আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্যা-বিভ্রাট!!! উৎসর্গঃ ব্লগার আরজু পনি'দিকে

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে জীবন উৎসর্গ আর লেখা উৎসর্গের পার্থক্য কি বল তো, আপু? দাড়াও, দাড়াও। । আপাতত বলার দরকার নাই। প্রথমটা আমি না পারলেও দ্বিতীয়টা পারি। আমার লেখালেখি জীবনের প্রথম গল্পটি তোমাকে উৎসর্গ করা হল।

নিঃস্বার্থ ভালো মানুষেষু, ব্লগার আরজু পনিদি ''তৃতীয় বর্ষে উঠিয়া লও, কিঞ্চিত পরিমান অধ্যয়ন আর অফুরন্ত সময়। সমস্ত বেলা ধরিয়া মজা আর মজা। বহুকাল বহুকাল যাবৎ বিজ্ঞ বড় দাদাদের পবিত্র মুখ-নিস্মৃত বাণী। কিছু দিবস আগেও বিশ্বাস করিতে বড়ই সুখ সুখ লাগিত। প্রথম বৃত্তিমুলক পরীক্ষা সমাপ্ত করিব, আর মজায় আকণ্ঠ ডুবিয়া থাকিব।

পরীক্ষা যথারীতি সাঙ্গ করিলাম। কিন্তু মজা নামক পূর্ণিমার চন্দ্রটি এখনো দৃষ্টি গোচর হইলনা। মেডিসিন নামক ওয়ার্ডের আমাবস্যার নিকষ কালো নিশিতে, তাহা আশা করাও সম্ভবত বৃথা। পুঁথি মধ্যে অধ্যয়ন করিয়াছিলাম, “প্রভাতের রবি দিবসের আগাম সংবাদ বলিয়া দিতে পারে”। কিন্তু রবি সাহেব বোধ হয় আর উদয় হইতে পারিলেন না।

উদয় হইবার পূর্বেই লেকচার রুমে রূমে দৌড়ঝাপ, অস্ত যাইবার পর মধ্যরজণীতে হাসপাতাল ত্যাগ ব্যতিত আসমানের মতিগতি কিছুই ভালো ঠেকিতেছেনা। তাহার উপর “হিস্টরী টেকিং” নামক ভয়ংকর বিষয়টি মস্তকের উপর চাপিয়া বসিয়াছে। প্রত্যেহ দিবস ও রজনীতে ডাক্তার মহাশয়ের একটানা তিনটি ঘন্টা বাকোয়াস সহ্য করা অসম্ভবপর ঠেকিতেছে। কিছুদিন গত হইয়াছে। মেডিসিন বিভাগের আইটেম পরীক্ষা দিচ্ছিলাম।

প্রত্যেক রোগীর পার্শ্বে ১:২ করিয়া একত্রিত হইয়াছি। আমার সহিত আমীর আজম নামক আবালটি রহিয়াছে। কিছুকাল পূর্বেই সে রেজিষ্টার মহোদয় স্যারের মুখ নিঃসৃত অমৃত সুধা পান করিয়াছে। তাহার কোন দোষ আমি খুজিয়া পাই নাই। সমস্ত দোষ তাহার মুখমন্ডলের।

দেখিলেই মনে হয় হাসিতেছে। স্যার শিক্ষাদানকালীন সময়ে তাহা হয়তোবা অবজ্ঞা ভাবিয়া মাইন্ড করিয়াছেন। যাহা হঊক, আসল ঘটনায় আসি। কিঞ্ছিত বিষয় আপনাদের আবগত করা ফরয বোধ করিতেছি। সাদা চামড়ার বিলেতি লেখকের কতিপয় পাঠ্য বইয়ের ধরা-বাধা নিয়ম অনুযায়ী, রোগীকে প্রশ্ন করিয়া খাতায় লিখিতে হইবে।

বিষয়টি বরাবরই আমাকে বেখাপ্পা লাগিত। দেশ হইতে পর্তুগীজ-মগ জলদস্যু বিতাড়িত করিয়াছি। কিন্তু তাহারা যে খাবার মশলার প্রচলন ঘটাইয়া গিয়াছে, তাহার স্বাদ ছাড়িতে পারি নাই। ঠিক তেমনি, বিতাড়িত হইয়াছে বিলেতে সাহেব-মেমরা। কিন্তু অদ্যবধি তাহাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বৃত্তের মধ্য হইতে আমরা বাহির হইতে পারিয়াছি কি? জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন রহিল।

। ইহাতে ছাত্র-ছাত্রীরা কিছুই যোগ বা বিয়োগ করিতে পারিবে না। তাহা করিলে আর, ইহ জীবনে ডাক্তার হইবার আজন্ম লালিত স্বপ্নটি পূরন করার খায়েশ বৃথা। আমাদের ভাগে যে রোগীখানা পড়িয়াছে, তিনি শ্বাস-কষ্টের রোগী। কিতাবী নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের পরিচয় প্রদান করিয়া সদয় অনুমতি গ্রহন করিলাম।

১। চাচা আপনার নাম কি? - আজ্ঞে, আতর আলী। বুঝিলাম, বেডের নিচের লাল গামলায়, হলুদ বর্নের,অ্যামোনিয়ার সুগন্ধযুক্ত তরল পদার্থগুলো তাহার নামের স্বার্থকতা প্রমান করিতেছে। ২। আপনার বয়স কত? রোগী আমার দিকে চাহিয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, - ডাক্তার সাব, আপনের ধড়ে কয়টি মস্তক রহিয়াছে ? - আজ্ঞে একটি।

কিন্তু আপনাকে দেখিয়া তো একবছরের বাচ্চা মনে হইতেছেনা। এইবার আতর আলী দ্বিগুন শক্তিতে চিৎকার করিয়া বলিল, -আপনার এত্তো বড় সাহস, আপনে আমার বয়স জিজ্ঞাসা করিতেছেন। বিপদ আঁচ করিতে পারিতেছি। এই লোকটির নামখানা আতর আলী না হইয়া ইতর আলী হইলেই বোধহয় মানাইত। বুঝিলাম, কপালে দুঃখ রহিয়াছে।

দুইখানা বেড পরেই রেজিষ্টার স্যার লুভরের মোমের মুর্তির মত দাড়াইয়া তামাশা দেখিতেছে আর আকর্ণ বিস্তৃত হাসিমুখে মজা লুটিতেছে। পাশ বোধ হয় আর ইহজীবনে হইলনা। অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তকে পরবর্তী প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হইতে হইবে। এমনিতেই রোগীর শ্বাস-কষ্ট শুরু হইয়াছে। তৃতীয় প্রশ্ন- ৩।

আপনি ছেলে না মেয়ে? রোগী তো পুরো হতবাক। ছানাবড়া চক্ষু বলিতে যাহা বোঝাই আর কি। অক্ষীগোলক কোটর হইতে বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছে। এইখানে বলিয়া রাখা ভালো যে,আমি নেহাৎ-ই গো-বেচারা টাইপের বালক। তাহার উপর জীবনের প্রথম ওয়ার্ড আইটেম পরীক্ষা।

নিশ্চিৎ না হইয়া কিছু লিখিতে বিবেকে বাধিতেছিল আর কি। অনুমান করিয়া লিখিলে ভুল ডায়াগনোসিস হইতে পারে। আমিতো তাহা করিতে পারিনা। গত প্রশ্নে যে শ্বাস-কষ্ট শুরু হইয়াছিল,তাহা বহুগুনে বাড়িয়া গিয়াছে। আর বাড়ানো ঠিক হইবেনা।

আশেপাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার দৃষ্টিগোচর হইতেছেনা। চতুর্থ প্রশ্নের মুখো-মুখি হইতে হইবে। ৪। আপনার পেশা কি? -“লিইখা নেন,টেরাক চালাই। ভাইবেন না লেখা-পড়া জানিনে।

১৯৭৬ এ মেট্রিক দিয়েছিলাম। পাশ করিতে পারি নাই। করিলে এতোদিনে নির্ঘাত আপনের মতো ডাক্তার-মাক্তার হইয়া যাইতাম। রোগীর নাট-ভাল্টুক ভালো কইরা টাইট কইরা দিতাম। এখন চালাই টেরাক,তখন চালাইতাম রোগী”।

রোগীর মুখ নিঃসৃত এমন মধুর বানী শ্রবন করিবার পর আমার শ্বাস-কষ্ট আরম্ভ হইল। রোগীকে ডাক্তার হিসাবে কল্পনা করিতেছি। তাহার একটি হস্তে বি.পি. মেশিনের পরিবর্তে ট্রাকের খোলা স্টিয়ারিং অন্য হস্তে ভ্যাপু। ভ্যাপু বাজাইতেছে আর বেডে বেডে রোগী দেখিতেছে। ডাক্তারকে দেখিয়া রোগীর আত্বীয় স্বজন রাস্তা ছাড়িয়া দিচ্ছে।

ব্যাপারখানা অনুভব করিয়া বড়ই প্রীত বোধ করিতেছিলাম। বঙ্গদেশের সকল ট্রাক চালক ডাক্তার হইইয়া গেলে, রোগীদের সিঙ্গাপুর-মাদ্রাজ যাত্রা ঘুচিবে। যেমন করিয়া কতিপয় সাংবাদিক দাদাবাবুরা ইতিমধ্যে ডাক্তার হইয়া গিয়াছেন, ঠিক তেমনি। ব্যাপারখানা মন্দ না। আমীর আজমের মৃদু হস্তধাক্কায় বাস্তবে ফিরিয়া আসিলাম।

অবশেষে সময় আসিল “পার্সোনাল হিস্টরী” নেওয়ার। যাহারা বাস ট্রাক চালনা করে, তাহাদের বিষয়ে এই প্রশ্নটি না করিলে পাশ করিবার দিবাস্বপ্ন না দেখায় সমিচীন। জিজ্ঞাসা করিলাম, -বিশেষ(!) জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস আছে কি? -বুঝিলাম না ডাক্তার সাব। -আজ্ঞে বলছিলাম কি, খারাপ মেয়েমানুষদের সাথে ইয়ে-- এবার রোগীর যাহা অবস্থা হইল তাহা দর্শন করিবা মাত্র আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হইয়া হইয়া গেলো। রোগী ঘামিতে লাগিলেন ।

তাহার সহিত শ্বাস-কষ্ট বহুগুন বহুগুন বাড়িয়া গেলো। শরিরীক কম্পন শুরু হইইয়াছে। বোধ হয় ইন্নালিল্লাহ হইবে। আমীর আজম হইতোবা বুঝিতে পারিল কি কাণ্ডখানা ঘটিবে । সময়মত আমার হস্তখানা টানিয়া ধরিয়া জোরপুর্বক ওয়ার্ডের বাহির করিয়া আনিল।

অতঃপর উর্ধশ্বাসে দৌড়াইতে লাগিল। আমিও তাহাকে অনুসরণ করিয়া, এপ্রোন উর্ধে তুলিয়া দৌড়াইতে লাগিলাম। পেছন থাকিয়া কর্নে আসিতেছিল, রোগীর আত্মীয়-স্বজনের চিৎকার আর অক্সিজেন সিলিণ্ডার টানিবার শব্দ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।