somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের সেই পথ চলা .....................

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শৈশবের সেই উশকোখুশকো চুলের দুরন্ত বালকটি, যার দুটো ডাগর খয়েরি রঙের চোখে লুকিয়ে থাকতো অনন্ত জিজ্ঞাসা আর অফুরান কৌতুহল কিংবা কৈশোরের মুখচোরা লম্বা লিকলিকে বিপন্ন কিশোরটি, যে কিনা দৃশ্যমান সবকিছু থেকে নিজেকে অদৃশ্য করার সুকঠিন কাজে ব্যস্ত থাকতো, এখন সে আমার কাছে অন্য ভুবনের অচেনা কোনো মানুষ। আয়নাতে জলের ঝাপটা পড়ার পরে যে রকম অপরিচিত দেখায় নিজেকে, ঠিক সেরকমই অপরিচিত এবং ঝাপসা আমার শৈশব এবং কৈশোর। অন্যের কাছে নয়, আমার নিজের কাছেই। এই রোগাপাতলা অচেনা কিশোরটিই একদিন বিপন্ন বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিল অদ্ভুত এক সত্যিকে। ভুল সময়ে, ভুল গ্রহে, ভুল মানুষদের মাঝে তাকে ফেলে দিয়ে গিয়েছে দয়ামায়াহীন চরম নিষ্ঠুর কেউ একজন। জীবনের কোন অভিজ্ঞতা হবার আগেই আচমকা একদিন জেনে গিয়েছিল নিষ্ঠুর বাস্তবকে সে। জীবন বড় কৃপণতা করেছে তার সাথে। বড় অনুদার আচরণ করেছে বিবেকহীন কোনো নির্মম বিমাতার মত। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পায়ে দলে এমনই এক জালে আটকে ফেলা হয়েছে তাকে, যার থেকে কোনো মুক্তি নেই তার কোনোদিন। নেই কোনো নিস্তার এই জনমে আর।

গ্রীক পুরাণের কোনো প্রতিহিংসাপরায়ন দেবীর অযাচিত অভিশাপে অভিশপ্ত জীবন আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে অনিচ্ছুক এবং অবাঞ্ছিত জন্ম পেয়েছি আমি। আশাহীন, স্বপ্নহীন এক জীবনকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই ধরায় পাঠিয়ে দিয়েছে বিধাতা আমাকে। জন্মমুহুর্তে চোখ মেলেই দেখেছি চারিদিকে অন্ধকারের শক্ত কালো দেয়াল। জন্মান্ধ ইঁদুর ছানার মত মাথা কু্টে মরেছি সেখানে অনন্ত যুগ, অফুরন্ত সময়। শুধুমাত্র মুক্তির আশায়, বন্ধনমুক্তির প্রত্যাশায়। মুক্তি চাই, মুক্তি চাই বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি অসহায় আমি। আলোর জন্য কো্নো আকুতি ছিল না আমার তখন, ছিল না কোনো ভালবাসাও। আলো কী সেটাই আসলে জানা ছিল না আমার। তীব্র প্রয়োজন ছিল শুধু অসহ্য আঁধার থেকে বের হয়ে আসার। পৌরাণিক কাহিনির অভিশপ্ত চরিত্রের মত নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত পথে হেঁটেছি আমি হোঁচট খেতে খেতে, টালমাটাল, তালচিহ্নহীন। এলোমেলো পথে সম্পূর্ণ একাকী ছিল সেই অনন্ত যাত্রা। দ্বিধাগ্রস্ত, দ্বন্দ্বমুখর আর দিশাহীন হেঁটে গিয়েছি আমি সূচিভেদ্য ঘন অন্ধকারের মাঝে। এক জীবনের অর্ধেকটাই কেটে গিয়েছে আমার সেই আঁধার রাজ্যের সীমানা পেরোতেই।

এই জন্ম অভিশপ্ততা এবং অনিরাপদ জীবনের কারণেই হয়তো আজন্ম লড়াকু আমি। কোণঠাসা আহত আক্রান্ত শার্দুলের মতই প্রবল আক্রমণাত্মক, ভয়াবহ বিপদজনক। নিজেকে বাঁচাতেই আমার চারপাশে গড়ে উঠেছে কাঠিন্যে মোড়া দুর্ভেদ্য নিরাপত্তামূলক রক্ষাব্যুহ। সামান্যতম আঘাতে, কণামাত্র হুমকিতে, অতি ক্ষীণ কোনো বিপদের ঝুঁকিতেই শ্বাপদশিকারীর মত সতর্ক হয়ে যাই আমি। লেজে পা পড়া গভীর ঘুমে ঘুমন্ত কালকেউটের মত লেজে ভর দিয়ে কবন্ধ সমান উঁচু হয়ে ফোঁস করে ফণা তুলি। ছোবল মারার প্রতীক্ষায়। অর্থহীন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণঘাতী লড়াইয়ে জড়িয়েও পড়ি অহেতুক। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই প্রাণঘাতী লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সাথে আমিও ক্ষতবিক্ষত হই, রক্তাক্ত হই, ক্লান্ত হই, রিক্তসিক্ত হই। তুমুল ক্লান্তিতে ঘুমের অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকি অনিচ্ছায়। একেকটা অর্থহীন লড়াইয়ের পরে শরীরে ক্ষতের দাগ লুকিয়ে, চোরা রক্তস্রোতকে উপেক্ষা করে বিজয়ের উল্লাসে উল্লসিত হই। জয়ের অপার আনন্দে রোমান ম্যাটাডোরের মত দর্শকদের দিকে বিজয়ীর মত হাত নাড়ি আমি। তারপর ভিতরের পরাজিতকে নিয়ে ফিরে যাই আবারো সেই অতল অন্ধকারে, নিজ গুহায়। নিজে নিজে ক্ষতবিক্ষত শরীরে মলম দেই অযত্নে, ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলি দেহ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্তিম রুধিরস্রোত। শরীরের রক্ত-ঘাম মুছে আরেকটি অনাগত এবং অপরিবর্তিত দিনের অপেক্ষায় থাকি আমি। আরেকটি আসন্ন অর্থহীন লড়াইয়ের অনাগ্রহী এবং অনিচ্ছুক প্রস্তুতি নেই।

এক জীবনে দুই বিপ্রতীপ জীবনের ভার বহন করছি আমি। বড় কঠিন এই ভার। সেই বিপুল ভার বহন করতেই সমান্তরাল বিশ্বের মত পাতলা, কিন্তু অস্বচ্ছ এবং অচ্ছেদ্য প্রাচীর দিয়ে আলাদা করে ফেলেছি এদেরকে আমি। নিজেকে রক্ষা করার তীব্র তাগিদে যে স্বেচ্ছা প্রাচীর এবং ব্যুহ তৈরি করেছি আমি আমার চারপাশ ঘিরে, তাকে অবমুক্ত করার সাধ্যি আমার নিজেরও নেই। তাই একদিন যখন গভীর নিশিথে খবর আসে যে, জরাগ্রস্ত জননী আমার আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে ডান উরুর সংযোগস্থলের হাড় ভেঙে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের দিকে চলে গিয়েছেন, তখন আমি আলোহীন আকাশের দিকে মুখ করে পাথরের মত স্থাণু হয়ে বসে থাকি নির্ঘুম সারারাত। ছায়াসঙ্গিনীর প্রবল আকুতিমিনতিতেও সেই পাথর গলে না, ফোন করা হয় না আর। নেওয়া হয় না কোনো খোঁজখবর। কেউ জানে না, এই চরম নিষ্ঠুরতার পিছনে রয়েছে কোন নিষ্ঠুরতার কাহিনি। নিজের গড়া দুর্ভেদ্য স্বেচ্ছাপ্রাচীর ভাঙার শক্তি এবং সাহস কোনোটাই আমার নেই। এক জীবনে বসে অন্য জীবনে ফেরা যায় না। অন্য জীবনের মানুষদের দূর থেকে ভালবাসা হয়তো যায়, কিন্তু কাছে যাওয়া যায় না, ছুঁয়ে দেখা যায় না। পরাবাস্তব যে সেই পূর্বজীবন, সমান্তরাল যে সেই সরে যাওয়া সময়।

সে কারণেই যখন গভীর ভালবাসায় সবুজ একখণ্ড জমিন আর তার অধিবাসীদের পক্ষ নিয়ে আমি তুমুল বিতর্ক করি, ক্ষ্যাপা ষাড়ের মত লড়াই করি তাদের হয়ে, তখন কেউ যখন নিঠুরের মতন প্রশ্ন করে, তবে ছেড়ে এলাম কেন এত সব ভালবাসার জিনিস? আমি আচমকাই থমকে যাই, উত্তরহীন একরাশ নির্বাকতা গ্রাস করে আমাকে। শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে হতাশার তীব্র অনল। বুকের ভিতরে উথলে উঠা একদলা আবেগকে শক্ত হাতে পাথর চাপা দেই। আসলেইতো, কাউকে যে বলতে পারি না, কেন ফেলে এসেছি সবকিছু পিছনে। কেনই বা আর কোনোদিন ফেরা হবে না আমার সবুজ কোমল ওই ভালবাসাময় পরিচিত পলিমাটিতে।

জানি ফেরা হবে না কখনো আর, জানি ওই জীবনকে আর কোনোদিন ছোঁয়া হবে না আমার। তারপরেও কেন যেন মাঝে মাঝেই ঝিলিক দিয়ে উঠে দূর অতীতের শৈশব। মানুষের নাকি বয়স যত বাড়ে ততই সে ফিরে যেতে চায় তার হারানো শৈশব আর কৈশোরের কাছে। যে সময়টার কোন মূল্য এক সময় ছিল না বললেই চলে, সেই সময়টাই অমূল্য হয়ে উঠে তার কাছে তখন। যে স্মৃতিগুলো অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে, সেই স্মৃতিগুলোই অনেক অনেক দামী হয়ে ফিরে আসে শোবার ঘরে। বুড়ো বয়সের একমাত্র সম্বলই যে হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতিমালা। আমারও হয়তো তাই। কিংবা বলা যায়, না পাবার বেদনার কারণেই হয়তো শৈশব কৈশোর নিয়ে আমার হাহাকারটুকুও অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। একটা আনন্দময় শৈশবের জন্য, একটা দুরন্ত কৈশোরের জন্য, একটা স্বপ্নময় তারুণ্যের বিনিময়ে আমি হয়তো এই বিশাল পৃথিবীটাকেও দিয়ে দিতে পারি যে কাউকে। সে কারণেই কি না কে জানে, তিনদশক আগে ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর নিজের অজান্তেই আবারো বাসা বাঁধছে আমার বুকের গহীনে। থেকে থেকে জানান দিচ্ছে আছি আমরা। তুমি ফিরবে না জানি, তাই বলে কী আমরা তোমাকে ফেলে দিতে পারি?

কী করে বোঝাই ওদের। ফেলে আসা শৈশবে যে আর ফেরা হয় না, ইচ্ছে থাকলেও ফেরা যায় না সেই সময়ে। এই সত্য যে আমার জন্য আরো বেশি বেশি সত্য। আমি তো অন্যদের মতন নই। একজন অপূর্ণাঙ্গ এবং অসম্পূর্ণ মানুষ যে আমি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×