somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পূরোনো সেই দিনের কথা, ভুলবি কি রে হায়-২

২২ শে আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমাদের ছেলেবেলার চিত্ত বিনোদনের প্রধান আকর্ষন ছিল বিভিন্ন এলাকাতে যে “ফাংশান” বা বিচিত্রা অনুষ্ঠান হতো সে গুলো, তা কখনো কলোনীর ভেতর, কখনও বা বৃটিশ কাউন্সিল বা ততকালীন ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিট্যুটে!

গুরুজন দের সাথে আমরা দেখতে যেতাম তা কালে ভদ্রে! মাঝে মধ্যে সার্কাস আর একজিবিশন হতো, আমরা বায় না ধরতাম সে গুলোও দেখতে, তবে খুব কমই সুযোগ মিলতো! ফুটবল খেলা খুবই জনপ্রিয় ছিল, ঢাকা মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ইপিআইডিসি, ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কেপিটি, ওয়েষ্টার্ন রেইলওয়ে ইত্যাদি খুব বিখ্যাত টিম ছিল! আগাখান গোল্ডকাপের খেলা দেখতে আমরা বড়দের সাথে স্টেডিয়ামে যাবার জন্যে বায়না করতাম, যদিও ফল খুব একটা হতো না!

পিডব্লিউডি নামেও একটা মাঝারি মানের টিম ছিল, তারা মতিঝিল কলোনীর ক্যান্টিনে বসবাস করতেন ফুটবলের সিজনে! সেই ক্যান্টিনটিই এখন অতি বিখ্যাত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ! আমাদের দোতলাতে পিডব্লিউডির অ্যাকাউন্টেন্ট প্রয়াত জনাব আজিজুল হক সাহেব ও তার পরিবারের সদস্যরা থাকতেন, মূলতঃ তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়, এ কাহিনী আজ অনেকেই হয়তো জানেন না!

তিনিই ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে নোয়াখালির থেকে একজন জনাব ফয়জুর রহমান নামে শিক্ষককে নিয়ে আসেন, পরবর্তী সময়ে বহু বছর ধরে যিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন! এর আগে আমরা ভাইবোনদের মধ্যে যারা বড়, তারা সবাই ততকালীন পুর্ব পাকিস্তানে একমাত্র সেন্ট্রাল গভরমেন্ট এর স্কুল, ততকালীন অতি বিখ্যাত ও কুলীন সেন্ট্রাল গভরমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি!ততকালীন উচ্চ পদস্থ আমলা ও ততকালীন পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের ছেলে আমাদের স্কুলে পড়তেন, স্কুলটি বিরাট কম্পাউন্ডে বালক ও বালিকা শাখা নিয়ে স্থাপিত ছিল!

পরবর্তীতে আমার ছোট ভাই, প্রয়াত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার ও ছোটো বোন, যে এখন ডাক্তার, তারা আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র! এই সফল উদ্যোগে অনেক সময় কলোনীর গ্রাজুয়েট ও মাস্টার ডিগ্রি পাশ করা অধিবাসীরা এক রকম নাম কা ওয়াস্তে বেতন নিয়ে ছাত্রদের পাঠদান করেছেন! তাদের সেই ত্যাগী মিশন যে ব্যর্থ হয় নি, তার প্রমান এই আইডিয়াল স্কুল!

আরামবাগ একটি মুলতঃ ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের বাস স্থান ছিল, পেছনে ছিল বিরাট ঝিল। আমরা পায়ে হেটে সেই ঝিলের সাঁকো পার হয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম! নটরডেম কলেজটি ছিল সবূজ বেস্টনীতে মনোহর, ইডেন হোটেল আর আল হেলাল হোটেল ছাড়া ওই এলাকায় আর কোন হোটেল ছিল না!

ইডেন হোটেলের সামনে নটরডেম কলেজের সাথে রাস্তাতে একটি বড় কাল্ভার্ট ছিল, বর্ষাকালে আমি বন্ধুদের নিয়ে বড়ঁশী দিয়ে সেখানে আর ইডেন হোটেলের পেছনে বিশাল ঝিলে মাছ ধরতে যেতাম! আরামবাগে ঢোকার রাস্তার পরে একটা বড় তাল গাছ ছিল, নীচে ছাপড়াতে একটি রেস্টুরেন্ট জাতীয় স্থাপনা ছিল!

সেখানে তখন দেড় টাকা সের হিসেবে খুব ভাল জিলিপি পাওয়া যেত, স্টেডিয়ামের ইসলামিয়া হোটেলে দশ আনায় পাওয়া যেত অপুর্ব মোগলাই পরোটা! তখন বাইরের বই (মানে পাঠ্য সূচির বই না) পড়ার জন্যে পাওয়া বেশ দুরুহ ছিল, স্কুলের একটা লাইব্রেরী ছিল বটে, কিন্তু তাতে আমার পড়ার ক্ষুধা মিটতো না, খাতির পাতানোর চেস্টা করতাম যাদের বাড়িতে বেশী বই পত্র ছিল তাদের সাথে! লেখা পড়ায় কিছুটা “ভাল” থাকায়, সেটা সম্ভব হয়েছিল, আর সেই ভাবেই পড়েছি ঠাকুরমার ঝুলি, দেব সাহিত্য কুটিরের পূজা সংকলন উত্তরায়ন সহ বিশেষ করে নীহারঞ্জন গুপ্তের বইগুলো, ইত্তেফাকে তখন রোববারে ছোটোদের পাতায় বেরুতো সুলেখক এখলাসউদ্দিন সাহেবের “এক যে ছিল নেংটি ইদুর” ধারাবাহিক ভাবে! একই ভাবে পড়েছি ভিক্টর হূগোর “লা মিজারেবল” ও আরো অনেক লেখা খবরের কাগজে! তাতেও আমার হতো না, তাই পাকিস্তান কাউন্সিলের সামনে গিয়ে বাইরের শো রুমের বইগুলোর দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম! পাকিস্তান কাউন্সিল ছিল তখন মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকার এখন যে খানে মেট্রোপলিটান চেম্বার ভবন! আমি হেঁটে হেঁটে মতিঝিল কলোনী থেকে স্টেট ব্যাঙ্ক কলোনী পার হয়ে ইডেন কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে সেখানে যেতাম!

বাবা মোটামুটি একটা সরকারী চাকরী করতেন, কিন্তু বই কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না! এভাবেই আমি ক্লাস সিক্সের মধ্যেই পড়ে ফেলি বিমল মিত্রের “কড়ি দিয়ে কিনলাম”, ত্রৈলক্যনাথের অতি বিখ্যাত “কঙ্কাবতী” ও অন্যান্য বই, উভয় বাংলার বিভিন্ন লেখকদের বই, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, শরতচন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত তো আছেনই, স্মরনীয় হয়ে আছে তারাশঙ্করের “পঞ্চগ্রাম” আর “গণদেবতা” ইত্যাদি! ওদিকে ততকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন এর প্রগতি প্রকাশনের থেকে বেরুনো থেকে ননী ভৌমিকের সরস বাংলা অনুবাদে পড়ে চললাম রুশ দেশের অমৃতক্ষরা গল্প আর কালজয়ী উপন্যাস সমুহ, ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামের কল্যানে পাওয়া আমেরিকার অ্যাডগার আলেন পো সহ অন্যদের অতূলনীয় সৃষ্টির অনুবাদ সমুহও পড়তে ছাড়লাম না!
১৯৬৯ আর ৭১ এই ভেতরকার সময়ে প্রকট হয়ে ওঠেন জীবনানন্দ আর সুকান্ত, সাথে অন্যেরাও কি বিপুল বিক্রমে আমাদের স্বত্তায়! কিন্তু সবার ভেতরে সবচে আমাকে সহ বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে উজ্জীবিত করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনী ও মাসুদ রানা আর কুয়াশা! এই পড়া আর সাংস্কৃতিক চর্চাই আমাদের জেনারেশন কে নিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তাক্ত কিন্তু স্বর্ণালী অধ্যায়ে বলেই আমার বিশ্বাস! অনেকে আমার এই বখে যাওয়া ধরনের আচরনে দুঃখ পেতে থাকলেন যে এতে করে আমি নিজের লেখাপড়ার বারোটা বাজাবো! হয়তো তাইই ঘটেছে আমার কপালে, কিন্তু দুরূহ মেডিকেল আর পিএইচডির সময় আমার সেই বখে যাওয়া পড়াশোনায় যে বেশ উপকৃত হয়েছি তা নিঃসন্দেহে আজ বলতে পারি!

পাকিস্তানী আমলে আমাদের ওই সময়টিতে জন্মদিন পালন করার কথা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে কখনও চিন্তা করে নি কেউ, কায়ক্লেশে তারিখটা মনে রাখতে হয়েছে শুধু পড়াশোনা আর জীবিকার জন্যে বিভিন্ন সময়ে তা উল্লেখ করতে হয় বলে আর বিয়ের পরে স্ত্রী ও দু’মেয়ের কল্যানে!

তবু প্রায় যুদ্ধ, কস্ট করে সেই পড়ার ভেতর যে কি আনন্দ ছিল তা আজকের ছেলে মেয়েদের বোঝানো যাবে না জানি! আমি এবং আমার উচ্চশিক্ষিতা চিকিতসক স্ত্রী, দু জনেই মাঝে মাঝেই ভাবি এই সব, সাথে এও ভাবি যে এখনকার ছেলে মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বিশাল পরিমান বিষয়ে পাখী পড়ানোর চেষ্টা করা হয়, তাতে তাদেরই বা সৃজনশীলতা কি ভাবে পুষ্পিত হয়ে উঠতে পারে!

হায়, জীবন, বহতা নদীর মতো তুমি বয়ে যাও, আর কোন দিন ফিরে একটি বারের জন্যেও দেখাও না সেই সুদূর অতীতের শীত সকালের ঘাসে ঘাসে মুক্তো টলমল শিশির বিন্দুটিকে!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×