তসলিমার সুনীল বোমার খবরটি পড়ে আমার একটি পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম আমাদের কৃতী কবি সাহিত্যিকেরা কতোটা তসলিমা আতংকে ভোগেন।
ঘটনাটি বছর চারেক আগের। আমার অফিসে বসে চা খাচ্ছিলেন সমকালীন বাংলা সাহিত্তের অন্যতম একজন প্রধান কবি। (আমি তার নামটি উল্লেখ করবোনা, শুধু এটুতুকু বলবো যে তিন এই বাংলা ও অপার বাংলার প্রায় সবগুলো সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন)। আমি উনার কাছে তসলিমার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছেয়েছিলাম বলে তিনি Game in Reverse এর এক কপি জোগাড় করে আমার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। আমি তখন ফেমিনিজম নিয়ে গবেষণার কাজ করছিলাম বলে বইটি আমার খুব দরকার ছিল। বইটি উল্টে পাল্টে দেখে আমি খুব মুগ্ধ, চমৎকার মলাট, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত; তাছাড়া অনুবাদও অসাধারন।
বইটি উল্টাতে উল্টাতেই আমি উনাকে বললাম, “ আমাকে তসলিমার ই মেইল নাম্বারটা দিবেন? একটা বিষয়ে তার মতামত চাইবো”।
“খবরদার এই কাজ ভুলেও করবেননা” – তিনি অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে আমাকে বললেন। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। (আমি বয়সে ওনার অর্ধেক হলেও তিনি আমাকে যথেষ্ট সন্মান করেন)। তাই অনেকটা বিনীতভাবেই বললেন। “ভাই, এই কাজটা কখনো করতে যাবেননা। বিপদে পড়বেন। ও (মানে তসলিমা) আপনার নামে এমন সব কথা বার্তা লিখে বসবে, যা হয়তো আপনি কখনো চিন্তাই করেননি।”
আমি বললাম, “বললেই হল।” তারপরই তিনি আমাকে আমাদের কৃতী কবি সাহিত্যিকদের তসলিমা- আতঙ্কের কথা জানিয়ে বলল যে তসলিমা কলকাতায় থাকলে কোন কবি সাহিত্যিক কলকাতা সফর করেননা। কেও কোন জরুরী কাজে গেলেও এমন ভাবে যান যেন কাকপক্ষীও টের না পায়। ভয় একটাই, তসলিমা জানলেই দেখা করতে চাইবে, তারপর পরবর্তী কোন বইতে অদ্ভুত কোন বোমা ফাটাবে।
তারপর তিনি তার নিজের তসলিমাতঙ্কের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলেন, সে বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি অতি সন্মানজনক সাহিত্য পদকের জন্য মনোনীত হন। পুরষ্কারটি নিতে তিনি তখন কলকাতায়। যা ভেবেছিলেন, তাই হল। তসলিমার ফোন – “বাংলাদেশ থেকে যারা আসে সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে, আপনি অন্তত আমাকে একটু হোটেলে দেখে যান”। বেচারা কবি খুব বিপদে পড়ে গেল। না গেলে তসলিমা ক্ষেপে গিয়ে কি লিখবে কে জানে; আবার গেলে বলবে তিনি আমার সাথে হোটেলে ছিলেন। মহা বিপদ। তসলিমাতঙ্কে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন।
একটি বুদ্ধি বের করলেন তিনি। তসলিমার সাথে তিনি হোটেলের reception এর সামনে বসে কথা বলে চলে আসবেন, তাইলে লোকজন সাক্ষী থাকবে; তসলিমা কোন বোমা ফাটাতে পারবেনা। যে ভাবা সে কাজ, তিনি তসলিমাকে জানিয়ে দিলেন I will meet you in front of the hotel reception।
পরের দিন যথাস্থানে গিয়ে বসে আছেন আর ঘামছেন। তসলিমা নেমে এসে খুব আবেগ নিয়ে বলল “ কত দিন দেশের মানুষ দেখিনা, আপনাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ছে”। এই কথাটি শুনার পর কবি সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আর মনে মনে বললেন, যাক যাকে দেখে বাবার কথ মনে পড়েছে তাকে নিয়ে আর যাই হোক অশ্লীল কিছু লিখবেনা। কুশল বিনিময় শেষে কবি দ্রুত বিদায় নিলেন।
এই গল্প শুনার পরে তসলিমাতঙ্কে আক্রান্ত হবার ভয়ে তসলিমাকে আমার আর ই-মেইল করা হয়নি।