somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বাবা আমার শিক্ষক ,আমার বন্ধু, আমার আদর্শ

১৬ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাবা, ভীষ্মদেব হালদার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া থানাধীন বাঁশবাড়িয়া ঝনঝনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। ১৯৭০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বাড়িতে যখন অলস সময় পার করছিলেন তখন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধ্যেয় লায়েক আলী তালুকদার সাহেব বাড়িতে এসে ডেকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষক পদে বসিয়ে দিলেন। যে গুরু দায়িত্ব তিনি সেদিন মাথায় দিয়ে দিলেন তা উপেক্ষা করার সুযোগ আর বাবার হয়নি। এই শিক্ষকতার মাঝে থেকেই পরবর্তী পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছেন। ২০১১ সালে বাবা অবসর গ্রহন করেন। কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪১ বৎসর একই বিদ্যালয়ে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাটিয়েছেন। এর মাঝে বিভিন্ন জায়গায় অধিকতর ভালো সুযোগ পাওয়া সত্বেও তা গ্রহন করতে পারেননি । সমাজসেবার নেশা আর এলাকার জনগনের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখতে পারেননি। তবে দুঃখের বিষয়, যে মহান ব্যক্তি বাবাকে খুঁজে বের করে যোগ্য মনে করে মহান দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই লোকটি দেখে যেতে পারেননি যে তাঁর প্রিয় পাত্র কতটা সফলতার সাথে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন। এর অনেক পূর্বেই তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। দেশে বিদেশে বাবার অনেক ছাত্র-ছাত্রী আজ নিজ নিজ অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে যারা আজ আমার এ লেখা পড়ছেন নিশ্চয় কিছুটা হলেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন, কেউবা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন আপনাদের প্রিয় শিক্ষকের কথা স্মরণ করে। আপনাদের সবার কাছে হয়তো তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। ব্যাক্তি হিসেবেও হয়তো তিনি অনেকেরই আদর্শ। তবে আমার কাছে আমার বাবা একটু বেশি কিছু। আজ (১৬ জুন) বাবা দিবসে সেই বেশি কিছুর সামান্য কিছু সবার সাথে শেয়ার করছি। যারা বাবাকে চেনেন তাঁরা খুব ভালো করেই বুঝবেন যে নিজের বাবা বলে একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বাবার সবথেকে বড় গুন, ছেলে বুড়ো সবার সাথে সমান ভাবে মিশতে পারেন। সকল শ্রেনীর মানুষের সাথে তাঁর সমান সখ্য। তাই এলাকার সবার কাছেই তিনি এক অতি প্রিয় মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় দিক হল, যেখানে যেমনটা প্রয়োজন সেখানে ঠিক সেই মেজাজটা নিতে পারেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা সত্যি অসাধারন।
একবার খাবারে বিষক্রিয়ার ফলে বাবাকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো কয়েকদিন। সেই অচেতন অবস্থায়ও বাবা বিদ্যালয়ের কর্মচারীর নাম ধরে বলেছেন “ আলমগীর, সব ক্লাশে শিক্ষকরা গেছেন তো? আগামী কাল ম্যানেজিং কমিটির মিটিং, সব চিঠি ঠিকমতো পৌঁছানো হয়েছে তো? এমন আরো অনেক কথা। বাবার ওই অবস্থা দেখে সকলে তখন বলেছিলেন, বিদ্যালয় ছাড়া ভীষ্ম বাবুর মাথায় বোধ হয় আর কিছুই নেই। আসলেই তাই, কর্তব্যের ক্ষেত্রে বাবা এতটাই নিষ্ঠাবান ।
আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র বাবা তখন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। পড়ালেখায় যতোটা ভালো ছিলাম তার চেয়ে ঢের ভালো ছিলাম দুষ্টুমিতে। তবে ক্লাশের ফার্স্ট বয় হওয়ায় না কি বাবার ছেলে হওয়ার জন্য জানিনা , আমার দুষ্টুমি সবার সয়ে যেতো। সহজে কেউ অভিযোগ করত না। কিন্তু একদিন কি জানি কি হল, খুব সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে আমার বিরুদ্ধে নালিশ গেলো। সাথে অভিযুক্তের তালিকায় যুক্ত হল আমার ক্লাসমেট, প্রিয় বন্ধু, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা লায়েক আলী তালুকদার সাহেবের ছোট ভাইয়ের ছেলে মুরাদের নাম। আমি একটু অবাকই হলাম ,যা হয়েছে তাতে করে নালিশ করার কথা নয়। বিশেষ করে আমার ক্লাশের মেয়েরা আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবে এ যেন আমার ভাবনার বাইরে। তাও আবার নালিশকারী দলের নেতৃত্বে ছিল সেলিনা, যার মাথায় একদিন আমি বালু দিয়ে ভরে দেওয়া সত্বেও নালিশ করেনি। ওদের কাছে আমার সাত খুন মাফ ছিল। আমার দুষ্টুমিই যেন ওদের কাছে স্বাভাবিক। অথচ ঐদিন কি যে হল! ভেবেছিলাম প্রধান শিক্ষক ভক্তদাস বরের হাতে কয়েকটি পিটুনি খেয়ে রেহাই পাবো। কিন্তু শনির দশাচক্রে, পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। আলমগীর কাকা (বিদ্যালয়ের কর্মচারী) এসে বললেন, “ ভীষ্ম স্যার তোমাদের দুজনকে ডাকছেন”। আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম। বাবা আমার গায়ে শেষ কবে হাত তুলেছেন তা মনে নেই, ভয়টা আমার সেখানেই। মাঝে মাঝে মার খাওয়ার অভ্যেসটা থাকলে এতোটা ভয় হতনা। জানিনা কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, ভয়ে ভয়ে আমি মুরাদের পেছন পেছন সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করলাম। বাবার চোখ মুখের অভিব্যাক্তি দেখে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হলাম যে ভীষ্ম বাবু আমার বাবা। তখন আমার শুধু মনে হচ্ছিলো আমি এলাকার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদর্শ সহকারী প্রধান শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে। মুরাদকে মরহুম প্রতিষ্ঠাতার ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, “এই কে, চিনিস?” মুরাদ কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো, “চাচা”। এর পর শুধু বললেন, “ তুই এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার ভাইপো ” আর আমাকে বললেন, “ তুই হচ্ছিস বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের ছেলে, তোদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আসে, তোরা যদি বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিস তাহলে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কে? ” বলেই মুরাদকে প্রথমে কয়েকটি বেত্রাঘাত করে ছেড়ে দিলেন। এরপর আমার উপর চলল সপাং সপাং বেত্রাঘাত । কতগুলো আঘাত গায়ে লেগেছিল তা আমার মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। কেননা ততক্ষনে আমি অসার হয়ে গেছি, বেতের আঘাত আমার গায়ে তখন আর লাগছিলো না, আমার কানে এবং মনে তখন শুধু বাজছে “তোরা যদি বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিস তাহলে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কে?” বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল এসে গেলো। অবশ্য একটু রাগও হচ্ছিলো এই ভেবে যে আমাকে জিগ্যেস করে সত্যটা জানলে বাবা বুঝতে পারতেন যে ঐ ব্যাপারে আমি প্রকৃত দোষী ছিলাম না। মনে খুব আঘাত লাগলো, সিদ্ধান্ত নিলাম আর কখনো ক্লাশে দুষ্টুমি করবোনা । এমনকি ঐ মেয়েদের সাথে আর কখনো কথাও বলব না। বাড়িতে ফিরে ঐদিন বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন এবং জিগ্যেস করলেন, “ কি ঘটনা ঘটেছিলো এখন বল তো। ” আমি আবেগ সামলে রাখতে পারিনি সেদিন, চোখের জল ছেড়ে দিয়ে কতক্ষন শুধু কেঁদেছিলাম, তারপর সব বলেছিলাম। সব শুনে বাবা আমায় স্বান্তনা দিয়ে, আদর করে অনেক কিছু বোঝালেন। সেদিন উপলব্ধি করলাম, বাবা বাড়িতে আমার বাবা কিন্তু বিদ্যালয়ে আমার আদর্শ শিক্ষক। ঐ দিনের পর থেকে দুষ্টুমি ছেড়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হলাম। ১৯৯৭ সালে এস এস সি পরীক্ষায় ৮০৯ নম্বর পেয়ে টুঙ্গিপাড়া কেন্দ্রে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। এর দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত সেলিনার সাথে কথা বলা হয়নি। ২০০৯ সালের কোন একদিন অপরিচিত এক নম্বর থেকে কল এলো। রিসিভ করার সাথে সাথে একটা মেয়ে কণ্ঠ, “বিপ্লব, আমি সেলিনা। স্যারের কাছ থেকে তোর নম্বরটা পেলাম। কেমন আছিস?” আমি কিছুক্ষণের জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম, ১৪ বৎসর পর এক ক্লাসমেটের সাথে কথা! পুরনো সেই দিনগুলো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠলো। সেলিনার কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। সেলিনা, তুই ঐদিন বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ না করলে বাবাকে হয়তো আমার পুরোপুরি চেনা হত না, হয়তো এস এস সি পরীক্ষায় এত ভাল ফল ও করা হতনা।
কর্মক্ষেত্রে আমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এক ব্যাংকের প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের সূচনা লগ্নে যে স্থানে আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি তা সম্পূর্ণরূপে আমার বাবার অবদান। আমার বাবা আমাকে কোনদিন কিছুতে না করেননি। শুধু বলেছেন, “ যা কিছু করবে দেখো যেন কিছুতে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়।” বাবার কাছেই পেয়েছি ভালোর মাঝে থেকে ভালটুকু গ্রহন করার আর মন্দের মাঝে থেকেও নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার শিক্ষা। আজও যে কোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমার বাবাই আমার প্রধান উপদেষ্টা। ঈশ্বরের কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ এমন এক বাবার সন্তান করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য। সারাদিন সারারাতও যদি বাবকে নিয়ে লিখি তাও শেষ হবেনা। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলি, আমার বাবা আমার শিক্ষক ,আমার বন্ধু, আমার দেবতা, আমার আদর্শ। সবার প্রিয় এই মানুষটির সুদীর্ঘ সুস্থ জীবন কামনায় আপনারা সবাই শুভ কামনা করবেন আর আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন যেন বাবার মুখের অকৃত্রিম মিষ্টি হাসিটা সারা জীবন অটুট রাখতে পারি।
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×