somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...বলতে বলতে কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন জয়নগরের বাড়িতেই গেলেন।। রেজা ঘটক

১৭ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন শেষ পর্যন্ত জামালপুরের শরিষাবাড়ির জয়নগরের বাড়িতেই চলে গেলেন। পেছনে রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি। প্রতি বছর বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বই মেলায় যে মানুষটির সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা হতো, তিনি ছিলেন কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন। আমি ডাকতাম খন্দকার ভাই। সম্ভবতঃ ২০০১/২ সালের দিকে বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা মোবারক হোসেন (কবি সাজ্জাদ আরেফিন) ভাইয়ের রুমে আমি আর কবি খায়রুল আলম সবুজ বসে আড্ডা দিচ্ছিলুম। আমরা সিগারেট ফুকছিলুম আর মেলার ধুলা নিয়ে ক্ষোভ ঝারছিলুম। তখন ওই রুমে প্রবেশ করলেন কাজী নজরুলের মতো ঝাকরা চুলের এক আধুনিক বাউল। সবুজ ভাই আর খন্দকার ভাই কুশল বিনিময় করলেন। আর মোবারক ভাই আমার সঙ্গে খন্দকার ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুনলাম, খন্দকার ভাই হুমায়ুন আজাদ স্যারের ডিপার্টমেন্টে ইংরেজি পড়ান। আমি একটু বিব্রত ছিলুম, স্যার বলবো নাকি ভাই বলবো? খন্দকার ভাইরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার তো আমি ছাত্র না, সো সিগারেট কিন্তু ফেলতে পারছি না। খন্দকার ভাই ভরাট গলায় এমুন একটা হাসি দিলেন, তখন থেকেই বুঝলুম, মানুষটা রসিক বটে।
তারপর সবুজ ভাই, খন্দকার ভাই আর আমি একসঙ্গে কেওড়াতলায় আসলুম। 'একবিংশ'-এর অনেক পুরানো সংখ্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলুম। আমি পড়ছিলুম টোকন ঠাকুরের সাত দিনের নামে সাতটি চমৎকার সনেট। সবুজ ভাই আমাকে ধমক দিলেন, তুই আমার কবিতা না পড়েই টোকনের কবিতা পড়া শুরু করলি? দে, আমার সিগারেট ফেরত দে? জবাবে বললুম, সবুজ ভাই, আপনার কবিতা তো বড়োরা পড়ে। আমরা লিলিপুটরা কি কবিতা বুঝি? একবিংশের সামনে আমাদের আড্ডা তখন জমে উঠেছে। আড্ডায় এসে যোগ দিল আমার কবি বন্ধু আলফ্রেড খোকন। খোকন তখন রোদ্দুর নিয়ে খুব মাতামাতি করছিল। রোদ্দুর নিয়ে খোকনের অনেক কবিতা হয় আমাকে খোকনের মুখে শুনতে হয়েছে, নতুবা পড়তে হয়েছে। আমরা আড্ডার এক ফাঁকে খোকন আর আমি মেলা ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লুম।
তারপর প্রায় প্রতি বছরই খন্দকার ভাইয়ের সঙ্গে বই মেলায় আড্ডা মেরেছি। এভাবে ধীরে ধীরে কবি খন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে আমার আন্তরিকতার শুরু। অমায়িক ভদ্রলোক বলতে যা বুঝায় এক কথায় খন্দকার ভাই তাই ছিলেন। দাম্ভিকতা একদম ছিল না। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বুনো বলেশ্বরী'র প্রথম ক্রেতা ছিলেন খন্দকার ভাই। আলফ্রেড খোকন ছিল দ্বিতীয় ক্রেতা আর আমাদের বন্ধু সাংবাদিক নজরুল কবির ছিল তৃতীয় ক্রেতা। খোকন আমার বইয়ের প্রথম ক্রেতা হতে না পারার দুঃখে সেদিন আমাকে কড়া ধমক দিয়েছিল। প্রতি বছরই আমার মনে হত এবার কবিতায় বা প্রবন্ধে বা অনুবাদে কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন বাংলা একাডেমী পরুষ্কার পাচ্ছেন। এই পারপাস অ্যাডভান্স আমরা চা খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার ধারণা পাল্টে দিয়ে রাম শ্যাম যদু মধুরা বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পেয়েছেন। খন্দকার ভাই পেলেন না। বাংলা একাডেমী পুরষ্কার নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছিলুম একাডেমী'র মোবারক ভাইয়ের রুমে। হঠাৎ সেখানে অরুনাভ সরকার দাদা ঢুকলেন। দাদা সেবার বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পান। দাদাকে বললুম, একটা দুইটা ছাড়া বাংলা একাডেমী'র অধিকাংশ পুরষ্কার যায় তোষামোদীদের কপালে, ব্যাপার কি দাদা? জবাবে অরুনাভ সরকার দাদা বলেছিলেন, আমারে তুমি কোন দলে রাখলা? কইলাম, আপনি দাদা সেইভ সাইডে পড়েছেন। আমি আপনার গল্পের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। টোকন ঠাকুরের কাছে আপনার ধানমণ্ডির ১৯-এর অনেক গল্প শুনেছি।
আজ বড় আফছোস লাগছে, কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার না পেয়েই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। গতকাল হঠাৎ তাঁর স্থায়ীভাবে বাড়ি যাবার কথা মনে হল। মনে পড়ল তার সেই বাড়ি যাবার কবিতা-

''বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...
পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি...

বৈশাখের বটবৃক্ষ তালুতে কপোল রেখে বলে, 'হায়,
এ ছেলেকে কিছুতেই ফিরতে দেয়া চলবে না'; নগরীর পথ,
দালানের পরভৃত কোকিলের পঞ্চস্বর ডেকে বলে, শোন
তোর কোনো বাড়ি নেই,
অন্তরঙ্গ উচ্চারণে যাকে বলে হোম
সুইট হোম - সে আজ ভেসে গেছে বিস্মৃতির যমুনার জলে।

তোমার আসার জন্য কেউ নেই হাট করে ঘরের দরোজা,
পলাতক সময়ের ঝুঁটিবাঁধা কাকাতুয়া
দাঁড় ছেড়ে পালিয়েছে সেই কবে; ঘাটলার কাঠগুলো
কবে কোন চোর
নিয়ে গেছে অন্তপুরে চুলোর হৃদয় জুড়ে শান্তি দেবে বলে।

তবু বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি....
পথ ছাড়ো সুসময়, প্রতিশ্রুত সুখনিদ্রা, নিমগ্ন বালিশ,
পথ ছাড়ো জীবনযাপন ব্যথা, পথ করে দাও।

আজ যাবো
ঝিনাই নদীর জল হাঁটুতে কাপড় তুলে পার হবো,
মধ্যরাতে ডাক দেবো
মা মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে
তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন
তুলোধুনো করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি।

আমার কিছুই হলো না মা, লোকে বলে আমি ভীষণ নারাজ
জীবনের তপ্ত গালে চুমু খেতে,
আমি ভীতু, জীবনের দ্রুতগাড়ি বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে কেন থামাতে পারি না,
হিচহাইকিঙ করে কত লোক চলে গেলো দূরতম গন্তব্যে, তবুও
আমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছি,
বাসভাড়া হয়েছে লোপাট অন্য কারো কলাবতী আঙ্গুলের হাতে
তবু আমি বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো, বাড়ি
এ বিশাল পৃথিবীতে এ মুহূর্তে অন্য কোনো গন্তব্য তো নেই!

পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বরে দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি..''

বাংলা একাডেমী অনেক আকাম করেছে। গত বছর প্রথম আলো ডেইলি স্টারের তোষামোদী রোষে 'হে ফেস্টিভাল'-এর নামকা ওয়াস্থে আয়োজক হয়েছিল। তখন 'হে ফেস্টিভাল' নিয়ে আমরা যারা বিরুদ্ধাচারণ করেছিলাম, বাংলা একাডেমী তাদের জামায়াত পন্থী বলে গালি দিয়েছিল। কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন তখন আমাদের দলেই ছিলেন। আমার অনেক লেখায় তখন খন্দকার ভাই কমেন্ট করেছিলেন নিঃস্কোচে। অনেক লেখক কবি বন্ধুরা তখন বাংলা একাডেমীর কুনজর এড়াতে কমেন্ট থেকে বিরত ছিলেন। অনেকে চেহারা দেখাতে তখন বাংলা একাডেমীতে কাঁঠালের বিচি টোকাতে গিয়েছিলেন। ডক্টর আনিসুজ্জামানরা কিছু তোষামোদী পাণ্ডা পোষেন। কিছু তেল মাখা বানরও রাখেন দলে। আর বছর ঘুরে তাদের পকেটে যায় বাংলা একাডেমী পুরষ্কার। কিন্তু কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন-এর মত নিরেট নির্লোভ সত্যিকারের কবি, প্রবন্ধকার বা অনুবাদকদের ভাগ্যে দৈববাণী না হওয়া পর্যন্ত কোনো পুরষ্কার জোটে না। দুঃখটা সেখানে। এমন কি শুদ্ধ বাক্য লিখতে জানেন না এমন লোকও বাংলা একাডেমী পুরষ্কার পাবার রেকর্ড আছে। তখন সেই দুঃখ ক্ষোভের নদী পার হয়ে ভূবনডাঙ্গায় পাড়ি জমায়। দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে আমাদের কিছু তোষামোদি লোক আরামছে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ দুঃখ রাখি কোথায়?
খন্দকার ভাই যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আমরা বরং আপনার 'মানুষ' কবিতাটি একটু এই ফাঁকে পড়ে নি-

মানুষ
কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়।

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্লা
না নদী না জন্মভূমি।
মানুষের কোনো উপমা নেই, রূপকল্প নেই, ব্যতিহার
বহুব্রীহি নেই, স্বরলিপি ব্যাকরণ নেই
শাসনতন্ত্র, অর্থ-অভিধান চর্যাচর্য নেই।

মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদিন সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।
না ঈশ্বর না দেবতা না পাষাণ মৃদঙ্গ না প্রভাত না
মধ্যরাতে নিমগ্ন বালিশ না ফোয়ারা না যোনি না
কবন্ধ রাত্রির ঘুম কোনো কিছু না।
শুধু মানুষই পারে নিজেকে ভাঙতে। যেমন সাজাতে।
আমি সেই ভঙ্গুর ভঙ্গপ্রিয় ত্রিভঙ্গ মুরারির জন্যে
আমার কবিতা রেখে যাই।
আর কেউ নয়, আর কারো জন্যে আমার
দীর্ঘশ্বাস নেই, না গ্রন্থ না সুহৃদ না পলাতক
ভ্রমর গুঞ্জন না নারী না নিশ্চল বসন্ত বাহার…

আমি মানুষকে ভালোবাসি কেননা সে একদিন
নিজহাতে নিজেকে পোড়াবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৪১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×