আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুভ জন্মদিন কবি হেলাল হাফিজ

শরীরে আচড়ের দাগ, নষ্ট হল বুঝি আবার মানবতা! তখন সময় উত্তাল। অশান্ত ঢাকার আকাশ বাতাস। অলিতে গলিতে, পাড়া মহল্লায়, চায়ের দোকানে, ষ্টেশনারীতে একই আলাপ, স্বৈরাচারের পতন। আগরতলা মামলার ঢেউ তখন সমস্ত রাজপথ প্রকম্পিত করে ছড়িয়ে দিচ্ছিল বিপ্লবের বিবর্ধিত মশাল। যখন রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে চলা মিছিলে পুলিশের গুলি, রক্তে মাখা আসাদের শার্ট ধূলিময় রাজপথে পড়ে থাকে নগ্ন উপহাসে, তখন মিছিল মিটিং আন্দোলন হয়ে ওঠে কবিতার আরেক নাম।

প্রতিবাদ নানা মাত্রায়, মিছিলে দৃপ্ত শ্লোগানে, কবির কলমে বিচ্ছুরিত শব্দের স্প্লিনটারে কিংবা ভূমিহীন মনু মিয়াদের কোদাল অলস পড়ে থাকায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণের জেগে উঠেছে কবিতার প্রতি এক ধরণের অনির্বচনীয় ভাল লাগা। তরুণটির বলবার আর কোন ভাষা জানা নেই, কবিতা লেখা ছাড়া। জন্ম নিলো ৪ পাতার এক দীর্ঘ কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। অগ্রজ কবি আহমেদ ছফার অনুরোধে কিছু কাট ছাট সংশোধন, শেষে আঠার লাইনে থামল কবিতাটি।

কবিতাটির প্রথম দুটি পংক্তি ছিল- এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এই দু’টি পংক্তি সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিমঞ্চে যেন ঢেলে দিল বারুদ। আশ্চর্য দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়ল পংক্তি দু’টো, মাঠে ময়দানে, পাঠক, লেখক এমনকি বোদ্ধা মহলে। সেদিনের সেই তরুণটি হয়ত ভাবতেও পারেননি এ দুটো পংক্তি দিয়েই বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কালক্রমে সেই তরুণ পরিণত হলেন ষাটের দশকের একজন প্রধান কবি হেলাল হাফিজে।

হেলাল হাফিজের কাব্যাঙ্গনে আগমন যেমন বিস্ময়কর, তেমনি চমক জাগানিয়া তার পরিমিতি বোধ। তার কবিতায় ঘটনার ঘনঘটা নেই, তীব্র বিপ্লব নেই এমনকি তীব্র অনুভূতির প্রকাশও নেই। শব্দ ও ভাবের বাহুল্যকে শত্রু জ্ঞান করে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন মেদহীন ঝরঝরে উপস্থাপন। অল্প কথায় হৃদয়ের গহীনে আঁচড় টানবার আশ্চর্য এক বেদনা পালকের সন্ধান পেয়েছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। হেলাল হাফিজের কালজয়ী আরেকটি কবিতা ‘একটি পতাকা পেলে’।

আজকে সেই কবিতার আলোকে কবি প্রত্যাশা ও জাতীয় জীবনে আমাদের আশা নিরাশার দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলবো। প্রতিদিন পশ্চিমে যখন সূর্যটা অস্ত যায়, তখন রক্ত লাল ওই আলোর গোলকটাকে বড় আপন মনে হয়। মনে হয় একাত্তরে এই সূর্যটাকে আমরা নিজেদের করে নিতে পেরেছি, নিজের ভাষায় তাকে সূর্য অধিকার পেয়েছি। আর তাইতো বাংলার চিরায়ত শব্দমালায় আমরা সাজাচ্ছি সূর্যের শক্তি শেলের বর্ণনাটুকু। কিন্তু এই লাল সূর্য, এই স্বাধীনতা আমাদের বুক খালি করে গেছে রূঢ়তা ও নির্মমতায়।

ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দু’লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি আমাদের দিয়ে গেছে লাল সবুজের পরম আরাধ্য একটি পতাকা। যে পতাকার জন্যে এত আত্মত্যাগ, এত রক্ত ও ক্লেদের উপাখ্যান, মৃত্যু ও ধ্বংসের মিথ রচিত হল এই বাংলার পলিতে, সেই পতাকা আমাদের অস্তিত্বের সাক্ষর, আমরা ভুলে যেতে পারি সকল কষ্টের ইতিহাস। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টটুকু ভুলতে চাওয়া কবি স্বপ্ন দেখেছেন কবি মানসের অনিবার্যতা থেকে। স্বপ্ন দেখেছেন সব শোষণ বঞ্চনা অবসানের। স্বাধীনতা আমাদের আজন্ম লালিত সাধ, রক্তবীজের প্রলয় স্পন্দন।

আমরা কামনা করেছিলাম একটি সুখী স্বাধীন ও প্রকৃত অর্থেই সার্বভৌম রাষ্ট্রের। যেখানে আমরা ভুলে যাব জাত, পাত, ধর্ম বর্ণের বাধা। যেখানে আমাদের পরিচয় হবে আমরা মানুষ। পর্দা ছেড়ার স্পর্ধায় আকাশ ছোবে দেশের সাত কোটি মানুষ। আমাদের এমনই অনেক আশা ও স্বপ্নের বয়ান করেছেন কবি তার এই কবিতায়।

সরাসরি তা হয় তো প্রকাশিত নয়, তবে অর্ন্তনিহিত ভাবে তা একান্তই আশার প্রতীক। যে আশা সব হারানো কাউকেও ফিরিয়ে দিতে পারে সঞ্জীবনী সুধা। যে মধুর মুরতি লাভে ভজন গায়িকা সবিতা মিস্ট্রেস ব্যর্থ চল্লিশে এসেও বলতে পারেন ‘পেয়েছি পেয়েছি’ । এমনি ভাবে কবিতায় আরো এসেছে ছোট ছোট চিত্ররূপ। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে, বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুধে-ভাতে। কবিতায় চিত্ররূপের আর্বিভাব মূলতঃ কবিতার আশাবাদের দিকটিকে প্রগাঢ় করে তুলবার জন্যই। কবি আশা করেছেন ভূমিহীন মনুমিয়ারা গাইবে তৃপ্তির গান, একেকটি যুদ্ধ শিশু তার প্রাপ্য সম্মান নিয়ে বেচে থাকবে এই উদার, অকৃত্রিম মমতাময়ী বাংলার মাটিতে। কবির সেই আশাবাদের চূড়ান্ত প্রকাশ দু:খ গুলোকে ছুড়ে ফেলে দিতে চান যৌথ খামারে। বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে কবি সুখের আরো সমৃদ্ধি কামনা করেন।

লক্ষ্যণীয় কবি এখানে বিজ্ঞানের প্রসঙ্গটি এনেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। একটি দেশের সামষ্টিক উন্নতি ও তার এগিয়ে যাবার প্রধান প্রেরণা বিজ্ঞানের অগ্রগতি। প্রশ্ন হলো, সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নতি কি আমরা আনতে পেরেছি? স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে আমাদের আত্ম জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয় এই প্রশ্ন, আমাদের অপরাধী করে দেয়। স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছে পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ। অথচ এই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উদার গণতান্ত্রিক সংগীতটি সুর হারিয়েছে বারবার।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুন, দেশব্যাপী দীর্ঘকাল সামরিক শাসন, গনতন্ত্রের খোলসে পারিবারিক রাজতন্ত্রের নগ্ন চর্চা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে বারবার স্বপ্ন পুকুরে লেগেছে চৈত্রের খরার টান। স্বাধীনতা শব্দটি এখন পরিণত হয়েছে দলীয় সম্পত্তিতে। হেলাল হাফিজের কবিতায় যে আশাবাদের জায়গাটুকু উপস্থাপিত হয়েছে তাকে বাস্তবতার নিরিখে অবলোকন করেছেন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আশির দশকের স্বৈরাচারের শাসনামলে তিনি তাই হেলাল হাফিজের কবিতাটির প্রেরণাতে রচিত কবিতায় উল্লেখ করেন- কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত, রাখালেরা পুনর্বার বাঁশিতে আঙুল রেখে রাখালিয়া বাজাবে বিশদ। ……(কথা ছিল সুবিনয়) সত্যিই কথা ছিল রক্ত গঙ্গার বয়ে যাওয়া আমাদের দিয়ে যাবে আরাধ্য সেই মুক্তি।

রাখালের বাঁশিতে আবার শোনা যাবে বাংলার চিরায়ত সাম্যবাদের গান। কিন্তু সেখানে বারবার হতাশার কালো ছায়া আমাদের করেছে শঙ্কা কাতর। তবে এই শঙ্কার পাশাপাশি আশার কথাও আছে। আমাদের জাতীয় জীবনে না পাওয়ার নানা দিক থাকলেও অর্জনের দিকটিও কম নয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত বাংলাদেশ যা এদেশের একটি বড় সাফল্য।

এছাড়াও শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, চিকিৎসার উন্নতিও আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমরা আশা করব অতীতের সব অন্ধকার ভুলে এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ কবি হেলাল হাফিজের ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় প্রদর্শিত অরুণোদয়ের ইঙ্গিতের মত করে। কবি হেলাল হাফিজের জন্মদিনে আমাদের ভালবাসা ও শুভেচ্ছা বি.দ্র : কবি হেলাল হাফিজের জন্মদিন উপলক্ষে লিখিত এই লেখাটি প্রকাশ হয় বি ডি লাইভ টুয়েন্টি ফোর ডটকম এ উৎসর্গ : পাগলাটে সৌভিক দা' কে ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।