আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রফিক-উল হক সবার খালু ( খালাম্মা কে!)

কাউকে সম্মান করতে না পারা এক কথা, অসম্মান করা ভিন্ন কথা। একটি মনের কার্পণ্য, অন্যটি মানবিক গুণ। একটি চিন্তার বৈকল্য, অন্যটি মানসিক ঔদার্য। তা ছাড়া কাউকে সম্মান করা-না-করার এখতিয়ার সবার থাকতে পারে, কিন্তু অসম্মান করার অধিকার কারো থাকা উচিত নয়। আমাদের জানা মতে, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবার ‘খালু’ অন্তত জাতির উল্লেখযোগ্য মানুষ তাই মনে করে।

কারণ তিনি বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, প্রাজ্ঞ আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, একই সাথে সুদিনে-দুর্দিনে জাতির অভিভাবক হওয়ার মতো যোগ্যতা তার আছে। এবং তিনি সেটা প্রমাণও করেছেন। তার পরও প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে ‘মুই কার খালু’র গল্প শোনান তাতে রফিক-উল হক ছোট হন না, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও জনগণের কাছে বড় হয়ে যান না। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত নিজেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমাদের জ্ঞাতসারে রফিক-উল হক তার প্রতিদ্বন্দ্বী নন, প্রতিপক্ষও নন।

তার সাথে কোনো রাজনৈতিক রেষারেষিও নেই। রফিক-উল হক খালেদা জিয়াকে ‘আমাদের নেত্রী’ বলাটা যদি এতটাই অপরাধ হয় তাহলে রফিক-উল হক প্রধানমন্ত্রীকে অজস্রবার ‘নেত্রী’ বলে সম্বোধন করে কি ভুল করেছেন! রাজনীতির সঙ্কটকালীন এই সময়টিতে জনগণ যখন রফিক-উল হকের মতো লোকদের কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য বেশি আগ্রহী, তখন দলনিরপেক্ষ বয়োবৃদ্ধ ও প্রাজ্ঞ একজন সম্মানিত মানুষকে এভাবে গ্রাম্যগল্প শুনিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি ভালো কোনো কিছু অর্জন করলেন! দুর্ভাগ্য, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে তার বিশেষ সহকারী যেন ক’কদম আগ বাড়িয়েই আছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ। আওয়ামী লীগের মতো দলের সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ সহকারী’র অবস্থান কি আমাদের জানা নেই। তিনি কি দলের মুখপাত্র না প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র, তাও আমরা জানি না।

এটা জানার মতো তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়। তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, মাহবুব-উল আলম হানিফ বিরোধী দলের বিপরীতে সরকারি দলের মাউথ অর্গান। মুখপাত্র বলা হবে কি হবে না ও সেটা সরকারি ও বিরোধী দলের বিষয়। মাহবুব-উল আলম হানিফ তার অবস্থান থেকে সরকার ও দলকে ডিফেন্ড করার ক্ষেত্রে কম পারদর্শী নন, তবে সরকার ও দলের ইমেজ রক্ষার জন্য তার ভূমিকা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছেÑ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সে বির্তক এবং আলোচনাও ততটা বাড়ছে।

সেটা প্রাসঙ্গিকও বটে। আদালত পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়ার আগেই সরকার অতিউৎসাহ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ধারণা উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করেছে। এর একটি উদ্দেশ্য ছিলÑ বিরোধী দলকে সাংবিধানিক বিতর্কে জড়িয়ে ব্যস্ত রেখে সময়ক্ষেপণ করা। বিরোধী দল এখন সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বেশি বলার সময় পায় না। আলোচনা-সমালোচনা করে সরকারকে তুলোধুনো করে দেয়ার ফুরসতই এখন তাদের নেই।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতেই বিরোধী দল ঘুরপাক খাচ্ছে। চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার মতো বিষয়টি এখন উপেক্ষিত। আড়ালে চলে যাচ্ছে পণ্যমূল্য, জনভোগান্তি, লুটপাট ও টেন্ডারবাজির মতো ঘটনাগুলো। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয় থেকে রেলের কালো বিড়াল সব আড়ালে চলে যাচ্ছে। বিরোধী দলকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে।

এখন তারা এই ইস্যুতে কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলার কাজে ব্যস্ত। সংবিধান সংশোধন করে বিরোধী দলকে উটকো বিতর্কে জড়িয়ে রাখার উদ্দেশ্যটি সফল হয়েছে। সরকার বিরোধী দলকে রাজপথ থেকে তাড়িয়ে অফিসে ঢুকিয়েছে। পুলিশ এতটা বেপরোয়া হতে পেরেছে কেন বিরোধী দল সেটা ভেবে দেখার সুযোগই পেল না। তেলের দাম বাড়ে, বিরোধী দল শক্ত অবস্থান নেয় না।

রেলের ভাড়া বাড়ে, বিরোধী দল অর্থবহ প্রতিবাদ করে না। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ছয়বার, বিরোধী দল মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ব্যাংক সেক্টর বিপর্যস্ত, অর্থনীতি লোপাটতন্ত্রের কাছে জিম্মি, তাও বিরোধী দল মুখ ফুটে কথা বলে না। সরকার একটা একটা করে ফাঁদ পাতে আর বিরোধী দল তাতে পা দেয়। সর্বশেষ দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের উদ্যোগ নিয়ে সরকার চারদলীয় জোটকে ফাঁদে ফেলে মিথ্যা প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছে।

এর আসল উদ্দেশ্যÑ বিদেশী, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে চাচ্ছে, সরকারই জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, তালেবান ভূত তাড়াতে ওস্তাদ। তাদের ওপর ভরসা করলে পশ্চিমা অ্যাজেন্ডা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধের একটা কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। এই সরকারের আমলে ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেয়ার মতো যত ঘটনা ঘটেছে অতীতে আর কখনো তেমনটি ঘটেনি। এ ধরনের একটা আরোপিত মিথ্যাচার বিরোধী দলের ওপর চাপিয়েও সরকার ধর্মব্যবসায়ের রাজনীতি করে যেতে পারছেÑ শুধুই বিরোধী দলের অকর্মণ্য আচরণের কারণে। নানা ইস্যুতে বিরোধী দলকে কথা বলতে দিলে তিস্তা চুক্তি, ট্রানজিট, সীমান্ত হত্যা, করিডোর সমস্যাসহ ভারতীয় আগ্রাসন স্পষ্ট হয়ে যেত।

আর সরকারের ভারত তোষণনীতির উলঙ্গ চেহারা জনগণ দেখে ফেলত। আওয়ামী লীগ সব সময় সালিশ মানে, কিন্তু তালগাছটা তার চাই। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেও তারা সালিশ মানবে কিন্তু তালগাছটা তাদের ভাগে ফেলতে হবে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সালিস করে তালগাছ আওয়ামী লীগের ভাগে দিতে পারলে তিনি তখন আওয়ামী লীগেরও খালু হয়ে যাবেন। না পারলে তাকে মান-ইজ্জত খোয়াতে হবে।

একই সাথে মুই কার খালুর গল্পও শুনতে হবে। এটা জানা কথা। জানি না আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার রিডিং ও বোঝাপড়া কতটুকু। তবে নিশ্চিত করে জানি, তিনি আওয়ামী লীগেরই পরীক্ষিত বন্ধু ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর একজন নিষ্ঠাবান অনুরাগী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তিনি এক রত্তিও ছাড় দিতে নারাজ। তাই এই চেতনার নামে অনেক অনাচার-অত্যাচারও তিনি মেনে নিতে পারেন।

তিনি এটাও জানেন বিরোধী দলকে আশকারা দেয়া যেমন সরকারি দলের কৌশল হয় না, তেমনি সরকারকে ছাড় দিয়ে বোবা হয়ে থাকাও বিরোধী দলের রাজনীতি হতে পারে না। তাই তিনি বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারেন। তিনি দেশের একজন সিনিয়র আইনজীবী, দেশের সিনিয়র নাগরিক হিসেবে তার একটা আলাদা ভাবমর্যাদা গড়ে উঠেছে। এটা তার অর্জন। কেউ তাকে এটা করুণা করে পাইয়ে দেয়নি।

এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে তিনি স্বীয় যোগ্যতায় দুই নেত্রীর মামলা লড়েছেন। একসময়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন, আদালতের বন্ধু বা এমিকাস কিউরি হিসেবেও তিনি একজন সম্মানিত মানুষ। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে তার পেরেশানি ও মধ্যস্থতা করার সাধু উদ্যোগটি দেশের জনগণ শত ভাগ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও আওয়ামী লীগ দেখল ভিন্ন দৃষ্টিতে। এমনটি যে হওয়ার কথা তা রফিক-উল হকের জানার বাইরে থাকার কথা নয়। কারণ এখন নন্দিত যেকোনো উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দেয়াও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল।

কার্যত ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কোনো ‘খায়েশ’ প্রকাশ করেননি। তিনি রাজনৈতিকভাবে তর্কিত প্রসঙ্গের প্রাসঙ্গিকতায় প্রয়োজনে দুই পক্ষের মধ্যে দূতিয়ালি করতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। প্রয়োজনে তার ওপর প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব এলে তাও নিতে অনাপত্তির কথা জানিয়েছেন। এটা ‘খায়েশ’ নয়, এটাকে বলে ভদ্রলোকের সম্মতির ধরন, যাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হানিফ বললেন ‘খায়েশ’। প্রধানমন্ত্রী বললেনÑ ‘মুই কার খালু’।

মনে হলো ভদ্রলোকের পরিশীলিত ভাষা বুঝতে হানিফ সাহেবরা অক্ষম। এটা মনে হওয়ার আরো কারণ হচ্ছে, সরকারি দল যেন আশা করে মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, টকশোর ব্যক্তিত্বগুলো ও কলামিস্টরা সবাই সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক শুধু সরকারেরই সারিন্দা বাজাতে ব্যস্ত থাকবেন, তাদের কোনো কথাই বিরোধী দলের দাবিদাওয়া ও মূল্যায়নের প্রতিধ্বনি হতে পারবে না। দোষটা সংস্কারযোগ্য বিশ্বব্যাংকের, দুর্নীতিবাজদের নয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভদ্রলোকের ভদ্র ভাষার কোনো দাম নেই। ডক্টর ইউনূস সেটা বিলম্বে বুঝেছেন।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে বোঝার জন্যও এত দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এখনো এই সরকারের দ্বৈতাচার ও ভাষা বুঝতে পারছে না। বাকিরা নস্যি। যদ্দূর জানি, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষ। ভয় তাকে ভয় পায়।

তিনি ভয়কে জয় করেন, নিন্দাকে হজম করেন অবলীলায়। সেই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এরপর থেমে যাবেন কি দমে যাবেন, সেটা জানি না। তবে তিনি যদি মানির অপমানকে বজ্রাঘাততুল্য ধরে নিয়ে খামোশ হয়ে যান, তাহলে তার পক্ষে দূতিয়ালি কিংবা মধ্যস্থতা কোনোটিই করা সম্ভব নয়। তিনি যদি মাহবুব-উল আলম হানিফের মতো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যকেই শেষ কথা ভাবেন, প্রধানমন্ত্রীর গল্পকেই আমলে নেন, তাহলেও তার পক্ষে সঙ্কট উত্তরণের জন্য কিছু করার সুযোগ থাকবে না। সাগরে বসতি গড়ে শিশিরে ভয় পাওয়ার মতো লোক হয়তো তিনি নন, তবে এই বয়সে তিনি যদি ঠুনকো মানইজ্জত এবং ঝক্কিঝামেলাকে বড় করে দেখেন সেটা আলাদা কথা।

তাকে মানতে হবে, এক কান কাটা মানুষ রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে, দুই কান কাটা মানুষ রাস্তার মাঝ পথ ধরে হাঁটে। কারণ তার লজ্জা, হায়া বা শরম বলতে অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। তাকে যারা অপবাদ দিয়ে কিংবা তার নিরপেক্ষ অবস্থানের ভাবমর্যাদাকে আহত করে সুখ পাচ্ছেন তারা দুই কান কাটা মানুষের আচরণ করছেন। আমরা মনে করি, বিএনপির অনাপত্তির বিষয়টি যেমন এখনো আমলে নেয়ার বিষয় নয়, তেমনি প্রধানমন্ত্রী ও হানিফ সাহেবের বক্তব্যও ধর্তব্যের মধ্যে আনার কোনো যুক্তি নেই। আমরা নিশ্চিত করে মনে করি, এই দেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন দলনিরপেক্ষ লোকের তত্ত্বাবধায়নেই হতে হবে।

সেটা যে ফর্মুলায়ই হোক, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচন হওয়ার কোনো অবকাশ তিনি নিজেই রাখেননি। সেই বিশ্বাসযোগ্যতা সরকার অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতার পথ ধরে সঙ্কট উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই। তাতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একজন ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করবেন এমনটি জনগণ শুধু আশা করে না, বিশ্বাসও করে। তত দিন রফিক-উল হক শক্তভাবে আজকের নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।

তবে জনগণ আশা করে, তিনি শুধু শক্তভাবে দাঁড়িয়েই থাকবেন না, রাজনৈতিক অচলাবস্থার জট খুলতে দুই নেত্রীর মধ্যে সেতুবন্ধ হয়ে ‘উন্নত মমশির’ থেকে একচুলও নড়বেন না ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।