somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্রেনের গতিকথা

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-“ট্রেন দুই ঘন্টা লেট”

নীলিমা পেছন ফিরে তাকায়। ধবধবে সাদা সার্ট পরা একটা ছেলে একটু উচু গলায় ছয় সাতজন যাত্রীদের একটা জটলার ভেতর থেকে কথা বলছে। ভার্সিটি পড়ুয়াই হয়ত হবে, কাঁধে একটা গিটার ঝোলানো। যাত্রীদের আগ্রহটা এখন তাকে ঘিরেই। বোধ হয় স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে কিছু একটা খবর নিয়ে এসেছে। হঠাত ছেলেটা কি যেন একটা বলে, সবাই একযোগে হেসে ওঠে। নীলিমা ভালো করে ছেলেটাকে লক্ষ করে। চেহারা তেমন আহামরি কিছু না, তবুও কেনো যেন নীলিমার ছেলেটাকে খুব সুদর্শন বলে মনে হয়, যদিও কারণটা বুঝতে না পারার একটা অস্বস্তি কাজ করে তার ভেতরে। সে খেয়াল করে, ছেলেটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে।



-“আপনি কি প্রভাতীর যাত্রী?”

-“জ্বি”

-“আর বলবেন না। নাম রাখসে প্রভাতী, আসবে বারোটায়। তাও কপাল ভালো নাম বৈকালী রাখেনাই, তাইলে তো রাতটা এখানেই কাটানো লাগত।”

ভদ্রতাসূচক ছোট্ট একটা হাসি দেয় নীলিমা। ছেলেটাকে কেনো সুদর্শন লাগছিলো সেই কারণটা সে ধরতে পেরেছে। রিমলেস চশমা। বিরাট চারকোণা কি একটা ফ্রেম ইদানিং বের হয়েছে, মেহেদী ঐটা পরে ঘুরে বেড়ায়। ঐ চশমা কেনার আগে একটা লেন্স পরতো, দেখতে লাগতো একটা বিলাইয়ের মতো। নীলিমা বেশ কড়া ধমক দিয়ে এই বিলাইপনা বিদায় করেছে। তারপরেই শুরু হয়েছে এই বিশাল ফ্রেমের উপদ্রব। নীলিমা এখনো কিছু বলেনি। বললেই যদি, “আমার কোন কিছুইতো তোমার এখন আর ভাল্লাগেনা” জাতীয় আজাইরা প্যানপ্যান শুরু হয় সেই ভয়ে। অথচ নীলিমা অবাক হয়ে ভাবে মেহেদীকেও হয়ত রিমলেস চশমায় অনেক সুন্দর লাগতো। এই ব্যাপারটা আগে সে কখনো খেয়াল করেনি।



-“মা, একটু পানি খাওয়া তো”

সুফিয়া বেগমের পানির তেষ্টা মোটেই পায়নি। কথাটা বলার উদ্দেশ্য মেয়ের সাথে যেই ছোকরাটা কথা বলছে তাকে বোঝানো যে এই মেয়ে একা একা ট্রেনে যাচ্ছেনা, সাথে তার মাও যাচ্ছেন। এই ধরণের ছেলে ছোকরা ট্রেনে একলা সমবয়েসী মেয়ে যেতে দেখলে কথা বলার উছিলা খোঁজে। এদের প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না।

-“আমি দিচ্ছি খালাম্মা, এই নিন”

-“কিছু মনে করবেন না, মা হালকা গরম পানি ছাড়া খেতে পারেন না” বলেই ফ্লাস্ক থেকে পানি ঢালতে থাকে নীলিমা।

-“ও, তা খালাম্মা, কোথায় যাবেন?”

-“আখাউড়া”

-“তাইলেতো মনে হয় ঠ বগির যাত্রী?”

এ তো ভারী যন্ত্রণায় পরা গেলো। প্রথমে ভেবেছিলেন বয়স্কা মহিলা সাথে যাচ্ছে দেখে ছেলেটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এখন দেখা যায় তার সাথেই গল্প জমানোর ধান্দা। সুফিয়া বেগম প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“জামাই কি ফোন দিয়েছিলো?”

এটা জানাটাও তার কাছে জরুরি কিছু না। মেয়ের হবু বর আছে এটা ছেলেটাকে জানিয়ে দেয়াটাই জরুরি।

-“না মা।”



নীলিমা বেশ অবাক হোল। এর আগে তার মা কখনোই মেহেদীকে “জামাই” সম্বোধন করেননি। গত সপ্তাহেই তাকে আংটি পরানো হয়েছে, মা এই সম্পর্কের ব্যাপারে জেনেছেন আরো দু বছর আগে। একটা সময় ছিলো, মা মেহেদীর ব্যাপারটা জানলে কি হবে তা ভেবে নীলিমার রক্ত হিম হয়ে যেত। তখন সে স্বপ্ন দেখতো মেহেদীকে তার মা “জামাই” বলবে, মাছের মাথাটা অর প্লেটে তুলে দিবে। আজ কেনো যেন কথাটা শুনে সে যথেষ্ট বিব্রত হয়।

-“শুনুন, আমরা ঠ বগির যাত্রী নই, চ বগির যাত্রী।”

-তাই নাকি, আমিও তো। ৩৮ নাম্বার সিট।”

-“ভালোই হলো, আমাদের ৩৬ আর ৩৭।”

-“কপাল ভালোই বলতে হবে, জানালার পাশে সিট পেলেন”

-“কি করে বুঝলেন ওগুলো জানালার পাশের সিট?”

-“ট্রেনে ৪ দিয়ে ভাগ যায় যে সংখ্যাগুলো আর তার পরের সংখ্যাগুলোর সিট জানালার পাশে হয়।”

-“তাই নাকি, আপনি তো মস্ত জানেন দেখছি।”

শব্দ করে হাসে ছেলেটা। গীটারের ব্যাগটাকে কোলে নিয়ে বলে,

-“আচ্ছা, আমার একটা বদঅভ্যাস আছে, ট্রেনে অনেকদূরে যাওয়ার সময় এই গীটার দিয়ে খানিকটা গুনগুন করি, আপনার অসুবিধা নেই তো?”

-“না না, তা কেনো থাকবে? অবশ্য গানের গলা ভালো না হলেতো বিপদে ফেলবেন।”

-“তাহলে আগেই দশ নম্বর বিপদ সংকেত দিয়ে রাখলাম।”



বলে দুজনেই হাসতে থাকে। নীলিমার মনে পড়ে মেহেদীর সাথে প্রেম হওয়ারো আগে যে অনাগত প্রেমিকের কল্পনা সে করতো সেই প্রেমিক সবসময় তাকে গীটার বাজিয়ে শোনাত আর ইচ্ছেমতো কথা সাজিয়ে গান গাইত নীলিমা। নীলিমা নিজের অজান্তেই বল ওঠে,

-“এক কাপ চা হলে খুব ভালো হতো, এখানে পাওয়া যাবে নাকি টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত যাওয়া লাগবে?”

-“আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থা করছি।”

-“এই বৃষ্টি--” বলে জোরে কাউকে ডাকে ছেলেটা। ছয় সাত বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে দৌড়ে আসে।

-“ডাকেন নি আনিস বাই?”

-“চাচা চা বিক্রী করতেছেনা আজকে?”

-“না বাইজান, বাজানের শরীলডা বালা নাই।”

-“তাইলে নে” পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে আনিস।

-“দুই কাপ চা নিয়ে আয় যা”

টাকা নিয়েই চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায় বৃষ্টি।

-“আপনি ওকে কীভাবে চেনেন?”

-“আমি মাস্টার্সে পথশিশুদের নিয়ে রিসার্চ করেছিলাম। সেখান থেকেই এদের সাথে পরিচয়।”

নীলিমার মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। মেহেদীর ফোন।

-“হ্যাল্ল বেইব, কি কলো?”

কয়েকদিন ধরেই মেহেদী এই নতুন আহ্লাদ আমদানি করেছে। আজকে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশী বিরক্ত হয় নীলিমা। ওর ইচ্ছে করছে ফোনটাকে মেঝেতে আছাড় মারতে। একরাশ বিরক্তি কন্ঠে এনে বলে,

-“শোন, মা তোমার সাথে কি যেন জরুরি একটা কথা বলতে চাচ্ছে। নাও, কথা বলো।”

ফোন মায়ের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় সে। সুফিয়া বেগম কোন কথা না থাকলেও তার হবু জামাইয়ের সাথে ঘন্টা খানেক কথা বলতে পারবেন। কলেজে পড়ার সময় নীলিমাকে আদর করে নীল ডাকতো মেহেদী। নীলিমাই তখন অভিমান করে বলতো, “তুমি আমাকে এইসব কাব্য করে কী ডাকো? দেখ না অন্য বয়ফ্রেণ্ডরা কি সুন্দর করে তাদের গার্লফ্রেণ্ডদের জান বলে, বাবু বলে।” আজ কেনো যেন নীলিমার বড্ডো নীল ডাকটা শুনতে ইচ্ছে হয়। খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো মেহেদী, একদিন রাগ করে নীলিমা তার নিজের একটা স্কেচ ছিঁড়ে ফেলেছিলো। ব্যস, মেহেদী ছবি আঁকা ওইখানেই শেষ। মেহেদীও কোনদিন তাকে বলেনি, ইন্টার পরীক্ষার আগের রাতে কি পরিমাণ যত্ন নিয়ে নীলিমার ওই স্কেচটি সে এঁকেছিল। রিকশায় উঠে আগে কী সব উদ্ভট কাজ করতো সে। রিকশাওয়ালাকে হঠাত করে জিজ্ঞেস করতো, “আচ্ছা ভাই, আপনি কখনো বাদাম চকলেট খাইসেন?” বলেই পকেট থেকে একটা চকলেটের প্যাকেট বের করে সে কি আবদার, “না ভাই, আপনাকে একটা খেতেই হবে।” নীলিমা তো এইসব পাগলামী দেখে হেসেই কুটিকুটি। এখন মেহেদীর রিকশায় ওঠা মানেই পলাশীর মোড়ে এক টুকরো অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করা। ভাবতেই নীলিমার গা ঘিনঘিন করে।



-“আপা। চা নেন।” হঠাত নিজের জগতে ফিরে আসে নীলিমা।

-“তোমার আনিস ভাই কই?”

-“দেহেন গ্যাছে কোথাও” বলেই চট করে অদৃশ্য হয়ে যায় মেয়েটি। সুফিয়া বেগম এখনো তার হবু মেয়ে জামাইয়ের সাথে এখনো কথা বলে যাচ্ছেন। নীলিমা খেয়াল করে তাদের একটা লাগেজ নেই। ফ্লাস্কটিও উধাও।

-“এক্সিউজ মি, এখানে যে লাগেজটা রাখা ছিলো সেটা কোথায়?” পাশের যাত্রীটিকে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করে নীলিমা। সুফিয়া বেগম ফোন কেটে দেন। আশেপাশের অনেক যাত্রী ফিরে তাকায়। কেউ একজন বলে,

-“আপনাদের সাথে যে সাহেব কথা বলতেসিলো আমরাতো ভাবলাম ঐটা তার ব্যাগ। উনি তো ঐ ব্যাগ নিয়ে কোথায় যেন গেলেন।”

দূর থেকে সুফিয়া বেগম আর আরো অনেক যাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। নীলিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কতোদিন মেহেদীর সাথে এরকম আকাশ দেখতে দেখতে গল্প করা হয়না।



-মোঃ তৌহিদুল ইসলাম-
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যারিস্টার সুমন দায়মুক্ত , চু্ন্নু সাহেব কি করবনে ?

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৭


দেশে প্রথম কোন সংসদ সদস্য তার বরাদ্ধের ব্যাপারে Facebook এ পোষ্ট দিয়ে জানিয়ে থাকেন তিনি কি পেলেন এবং কোথায় সে টাকা খরচ করা হবে বা হচ্ছে মানুষ এসব বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×