somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খনার বচন এবং আমাদের কৃষি ঐতিহ্য। (২য় পর্ব)

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব

প্রারম্ভিকাঃ

অনুমান করা হয় প্রাচীন চীনা এবং তিব্বতী জাতিগোষ্ঠীই এ অঞ্চলে প্রথমে একটি পরিকল্পিত চাষ ব্যবস্থার অবতারণা করে এখানে স্থায়ী হয় এবং এর মাধ্যমেই বাইরের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে অত্র অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে প্রাচীন চৈনিক শব্দ বং এবং আল শব্দ দু'টির সংমিশ্রণেই বাঙ্গাল শব্দটি এসেছে। যেখানে চৈনিক ভাষায় "বং" শব্দের অর্থ জলাশয় এবং "আল" শব্দের অর্থ উঁচু ভূমি। সম্ভবত জলাশয়ের ধারে উঁচু ভুমি হিসেবে চীন ও তিব্বতিদের মাঝে পরিচিত ছিল। যে নামেই পরবর্তীতে এ অঞ্চল বঙ্গ বা বাঙ্গাল নামে পরিচিতি লাভ করে। তাছাড়া আর্যদের ঋগ্বেদে বঙ্গা নামে এ অঞ্চলের পরিচিতির একটি ধারণা পাওয়া যায়। এর থেকে ধারণা করা হয় আর্যদের আগমনের বহু পূর্বেই এদেশে কৃষি ভিত্তিক একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তাছাড়া ইতিহাসের সাক্ষ্য মোতাবেক অত্র অঞ্চলের সাথে আর্যদের কখনো তেমন সুসম্পর্ক ছিলনা। পরিব্রাজক হিউ এন সাং এর মতে তৎকালীন আর্যরা অত্র অঞ্চলের মানুষদের মগা (মগধ থেকে) বলে বিদ্রুপাত্তক সন্মোধন করত। যা আজো নির্বোধ অর্থে আমাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়া বেদ বিরোধী বিভিন্ন মতবাদ যেমন, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন এসব মতবাদের জন্ম প্রচার প্রসার এবং জনপ্রিয়তা অত্র অঞ্চলের মানুষদের আর্য বিরোধী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। যে কারনে এটা ধারণা করে নেয়া যায় যে বাংলার কৃষি ব্যবস্থা এবং প্রাচীন প্রবাদ সমূহের সাথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের প্রবাদের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য থাকলেও মূলত এ অঞ্চলের কৃষি এবং প্রবাদ প্রবচন গড়ে উঠেছে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের প্রভাব মুক্ত হয়ে। এদিকে সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অত্র অঞ্চলের মানুষের তৎকালীন স্বতন্ত্র ভাবে পরাক্রমশীলতার একটি ধারণা পাওয়া যায় যেটা আর্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। আলেকজান্ডারে সৈন্য বাহিনী সমগ্র ভারত দখল করে নিলেও বিহারের পাটনার পর আর এদিকে তারা এগুতে পারেনি। এর থেকেও অনুমান করা যায়, তৎকালীন বিহার পূর্ববর্তী এবং বিহার পরবর্তী রাজ্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। আর যে কারণেই সম্রাট আলেকজান্ডার বিহারের পাটনার পর আর এদিকে এগুতে পারেননি।

খনার পরিচয়ঃ

প্রথম পর্বে খনা নিয়ে একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ রয়েছে। এবার একটু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে খনার পরিচয় জানার চেষ্টা করা যাক। পালি ভাষায় রচিত "মহাবংশ" নামক সিংহলী প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায় যে, লালাধিপতি বিজয় সিংহের পুত্র বিজয় সিংহ পিতা কতৃক পরিত্যাক্ত হয়ে তৎকালীন বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র সিংহলে বসবাস স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে সিংহল রাজ্য দখল করেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ কয়েক শতাব্দী সিংহলে রাজত্ব করেন। হতে পারে খনা সেই রাজবংশের কোন দুর্ভাগা রাজকন্যা। বংশ পরম্পরায় যার মাতৃ ভাষা ছিল বাংলা। তাছাড়া সিংহলী ভাষার সাথে বাংলা ভাষার মিলটাও লক্ষ্যনীয়। তবে বিজয় সিংহের বংশধররা ঠিক কত শতাব্দী রাজত্ব করেছেন তার কোন সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।

খনার বচনঃ

খনার বচন মূলত কৃষি ভিত্তিক হলেও স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, নিয়ম রীতি, পশুপালন, আচার আচরণ, জ্যোতিষ গণনা দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব দিক নিয়েই রয়েছে খনার বচন। নিচে আমরা কয়েকটি আবহাওয়ার পুর্বাভাস ভিত্তিক খনার বচন ও তার অর্থ জেনে নেই।

দিনে জল রাতে তারা, এই দেখবে খরার ধারা।
অর্থঃ বর্ষার শুরুতে যদি দিনে বৃষ্টিপাত হয় আর রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে সে বছর খরা হবে।

আষাঢ় নবমী শুক্ল পক্ষা, কি কর শ্বশুর লেখা জোখা
যদি বর্ষে মুষল ধারে, মাঝ সমুদ্রে বগা চড়ে
যদি বর্ষে ছিটে ফোটা, পর্বতে হয় মীনের ঘটা
যদি বর্ষে রিমঝিমি, শস্যের ভার না সহে মেদেনী
হেসে সূর্য বসেন পাটে, চাষার বলদ বিকোয় হাটে।

অর্থঃ আষাঢ় মাসের প্রথম চাঁদের শুক্ল পক্ষের নবমীর দিন অর্থাৎ চন্দ্র মাসের নয় তারিখে যদি মুষল ধারে বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা কম হবে। যদি সামান্য ছিটে ফোটা বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা বেশী হবে। সেদিন মাঝারী বৃষ্টিপাত হলে ফসলের উৎপাদন ভালো হবে আর যদি আদৌ বৃষ্টি না হয় তাহলে সেবছর ভালো ফসল হবেনা।

স্বর্গে দেখি কোদাল কোদাল মধ্যে মধ্যে আইল
ভাত খাইয়া লও শ্বশুর মশাই বৃষ্টি হইবে কাইল।

অর্থঃ যদি ছোট ছোট খন্ড খন্ড মেঘে আকাশ ভর্তি থাকে তাহলে পরদিন বৃষ্টি হবে।

চৈতে কুয়া ভাদ্রে বান, নরের মুন্ড গড়াগড়ি যান।
অর্থঃ চৈত্র মাসে কুয়াশা অথবা ভাদ্রমাসে বন্যা দেখাদিলে মহামারী হয়।

যদি ঝরে কাত্তি, সোনা রাত্তি রাত্তি
যদি ঝরে আগন, হাতে কুলায় মাগন।

অর্থঃ কার্তিক মাসে বৃষ্টি হলে ধানের উৎপাদন ভালো হয়। আর অগ্রহায়ণে বৃষ্টি হলে ধান নষ্ট হবে।

জৈষ্ঠ্যে শুখা আষাঢ়ে ধারা, শস্যের ভার সহে ধরা।
অর্থঃ জৈষ্ঠ্যমাসে প্রচন্ড খরা হলে আষাঢ় মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং সে বছর প্রচুর ফসল ফলবে।

পশ্চিমে ধনু নিত্য খরা, পূর্বে ধনু বর্ষে ধারা।
অর্থঃ পশ্চিমে রংধনু দেখা গেলে সেটা খরার লক্ষণ আর পুবে রংধনু দেখা গেলে বৃষ্টিপাতের লক্ষণ।

দূর সভা নিকট জল, নিকট সভা রসাতল।
অর্থঃ চন্দ্রসভা বা চাঁদের চারিদিকে মেঘের বৃত্ত বড় হলে তাড়াতাড়ি প্রচুর বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে আর চন্দ্রসভা ছোট আকৃতির হলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম।

ধানের গাছে শামুকের পা, বন বিড়ালী করে রা
গাছে গাছে আগুল জ্বলে, বৃষ্টি হবে খনায় বলে।

অর্থঃ শামুক ধান গাছ বেয়ে উপরে উঠতে থাকলে শিঘ্রই প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে।

আমে ধান, তেতুলে বান।
অর্থঃ যে বছর আম বেশী ফলে সেবছর ধানও বেশী হয়। যেবছর তেতুল বেশী ফলে সে বছর ঝড় বন্যা বেশী হয়।

বিয়ানে আউলি বাউলি, দুপুরে বাউ, দিনে বলে খরানের ঘর যাও।
অর্থঃ সকালে মেঘলা আকাশ দুপুরে প্রবল বাতাস খরার লক্ষণ।

চাঁদের সভায় বসে তারা, জল পড়ে মুষল ধারা।
অর্থঃ চন্দ্রসভার ভেতরে তারা দেখা গেলে মুষল ধারায় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

আগে পাছে ধনু চলে মীন অবধি তুলা
মকর মুম্ভ বিছা দিয়া কাল কাটায়ে গেলা।

অর্থঃ পৌষ মাসের ৩০ দিন কে ১২ ভাগে ভাগ করলে প্রতি ভাগে আড়াই দিন করে পরে। এর প্রথম ও শেষ সোয়া দিন পৌষের জন্য রেখে প্রথম সোয়া দিনের থেকে প্রতি আড়াই দিন ক্রমে মীন অর্থ্যাত চৈত্র মাস থেকে প্রতি মাসের জন্য গণনা করতে হবে। পৌষের এই ভাগ সমুহের ক্রমে যে আড়াই দিনে যেরুপ আবহাওয়া থাকবে সেই মাসেও তদ্রপ আবহাওয়া হবে।


হয়তো খনা কোন একক মহিয়সী নারী অথবা সকলের সম্মিলিত প্রয়াস বা সকলের অভিজ্ঞতার সম্মিলিত রুপই কালে কালে প্রকাশ পেয়েছে খনার বচন রুপে। হতে পারে যে কোন কিছুই কিন্তু খনার বচন নিঃসন্দেহে সেই অতীত কাল থেকেই আমাদের কৃষি ও প্রকৃতি নির্ভর জীবন ব্যবস্থাকে করেছে উন্নত থেকে উন্নত তর। দিয়েছে আমাদের ঐতিহ্য মন্ডিত সংস্কৃতির একটি ধারা। যা আমাদের চিন্তা চেতনাকে আজো প্রভাবিত করে। খনার বচনের মাধম্যে আমরা জানতে শিখি আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে আমাদের অতীতের গর্বভরা ইতিহাসকে।



(চলবে , , , , , , )

তৃতীয় পর্ব


খনা ও খনার বচন নিয়ে শায়মা আপুর একটি চমৎকার পোষ্ট-

চির রহস্যময় কিংবদন্তী-খনা!!!

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০৭
২৮টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×