somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ দাম্পত্য

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলেই গেল। যাব যাব করেও প্রায় দশটি বছর সে আমার সংসারে থেকে হঠাৎ এক তুচ্ছ উপলক্ষে একদিন এ বাসা ছেড়ে চলে গেল। আমার ঘোলাটে চোখের নিস্পলক দৃষ্টি বুঝি তার মন থেকে মায়াবশিষ্টটুকুও মুছিয়ে দিল। আমর পাথর চোখের অপলক দৃষ্টিই নাকি তার কাছে ছিল সবচেয়ে রিপালসিভ, যাবার বেলায় আমি তাকে সেই ভয়ঙ্কররকম অপছন্দনীয় দৃষ্টিটাই উপহার দিলাম।

কিন্তু এমনটা হবারতো কথা নয়, আমি মানুষটা দেখতে কদাকার অথবা লম্পট কি রগচটা টাইপের নই মোটেও। বরং লোকে জানে যে আমি এসবের পুরো বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অর্থাৎ মোটামুটি সুদর্শন, সৌম্য, সচ্চরিত্র এবং নিরীহ মেজাজের মানুষ। আমাকে যারা ভাল করে চেনে তারা আমাকে পছন্দও করে। নারীরা আমাকে কোন চোখে দেখে তা আমার জানা নেই তবে এ পর্যন্ত কোন নারী আমার বিষয়ে কোন আপত্তি তোলেনি বা জনান্তিকেও বিরক্তি বা বিরাগ কোনটা প্রকাশ করেছে বলে আমার জানা নেই। নারীদের প্রতি আমার আচরণ আপাত দৃষ্টিতে নিরাসক্ত ও কেজো। আমার এই কেজো আচরণটাই বুঝি তনিমাকে দিনে দিনে হতাশ করে তুলেছিল।

তনিমার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল খুব সাদামাটা ভাবে। আমার এক বন্ধুর বরাতে তার সাথে আমার পরিচয়। পরিচয়টা প্রণয়ে না গড়িয়ে সরাসরি পরিণয় দ্বারা পরিণতি পেয়েছিল। আমি খুশী হয়েছিলাম কারণ তনিমাকে আমার প্রথম পরিচয়েই ভাল লেগেছিল। কিন্তু আমাকে তনিমার কেমন লেগেছিল তা আমার জানা হয়নি কারণ এ জাতীয় প্রশ্ন করার ধাত আমার নয়। তনিমাও কখনো নিজ থেকে এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলেনি। শুধু বিয়ের তৃতীয় সন্ধ্যায় আমাদের ভাড়া বাসার একচিলতে ব্যালকনিতে বসে লোডশেডিংয়ের আঁধারে আমার হাতখানা টেনে নিয়ে অনেকক্ষণ তার হাতের মাঝে ধরে রেখে হঠাৎ বলে উঠেছিল, আচ্ছা আমার অতীত জীবন জানতে তোমার ইচ্ছে করেনা ?

আমি বললাম, কেন ? কী আছে তোমার অতীতে যা আমার বিশেষ করে জানা দরকার ?

তনিমা বলল, প্রতিটা মানষের জীবনইতো একেকটা ভিন্ন ভিন্ন গল্প। তোমার গল্প একরকম আমারটা ভিন্ন রকম-- এটাইতো স্বাভাবিক। এই ভিন্নরকম গল্পটা তোমার জানতে ইচ্ছে করে না ?

আমি বললাম, তোমার কাছে ভিন্নরকম মনে হয় কেন জানিনা, আমার কাছেতো একইরকম মনে হয় । মানুষ জন্মে, বড় হয়, বুড়ো হয় তারপর একসময় মরে যায়। কারো কারো অবশ্য অকালমৃত্যু বা অপমৃত্যুও হয়।

তনিমা বলল, শুধু এই?

--তবে কী?

মানুষের জীবন বলতে কি কেবল জন্মানো, বড় হওয়া আর বুড়ো হওয়া ? এই মোটা দাগের ভেতরেই যে মানুষের জীবনে কত বৈচিত্র, কত রং, কত এলোমেলো শুন্যতা-- সেসব কিছু তোমার চোখে পড়েনা ? আমারতো মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষ একেকটা শুন্য ক্যানভাস হতে পৃথিবীতে আসে, জন্মানো মাত্র সে ক্যানভাসে রঙের পোচ পড়তে শুরু করে। দিনে দিনে কারো কারো ক্যানভাসটা হয়ে ওঠে রঙিন, বর্ণিল কারোটা সাদামাটা ফ্যাকাশে রঙের সমাহার। তোমার জীবনের এই ক্যানভাসটা যদি কল্পনার চোখে দেখ তাহলে তা কেমন দেখতে পাও ?
সর্বনাশ! এ আমি কাকে বিয়ে করেছি। বিয়ের আগেতো একে সাদামাটা ঘরোয়া মেয়ে বলেই ভেবেছিলাম। বাসর রাত থেকে শুরু করে গত দু’দিনে তার কথায় বা ব্যবহারে কিছুমাত্র অসাধারণত্ব প্রকাশ পায়নি। আমাদের মত সাধারণ ঘরোয়া জীবনযাপনে বিশ্বাসী মানুষের যেমন বৌ পাওয়া দরকার আমার মনে হচ্ছিল যে এ ঠিক তেমনটি। আজ দুপুরে সে যখন নিজ হাতে রান্না করে সবাইকে অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে গ্রাম থেকে আগত আমার মা-ভাই-বোনদেরকে পরিবেশন করে খাওয়াল তখন একধরনের শান্তি ও তৃপ্তিবোধ আমার মনটাকে আবিষ্ট করেছিল। আমি বিরক্তি চেপে শান্তস্বরে বললাম, মোমবাতিটা মনে হয় এখনি নিভে যাবে, দেখতো আরেকটা পাও কিনা। টেবিলের ড্রয়ারটা আগে দেখ।

তনিমা তখনই উঠে গেল। একটা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম কি পেলাম না তা তখন খেয়াল করা হয়নি।

এরপর সপ্তাহখানেক হবে বোধহয়। ফাল্গুনের প্রায় শেষ। চৈতালী হাওয়া বইতে শুরু করেছে বেশ জোরেশোরে। তবে আমাদের বাসার ভেতরের গুমোট ভাবটা কাটবার মত বাতাস জানালার অপর্যাপ্ততাহেতু ভেতরে ঢুকতে পারছেনা। অসহ্য গরমে তনিমা কেবল একটা পাতলা সুতি নাইটি পরে ঘরময় ঘুরছে অর্থাৎ এলোমেলো টুকিটাকি গুছিয়ে তুলছে। সারাদিন তনিমা বাসায় থাকেনা। একটা এনজিওতে ও সকাল-সন্ধ্যা শ্রম দেয়। চাকরি সে বিয়ের বেশ আগে থেকেই করছে অথচ ওর বয়স এখন মাত্র একুশ। গ্রাজুয়েশনটা শেষ করে মাষ্টার্সের পড়াশুনাটাও ওরই মাঝে চলছে। সারাটা দিন বাইরে খেটেখুটে শ্রান্ত দেহে ঘরে ফিরে তনিমা ঘর গোছায়, রান্না করে, তারপর পড়তে বসে। আমি এ সময়টায় একটু ঘুমিয়ে নেই। কিন্তু সেদিন ঘর গোছাতে গোছাতে হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। তনিমা মোম জ্বালিয়ে হাসফাঁস করতে করতে বলল, এখন ঘরে টেকা যাবেনা, চল বরং ছাদে যাই। ছাদে এসে একটা মাদুর বিছিয়ে হাতের পরে মাথা রেখে তনিমা শুয়ে পড়ল। আমাকে বলল ওর পাশে শুতে। কিন্তু যত নির্জনই হোক ছাদবিহীন, দেয়ালবিহীন স্থানে দাম্প্যতের প্রকাশ ঘটাতে আমার কেমন দ্বিধা হল। তনিমা কালো আকাশে ফুটে থাকা অগুনতি তারাদের পানে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ যেন কত দূর থেকে বলল, মুনিম, তুমি আমাকে পছন্দ করনা ?

প্রশ্নটা আমার কানে খুব অদ্ভুত ঠেকল। তনিমাকে পছন্দ করিনা বলে মনে হতে পারে এমন কোন আচরণের প্রকাশতো আমার দ্বারা আজো ঘটেনি। মাত্র দিনপনের হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। সারাদিন দুজনেই বাইরে ব্যস্ত থাকি। বাসায় ফিরে তনিমা ব্যস্ত তার পড়া নিয়ে আর আমি বিভোর ঘুমে। এর মাঝে এমন কী হল যা থেকে তার মনে হতে পারে যে আমি তাকে পছন্দ করিনা ?

আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, অপছন্দের কী আছে? পছন্দ না হলে কি বিয়ে করতাম?

আমার একখানা হাত টেনে নিয়ে তার গালে ঠেকিয়ে বলল, আমাকে ভালবাস ?

আমার কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করল। এই মেয়ে আসলে কী জানতে চায় ? তাকে প্রথম দেখে আমার ভাল লেগেছিল বলেই না উপযাচক হয়ে তার বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা সরাসরি তার বাবাকে দিয়েছিলাম। এটা সে জানে। তবু যে কেন বারবার এমন প্রশ্ন করে । আসলে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে আমার কেমন জানি অস্বস্তি হয়। এ ধরনের প্রশ্নগুলোকে কেমন ন্যাকান্যাকা ঠেকে আর এর উত্তরগুলোতো হয় আরো ভয়ঙ্কর রকম ন্যাকামীতে ঠাসা।

আমাকে নিশ্চুপ দেখে তনিমা কী ভাবল জানিনা কিন্তু সে হঠাৎ এক অদ্ভুত বায়না জুড়ে দিল। সে নাকি সারারাত ছাদে শুয়ে তারা দেখবে। আমি প্রমাদ গুনলাম। এই ছাদতো আমার একার নয়; বলতে গেলে এই ছাদে আমার কোন অধিকারই নেই। তিনতলা এই বাড়ির তৃতীয়তলার একটা ফ্লাটের আমি ভাড়াটিয়া। ছাদের একটা চাবি বাড়িওয়ালা দিয়ে রেখেছে যাতে কাপড়-চোপড় শুকাতে আমরা ছাদে আসতে পারি। কিন্তু ছাদে রাত্রিবাস করবার মত নির্জনতা তিনি দেবেন অর্থাৎ অন্যকোন ভাড়াটে বা বাড়িওয়ালার পরিবারের কেউ এসময় অনাহুত এসে পড়ে আমাদেরকে বিরক্ত ও বিব্রত করবেনা--এমন নিশ্চয়তাতো তিনি দেননি। দেশে লোডশেডিংয়ের যা অবস্থা তাতে সারারাতও বিদ্যুৎ না আসতে পারে। তবুও এ ছাদে শুয়ে নিশিযাপনের কথা ভাবা যাচ্ছেনা। প্রাচীন দম্পতি হলেও হয়ত কথা ছিল কিন্তু নবদম্পতির সবকিছুতেই অন্য লোকের রসাল কৌতুহল। কে জানে এভাবে এখনই যদি কেউ এসে দেখেতো ভাববে যে আমাদের নবপ্রেমলীলা আমারা অন্দর ছাপিয়ে বাইরেও চর্চা করতে শুরু করেছি। অপর্যাপ্ত জানালা সমন্বিত দু’কামরার ছোট্ট ফ্লাটে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতার কথাটা হয়ত তাদের মনেই আসবেনা।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। এরপর আর এখানে এভাবে থাকাটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তনিমাকে বললাম, ঘরে চল। তনিমা আর কথা না বাড়িয়ে মোবাইল ফোনের আলোয় সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্ধকার ঘরে ঢুকে অনিচ্ছুক হাতে একটা মোমবাতি জ্বালাল।

আরো কিছুদিন পর। বৈশাখের রুদ্রতান্ডব শুরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই ঘূর্ণি হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বর্ষণ মিশিয়ে কালবৈশাখী তার তাণ্ডবনৃত্য করতে করতে ধেয়ে চলে। তবে সারাদিন কাজকর্মের ঘোরে থাকায় প্রকৃতির মাতলামো দেখার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনটাই আমার হয়না, কিন্তু তনিমাকে প্রকৃতির রুদ্ররোষের মোকাবেলা করেই চাকরিটা করতে হয়। একটা এনজিও-র ও মাঠকর্মী মাত্র।

সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তনিমা ব্যস্ত ছিল ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করার কাজে। ওর আবার খানিকটা পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে, এ ক’দিনেই আমি তা বুঝেছি। মাঝে মাঝে এসব কাজে আমাকেও হাত লাগাতে বলে কিন্তু ওসব আমাকে দিয়ে হয়না। সারাসপ্তাহ খাটনীর শেষে ছুটির দিনে আমি একটু ঘুমাতে চাই; তাছাড়া ঘরোয়া কাজে আমি কোন কালেই অভ্যস্ত ছিলাম না। পুরুষ হয়ে জন্মে নারীর কাজে হাত পাকাবার দরকার আমি কোনকালেই বোধ করিনি। অথচ তনিমা প্রায়ই আমাকে এটা সেটা কাজে হাত লাগাবার অনুরোধ করে। মেয়েটার কথা ও ব্যবহারে আমি মাঝে মাঝেই কেমন নারীবাদী গন্ধ পাই। ভাবছি একদিন কষে একটা ধমক লাগাব। শুরু থেকে রাশ না ধরে কেবল লাই দিয়ে চললে ভবিষ্যতে ভুগতে হতে পারে। যাহোক, তনিমা আমার ভিজিয়ে রাখা শার্ট-প্যান্ট গুলো আমাকেই কেচে নিতে অনুরোধ করলে মেজাজটা সত্যিই বেশ খারাপ হয়ে গেল। তবু আমি চুপচাপ টিভিপ্রোগ্রাম দেখার ভান করে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিলাম।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম, কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল তনিমার ডাকাডাকিতে। চরম বিরক্তির সাথে চোখ মেলে দেখি আমার মুখের পরে দারুণ উল্লাসময় আনন্দে ডগমগ করতে থাকা একটা মুখ খলখলিয়ে কী সব বলে চলছে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লাগল। বুঝতে পেরে আমার গাটা বুঝি আক্ষরিক অর্থেই জ্বলে গেল। বাইরে তখন কালবোশেখীর প্রবল তাণ্ডব। জানালার শার্সিগুলো পর্যন্ত শব্দ করে কাঁপছে। নিকষ কালো আঁধার দিনটাকে পর্যন্ত রাতে পরিণত করে ফেলেছে। আমাদের ছোট্ট বাসার এক চিলতে ব্যালকনিপথে নাকি বাতাসের প্রবল ঝাপটার সাথে বৃষ্টি এমনকি শিলার টুকরোও ছুটে এসে পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে সেই শিল কুড়োতে নাকি দারুণ মজা। তনিমা চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বলছে আর বিছানা ছেড়ে ওঠার জন্য টানা টানি করছে। অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটা কঠিন ধমক বেরিয়ে এল। তনিমার উৎফুল্ল জ্বলজ্বলে মুখটা এক ফুৎকারে নিভে যাওয়া প্রদীপের পরিণতি পেল কি ? চেয়ে দেখা হয়নি। কাঁথাটা আপদ-মস্তক মুড়ি দিয়ে আমি ফের ঘুমোবার উদ্যোগ করলাম।

তনিমাকে কি আমি কখনো শারিরীক আঘাত করেছিলাম ? হ্যা... তা হবে দু’য়েক দিন। প্রথম দিনের কথাটা বেশ মনে আছে । আমাদের দাম্পত্যের প্রথম বছর। সেদিন ছিল তনিমার জন্মদিন। আমরা চাইনীজে গেলাম, খেলাম। রেষ্টুরেন্টের বিলটা অবশ্য তনিমাই দিয়েছিল। আমার তখন সংসার খরচের বাইরে দু'টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য ছিলনা । অথচ আমার নবোঢ়া চাইছিল তার জন্মদিনে দু’চারজন কাছের মানুষ নিয়ে একটা ভাল রেষ্টুরেন্টে খেতে। কাছের মানুষ বলতে অবশ্য তার মা-বাবা, বোন-বোনাই আর কে এক ভাইয়া যার বপু দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলত। তনিমার এই ভাইয়া-টাইয়া জুটত বেশ।এরা সারাজীবন আমার চক্ষুশূল হওয়া সত্ত্বেও এদের অস্তিত্ব আমায় সইতে হয়েছে-- ভদ্রলোক হওয়ার এই এক জ্বালা। ঐ ভাইয়া প্রসঙ্গেই সেদিন তনিমার সাথে আমার লাগতে পারত কিন্ত লেগে গেল তার বোনাইকে নিয়ে। সে ঘটনাটা আজ আর বলছিনা। বরং তনিমার সাথে আমার যৌথদিনযাপনের চূড়ান্ত দিনটার কথাই বলা যাক। সেদিন সকালে ব্যাপারটার সূচনা ঘটেছিল এভাবেঃ

বাবুইকে নিয়ে বাবুইয়ের আয়া ব্যালকনিতে খেলছিল। তনিমা ব্যস্ত ছিল বাবুইয়ের সারাদিনের খাবার নিজ হাতে তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রাখার কাজে। এই এক কাজ জুটিয়েছে তনিমা; কোথা থেকে বাবুইটাকে যোগাড় করে এনে তাকে নিয়েই মেতে আছে ইদানীং। চাকরীতে থিতু হবার পর থেকে তার মনে মা হবার প্রবল সাধ জেগে ওঠে। ডাক্তারী ও কবিরাজি বটিকা যখন ফেল করল তখন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ বিখ্যাত সব বাবাদের ঝাড়-ফুঁক, পানিপড়ার দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দিতে শুরু করলে তনিমা একদিন একটা ন্যাকড়ার পুটুলিকে নিপুন সতর্কতায় বুকের কাছটিতে দু’হাতে আলগোছে চেপে ধরে নিয়ে ঘরে ফিরল। সেই পুটুলি থেকে যে জীবন্ত অস্তিত্ব দূর্বল-ক্ষীণ স্বরের ক্রন্দনে আমাকে চমকিত করল সে যে তার দুটি দুর্বল বাহু দ্বারা তনিমাকেও চিরতরে আমার কাছ থেকে ঐ মুহূর্ত থেকে ছিনিয়ে নিল তা কি আর আমি তখন বুঝেছিলাম ? আমি কেমন বিস্ময়াভিভূত হয়ে তনিমার দুঃসাহস নিয়ে মনে মনে আলোচনা করছিলাম-- কত বড় বুকের পাটাঅলা মেয়ে মানুষ! একটা উটকো আপদ জোটাবার আগে স্বামীর মতামতের তোয়াক্কাটাও করেনা!

দিনে দিনে এই শিশুর জন্য রঙ-বেরঙের জামা-জুতা-খেলনা এল, এলো ন্যাপকিন-ডায়াপার-ফিডার এবং দামী দামী গুড়ো দুধের টিন। মশারী থেকে শুরু করে ভরাট বুননের পলিশ করা বেতের দোলনা, আড়ঙের নকশীকাঁথা এমনকি একজন নকশাদার শাড়ি পরা ফিটফাট আয়াও দেখি জুটে গেল। একটি দু’সপ্তাহ বয়সী শিশুর আগমনে মাত্র ক’দিনেই বদলে গেল আমার ঘরের চালচিত্র।

যে শিশু তার জন্মের পরমূহুর্তে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়ে টোকাইদের খোঁজারু হাতে আবিস্কৃত, সদাশয় পুলিশ দ্বারা উদ্ধৃত ও সমাজসেবা অধিদপ্তরে তের দিন পালিত হবার পর আমার ঘরে এল তার এখন সামান্য গরমে অস্বস্তি হয়, একটুখানি ঠান্ডায় বুকে কফ বসায়, ডিমপোচের বাটি উল্টে ফেলে এবং বিদেশী ব্রান্ডের দুধের বদলে দেশী গরুর দুধ পেটে পড়লে তার এলার্জী হয়। ছেলেটা যত বড় হতে লাগল তার প্রতি বিরাগও আমার তত বাড়তে থাকল। আমাদের কোন সন্তান হবেনা এটা ধরে নিয়েই তনিমা অপরিসীম স্নেহ ও অপরিমিত অর্থব্যয়ে দিনে দিনে তার আর আমার মাঝে এই গগনচুম্বী দেয়ালটা গড়ে তুলছে এই ভাবনাটাই ছিল শিশুটির প্রতি আমার সদয় হবার পথে প্রধান অন্তরায়।

পড়াশুনার অজুহাতে আগে থেকেই তনিমা প্রায়ই আলাদা ঘরে ঘুমোত। বাবুই আসার পরে সে ঘরে আমার প্রবেশটাও বুঝি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। দিনে দিনে আমি তনিমার কাছে হয়ে উঠলাম স্রেফ একজন আগন্তুক।

অফিস করি, ঘরে ফিরি, ছুটির দিনে বাজার করি , খাইদাই, টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা হিন্দি মুভি দেখি। এর বাইরে বলতে গেলে আমার আর কোন জীবন নেই। তনিমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবার অভ্যাস আমার কোন কালে ছিলনা আর এখনতো আমাকে তনিমার কোন কাজেই লাগেনা। বাবুই আর আয়াকে নিয়ে তনিমা ছুটির দিনে খুব বেড়ায় ; আমাকে জিজ্ঞেস করার দরকারটাও বোধ করেনা।

যাহোক, যে প্রসঙ্গে বলছিলাম। তনিমা যখন বাবুইয়ের খিচুড়ি-ফিরনি, চিকেন স্যুপ প্রভৃতি বিশেষ যত্নে বেড়ে ঢাকনা লাগিয়ে টেবিলে গুছিয়ে রেখে তার পাশে ফলের ঝুড়িটাও সাজিয়ে রাখছিল তখনই আমি টেবিলে এসে নাশতার অপেক্ষায় বসলাম। সকালবেলা এসময়টাতে রান্নাঘরসমেত এস্থানটাতে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। আমি সকালের নাশতায় হাতেগড়া রুটি পছন্দ করি, তনিমা খায় টোস্ট আর সালাদ। দুপুরের জন্য আমার লাঞ্চ বক্সে সাজান হয় ভাত-ডাল-ভাজি-মাছের ঝোল জাতীয় খাবার । তনিমা তার ছোট্ট টিফিন বক্সে ভরে নেয় দুইটা রুটি, দু’টুকরো পেঁপে কিংবা এমনই কিছু। বাবুইয়ের আয়া আবার ভরপেট খেতে পছন্দ করে। মাছ-ভাত তার পছন্দের খাবার। সে ব্যবস্থাটাও তনিমাকে সকালেই করে রেখে যেতে হয়। বাবুইয়ের আয়া সারাদিন বাবুইকে নিয়েই থাকবে অন্য কোন কাজে হাত দেবেনা, তাই তনিমার এ সতর্ক ব্যস্ততা।

আমি টেবিলে বসতেই তনিমা বলে উঠল, তোমাকে আজ একটু কষ্ট করে টোষ্টই খেতে হবে। বাবুইয়ের শরীরটা আজ একটু গরম মনে হচ্ছে। রাতে বেশ জ্বালিয়েছে; সকালে রুটি করার সময় পেলামনা।

আমি খানিকটা বিরক্তির সাথে বললাম, রাতে ওর জ্বালানোর সাথে সকালে রুটির কী সম্পর্ক ?

তনিমার মুড খুব দ্রুত পরিবর্তনযোগ্য বিমূর্ত বস্তুবিশেষ। ওর আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা খুবই কম। সামান্যতেই আহত হয়, কষ্ট পায় এমনকি চটেও যায়। ইদানীং আবার ঝগড়া-ঝাটি না করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে হিসহিসিয়ে কথা বলার কৌশল রপ্ত করেছে। ওর এই শীতল কন্ঠই আমার পিত্তিকে পলকে জ্বালিয়ে তোলবার পক্ষে যথেষ্ঠ। তাই জবাবে ও যখন বলল যে প্রশ্নটা আমার মত বিবেকবর্জিত লোকের পক্ষেই উপযুক্ত বটে তখন বাস্তবিকই আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল।

অভূক্ত আমি টেবিল ছেড়ে ওঠার সময় সমুখের প্লেটটা সজোরে ঠেলে দিয়ে একটা কটুক্তিও করে ফেললাম। প্লেটটা একটু জোরেই ঠেলা হয়ে গিয়েছিল; সেটা তনিমার পায়ের কাছে সজোরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কটুক্তিটাও হয়ত একটু মাত্রাছাড়া অশ্রাব্য হয়ে গিয়েছিল।

এরপরই বিস্ফোরনটা ঘটল। তনিমা বরফশীতল অথচ হিংস্র কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, একটা আপাত নিরীহ রোবটের সাথে আমি আমার জীবনের সবচে মূল্যবান দশটা বছর কাটিয়েছি। সেই রোবট যখন মাঝে মাঝে অমানুষ হয়ে তার নিরীহ আবরণটা সরিয়ে ফেলত তখন আমি সয়ে গেছি কিন্ত এখন আমি আর সইতে রাজি নই। এ বাসা ছেড়ে আজই আমি চলে যাব।

আমি কোন মন্তব্য না করে লাঞ্চবক্সসমেত সাইডব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আমার অজান্তেই আমার ঠোঁটটা কিঞ্চিত বেঁকে গেল, হুঁ, অমন হুমকি এই নিয়ে কতবারইযে শুনলাম! যাবে কোন চুলোয় ? চাকরি করে বলে মাঝে মাঝে পান থেকে চুন খসলেই একেকটা কঠিন ডায়লগ দিয়ে বসে। কিন্তু যে ভেতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তাতে..........ইত্যাদি।

আমার শ্বশুর সাহেব ছিলেন সরকারি অফিসের কেরানী । সরকারি অফিসে কেরানী নেহাত ফ্যালনা জিনিস নয়। এমন বহু দপ্তর আছে যেখানে নাকি কেরানী সাহেবরা কর্মকর্তাদের চেয়েও ঢের প্রতাপশালী ও বিত্তবান। আমার শ্বশুর যে দপ্তরে ছিলেন সেখানে অত রমরমা ব্যবস্থার সুযোগ ছিলনা। হরিপদ কেরানীর চেয়ে তার অবস্থা তুলনামূলক হয়ত ভাল ছিল কারণ তিনি সময়মত পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের উপদেশ মেনে চলে ছিলেন। এই একটা বিষয় ছাড়া আর কোন বিষয়েই মানুষটার মাঝে আধুনিকতা কিছুমাত্র ছাপ ফেলতে পারেনি। সেই মানুষের মেয়ে হয়ে তনিমা যে মেজাজে চলে তাকে ফুটানি বললে অত্যুক্তি হয়না বলেই আমার বিশ্বাস।

আমি নিজে অবশ্য কৃষক পরিবার থেকে উদ্ভূত-- তাও আবার ভূমিহীন কৃষক। তবে সেজন্য হীনম্মন্যতায় ভুগবার কারণ আমি দেখিনা। বর্তমান যুগে পুরুষের গৌরব তার বংশ নয়; সে স্বয়ং। নইলে আমার এক বন্ধুর বাপ গরুর দালালীর অর্থে ছেলে পড়িয়ে একজন এ্যডিশনাল সেক্রেটারীকে বেয়াই হিসেবে পেল কী করে?

যাহোক, বলছিলাম আমাদের ছাড়াছাড়ির বিষয়ে। কিন্তু এ বিষয়ে আর বলবার কীইবা বাকি আছে ? এ বিষয়ে আর আলোচনা করা মূল ঘটনাকে ফেনিয়ে পরিবেশন ছাড়া আর কিছু নয়। তাই এই সেদিনের কথাটুকু বলে আমার এই সাতকাহন শেষ করব।

দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছি বছর তিনেক হল। তনিমাকে অতসহজে মুক্তি দেবার ইচ্ছে আমার ছিলনা কিন্ত আমার যে করারও কিছু ছিলনা। এদেশের যাবতীয় আইন যে এখন নারীর পক্ষে। আমাদের মত নিপীড়িত পুরুষদের এখন ’পুরুষ রক্ষা সমিতি’ গঠন করা ছাড়া আর বাঁচবার উপায় দেখিনা।

তনিমা চলে যাবার পর এই চার বছর তিনমাস ষোলদিনে একবারো তাকে দেখতে পাইনি। অথচ শুনতে পাই সে এই শহরেই আছে। আসলে গত চার বছরের অধিক এ সময়টাতে আমি অফিস, বাসা এবং কাঁচাবাজার ছাড়া কখনো কোথাও যাইনি। যেতে যে একে বারেই মন চায়নি, তাও নয়। কিন্তু কোথায় যাব? অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমি যে পরাজিত-পরাভূত এক মল্ল মাত্র।

তনিমার সাথে আমার সেপারেশনটা লিগালাইজড হবার আগেই বাজারে তাকে কেন্দ্র করে নানা রোমাঞ্চকর গুজব অহর্নিশ আমার কানকে পীড়িত ও হৃদয়কে ঈর্ষাকাতর এমনকি হিংসাজর্জর করে তুলেছিল। আইনমতে ডিভোর্স কার্যকর হবার পরপরই গুজব বাস্তব হয়ে দাঁড়াল অর্থাৎ জনৈক পদস্থ সরকারী কর্মকর্তার সাথে তনিমার বিয়ে হয়ে গেল। খুব ভাল হত যদি তনিমা ও তার স্বামী এ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেত কিংবা আমিই বদলী হয়ে অন্য কোথাও যেতে পারতাম। কিন্তু আমার যা চাকরি তাতে ঘুরে ফিরে আমাকে এই শহর বা শহরতলীতেই থাকতে হবে। আর তনিমাতো স্বামীর খুঁটির জোরে এ শহরটার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটাই বুঝি বাগিয়ে বসল । আমার তাই ঐ দাগকাটা গন্ডির বাইরে পা বাড়াতেই আতঙ্ক। পাছে দেখা হয় ! সইতে পারব কি?

কিন্তু এত সতর্কতার পরেও গতকাল বিকেলে হঠাৎ তনিমার মুখোমুখি পড়েই গেলাম। স্ত্রীর জোরতাগাদায় পড়ে মীনা বাজারে গিয়েছিলাম কিছু সাংসারিক কেনাকাটা করতে। এসব জিনিস সাধারণ মুদি দোকানেই পাওয়া যায় কিন্তু আমার এই স্ত্রীকেও ইদানীং মীনাবাজারপ্রীতিতে ধরেছে। মহুয়া গ্রামের মেয়ে কিন্ত এই শপিংমলগুলো তাকে এতটাই বিমোহিত করেছে যে সাধারণ মুদি দোকানের সওদাকে সে রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করেছে। শপিংমলের চাকচিক্য, থরেথরে সাজিয়ে রাখা সুদৃশ্য সওদার সমাহার, ট্রলি নিয়ে ঘুরে ঘুরে যেমন খুশী পন্যটি বেছে নেয়ার সুযোগ তার স্বামীর পকেটের স্বাস্থ্যচিন্তাটাও দিব্যি ভুলিয়ে রাখে । ঠিক একই রোগ তনিমারও ছিল। কেবল পার্থক্য এইযে, তখন আমার ওয়ালেটের পাশে হাত বাড়ালেই তনিমার পার্সটাও পাওয়া যেত কিন্তু এখন আমার হস্তকে বিলম্বিত করলে শ্বশুরবাড়ির ঘুনজীর্ণ দরজায় ঠোকর খাওয়া ছাড়া আর কোন প্রাপ্তি ঘটেনা। সবই কপাল ! নইলে দোস্ত ছদরুল কত অনায়াসে পেল অ্যাডিশনাল সেক্রেটারী শ্বশুর আর আমি......হাহ্!

যাক যেটা বলছিলাম। তনিমাকে দেখতে পেলাম মীনাবাজরের ফুড এন্ড বেভারেজ কর্ণারে। ম্যাগী নুডলসের প্যাকেট তুলতে গিয়ে একটা নিতান্ত কচি হাতে হাত ঠেকে গেলে আমি অনিচ্ছাকৃতভাবেই একপলক তাকালাম একমাথা কোঁকড়া চুলে ঘেরা ছোট্ট মুখটার পানে। কিন্তু ঐ একপলক দৃষ্টিই হঠাৎ অপলক হয়ে আটকে গেল সেই মুখটায়। একে! এক কাকে দেখছি! খুব চেনা চেনা লাগছে যে!

‘খুব চেনা চেনা’ শিশুর পাশে এক স্মার্টদর্শন ভদ্রলোক। শিশুটির প্রতি আমার অপলক দৃষ্টি আমার প্রতি ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে প্রেরণা যোগাল। একটা সৌজন্যময় স্মিত হাসি আমাকে উপহার দিয়ে তিনি বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো একটু নেড়ে দিয়ে বললেন, ম্যাগী নেবে বাবুই? তোমার আম্মুর কাছে শোন নেওয়া লাগবে কিনা। তারপর নিজেই ডাকলেন, এই তনু, দেখতো বাবুই কী কী নিতে চায়।

তখনই আমি তনিমাকে দেখতে পেলাম। একটা জুনিয়র হরলিক্সের কৌটায় ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত হাতখানি রেখে সে এদিকে একটু চমকিত চোখে তাকালে তৎক্ষণাৎ আমার হৃদস্পন্দন বুঝি বন্ধই হয়ে গেল। প্রানপণ চেষ্টায় নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে প্রায় অকেজো হৃদপিণ্ড নিয়েই বাসায় ফিরলাম। গিন্নীর লিস্টের প্রায় কিছুই আমি কিনতে পারিনি। তবু মহুয়া রাগ না করে বরং উদ্বিগ্নস্বরে বলল, তোমার কী হইছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

সারাটা সন্ধ্যা কেটে গেল এক অবর্ণণীয় অনুভূতির মাঝ দিয়ে। তনিমাকে প্রথম দেখার ক্ষণ, প্রথম দৃষ্টি বিনিময়, প্রথম স্পর্শ, প্রথম চুম্বন এমনকি প্রথম সঙ্গমের অনুভূতিও কোনকালে আমার হৃদয়ে বিশেষ কিছু বলে অনুভূত বা বিবেচিত হয়নি। অথচ আজ তনিমার ঐ গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকান, শর্টস্লিভ কামিজের মধ্য হতে উত্থিত প্রায়নগ্ন বাহু, মনিবন্ধ আলো করে বেড়িয়ে থাকা কয়েকটা সোনার চুড়ি, অনামিকায় জ্বলতে থাকা রুবি বসানো রিং-- কিছুই ভুলতে পারছিনা। এমনকি ভুলতে পারছিনা তনিমার পাশে ট্রলিতে বসে থাকা ছোট্ট টুলটুলে মায়াবী মুখের পরে বিস্ময়ের কাজলমাখা একজোড়া বড়বড় চোখ এবং পৃথিবীর সমস্ত পবিত্রতায় মাখামাখি সেই অবোধ শিশুমুখের হাসি।

রাত ঘনিয়ে এলে মহুয়া এল বিছানায় । তনিমার সুতন্বী দেহ এবং পেলব তনু যেমন কোনদিন আমাকে আবিষ্ট করতে পারেনি মহুয়ার মদও আমার ক্ষেত্রে প্রায় অনুরূপ । তবুও প্রথম স্ত্রী আমাকে পরিত্যাগ করে গেলে বহু উপযাচকের উপদেশ হতে আমি এটুকু বুঝেছিলাম যে বৌকে নিয়ে আদর-সোহাগের ভান করে হলেও খানিকটা নাড়াঘাঁটা করাটা স্বামীর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এমনকি কোন কোন গুরু থেকে আমি এ জ্ঞানও লাভ করলাম যে ‘ভাত দেবার ভাতার’ না পেলেও আজকের দিনে কোন কোন নারীর দিব্যি চলে যায় কিন্ত কিল মারবার গোঁসাইকে যেমন আজ তারা কিছুমাত্র বরদাশ্ত করেনা তেমনি কোনকালেই কোন নারী সহ্য করতে পারেনা জিতেন্দ্রীয় সাধু স্বামীপ্রবরকে। নিজেকে নুপুংশুক বলে আমি কোনকালেই স্বীকার করিনা। তনিমা তাই আমায় টিট্কারী দিত সাধু বলে। মহুয়ার কাছে আমি সাধু নয়, বরং প্রবল পুরুষ হতেই চেয়েছি। বিস্তর এফসিপিএসের প্রেসক্রিপশন ও কবিরাজের হাতযশ গুলে খেয়েও আমি মামুলি পুরুষের প্রমান দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। নিজের অক্ষমতাকে মেজাজ ও অজুহাতের বর্মে ঢেকে না রেখে আজ মহুয়ার পা দুটো ধরে ক্ষমা চাইলাম আর বিধাতার প্রতি অগুনতি নালিশভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বিছানায় চুপচাপ দেয়াল ঘেঁষে পড়ে রইলাম।

আমার অভিমানক্ষুব্ধ হৃদয় একসময় শান্ত হয়ে এলে তনিমার সাথে আমার যাপিত জীবনাংশের সুন্দর কোন স্মৃতি মনে মনে হাতড়ে ফিরতে লাগলাম। নাহ্, তেমন কোন দৃশ্য স্মৃতিপটে ভেসে উঠলনা যা ভেবে আজ একটু মদ্যপানের মত তীক্ষè জ্বালাময় আনন্দ পেতে পারি। নিজেকে বড্ড দুর্ভাগা, রিক্ত ও সত্যিকারের অপদার্থ মনে হতে লাগল। প্রায় দশবছর সংসার করেও একটা সুন্দর ক্ষণ, আবেগময় মুহূর্ত, রোমাঞ্চকর অনুভুতি যার স্মৃতিভাণ্ডারে জমা পড়েনা জীবনের জমা-খরচের খাতায় তার কী সঞ্চয় থাকতে পারে?

হঠাৎ আমার মনে পড়ল বাবুইয়ের পাশে শুয়ে তার পিঠে আলতো করে চাপড় দিতে দিতে তনিমার গাওয়া সেই ঘুমপাড়ানি সুরের গান,

সুজন আমার কূজন ডাকলে কুজন মনে হয়,
সুজন যদি না রয় পাশে হায়রে কী উপায়।
সুজন গ্যাছে নাইয়রেতে একলা কাটে দিন,
এবার সুজন এলে হব তারই বুকে লীন।


২৭টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×