১৯৭২ সালের ৮ জুন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাপাম বোমার আগুনে জ্বলছে Trang Bang গ্রাম। আগুনে দগ্ধ নয় বছরের নগ্ন বালিকা Kim Phúc (ফুক) ও আতঙ্কিত কিছু শিশু জীবন বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে। উল্লেখিত ছবিটি তুলেছিলেন AP-এর ফটোগ্রাফার Nick Ut. এই ছবিটির জন্য পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।নাপামের আগুনে দগ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্থ কিম ফুকের নগ্ন ছবিটি ভিয়েতনাম যুদ্ধ তথা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে আগুনে ঘৃতাহুতির মত কাজ করেছিলো। আজও বিশ্বব্যাপী আমেরিকান আগ্রাসন চলছে। আর এর বড় স্বীকার হচ্ছে শিশু আর নারীরাই...
মুক্তিযুদ্ধের ছবি যারা তুলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আফতাব আহমেদ প্রমুখ। বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ছিলেন ডন ম্যাককালিন, রেইমন্ড ডিপারডন, মার্ক রিবান্ড, ম্যারি অ্যালেন মার্ক, রঘু রাই, মেরিলিন সিলভারস্টোন, কনটাক্ট প্রেসের ডেভিড বার্নেট, ম্যাগনাম ফটোজ-এর ইরানী ফটোগ্রাফার আব্বাস এবং সে সময়ে ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত বিদেশী ফটোসাংবাদিক।
কিশোর পারেখ (১৯৩০-১৯৮২) একজন ভারতীয় ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের নানা দেশের নামী-দামী পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিক অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদের মধ্যে পারেখ ছিলেন ব্যতিক্রম যিনি কোন অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তাঁর তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন। ভারত সরকার তাঁর ছবি দেখে বইটির ২০ হাজার কপি অর্ডার দেন।৬৭ সালের পর কিশোর পারেখ ফটো জার্নালিজম ছেড়ে দেন। চলে যান সিঙ্গাপুর ও হংকং-এ। যোগ দেন দি এশিয়া ম্যাগাজিন-এ। সেখানে তিনি এক্সক্লুসিভ কিছু ফটো সিরিজ করেন । এরপর তিনি কাজ করেন দি প্যাসিফিক ম্যাগাজিন লিমিটেড-এ। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন পিকচার এডিটর।১৯৮২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে হিমালয় পবর্তে ছবি তোলার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এ অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী।
এখন আপনাদের একটি ঘটনা শোনাবো- বলবেন এই ঘটনাটি কার অথবা ফটোগ্রাফারটির নাম কি (?) ।
অনেকদিন আগে এক মেঘলা দুপুরে এক ক্ষিপ্ত মিসিলের ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ করছিল। শাহবাগে। যাদু ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ফ্রি লান্স ফটোগ্রাফার দৃশ্যটা তুলছিল।একজন পুলিশ হঠাৎ তেড়ে এল তার দিকে। হাটুতে খটাং করে এসে পড়ল লাঠি। ফটোগ্রাফারটি ব্যথায় চিৎকার করে পড়ে গেল, তারপর অন্যপায়ে পুলিশটাকে একটা লাথি কষিয়ে দিল। খুবই সাহসের কাজ। পুলিশয়া পিস্তলে হাত দিয়েছিল।হয়তো মেরে ফেলত। কিন্তু সেই সময়ে মিসিলে মার-খাওয়া কিছু লোক ছিটকে এলো এদিকে ।তাদের বেপরোয়া হতচকিত ধাক্কায় পুলিশটা সরে গেল। ফটোগ্রাফারটি উঠে দাঁড়াল। হাঁটুতে খুব ব্যথা, চোখে পানি এসে পড়েছে, ঠিক সেই সময়ে দু'টি গুলির আওয়াজ। আর্ত চিৎকার।
সে দুপুরে পুলিশ ঠিক তিন রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। তাতে চলন্ত বাসের মধ্যে বসে-থাকা একটি লোক মারা যায়। ফটোগ্রাফারটি তার জল-ভরা চোখেও দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল।অন্য ফটোগ্রাফাররা দেখেছিল একটু দেরীতে। ফটোগ্রাফারটি তার জখম পা নিয়েই কাছ-ঘেষা বাসটায় উঠে পড়ল। তখন হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা নামছে।আর গুলি খাওয়া লোকটা গোঙাচ্ছে, পানি-পানি। তখনও মরেনি তবে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বাসের সীট, মেঝে। চকাচক দু-তিনটে ছবি তুলে নিল সে।আর দেখতে পেল,লেডীজ সীটে সাদা মুখে একটি মেয়ে বসে আছে।এত ভয় পেয়েছে যে, পালাতে অবধি পারেনি।
আরে! পালান ! পালান ! নামুন শিগগির ! বলে ফটগ্রাফার গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিয়েছিল বাস থেকে। বাইরে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া, লোকজন পালাচ্ছে, পুলিশ তেড়ে যাচ্ছে যাকে পাচ্ছে সামনে তার দিকে । দমাস দমাস করে লাঠি পড়ছে। অন্তত তিনজন পুলিশ লাঠি তুলেছিল। সঙ্গে মেয়েটি ছিল বলে বেঁচে গেল ফটোগ্রাফারটি।পুলিশ মেয়ে দেখে মারেনি। তীব্র টিয়ার গ্যাসে প্রায় অন্ধ চোখে ছুটতে ছুটতে তারা কাটাবনের দিকে চলে যেতে পেরেছিল।
কোথায় থাকেন আপনি ?
মেয়েটি কোনো জবাব দিতে পারেনি। শুধু কাঁপছিল। ভয়ে, অবিশ্বাসে।
নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে ঘাসে বসাল ফটোগ্রাফারটি। জিরোতে দিল।দুজনেই চোখ ফুলে ঢোল। দুজনেই হাপাচ্ছে ।
অনেকক্ষন পরে মেয়েটি তার ঠিকানা বলতে পারল।
একা যেতে পারবেন ?
না । ভীষণ ভয় করছে ।
কিন্তু আমাকে যে পত্রিকা অফিসে যেতে হবে। এই ফটো কাল কাগজে বেরোবে।
মেয়েটি কাদছিলো। কিছু বলল না ।
ঠিক সেই সময়ে আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছিল।খুব বৃষ্টি। সাংঘাতিক বৃষ্টি।
আরে, ভিজবেন যে! উঠুন! কোনো বাসার বারান্দায় দাড়াতে হবে ।
মেয়েটি ওঠেনি। বসে রইল মুখ নিচু করে। ক্যামেরা ভিজছিল।
ফটোগ্রাফারটি চলে যেতে পারত। যায়নি শেষ পর্যন্ত। মেয়েটির সঙ্গে সেও ভিজেছিল ক্যামেরা সমেত।
সেই বিকেলে বৃষ্টি আর থামেনি।প্রচন্ড বৃষ্টিতে আন্দোলন থেমে গেল, পুলিশের হামলা বন্ধ হলো, জনসাধারণ পালালো নিরাপদ আশ্রয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই মেয়েটিকে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিল তরুণ ফটোগ্রাফার। খানিকটা রিকশায়, খানিকটা হেঁটে।
তার ফটো পরদিন বেরিয়েছিল কাগজে। নাম সমেত।আরো অনেকেই ফতো তুলেছিল সেদিনের হাঙ্গামার। তবে গুলি-খাওয়া লোকটার অমন নিখুঁত ছবি আর কেউ পায়নি । বেশ নাম হয়েছিল তার। পায়ের যখন সারতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল।
অফিসের ঠিকানায় প্রায় সাত দিন পর চিঠিটা আসে। মেয়েলি হস্তাক্ষর, আমি সেই মেয়েটি, যে সেদিন চোখের সামনে লোকটাকে মরতে দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় আমার হার্টফেল হয়ে যেত, আপনি আমাকে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে না আনলে। আমার বোধ হয় জ্ঞানও ছিল না । কি রকম যে হয়ে গিয়েছিলাম! বৃষ্টিতে ভিজে আমার জ্বর হয়েছিল, জানেন ? তবু এই বৃষ্টিটাও বোধ হয় দরকার ছিল।ভিজে ভিজে মাথা ঠান্ডা হয়েছিল, শরীরে শক্তি ফিরে এসেছিল। আপনার সঙ্গে আর একবার দেখা হতে পারে কি ? আমার যে মুখোমুখি একবার ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার আপনাকে! আর কী অভদ্র আমি! সেদিন তো এক কাপ চাও অফার করা হয়নি আপনাকে ?
ফটোগ্রাফারের সময় হয়েছিল আরও সাত দিন পর । তারপর আর সময়ের অভাব হয়নি।
আলোচিত ব্লগ
=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফিরে দেখা - ১৩ মে
১৩ মে ২০০৬
দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
কাঁচা আম পাড়ার অভিযান
গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমরা কেন এমন হলাম না!
জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন