somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেদীপ্যমান শামসুর রাহমান

১৭ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক.
সেই শিউলিকুড়ানো কালে অথবা ছিন্নসূতো ঘুড়ির পেছনে ধাবমান শৈশবে দূর থেকে কবিকে দেখেছিলাম। পক্ককেশভর্তি মাথা, সোনালি ত্বকের আভাজড়ানো অবয়ব আর নুয়ে থাকা লতার মতো আনত নম্র স্বভাবের কোনো এক দেবদূত যেন বা। তখনই গেঁথে গিয়েছিল বুকের গহনে অমোচনীয় অভিজ্ঞান হয়ে কবির কাঠামো। তারপর সময় গিয়েছে গড়িয়ে, কখনো লোকাল, কখনো অবিরাম ছুটে চলা মেইল ট্রেনের গতিতে। আত্মযাপনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বুঝে উঠবার চেষ্টা ছিল, কীভাবে জীবনের বাঁকবদলটুকু ঘটে যায়। প্রাত্যহিকতা কারই বা মনে থাকে, কে ই বা হৃদয় তোরঙ্গে সযতনে তুলে রাখে বয়সবাড়ানো অর্থহীন দিনগুলোর খুঁনসুটি! গান শিখতে চেয়ে কায়দা-সিপারার প্যাঁচানো বর্ণগুলোয় আটকে গেলেও আঁখিতারায় উন্মীলিত সর্বক্ষণ দুঃখিনী বর্ণমালাগুলো সুর হয়ে ভাসতে চেয়েছে বৈকী। আমারই মনের অব্যক্ত ক্ষোভ সেই কবির হাত গলে কত সহজে-সরলে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে স্থিত হয়েছে। ছোট নদীর বাঁকে বাঁকে চলা দেখতে দেখতে সদ্যকৈশোরের দুরন্ত ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে গেলে খানিক বেয়াড়া। ঠোঁটের ওপর সরু লোমের আভাস, কণ্ঠ বসে গিয়ে চোখে বেপরোয়ার দ্যুতি। আসরে আসরে উড়িয়ে দিই গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবী কিংবা সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট। কেন বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠা দীর্ঘশ্বাস, কেনই বা মধ্যবিত্ত গণ্ডি পেরুতে চেয়ে হ্যাচকা টানে পেছন ফেরা, সেই রহস্যপুরাণ জানা হয় তো হয় না। শুধু আমাদের বিভক্তিগুলো বেড়ে যায়, ক্ষতেরা অনুঘটক পেয়ে পেয়ে বর্ধিষ্ণু। রক্তস্রোতা নদী পাড়ি দিয়েও তো এড়ানো যায় নি, তীক্ষè দন্ত আর বিষাক্ত নখরের আঁচড়। কার ভুলে কিংবা উদাসীনতায় অদ্ভুত উটের পিঠে উঠে গেল স্বদেশ। অপরিপক্ক মানসে খুঁজে ফেরা শুধু, আর তলিয়ে যাওয়া হতাশায় ভাবি তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন? পিতামহ দেখেছেন, পিতার লড়াইয়ে অর্জিত কায়াহীন অনুভবের মন্ত্র ‘স্বাধীনতা’ সেও তো বারবার স্বার্থের মোহে হয়েছে ন্যুব্জ। কিন্তু তাই বলে সময় নেয় নি বিরতি। পথ যায় নি শেষ হয়ে। গন্তব্যও তো ছিল না অজানা। বিরুদ্ধ সময় পাড়ি দেওয়ার গুপ্তকৌশল জানিয়েছেন কবি, যদি দিতে চাও তুমি সভ্যতার বিশুদ্ধ প্রমাণ, তবে সুনিশ্চিত তোমাকে যেতেই হবে দাউ দাউ আগুনের মধ্য দিয়ে আর অলৌকিক নগ্ন পায়ে হেঁটে সাবলীল পাড়ি দিতে হবে খরনদী। বুঝতে শিখেছি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুল, সৃষ্টিসুখের উল্লাস। দেখেছি শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্র“য়ারির উজ্জ্বল সভা। এসব আমাদের গহীন অন্ধকালে জেগে থাকা বাতিঘর। সেই বাতিঘরে প্রতিনিয়ত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন যিনি, তিনি কবি। আমাদের শৈশবউত্তীর্ণ কৈশোর আর তারও পরে সাহসী তারুণ্যে আমাদের মননে সংগ্রামক্ষুব্ধ লড়াকু ইতিহাসের পাঠ শৈল্পিক বিন্যাসে গুঁজে দিয়েছিলেন, মাথায় বাতাসার পেখম মেলে কবি শামসুর রাহমান।




দুই.
মানুষের জীবনে কবিতার প্রয়োজন কি? কতিপয় বিন্যস্ত শব্দের গাঁথুনিতে এমন কি থাকে যা অনিবার্য হয়ে ওঠে যাপিতকাল জুড়ে? যে মোহময় স্রষ্টার নিরন্তর খননের মধ্যদিয়ে ফুটে ওঠে প্রতীকের চিত্রকুসুম তার গন্তব্য আসলে কোথায়! উচ্চারিত এইসব প্রশ্নসকল নতুন কিছু নয়। কবি ও কবিকে বরাবরই মানুষের স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বিশেষ করে শাসকচক্র খুব আপন করে নেয় নি কখনো। আর তাই গ্রিক নগররাষ্ট্রের পরিকল্পনায় প্রখ্যাত দার্শনিকের প্রস্তাবনাতেও কবির ঠাঁই মেলে নি। স্বার্থান্ধ মানুষের গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্রতার বলি হয়েছে কবিতার অসণিত বরপুত্র। তবু কবির কবিতা চিরকালই আপামর মানুষকে প্রণোদিত করেছে, কি লড়াইয়ে অথবা আত্মিক শান্তির পথে। শুধু কায়িকশ্রমে গড়ে ওঠা সভ্যতা আর উৎপাদন যান্ত্রিক বৈকল্যে পতিত হতে বাধ্য যদি না তাতে থাকে সংস্কৃতির পাঠ। সেই পাঠ শিল্পের বর্ণিল বৈচিত্র্যের পাখায় ভর দিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন কবি। সম্মুখ সমরে অস্ত্রই হয় লড়াইয়ের উপাদান অথচ মনোবল যা ফলের নিয়ন্তা সেটুকুর জন্য কবির কাছেই তো হাত পাতে যোদ্ধা। জাতি হিসেবে নিজস্বতার যে বৃহত্তর অহং তারও অভিজ্ঞান নির্মিত হয় কবির করতলে। ফলে সভ্যতার গোড়াপত্তন বলি আর অগ্রসরমানতা, এসবকিছুতেই শিল্পী তথা কবির রয়েছে অমোচনীয় ভূমিকা।
কেউ কেন আর কীভাবেই বা কবি হয়ে ওঠেন সেই ব্যাকরণ জানা নেই। এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনার ফিউশন প্রতিনিয়ত কোনো কোনো মানুষকে কবি করে তোলে। এ কথা আজ অথবা আগামীর জন্য সমান সত্য। কবি সত্যের ততোধিক সত্যদ্রষ্টা বলে বস্তুজগতের সবকিছু সবসময় তাকে বোধগম্যতার পরিধিতে এঁটে উঠতে পারে না। এ কারণে কবিকে কখনো কখনো মানুষের ভুল পাঠের শিকার হতে হয়। শামসুর রাহমান এই সত্য জানতেন। তিনি জানতেন, কবি তার বেদনাকে হন্তারকের ছুরিতে পরিণত করেন না, শুধু ব্রাহ্মাণ্ডের অসীম বিস্তারে ছড়িয়ে দেন নিজের ক্রন্দন। তিনি জানতেন অনেক কোলাহলে থেকে একলা হয়ে যাওয়ার কৌশল। তাই বলতেন, কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি তার নিঃসঙ্গতা কফিনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে ফুটপাতে একা। আর আমি বলি-

বেদনার নাম জপে
কবি হয় পীর,
কবিতাতো শোকভূক
আলোর শরীর।



তিন.
বাংলা ভাষার অনিবার্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অলৌকিক প্রভাববলয়ের বাইরে পৃথক কণ্ঠস্বরের অঙ্গীকার নিয়ে স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছেন বিগত শতকের ত্রিশের দশকের পাঁচ কবি। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের অমৃত ভাষা মাধুর্যের পর বাংলা কবিতায় স্পষ্ট বাঁক বদলের নিশানা দেওয়া কঠিন কর্মই ছিল বটে। কিন্তু সে তো কবিতার আঙ্গিক আর কাব্য ভাষার মধ্যকার উচ্চমার্গীয় লড়াই। এনসব দোলাচলে সাধারণ মধ্যবিত্তের আবেগ নিজ করোটিতে ধারণ করে তাকে শৈল্পিক সুষমা দিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। বাংলা ভাষা আর বাঙালির চূড়ান্ত লড়াইয়ের পরম্পরাটুকু আত্মঅধিকারে নিয়ে আপামরের হয়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন তিনি। এ কারণেই তিনি বিশেষভাবে পৃথক অন্য অনেক কবি থেকেই। এ স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের প্রতিটি বাঁক শামসুর রাহমানকে এড়িয়ে সম্মুখবর্তী হবে না কোন দিন। কেননা এর সবকিছুতেই তিনি মিশে আছেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। আমাদের বিভাজনের নানাসূত্রভরা ইতিহাস লুপ্ত করে দিলে শামসুর রাহমানের কবিতা পরম্পরাতেই সোনালী রোদনভরা দিনগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে নিশ্চিত। কেননা তিনি আর ইতিহাস সতত আগামীর পানে ধাবমান। তিনি ছিলেন ভবিষ্যতের হাত ধরে, তাই তাকে বয়ে নেবে কাল থেকে কালান্তরে।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×