আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোটর সাইকেল (কৃতজ্ঞতা: হাসান মাহবুব)

যাবে? হঠাৎ এগিয়ে আসা মোটরসাইকেল আরোহীর প্রশ্ন। নীলা ছেলেটিকে ভাল করে খেয়াল করল। এটা তো সেই ছেলে! এটা তো সেই ছেলে যে রোজ সকালে নীলাকে ফলো করে। নীলার পিছু পিছু কলেজ পর্যন্ত যায়। নীলা কলেজ গেটে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে।

এ নিয়মের অন্যথা হয় না কখনো। নীলা একদিন ইচ্ছে করেই কলেজ গেল না। দোতলার সিঁড়ি ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, ছেলেটা সামনের চা স্টলে দাঁড়িয়ে নীলাদের বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। কবে থেকে ছেলেটা তাকে ফলো করছে এটা সে ঠিক করে জানে না। তবে প্রথম যেদিন সে বুঝতে পারে, সেদিন ছিল তাদের কলেজে প্রথম বর্ষের নবীন বরণ অনুষ্ঠান।

নীলা আর তার তিন বান্ধবী শখ করে সেদিন শাড়ি পড়েছিল। নীল রঙের শাড়ি। রূপা আর সালমা এসেছিল নীলাদের বাসায়। বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠতে যাবে, তখনই নীলা টের পেল ভেতর পোশাকের কিছু একটা ঢিলে হয়ে গেছে। ফিতে খুলে গেছে।

শাড়ি পড়ার অনভ্যস্ততার জন্য এমনটা ঘটল। বান্ধবীদের অপক্ষা করতে বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাবে অমন সময় চা স্টলটার দিকে চোখ পড়ল তার। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তার চোখ আটকে গেল একটা লাল রঙের টিশার্ট পড়া ছেলের দিকে। লাল রঙের কারনেই বোধ হয় এতো এতো মানুষ থাকতে তার চোখ ঠিক চলে গেল সেই ছেলেটার দিকে যে কিনা তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সেদিন সে সেই তাকিয়ে থাকাটাকে অতোটা পাত্তা দিলনা।

সুন্দরী মেয়েদের দিকে অমন করে কতো ছেলেই তাকায়! কিন্তু পরের দিন আবার সেই লাল রঙ তার দৃষ্টি কাড়ল। সেই টিশার্টটি চিনে নিতে তার বিন্দু মাত্র ভুল হল না। তারপর থেকে প্রতিদিন। প্রতিদিন ছেলেটির তার পিছু পিছু হাটা। প্রথম দিকে বেশ অস্বস্তি লাগত।

একবার ভেবেছিল ব্যাপারটা মাকে বলে। কিন্তু পরক্ষনেই যখন ভাবল যে মা হয়তো ভয় পেয়ে যাবেন। তাকে হয়তো আর কলেজ যেতে দেবেন না। তখনই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সে। তারপর একসময় ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল।

থাক না ছেলেটা। কোন ক্ষতি তো তার করছে না। দূর থেকে কেবল দেখেই যদি একটা মানুষ আনন্দ পায়, পাক না। কি দরকার সবাইকে বলে কয়ে একটা মানুষের আনন্দ কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা করার। সে নাহয় ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করবে।

কখনো সে পিছু ফিরে দেখবে না কেউ তাকে ফলো করছে কিনা। চল, পৌছে দেই। নীলা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে ছেলেটা আবার প্রশ্ন করল। নীলা এবারও জবাব দিতে পারল না। সে ভেবে উঠতে পারছে না এতোদিনকার সেই লাজুক ছেলেটা দুম করে এতো সাহস কই পেল।

এটা কি ধরনের প্রশ্ন? নীলাকে এভাবে মোটরসাইকেলের পেছনে উঠার প্রস্তাব করবে ছেলেটা এ সে স্বপ্নেও ভাবেনি। অবশ্য মোটর সাইকেলে ছেলেটার পেছনে চড়ার স্বপ্ন সে দেখেছিল কোন এক রাতে। এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। মোটর সাইকেলে চড়া তার অনেক দিনের শখ। সে প্রায়ই ভাবত সে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে আছে, আর সামনে তার বসে আছে রাজপুত্তৃর তার, এমন কল্পনা সে প্রায়ই করেছে।

তাই বলে সেই ছেলেটাকে এভাবে স্বপ্নে দেখবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো। সে ভেবে পেল না ছেলেটাকে সে কেন দেখল স্বপ্নে। তাও আবার এমন একটি দৃশ্যে। তবে কি ছেলেটা ধীরে ধীরে তার মনে জায়গা করে নিচ্ছে? পরদিন কলেজে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করল। বান্ধবীদের সে কি ফুর্তি! তুই নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছিস তার।

রূপার মতামত। না, অসম্ভব। চিনিনা, জানিনা এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়ব আমি? নীলার উত্তর। চিনিস না, আজ চিনে নিবি। সমস্যা কি? সাজেস্ট করল সালমা।

আরে না। খেয়ে দেয়ে কাজ নাই আরকি! অ্যাই! কাল না ইংরেজী টিউটরিয়েল, জানিস তোরা? নীলা ছেলেটার প্রসঙ্গ সেদিন এভাবেই কাটিয়েছিল। না। অবশেষে কোন রকমে ছেলেটার প্রশ্নের জবাব দিল নীলা। নীলা, তোমাকে নিয়ে চড়ব বলে সাইকেলটা কিনেছি।

যেন কতদিনের পরিচয়! নীলার খুব রাগ হচ্ছে। এভাবে একটা মেয়েকে একটা ছেলে কিভাবে প্রথম কথাতেই মোটরবাইকে চড়ার প্রস্তাব করে? এসব তো নাটক সিনেমায় দেখা যায়। আরে বাবা! নাটক সিনেমা আর বাস্তবতা এক হল? বাস্তবে তো এভাবে কেউ প্রেম নিবেদন করে না। প্রেম নিবেদনের তো আরো অনেক উপায় আছে। একটা লাল গোলাপ প্রেমিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা যায়, ভালবাসি।

অথবা, ধরিয়ে দেয়া যায় একটা নীল খাম। যাতে থাকবে নীল রঙের একটা চিঠি। যাতে থাকবে ভালবাসার কথা। অথবা মিষ্টি একটা মোবাইল টেক্সট। নীলা চেয়েছিল তাকে তার ভালবাসার মানুষটা এভাবেই ভালবাসার কথা জানাক।

অথচ রাহুল কি না তাকে মোটর সাইকেলে ঊঠতে বলছে! কি বোকা ছেলেটা। নীলার খুব কান্না পেল। এভাবে নীলার আরো একদিন কান্না পেয়েছিল। কান্না পেয়েছিল যেদিন রূপা এসে তাকে জানাল ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেছে। নাম রাহুল।

নামকরা ব্যবসায়ী রুহুল সাহেবের ছেলে সে। এটা জেনে তখন সালমা বলেছিল, এমন ব্যবসায়ীর ছেলেরা বখাটে হয়। রাহুল বখাটে হতে যাবে কেন? সে তো নীলাকে কখনো কোন বাজে মন্তব্য করেনি। অন্য ছেলেদের মতো নীলার দিকে কখনো শীষ ছুঁড়ে দেয়নি। প্রিয় মানুষদের কেউ খারাপ কোন কথা বললে তার খুব কান্না পায়।

কিন্তু কি আশ্চর্য! রাহুল তার প্রিয় মানুষদের একজন হতে যাবে কোন দু:খে। তার সাথে তো কখনো কোন কথাও হয়নি। একদিন অবশ্য নীলা চেয়েছিল রাহুলের সাথে কথা বলে। রাহুল তখন তার থেকে দশ গজ পেছনে ছিল। নীলা হঠাৎ তার হাটার লয় ধীর করেছিল।

ভেবেছিল দুজনের হাটার লয় সমান না হলে, একসময় রাহুল তার কাছাকাছি চলে আসবে। সেদিন রাহুল তাকে হতাশ করেছিল। রাহুল দূরত্ব কমানোর সে সুযোগটি নেয়নি সেদিন। নীলা বেশ রেগে গিয়েছিল রাহুলের উপর। পছন্দের মানুষের সাথে এতোদিন দূরত্ব বজায় রাখতে হয় না, এটা রাহুলকে কে বুঝাবে? রাহুল আবার বলল, যাবে না? রাহুলের দূরত্ব ভাঙার এমন পদ্ধতি নীলার কাছে একেবারেই শোভন বলে মনে হল না।

তার কান্না পাচ্ছে। রাহুল কেন এমনটা করল? অন্যভাবে সে নীলার কাছে আসতে পারত না? মোটরসাইকেল পরে হতো! যদিও মোটরসাইকেলে চড়া তার অনেকদিনের শখ। না। আমি অচেনা কারো মোটরসাইকেলে ঊঠি না। বলেই নীলা কলেজের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করল।

নীলা ভাবছে রাহুল এখন কি করবে? সে কি চলে যাবে? নাকি মোটর সাইকেল ছেড়ে কথা বলতে বলতে এগুতে থাকবে। দ্বিতীয়টা করলেই ভাল হয়। তার সম্পর্কে জানা যাবে অনেক কিছু। কলেজ যেতে প্রায় আধা ঘন্টা। এই আধা ঘন্টার পুরোটা সময় কথা বলা যাবে।

রূপা, সালমা এরা রাহুলের সাথে নীলাকে কথা বলতে দেখলে কি বলবে? রঙঢঙ করা শুরু করবে। দুইটা যা ফাজিল হয়েছে ইদানিং! রাহুল নীলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল হঠাৎ। খুব স্পিডে। নীলার মন খারাপ হয়ে গেল আবার। রাহুল কি তবে কষ্ট পেল? এখন আবার নীলার খুব মোটরসাইকেলে চড়ার ইচ্ছে হল।

রাহুল কি আবার ফিরে আসবে না এখন? যদি এসে আবার তাকে বলে, কেন জানি না তোমার উপর রাগ করতে পারছি না। তাই আবার আসলাম। চড়ো না একবার! তোমার জন্যই তো সাইকেলটা কেনা! সে তখন বলবে, বুদ্ধু কোথাকার! এভাবে কেউ হুট করে কাউকে বাইকে চড়তে বলে? নাহ! ইচ্ছেরা বুঝি কখনো সত্য হয় না। রাহুল আজ আর আসবে না। এভাবে রূঢ়ভাবে তাকে না করাটা উচিত হয়নি।

কাল আসুক। নীলা নিজে থেকেই তার সাথে কথা বলবে। একবার যখন কথা বলা হয়ে গেছে, তো নীলার নিজে থেকে কথা বলতে আর দ্বিধা নেই। রাস্তার পাশে হঠাৎ একটা জটলা দেখে নীলা এগিয়ে গেল। কি হয়েছে? কোন চোর ধরা পড়েছে? নাকি, কোন হাইজ্যাকার কোন পথচারীর সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

নাকি অন্য কিছু। একটা মেয়ে হয়ে তার এ কৌতুহল ঠিক না। মা কতোবার বলে দিয়েছে, এরকম জটলা দেখলে তার আশোপশে না যাওয়ার জন্য। তবু নীলা পারে না। তার কৌতুহল তাকে জটলার কাছে নিয়ে যায়।

কাছে গিয়ে সে দেখতে পায় পিচ ঢালা কালো রাস্তা রক্তে লাল হয়ে গেছে। আরো দেখতে পায় একটা মোটর সাইকেল। পড়ে আছে। তারপর খুঁজে পায় রক্তের উৎস। রাহুলের নিথর দেহ।

নীলার পৃথিবীটা দুলে উঠে হঠাৎ। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। কাঁদতে পারে না। কান্না গলা পর্যন্ত এসে আটকে যায়। চোখে জমে উঠে পানি।

এভাবে রাস্তায় কান্না করা ঠিক না। তাই সেগুলো সে আটকে রাখতে চায়। তারা তবু তার গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।