বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রেসিপি ।
আমসত্ব দুধে ফেলি,
তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে ;
হাপুস হুপুস শব্দ,
চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে ।
রবীন্দ্রনাথের কোন এক কবিতায় এই যে রেসিপিটা দেয়া ছিল, সেটা দিয়ে সকালের জলখাবার বানানোর কথা প্রায়ই ভেবেছি । মনে হয় সে রকম জোর কোন প্রচেষ্টা নিইনি বলে ওই চারটে জিনিষ একসাথে মিলিয়ে খাবারটা বানান হয়নি । তবে এমন হয়েছে যে কখনও কলা, দুধ সন্দেশ যদি বা মিলেছে- আমসত্ব পাইনি । এই জিনিষটি বাংলাদেশে,পশ্চিম বঙ্গের মত বেশি জনপ্রিয় ছিল না । কেউ কলকাতায় গেলে আনতো। এলেও, কিন্তু ঠিক তখন হয়তো ,যে কোন কারনেই হোক সন্দেশ মেলেনি । আবার কলা , আমসত্ব এলেও তখন সন্দেশটা মিস হয়ে যেত। আমার ছোট বেলায় এই চতুর্কলার একত্র যোগ হয়নি ফলে ওইটা মিস করেছি,হাপুস হুপুস করে খাবার মজাটা পাইনি । তাই ঠিক করলাম আমার মেয়েদের অন্ততঃ এই অমৃতের স্বাদ দিতে হবে ।
বানাতে গিয়ে প্রথম যে সমস্যায় পড়লাম তা হলো- রবীন্দ্রনাথ জিনিষগুলোর পরিমান দিয়ে যান নি। তাই
আমি মেয়েদের বললাম-‘ পরিমান টা তোরাই ঠিক করে নে ।’ সমস্যা হল অন্যত্র – খাবারটার বেস্ টা কি হবে ? অর্থাৎ সেই চারটে উপকরণ কিসের সাথে মেশাব ? শুধু দুধের সাথে সন্দেশ ,কলা, আমসত্ব মেশালে তাতো সরবতের মত কিছু হবে ,পাতে নিয়ে খাওয়া যাবেনা । তাহলে কি ? সেদ্ধ ভাত, চিড়া ,মুড়ি -নাকি অন্য কিছুর সাথে মেশাব । ছোট মেয়ে বললো -‘বাবা -কর্ন ফ্লেক্স দাও ।
-কিন্তু সেটা তো বিদেশী মিক্স হয়ে যাবে, বাঙালি ফ্লেবার টা থাকবে না ।’
-বাবা ,আজকাল রবীন্দ্রনাথের গানে ফিউশন হচ্ছে , এটাও নাহয় একটু বাঙালি খাবার সাথে বিদেশি খাবার মিক্স হবে ।’
বলার কিছু নেই। কদিন আগেই ওরা সোমলতা আচার্যের গাওয়া ‘মায়াবন বিহারিনী হরিনী’ শুনেছে । ওই রক্-রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার কর্ণকুহর ঝালাপলা করলেও বলার কিছু নেই- যুগটাই গ্লোবালাইজেশনের ।
যাইহোক মেয়ের কথামত প্রথমেই আনা হল চকলেট গন্ধি কর্নফ্লেক্স । আগেই আনা ছিল কলকাতার আমসত্ব , আর নাটোর থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আনা কড়া পাকের সন্দেশ । মানিকগঞ্জের অরিজিন্যাল অর্গানিক কেমিক্যাল ছাড়া পাকানো স্পটলেস সাগর কলাও যোগাঢ় করা হলো । এইখানে সিথির মা বাগরা দিল বললো – এটা পিরিওডিক্যাল রেসিপি, তখন সাগর কলা ছিল না , আর মানিকগঞ্জের তো নয়ই। বরং বিক্রমপুরের মালভোগ কলা আন । তখন তো এদিক থেকেই সব যেত তো’-
তাই সই যতটা কাছাকাছি থাকা যায় উনিশ শতকের ।
এরপর শুরু হল রবীন্দ্রনাথের রেসিপির রান্না । ঘন করে জ্বাল দেয়া হল দুস্প্রাপ্য খাঁটি দোয়ানো গরুর দুধ। তারপর সেটা ঢালা হল কর্নফ্লেক্সের উপর । কলা গুলো সিঁথি সুন্দর পিস পিস করে কাটছিল - বললাম,
-হল না। কলা তো চটকাতে হবে ওর সাথে আলু ভর্তার মত। লেখা আছে কদলি দলি,-দলা মানে চটকানো।
-তাহলে তো ক্রিসপি টা থাকবে না ।’ কাঁদ কাঁদ গলায় সিঁথি বললো ।
এবার ওর মা এগিয়ে এসে বললো -তুমি বরং কলাটা গ্রাইন্ডারে পেস্ট কর আলাদা করে । বললাম,
-অসম্ভব ।অমন হলে পেস্ট হবে, দলান হবে না । দুটোর মধ্যে তফাৎ হল দলানোর মধ্যে কিছু আধো ভাঙ্গা থাকবে ,সেটা মুখের মধ্যে ভিন্ন স্বাদ দেবে।’
মনে মনে যদেও একটু কিন্তু কিন্তু থাকলো । যাইহোক-
এরপর এল কলকাতা থেকে ফরমাস করে আনা আমসত্ব ।সেটা নানা কান্ড করে কুচি কুচি করে কেটেছিঁড়ে তারপর ছাড়া হল । সন্দেশগুলো কিভাবে দেয়া হবে গোটা গোটা না ভেঙ্গে- এনিয়েও বিস্তর গবেষণা হল,শেষ পর্যন্ত গুঁড়ো করে ছিটিয়ে দেয়া হলো।--
তারপর কি হল ?
আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না । কেউ যদি চেষ্টা করে এই জলখাবারটি [বা ফারসীতে নাস্তা] বানায় , তাহলে শেষটা তারাই লিখে নেবে । আমার এটুকুই বলা- শুধু হাপুস হুপুস শব্দই নয়, যেন জগৎ তোলপাড় করা উল্লাসে আর মেয়েদের উচ্ছ্বাস ভরা আওয়াজে আমার ঘর আমোদিত হল- গীতবিতানের বাইরে সম্পুর্ণ অন্য একরকম আনন্দের জন্য কবিগুরুকে সেজন্য সেলাম জানালাম -মেনি মেনি থ্যানকস্ ঠাকুর।
যুগ যুগ জিও তুমি বাঙালির ঘরে ঘরে,
বিলিও এমন রস সাজানো যা থরে থরে-
তোমার রঁসুই ঘরে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:০২