আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিএনএ টেস্ট এর সাতকাহনঃ (পর্ব -১)

নক্ষএ রাজ্যের দেবী তারার গর্ভে জন্ম নিল এক পুত্র সন্তান। উজ্জ্বল সুন্দর দিব্যকান্তির পুত্রকে দেখে সোম এবং বৃহঃস্পতি উভয়েই নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। পাঠক বুঝতেই পারছেন- ডাল মে কুচ কালা হে, এর ভিতর একটু ঝামেলা আছে। তাহলে খুলেই বলি এ পৌরাণিক কাহিনী। তারা ছিলেন বৃহঃস্পতি স্ত্রী।

অপূর্ব রূপসী তারার উপর বদ নজর পড়ে সোম বা চন্দ্রের। যথারীতি সোম তারাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। শান্তি প্রিয় বৃহঃস্পতির শত অনুরোধ সত্ত্বেও সোম তারাকে ফিরিয়ে দিল না। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ। দেবকূ্ল বৃহঃস্পতির পক্ষে আর অসুররা সোমের পক্ষে।

সে এক ব্যাপক যুদ্ধ। অনেক যুদ্ধের পর ও যখন ফলাফল ড্র, তখন মহামতি বৃহঃস্পতি ব্যাপক ধবংসযজ্ঞের আশংকায় আবার শান্তি প্রচেষ্টার উদ্যোগ নিলেন। তিনি আবার সোমকে অনুরোধ করলেন তারাকে ফিরিয়ে দিতে। এবার সোম রাজি হলেন। তারাকে ফিরিয়ে দিলেন বৃহঃস্পতির কাছে।

তারা ফিরে আসার কিছু দিন পর বৃহঃস্পতি টের পান তারা অন্তঃসত্ত্বা। বৃহঃস্পতি জানতে চান কে এই সন্তানের পিতা? তিনি না সোম? কিন্তু তারা কিছুতেই জবাব দেন না। বৃহঃস্পতি এ নিয়ে মহাটেনশনে পড়ে যান। পুরাণে বর্ণিত এ সমস্যার সে কালে সমাধান হয়েছিল সে দিকে না গিয়ে একবার চিন্তা করুন তো যদি এ ঘটনা এখন ঘটত তাহলে কি হতো? মহামতি বৃহঃস্পতির চাপরাশিই বলে দিত, বস নো টেনশন, ডিএনএ টেস্ট করান, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ডিএনএ টেস্ট কে নানা নামে অবহিত করা হয় যেমন-ডিএনএ প্রোফাইলিং, ডিএনএ টাইপিং, জেনেটিক ফিনগার প্রিন্ট ইত্যাদি ।

একজন মানুষ এর সাথে আর একজন এর মানুষ এর ডিএনএ ৯৯.৯% মিল। বাকি দশমিক এক পারসেন্ট অমিলের জন্য মানুষে মানুষে এত বৈচিত্র , আর পৃথিবীটাও এত লীলাখেলার রঙ্গমঞ্ছ। ডিএনএ টেস্ট প্রথম আবিষ্কার করেন ইংল্যান্ড এর University of Leicester এর Sir Alec Jeffrey ১৯৮৪ সালে। এবং বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করা হয় ১৯৮৭ সাল এ। Sir Alec Jeffrey তার ল্যাব টেকনিশিয়ানের ফ্যামিলির সদস্যদের ডিএনএ, এক্সপেরিমেন্ট ডিএনএ হিসেবে ব্যবহার করে এ গবেষণা সম্পন্ন করেন।

আবিস্কারের প্রথম দুই বছর Jeffrey এবং তাঁর টেকনিশিয়ানই শুধু জেনেটিক ফিনগার প্রিন্ট টেস্ট করতেন। ব্রিটেনে এক অভিবাসন মামলায়, ঘানার অভিবাসী পরিবারের এক বালকের পারিবারিক পরিচয় নির্ণয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় Sir Alec Jeffrey কে। ডিএনএ টেস্ট এর ফলাফলে দেখা যায় যে ওই বালকের ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ডিএনএ প্রোফাইলের মিল আছে, এবং ছেলেটি ব্রিটেন থেকে বিতাড়নের হাত থেকে রক্ষা পায়। এরপর মানুষ লাইন ধরে Jeffrey র কাছে আসতে থাকে ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য। তখন Jeffrey চিন্তা করেন ডিএনএ টেস্ট বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার।

জেনেটিক ফিনগার প্রিন্ট পদ্ধতি আবিস্কারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশ্বখ্যাত Newscientist ম্যাগাজিন Sir Alec Jeffrey কে “ Father of DNA evidence” বলে অভিহিত করে। ডিএনএ টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নমুনা ব্যবহার করা হয় যেমন-চুল, রক্ত, লালা, বীর্য ইত্যাদি । বিভিন্ন ধরনের বাক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস যেমনঃ ট্রুথ ব্রাশ, রেজর ইত্যাদি এমনকি আপনার চর্বিত চুইংগাম থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে সেই টিস্যু ও নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পপ কুইন ব্রিটনি স্পিয়ার্স একবার চুইংগাম খেয়ে ফেলে দেওয়ার পর যে হোটেলে ছিলেন সে হোটেলের কর্মচারী চুপিসারে তা সংগ্রহ করে বিখ্যাত নিলাম কোম্পানি E Bay তে নিলামে তোলে। নিলামকারী এ বলে প্রচারণা চালায় যে এতে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ডিএনএ আছে।

সেই চর্বিত চুইংগামের দাম উঠেছিল কত জানেন? মাত্র ৭৯০ পাউন্ড ! উন্নত দেশগুলতে ডিএনএ টেস্ট করানো অনেক সহজ একটা বিষয়। ওখানকার ডিএনএ টেস্টিং ল্যাবগুলো অন্যান্য পণ্যর বিজ্ঞাপনের মতো ডিএনএ টেস্টের বিজ্ঞাপনও দিয়ে থাকে। এ রকম একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা পড়ে ই দেখুন না... Paternity Testing If you have had more than one partner, it is natural for you to wat to know who the father of your baby is. Different reasons to establish paternity include the need to collect support financially or emotionally, or simply for the peace of mind that accompanies knowing for sure. Questions about Paternity, call 1-800-798-0580 Paternity testing from an accredited laboratory typically costs between $400.00 and $2,000.00, depending on the area in which you live in and the type of paternity testing you choose. The American Pregnancy Association recommends paternity testing from a testing facility that has been accredited by the AABB such as DNA Diagnostics Center. Results are usually available to the patient in 2 business days বাংলাদেশ এ ডিএনএ টেস্ট এখনও এত সহজ লভ্য নয়। ডিএনএ টেস্ট বা ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য দেশের একমাএ প্রতিষ্ঠান National forensic DNA profiling Laboratory প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৬ সালে। ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ ল্যাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

আপনি কোন সমস্যায় পড়ে যদি ডিএনএ টেস্ট করাতে চান তাহলে এ ল্যাবে করাতে পারবেন না কারন এ ল্যাবে শুধু পুলিশ কতৃক রেজিস্ট্রিকৃত অথবা আদালত কতৃক নির্দেশিত মামলার ডিএনএ টেস্ট করানো হয়। প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নমুনার ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে এ ল্যাবে। পিলখানার দুঃখ জনক ঘটনায় নিহত সেনা সদস্যদের লাশ শনাক্তকরণ ও পুলিশের সাবেক ডিআইজি আনিসুর রহমানের সাত সন্তান সংক্রান্ত জটিলতার অবসানের জন্য এদের পিতত্ব নির্ণয়ের পরীক্ষাও এখানে করা হয়েছে। যদিও আলোচিত সাগর-রুনি হত্যা মামলার আলামত ডিএনএ টেস্টের জন্য National forensic DNA profiling Laboratory তে না পাঠিয়ে আমেরিকা পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ সম্পর্ক আমরা সবাই জানি যে ডিএনএ বংশ গতির একক বা বাহক ।

এটি আমাদের জীবন পক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে। ডিএনএ অবস্থান করে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোসোমে। দ্বি সুত্রক বিশিষ্ট এ পেঁচানো নিউক্লিক এসিড অণুটি মাস্টার মলিকিউল নামে পরিচিত। ডিএনএ এর গাঠনিক উপাদান হলোঃ ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার, অজৈব ফসফেট ও অ্যাডেনিন (Adenine), গুয়ানিন ( Guanine), সাইটোসিন ( Cytosine), থায়ামিন (Thymine) নামক নাইট্রোজেন বেস । এ ডিএনএ তে লেখা থাকে আমাদের বিধিলিপি বা ভাগ্য।

মাএ চার অক্ষরে লেখা হয় এ বিধিলিপি বা ভাগ্য। জীববিজ্ঞানীরা A, T, G এবং C এ ই চারটি আদ্যক্ষর দ্বারা বিধিলিপির এ ভাষাকে প্রকাশ করেন। আদ্যক্ষর গুলো নেয়া হয়েছে নাইট্রোজেন বেসগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যখন মানুষ বিধিলিপি বা ভাগ্য জানার জন্য ভাগ্য গণনার জন্য গণকের কাছে না গিয়ে যাবে জীন বিজ্ঞানীদের কাছে! ভাগ্য সংক্রান্ত প্রচলিত কথাগুলিও তখন পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেমন এখন আমরা বলি “ভাগ্যর লিখন যায় না খণ্ডন” , “এ লিখা ছিল আমার কপালে” অথবা “সবই আমার কপালের দোষ” এক সময় হয়তো সবাই বলবে “ডিএনএ এর লিখন যায় না খণ্ডন”, “এ লিখা ছিল আমার ডিএনএ তে” অথবা “সবই আমার ডিএনএ এর দোষ” ।

বিধিলিপির এ ভাষা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে মা বাবার কাছ থেকে পেয়ে থাকি। পিতার শুক্রাণু আর মাতার ডিম্বাণু মিলিত হয়ে যে জাইগোট গঠন করে তাতে একটি পূর্ণ ডিএনএ মলিকিউল থাকে। এ ডিএনএ মলিকিউল বৈশিষ্ট্যর ৫০ ভাগ পায় পিতা থেকে আর বাকী ৫০ ভাগ পায় মাতার ডিএনএ থেকে। এখানেই ডিএনএ টেস্ট এর মাধ্যমে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নির্ণয়ের মূল সূত্র নিহিত থাকে। ..................... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.