somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পূর্ব বাংলার লাঠিয়ালদের কথা

২৮ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্ব বাংলার লাঠিয়ালদের কথা বর্ণনা করে কবি জসীম উদ্দিন তার সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে এক প্রাণময় বর্ণনা দিয়েছেন। সেখান থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি-

"মফিল ছেড়ে উঠল তেড়ে যতেক নওজোয়ান,
'আলী' 'আলী' শব্দ করি ভাঙিল আসমান।
লাগলো আগুন, জ্বলল দুগুন জগত-জোড়া শিখা,
কপালেতে পরছে যেন জাহান্নামের টিকা।
এলো কাজেম খুনী, শব্দ শুনি বন্দুকেরই গুলি,
আলীর নামে ডাক ছাড়িয়া মুখেই নিত তুলি।
এলো ছদন মাল, জুতীর কলে বিধত মাথার চামে,
সাত-আট দিন লড়াই করে গা নাহি তার ঘামে।
গদাই মাল দেয় ফাল আট কাঠা ভুঁই জুড়ে,
আকাশ ছিড়ে বিজলী ছোটে বর্শা যখন ছুড়ে।"

আমাদের শুনই গ্রামের মেঘারকান্দায় এই রকম দুই লাঠিয়াল ছিল।নাম আলু আর আছালত। সম্পর্কে, মামা-ফুপাতো ভাই। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে আলু-আছালত মেঘারকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। গ্রাম তখন ধন ধান্যে পরিপূর্ণ ছিল। পালাগান, জারিগান, যাত্রাগান, 'মাল-জোড়া', বাউলের গান, গাড়ু গান ও কবি গানে গ্রাম মুখরিত।
আলু-আছালত সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, মোহনগঞ্জ বাজারের গাড়ু গানের আসর হতে ‍"গাডু" ছেলেকে মাত্র দু'জনে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন। মোহনগঞ্জ বাজার ও আশপাশের শত শত জনতা তাদের ঘেরাও করে। এমনি অবস্থায় আলু-আছালত টেঙ্গাপাড়া গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শত শত লোক এ বাড়িকে ঘেরাও করে। তখন আলু-আছালত গৃহস্বামীকে বলে, ‌"আমরা ক্ষুধার্ত। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।" মালিক তৎক্ষণাৎ মুরগী রান্না করে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। জনতা বাড়ি ঘেরাও করে রাখে। খাবার শেষে আলু-আছালত মালিকের বাঁশঝাড় থেকে দুটি বৌরা বাঁশের লাঠি কেটে নিয়ে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, "আপনারা আমাদের বের হবার একটু রাস্তা দিন। আমরা আপনাদের গ্রাম থেকে পালাচ্ছি না। মাত্র দুজনকে তো আপনারা পিষে ফেলতে পারবেন।" জনতা একটু সরে দাঁড়ায়, ফাঁক পথে তারা বেরিয়ে আসে। আলু জনতার সামনে আলের মধ্যে এক প্রচণ্ড আঘাত করে। লাঠির আঘাতে মাটি গর্ত হয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। তাঁদের ভীম মূর্তি দর্শনে জনতা সরে যায়।
আলু-আছালতের এরকম ছিল পরাক্রম। মাত্র দু'জনে শত শত লোকের কবল থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে।
হিন্দুরা তখন মুসলমানদের নির্যাতন করত। আমাদের গ্রামের চাঁড়ালেরা মুসলমান বসতিতে অনেক নির্যাতন করত। কিন্তু আলু-আছালতের আবির্ভাবে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে নারী হরণ মামলায় আলু-আছালতকে আসামী করে দেয়। ফলে আলু-আছালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায়। মেঘারকান্দা গ্রামে আলু-আছালতের বংশধরেরা এখনো আছেন।



বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বকীয়তা রয়েছে তার বড় একটি প্রমাণ নাগরীপুঁথি সাহিত্য। কয়েকশ’ বছর আগে ভাষাটি সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও টিকে আছে তার কিছু ইতিহাস, দলিল বা পুঁথি। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কিছু অঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল। সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এ বর্ণমালাটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। চর্চা ও রক্ষণাক্ষেণের অভাবেই বলা চলে নাগরীলিপির উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে নানা মতপার্থক্য থাকলেও এটির সংরক্ষণ একটি সিদ্ধান্তে পৌছতে সাহায্য করবে। বিলুপ্তপ্রায় দুর্লভ এ লিপিসংবলিত কিছু পুঁথি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যা হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যের বিশাল একদিককে আবারও পাঠক আগ্রহী করে তুলতে পারে। আমার বাবা এইসব নাগরী পুঁথির খুব কদর করতেন, মানুষকে পড়ে শুনাতেন। কেতাব হালাতুন্নবী, আদি বড় জঙ্গনামা, ছহি বড় আছরার ছালাত, গাজী-কালু, সোনাভান বহুবার বাবাকে পড়তে দেখছি। আজ সেই হিরন্ময় দিন হারিয়ে গেছে। বাবার পুঁথির চিরচেনা সুর আমার কানে বাজে। বাবা নাগরী হালাতুন্নবী পড়ছেন- হজরতের মনাজাতের বএআন শোন ভায়েরা:

ক্ষআএশা বিবি রছুলকে কহে একবার।।
আহাদের জংগে চট লাগিছে আপনার*
দান্দান শহিদ কাফিরের রনে।।
এর বেশি ইজা নি পাইছ কুনু দিনে*
রছুলে জওআব দিলা শুন শমাচার ।
এক দিন জত দুখ হইছে আমার*
কাফিরের জমাওত পাইলু এক খানে।
জত নছিহত কৈলু না আশিল দিনে*
কুরান কালামে কিছু না হইল পিজির।
চারিদিক ঘিরি লৈলা তামাম কাফির*'

বাবা পরতেন আর অর্থ তরজমা করে বুঝিয়ে দিতেন।
জঙ্গনামা পুঁথির কথা বেশ মনে পড়ে। এই পুঁথিটা এতো বেশি পড়া হয়েছিল যে, পড়তে পড়তে পাতা ও সেলাই ছিড়ে গিয়েছিল। বাবা বাঁশের চটি দিয়ে সূঁতা পেচিয়ে সেলাই করেছিলেন সে পুঁথি। সে পুঁথির কয়েকটি লাইন শোনাই-
পয়ার*
শুনহ মোমেনগন আছ যত জন।
দুনিয়া হামেশা কার হইছে কখন*
আল্লা আল্লা বল ভাই ইয়াদ রাছুল।
মোহাম্মদী দীন ভাই বড়ই মাকুল*
এই যে দুনিয়া দেখ সব অকারণ।
দিন চারি ধুলা খেলা আখেরে মরন*
হোসাইনের বাবে রোজা রাখ দশদিন।
আল্লার নামেতে সবে করিরা একিন*
ইহার সওয়াব যত কেতাবে বয়ান।
কি লিখিতে পারি আমি হইয়া নাদান*
আল্লা সবে রাজি হবে রাসুল আমিন।
শাফায়াত পাইবেন যতেক মোমিন*


সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:০৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×