শুচি সৈয়দ
দেখতে দেখতে চারটি বছর অতিক্রান্ত হল। পাক্ষিক মত ও পথ পঞ্চম বর্ষে পা রাখতে যাচ্ছে। আমি নিজে কোনও আহামরি লেখক নয়, তা সত্ত্বেও এই পাক্ষিক পত্রিকাটিতে গত চার বছর প্রায় নিয়মিত লিখে যাচ্ছি কিভাবে সম্ভব হল এই অসম্ভব ঘটনা সেটা ভেবে নিজেই বিস্মিত হচ্ছি। যতটা না লিখে নাম ফোটাবার ইচ্ছে কিংবা নিয়মিত কিছু পারিশ্রমিক পাবার নিশ্চয়তা তার চাইতে বেশি আন্তর্তাগিদ এবং এই পত্রিকার সম্পাদক র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর সøেহ প্রশ্রয় এবং øেহভাজন দুই তরুণ কবি এহসানুল ইয়াসিন ও হেলাল উদ্দিনের তাড়নায়। বলতে দ্বিধা নেই বিশেষত, শেষোক্ত দুজনই গত চার বছর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে নিরন্তর। আমি ওদের দুজনের মধ্যে আমার তারুণ্যের ভালোবাসা দেখতে পাই। লিখি সেই নস্টালজিয়ায়ও।
একটি অলাভজনক পত্রিকা, একটানা চার বছর চালিয়ে যাওয়া কোনও ছোট ঘটনা নয়। তার ওপর এর লেখকদের নিয়মিত পারিশ্রমিক প্রদান করা এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটানো। পত্রিকা সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারা এটি উপলব্ধি করতে পারবেন না। আমি এটা উপলব্ধি করতে পারি, সবিস্তার পত্রিকা বিষয়ে জানি জন্যই। আর বিষয়টি উপলব্ধি করে আরও বেশি শ্রদ্ধানত হই র আ ম উবায়দুল মুক্তাদিরের প্রতি।
আমি নিজে পত্রিকার প্রকাশনার কাজের সঙ্গে জড়িত ১৯৭৮ সাল থেকে। পত্রিকার আদ্যপ্রান্ত আমি জানি, যাকে বলে ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’Ñ সেই অভিজ্ঞায় আমি পুরোপুরি সমৃদ্ধÑ পত্রিকা বিষয়ে। তাই আজ মত ও পথ যখন পঞ্চম বর্ষে পা রাখতে যাচ্ছে তখনও বিস্ময় এবং শ্রদ্ধাবোধ করছি মুক্তাদির ভাই এবং মত ও পথের সঙ্গে যারা নিরন্তর পথ চলছেন তাদের প্রতি।
আমার কথাগুলোকে তোষামোদ বলে মনে হবে। তাই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়ার মত আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি পাঠক সমীপেÑ নিজের ঢোল নিজে পিটিয়েÑ
কবিতারোগে আক্রান্ত হয়নি এমন বাঙালি তরুণের দেখা মেলা সত্যিই ভার বাঙালি সমাজে। আমি কবিতারোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম স্কুল পড়া বয়েসে। সবাই আমাকে ইচড়ে পাকা বলত, কারণ আমার মেলামেশা বেশিরভাগই ছিল আমার চাইতে বয়সে বড়দের সঙ্গে। বলাইবাহুল্য এই বন্ধুত্ব মূলত কবিতা সূত্রে। জেলা শহর পাবনায় আমরা যারা কবিতা লিখি তারা স্থানীয় ছোটকাগজ গুলোয় লেখালেখি করি আর স্বপ্ন দেখি দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোয় আমাদের কবিতা ছাপা হবে গুরুত্ব দিয়ে। দেশের প্রধান কবিদের সঙ্গে। কারও কারও সে সাধ পূরণ হয়ও। তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক বাংলা, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা প্রভৃতি পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হতে থাকে। লেখা ছাপা হয় অগ্রজপ্রতিম আবু মহম্মদ রইস, আতাহার আলী, শ ই শিবলী, জাহাঙ্গীর উল হক প্রমুখের। কিন্তু তাতে আমাদের আশ মেটেনা। আমাদের মনে হয় ইশ, যদি আমাদের নিজেদের একটি পত্রিকা থাকতো! সেই স্বপ্নটি যেন সত্যি হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আমাদের জেলায় তখন কোন সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল না স্থানীয় পর্যায়ে। সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা নামে একটি পত্রিকা মাঝে মাঝে বের করতেন শফিউর রহমান খান। সেটি ছাপা হত আমরা যে প্রেসটিতে আড্ডা দিতাম সেই বুলবুল আর্ট প্রেস থেকে। প্রেসের মালিক আবদুল হাই সাহেব কখনও সে পত্রিকা ছাপার টাকা পেতেন, কখনও পেতেন না। তিনি পৃষ্ঠপোষকের মতই মমতায় ছেপে দিতেন পত্রিকাটি। আমরা কমবেশি সকলেই তার সেই মমতার প্রশ্রয় পেয়েছি। আমাদের সবার অলিখিত ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ট্রাফিক মোড়, এ হামিদ রোড, পাবনার বুলবুল আর্ট প্রেস। এরকম একটি যৌথ ঠিকানা এযুগেও দুর্লভ বলে বিবেচিত হবে। পাবনা বার্তা-র অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার স্বপ্নকে কখনও দুরূহ, কখনও সহজ মনে করাতো। এর ভেতরেই ঘটল একটা ঘটনা। সে সময় পাবনার প্রেসগুলোর মধ্যে নামী প্রেস বাণী মুদ্রণ। সেটির স্বত্বাধিকারী ছিলেন ইউসুফ আলী মৃধা। তাঁর তরুণ পুত্র ইয়াসিন আলী মৃধা রতনকে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে অভিষিক্ত করতে চাই ছিলেন। প্রেসে বসার পাশাপাশি তিনি একটা চ্যালেঞ্জ যেন চাপিয়ে দেন তাঁর পুত্রের কাঁধে। আর তা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনার কর্মভার তার ওপর অর্পণ করে। মফস্বলের এক প্রেস ব্যবসায়ীর তরুণ পুত্রের কাঁধে এ রকম একটি দায়িত্ব প্রদান ছিল নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত। কতটা দুরূহ এবং দুঃসাধ্য সেটা আমি আমার দীর্ঘ পত্রিকা জীবনের অভিজ্ঞতায় হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি; আমার মনে হয় তেমন করে ইয়াসিন আলী মৃধা রতনও তা উপলব্ধি করেননি। আর এই প্রকল্পের সবটাই ঘটেছিল আমাদের অগ্রজপ্রতিম শ ই শিবলীর নেপথ্য কর্মতৎপরতায়। মূলত তারই প্রেরণা ও প্ররোচনায় ইউসুফ আলী মৃধা রচনা করেছিলেন তার পুত্রের জন্য এই প্রকল্প।
তখন প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক কবিতাপাঠের আসরে আমরা মিলিত হতাম। আমাদের সেই আসরটির নাম কবিকণ্ঠ। সেই আসরের সব সদস্য জড়িয়ে গেলাম এই প্রকল্পে। একদল কবিতাকর্মী হয়ে গেল সংবাদকর্মী। আমাদের শ্রমে এবং প্রকাশকের সমর্থনে এই পত্রিকা নিজের আয়ে নিজে চলার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিল নিয়মিত প্রকাশ হবার সামর্থ্য। যেন একটি যৌথখামার রচনা করেছিলাম আমরা আমাদের যৌবনে। এই যৌথখামার আর কখনও কেউ তৈরি করতে পারেনি। পারা সম্ভবও নয়Ñ একথা আমি বলতে পারি। পত্রিকাটির সঙ্গে আমরা জড়িয়েছিলাম, আমাদের কবিতা ছাপা হবে সেই স্বপ্নে কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কোথায় কর্পূরের মত উড়ে গেছে সেই স্বপ্ন তা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারিনি! আমরা সমস্ত জেলার সংবাদ ছাপার উš§াদনায় হারিয়ে গেছি। কত ঘটনা সেই যৌথখামারকে ঘিরে। কত বিচ্যুতি, লোভ, পরীক্ষাÑ সেসব উৎরে উৎরেই আমাদের পথচলা। আমরা আমাদের একটা মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছিলাম। মফস্বল শহর পাবনার সংবাদপত্র পাঠক বিশ্বাস করত আমরা সত্য কথা লিখি। বিশ্বাসের সেই ভিত্তি আমরা নির্মাণ করতে পেরেছিলাম স্বপ্নবান তারুণ্যের কারণেই।
কি ছিলাম না আমরা সেই পত্রিকার? লেটারপ্রেসে হ্যান্ড কম্পোজে প্রকাশিত সেই চার পৃষ্ঠার সাপ্তাহিক ‘বিবৃতি’র কম্পোজিটর, হকার, সম্পাদক, প্রতিবেদকÑ সবই ছিলাম আমরা। এযুগের তরুণরা বুঝতেও পারবে নাÑ এখনকার পত্রিকার একটি পৃষ্ঠা মাত্র সেই বিবৃতি; সেটার পেছনে আমাদের ঘাম-রক্ত-শ্রমের কি বিপুল উৎসব ব্যয়িত করেছি আমরাÑ আমাদের জনপদের মানুষের দাবি-দাওয়া স্বপ্নকে তার পৃষ্ঠায় তুলে ধরতে, আদায় করতে। সাপ্তাহিক বিবৃতি ছিল আমাদের জেলা শহর পাবনা নামক জনপদের জনগণের অবিসম্বাদী মুখপত্র। প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল বিবৃতির ডেটলাইন। আমরা লিখতাম বিষ্যুদবার, স্থানীয় উচ্চারণ। প্রথম প্রথম সবাই হোঁচট খেত কিন্তু পরে সবাই মন থেকেই একাÍ হয়ে যায় এই শব্দের সঙ্গে। সারা সপ্তাহ ধরে বিবৃতির সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, চিঠিপত্র ও সংবাদ, প্রতিবেদন কম্পোজ করতেন একজন কম্পোজিটর। দুই দফায় ফ্লাট মেশিনে ২ পৃষ্ঠা ২ পৃষ্ঠা করে ছাপা হত ৪ পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি। বিষ্যুদবার সকালে ছাপা হয়ে বিবৃতি অফিসে এলে আমাদের সবার কাজ ছিল ভাঁজ করে পিন মেরে ডাকটিকিট লাগিয়ে লোগোর ফাঁকা জায়গাটিতে দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বিজ্ঞাপনদাতাদের নাম ঠিকানা লেখা, দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোর সম্পাদক, দেশের সমস্ত পাবলিক লাইব্রেরি, পাঠাগার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি, সমস্ত প্রেসক্লাব এবং দেশের বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে সৌজন্য কপি প্রেরণ।
সারা শহরে পত্রিকা বিলি করতেন একজন হকার। কারো কাছে পত্রিকা পৌঁছুতে দেরি হলে অনেক গ্রাহকই অফিসে চলে আসতেন। তখন সারা পাবনা শহরে জাতীয় পত্রিকার গ্রাহক ছিল প্রায় তিন হাজার; এদের প্রায় সবাই বিবৃতির গ্রাহক ছিলেন। মাসে জাতীয় পত্রিকার বিল হত ৩০ টাকা / ৩২ টাকা সঙ্গে বিবৃতির জন্য তাদের দিতে হত ৩ টাকা বা ৩.৭৫ পয়সা। প্রথম দিকে তারা পত্রিকা রাখতেই চাইতেন না অথচ পরে বিবৃতি না পড়লে তাদের সপ্তাহ চলত না। আমরা দল বেঁধে শহরের প্রত্যেকটি দোকানে দোকানে গিয়ে গ্রাহক তৈরি করতাম। পাবনার রাজনীতি, সংস্কৃতি অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে কেউ আমাদের ফেরাতেন না। আমাদের শ্রমে, পাবনাবাসীর সমর্থনে বিবৃতি একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল শহরের। পরবর্তীতে জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে আমরা পাবনা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় বিবৃতি-র প্রকাশনায় ছেদ পড়ে। পরে দৈনিক হিসেবে নিবন্ধিত হলেও সেই যৌথখামার আর টিকে থাকেনি।
আজকে মত ও পথের তরুণ কর্মীদের যখন ছাপাখানা, বাইন্ডিংখানা, আর্টিস্ট, বুকস্টল আর লেখকদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখি তখন আমার তারুণ্যের স্মৃতি মনে পড়ে। ওরা জানতেও পারে না ওদের মুখচ্ছবির ভেতর আমি আমার কোন ভালবাসাকে, কোন ভাললাগাকে প্রত্যক্ষ করি। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার’ মধ্যে যে কি পরিতৃপ্তি তা বলে বোঝাতে পারবোনা পাঠক আপনাদের। নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া তা বোঝা দুঃসাধ্য। মত ও পথের পঞ্চম বর্ষে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত এই লেখাটি লিখে আমাদের ফেলে আসা সেই হিরš§য় তারুণ্যকে অনুভব করছি। কামনা করি মত ও পথ-ও হয়ে উঠুক এক যৌথখামারÑ স্বপ্নের, সম্ভাবনার।