে সেটা তার মাঝে টিকে থাকবে আরও বেশি সময় ধরে। করার মত কাজ একটাই হতে পারে।

ফয়সাল চেষ্টা করতে লাগল চিন্তাটুকু মুছে ফেলতে। ‘পেছনে সরে আয়। বৃষ্টির ছাট লাগবে। ’ মায়ের গলা শুনেও ফয়সালের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। মা আর কথা বাড়ালেন না।

কারণ খুব ভাল করেই জানেন ফয়সালের ইচ্ছে না হলে, সে এখন কোন কাজই করবে না। মা ফেরার জন্য উল্টো ঘুরতেই ফয়সাল বলল, ‘মা, এক কাপ লেবু চা দিতে পারবে?’ মা অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, তার মধ্যে একটা হাহাকার কাজ করছে। এক বছর আগে হলে ফয়সাল কথাটা কীভাবে বলত? ‘মা, এক কাপ চা দাও তো। ’ তিনি বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘পারব না। আমি আমার কাজের চোটে দেখি চোখে অন্ধকার! এর মধ্যে আবার লাট সাহেবের ব্যাটাকে চা করে দিতে হবে।

এত কিছু লাগলে, একটা বিয়ে করে ফেল। ’ ফয়সালও রেগে যেত, ‘এক কাপ চা খেতে চাইলে এত কথা শুনতে হবে?’ আর এখন... ফয়সাল খুব ভাল করেই জানে, সে যে একটা কথা বলেছে, এতেই তার মা অনেক খুশি। চা না দেয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না। অথচ, এখন কথাটা বলে অনুরোধের সুরে। যেন তাদের দু’জনের মধ্যে যোজন যোজনের দূরত্ব।

‘হ্যাঁ, দিচ্ছি’ বলে তিনি পা বাড়ালেন। ফয়সাল পেছন থেকে বলল, ‘আমি আজকে একটু বেরুব। ’ মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘কোথায় যাবি?’ ফয়সাল কোন উত্তর দিল না। মা চা করতে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। চা নিয়ে ফিরে ফয়সালকে পেলেন না।

ফয়সাল বেরিয়ে গেছে। খিলগাঁও লালমাঠে ফয়সাল বসে আছে তিন ঘণ্টা ধরে। জায়গাটা প্রকৃতপক্ষে একটা গোরস্থান। উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে এটা ঠিক কীভাবে লালমাঠ নাম পেয়ে গেছে, ফয়সালের ঠিক জানা নেই। ফয়সালের মনে হল, তার জায়গায় যদি হুমায়ুন আহমেদ থাকত তাহলে নিশ্চয় লালমাঠ নামের একটা মজার কাল্পনিক প্রেক্ষাপট বের করে ফেলত।

ফয়সাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জীবনটা উপন্যাস নয়। তাই উপন্যাসের শেষে কখনও একটা খ্যাপাটে স্বভাবের মেয়ে পাগলের মত নায়কের কাছে ছুটে আসে না। বরং কোন শান্ত স্নিগ্ধ মেয়ে জীবন থেকে হারিয়ে যায়। আর নায়ক এসে গোরস্থানে বসে থাকে।

অবশ্য এই গোরস্থানে কবর আছে মাত্র দু'টো। অন্যটা কার ফয়সালের জানা নেই। তবে একটায় কে শুয়ে আছে, সেটা ফয়সাল খুব ভালভাবেই জানে। গোরস্থানটায় অবশ্য মোটেও কোন গোরস্থান ভাব নেই। যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা উঠিত বয়সের ছেলেদের ক্রিকেট আর যুগলদের আড্ডা।

এখন অবশ্য গোরস্থান কিংবা লালমাঠ একেবারের জনমানবশূন্য। একটা গরুকে দেখা যাচ্ছে। সে নিবিষ্টচিত্তে ঘাস খাচ্ছে। ফয়সাল গত তিন ঘণ্টা ধরে গরুর ঘাস খাওয়া দেখছে। একই সাথে গত তিন ঘণ্টা ধরে তার মোবাইলটা অনবরত বেজে চলেছে।

ফয়সাল সেটা তুলছে না। সে খুব ভাল করেই জানে, কে কল করেছে। জানে বলেই ধরছে না। করুক অপেক্ষা। এই ছোট্ট অপেক্ষায় কিছু আসে যায় না।

ফয়সাল তো দশ মাস ধরে অপেক্ষা করছে। কারও কিছু এসেছে, গেছে? কিছুই হয় নি। ফয়সালের তাহলে এত দায় কীসের? একটু পরে, কী ভেবে ফয়সাল ফোনটা তুলল। যা ভেবেছিল তাই। তিথির ফোন।

ফয়সাল সামনে তাকাল। প্রবল বর্ষণে কিছুই ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হয় কে যেন আসছে। বৃষ্টিতে চেহারাটা ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু, আসছে।

গাড় নীল রঙা কামিজ আর হালকা বেগুনী রঙয়ের একটা ওড়না পরে। কেন একজন আসছে। ফয়সাল তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে। সে জানে সে যা দেখতে পাচ্ছে তার সবই মিথ্যে তবুও বিশ্বাস করতে মন চাইছে। এবং ফয়সাল তা বিশ্বাস করছে।

বিশ্বাস করছে অন্তর থেকে। তিথি আসছে। তার অবচেতনা থেকে একরাশ স্পন্দন ভেসে আসছে। ফয়সাল বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না সেগুলোকে ফেরত পাঠাতে। কিংবা তা মুছে ফেলারও কোন চেষ্টা করছে না।

কিছু মিথ্যে সত্যের থেকেও সুন্দর। এটা তেমনই কিছু। লালমাঠের গেটটা বন্ধ। ফয়সাল দেয়াল টপকে ঢুকেছে। তিথি সেভাবে ঢুকতে গেলে দু’টো পা আর একটা হাত ভাঙ্গত।

তবুও তিথি এসেছে। তিথি আসছে। ‘বৃষ্টিতে ভিজলে তিথিকে অপ্সরীর মত লাগে’ কথাটা ফয়সাল তিথিকে বহুবার বলেছে। তিথি রেগে উঠেছে, ‘মানে কী? তোমাকে না কতবার বলেছি, অপ্সরী মানে স্বর্গের পতিতা। তারপরও আমাকে অপ্সরী বল কোন সাহসে?’ ফয়সাল চুপচাপ হাসত।

বলত, ‘হ্যাঁ, তাইতো! আর আমি দেবতা। ’ তিথি কপট রাগ দেখাতো। তারপর আলতো করে মাথাটা রাখত ফয়সালের বুকে। সময় যেন থেমে যেত সেই মুহূর্তে। সেভাবেই যে কতটা সময় কেটে যেত, খেয়াল করত না কেউ ই।

সময় যেন আজ, এই মুহূর্তে আবার থেমে গেছে। সেই তিথি আবার আসছে। ঠিক তিনশ তিন দিন পর। সেই অপ্সরী আবারও বৃষ্টিতে ভিজছে। ফয়সালের হাতে মোবাইলটা আবারও বেজে চলছে।

কাঁপা কাঁপা হাতে ফয়সাল কলটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে শোনা গেল, ‘ভিজবে?’ ফয়সাল হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। সে অনুভূতিটা ওপাশে পৌছতেই শোনা গেল, ‘আমি এখন ছাদে। সূর্যটা যেখানে লুকিয়ে আছে তার উল্টো দিকে তাকাও। ’ ফয়সাল তাকাল।

ছায়াপথের মত প্যাঁচানো কালো মেঘটা দেখতে পাচ্ছ? ফয়সাল হ্যাঁসূচক মাথা দোলাল। আমি ঠিক ওইখানটায় আছি। ফয়সালের মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। নিজের মনকে সে বলল, ‘সব মিথ্যে।

যা দেখছি, যা শুনছি সব মিথ্যে। ’ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘যদি সত্য হত...’ তার চোয়াল আবার শক্ত হয়ে উঠল। দৃঢ় গলায় বলল, ‘সব সত্যি। ’ ফয়সাল মেঘ থেকে দৃষ্টি নিচে নামাল। তিথি দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।

পাখির মত ডানা ঝাপটাচ্ছে তার হাত দু’টো। তার শরীরের নীল রং যেন দিগন্ত থেকে দিগন্তে মিশেছে। পুরো পৃথিবীটা এখন নীল। পুরো পৃথিবীতে এখন নীল। নীলিমার নিচে এখন নীলের রাজত্ব।

ফয়সাল বিড়বিড় করে বলল, ‘অপ্সরী’। ধীর পায়ে ফয়সাল এগোতে শুরু করল। তার জগতটা এখন একটা পরমাণু। একটা মিথ্যে পরমাণু। সত্যের চেয়েও বাস্তব এক মিথ্যে।

ফয়সাল শক্তি হারিয়ে ক্রমশই নিউক্লিয়াসের দিকে এগোচ্ছে। তার মনের আলোটুকু একটু একটু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশটা আরও কালো হয়ে উঠছে। যেন প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে, আজ ফয়সালের কাছে কোন আলো পৌছতে দেবে না। আলো পৌছলেই সে দুরের কক্ষপথে চলে যাবে।

স্বয়ং সূর্যও মুখ লুকিয়ে অপেক্ষা করছে সত্য আর মিথ্যের মিলনের। ফয়সাল এগিয়ে চলছে। তার মনে হচ্ছে, সে যেন চলছে অনন্ত কাল ধরে। এই পথের যেন কোন শেষ নেই। মনে হচ্ছে অচেনা কোন কক্ষপথে সে চক্রাকারে আবর্তন করছে।

নিউক্লিয়াসটাও যেন তার অবস্থান থেকে বারবার সরে যাচ্ছে। ইলেকট্রন ক্রমশ শক্তি হারাচ্ছে। এবং তিথির নিকট হতে নিকটতর হতে নিকটতম হচ্ছে। এই তো আর খানিকটা পথ। আর সামান্য।

আর একটু পথ পেরুলেই সে পৌঁছে যাবে তিথির কাছে। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসে পতিত হবে। কোন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন কি হবে? একক ইলেকট্রন মৌল হাইড্রোজেনের কি হবে হিলিয়ামে রূপান্তর? আর তা থেকে ঠিকরে আসা প্রবল আলোর ঝলকানি? যে আলো নিয়ে বেঁচে থাকে প্রতিটা নক্ষত্র। হঠাৎ, প্রবল আলোর ঝলকানিতে ফয়সালের চোখ আধার হয়ে এলো। পরদিন দৈনিক পত্রিকাগুলোর এক কোণায় ছোট্ট একটা খবর ছাপা হল- ‘বাসাবো খাল থেকে বজ্রাঘাতে নিহত অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের লাশ উদ্ধার’।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।