আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'বনলতা' কে ছিলে.....

▌││ │▌▌▌▌ ││▌||▌▌||▌▌® 19881712066021718891198 হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ' এতোদিন কোথায় ছিলেন?' পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে--সব নদী--ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। -------------------------------------------------------------- কবিতা হিসেবে কেন গুরুত্বপূর্ণ বনলতা সেন কবিতাটিকে বাংলা কবিতায় একটি নতুন যুগ এনে দেয়া কবিতা বলা হয় কারণ রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কাটিয়ে কল্লোলযুগের পাঁচ কবি যে আধুনিকতার সন্ধান করছিলেন তার যোগ্যতম প্রতিনিধি এই কবিতাখানি। অথচ এই কবিতায় কোন বিদ্রোহ নেই, সদম্ভ উচ্চারণ নেই, নিজের অনন্যতা ঘোষনা করবার কোন সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও নেই।

কবিতাটির বুনোট অত্যন্ত নিবিড়, রোমান্টিকতার মোড়কে কবি পুরো মানবসভ্যতার পরিভ্রমণ আর গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনটি স্তবকের আঠারোটি লাইনের মাধ্যমে। কবিতাটি পাঠে মনোরম, শব্দচয়নে ঐতিহ্যনির্ভর, ভাবে মিলনোন্মুখ। হাজার হাজার বছরের অবিরাম সন্ধান শেষে ‘বনলতা সেন’রূপী নারী অথবা প্রকৃতির কাছে মানবসভ্যতার স্বস্তিময় আত্মসমর্পণই কবিতার মূল সুর হিসেবে বেশিরভাগ পাঠকের কাছে বেজে ওঠে। 'বনলতা' কে ছিলেন বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করা হয়েছে বিদিশা নগরীর আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করা হয়েছে শ্রাবস্তী’ র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। বনলতা’র চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া।

মধ্যযুগের শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক বিদিশা’র অমোঘ আকর্ষণের মতো তার চুলের নেশা, শ্রাবস্তীর হাজারো স্থাপত্য আর লাখো শিল্পীর সযত্ন-মনসিজ মুখচ্ছবির মতো তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, বনলতা’র চোখ তেমনি। কবি নির্মিত এই অপার্থিব নারীর অবয়ব নির্মাণে মাটির পৃথিবীর কোন নারী রসদ জুগিয়েছে তার রহস্য অনেকেই জানতে চান। সত্যিকারের 'বনলতা কে?' তা নিয়ে নানা ধরণের মতবাদ এসেছে। ১।

কেউ কেউ মনে করেন (আমি এই দলের) বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। নামটির দু’টি অংশ বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই একমাত্র শান্তি খুঁজে পেয়েছে কবির মূল বক্তব্য এটিই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি এই নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র।

২। বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার 'পরার্থপরতার অর্থনীতি' বইয়ে বনলতা সেনের 'সেন' উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযোগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ইনার ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট কনভিন্সিং। আকবর আলী খানের মতে 'নাটোর' শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য নয়, বিখ্যাত ছিলো রূপোপজীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে।

'সেন' শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর 'বনলতা' নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গোপন করেছে। ‘দু’দণ্ড শান্তি’ কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রশ্নটি এই হাহাকার প্রকাশ করে যে, কবিতার ‘আমি’ আগে দেখা দিলে, বনলতা রূপাজীবা’র পেশাটি গ্রহণ করতেন না। দুঃসময়ে কেন পাশে ছিলেন না, এই হাহাকার বনলতার বুক জুড়ে। আর এই কবিতায় আরোপিত 'অন্ধকার' বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযোগ নেই। 'অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার' স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতোই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে সাধারণ নারী’।

৩। কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতায়। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি রাখা আছে। সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্‌ হিসেবে Y নামে এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তার নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন Y=শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী।

ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের চাচাতো বোন শোভনার প্রতি কবি দূর্বল ছিলেন। এই শোভনাই হচ্ছেন ওয়াই বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলিতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা।

৪। বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন।

সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।