এক বন্ধুর কাছ থেকে যোগাড় করেছিলাম হুমায়ন আহমেদ রচিত সাড়া জাগানো ধারাবাহিক নাটক কোথাও কেউ নেই।।এই নাটক যখন বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো তখন আমি কথা বলতেও শিখি নাই।কিন্তু এখন ব্লগ লিখেই জানাচ্ছি নাটক দেখার অভিজ্ঞতা।
গত কয়েক দিন ধরেই বুদ হয়েছিলাম এই নাটকে।আজ একটানে শেষ ১৪টি পার্ট দেখে নাটক দেখার পাট চুকালাম।আগেই জানতাম নাটকের জনপ্রিয় চরিত্র বাকের ভাই-এর ফাসি হবে,সমাপ্তি কি জানা থাকলেও নাটক দেখার আগ্রহ একটুও কমেনি নাটকের অভনয়শিল্পীদের চমতকার অভিনয়ে এবং নাটকের ঘটনাপ্রবাহে।শুরুর দিকে নাটক দেখে মনে হয় বাকের ভাই নয়, মোনা চরিত্রটাই (অভনয়ে সুবর্ণা মোস্তফা) নাটকেরর মূল চরিত্র।বাবা-মা মারা যাওয়ায় মামার কাছে বড় হওয়া মেয়ে মোনা দৃঢ় চরিতের একজন চাকুরীজীবি নারী।সারাদিন অফিসের খাটুনী শেষে মোনা বাসায় ফিরে তার অসুস্থ মামী (লাকী ইনাম)কে সেবা-যত্ন করে, তার মামা শওকত সাহেব যখন তার নিজের ছেলেমেয়দের লেখাপরা না করার জন্য মারেন তখন মোনা মামা-কে ধমক দেয়।একই সাথে সে তার মামাতো ভাই বোন বকুল(আফসানা মিমি), লিনা (শিলা) আর সবার ছোট বাবু-কে গাইড করে থাকেন।বাকের ভাই আর দুই চামচা (বদি আর মজনু)-এর কাজ হলো সারাদিন ময়নাদের বাড়ির সামনের আজিজ মিয়ার দোকানে বসে “হাওয়া মে উরতা যায়ে মেরে লাল দুপাট্টা” গান শোনা, এলাকার উঠতি সন্ত্রাসী মতিকে (অভিনয়ে মাহফুজ) ছোলাসুদ্ধ আম খেতে বাধ্য করা আর মোনাদের পরিবারে বিপদে আপদে এগিয়ে আসা।বাকের ভাই-এর ধারনা মোনা তাকে পছন্দ করে, কিন্তু বাকের ভাই-এও জানে মনার প্রেমিক মামুন সাহেব।মামুন সাহেব বেকার,পার্কে চাওয়ালাকে দেখিয়ে মামুন সাহেব মোনাকে বলে “দেখেছো, ছেলেটা কি সুন্দর হাসছে।কারন ওর একটা স্বাধীন ব্যাবসা আছে,আমার তাও নেই”।
নাটকটি গতি পায় যখন অফিসের তহবিল তপছরুপের অভিযোগে মোনার মামাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।বাকের ভাই মোনাকে নিয়ে যায় তার পরিচিত উকিল ইয়াকুব সাহেবের (হুমায়ুন ফরীদি) কাছে।উকিল সব শুনে বলে “আমি তো চুরিচামারির কেস নেই না,শুধু খুনের কেস নেই।আপনার মামাকে দিয়ে একটা খুন করায় আমার কাছে আইসেন”।কিন্তু বদি পায়ে ধরে আর বাকের ভাই অনেক অনুরোধ করে উকিলকে রাজি করায়।উকিল জামিনে বের করিয়ে আনেন মামাকে।আবার মোনার মামি যখন অসুস্থ হয়ে যায়, তখন বকুল খুজতে থাকে বাকের ভাইকে।দৌড়তে দৌড়তে আসতে থাকা বকুলকে বাকের ভাই-এর সাবধানবানী “শাড়ী পরে এভাবে দৌড়াদৌড়ী করবা না।ব্যারাছ্যাড়া হয়ে পড়ে যেতে পারো”।বাকের ভাই-এর পাঠানো ডাক্তার জহির (শহিদুজ্জামান সেলিম) দেখতে আসে বকুলের মাকে।তার সাথে প্রেম হয়ে যায় বকুলের।
বাকের ভাই এলাকার শান্তি কটেজের দারোয়ান চান মিয়ার সাথে ভাব জমায়।ঐ বাড়ির মালিকিন সারাদিন কুকুর নিয়ে থাকায় বাকের ভাই-তার নাম দেয় কুত্তাওয়ালী।কুত্তাওয়ালীর বাসায় থাকে তিন মেয়ে সোমা,ঝুমা,রুমা।এর মধ্যে সোমার (অভিনয়ে তমালিকা) আবার মাথায় ছিট আছে, আকস্মিক বাচ্চাদের গলা করে গল্প বলা তার স্বভাব।সে যখন বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করে তখনও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় বাকের ভাই।ওই আমলে হয়তো ঢাকায় এম্বুলেন্স সার্ভিস ছিলো না!কুত্তাওয়ালি ঐ মেয়েদের এনে রেখেছে বিদেশে বিক্রি করে দেরবার জন্যে।মেয়েদের ব্যাপারে কুত্তাওয়ালীর বাসায় আসা-যাওয়া শুরু করে সাদা চুলের এক বৃদ্ধ।সন্দেহ জাগায় বাকের ভাই তাকে ধরে নিয়ে বেধে রাখে।আমতাবস্থাতেই বাকের ভাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অনেকদিন কেটে গেলেও তার জামিন হয় না।খোজখবর নিতে বাকের ভাই-এর বড় ভাই-এর বাসায় যায় মোনা।সরকারী উচ্চপদস্থ আমলা সেই বড় ভাই যে কিনা আগেই বাকের ভাইকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে সে বলে “বাকেরের উপরকার লোক দেখানো উপকার”।মোনার ডায়ালোগ “লোক দেখানো উপকারই বা কয়জন করে”?এই মোনাই অবশেশষে বাকের ভাই-এর জামিনের ব্যাবস্থা করে।
নাটকে এর পর শুরু হয় বিয়ে পর্ব।মামুন সাহেব চাকুরী পেয়ে মোনাকে বিয়ে করতে চাইলেও পরিবারের কথা ভেবে মোনা আরো সময় চায়।মামুন সাহেব বিয়ে করে বসে তার জন্য আগেই দিওয়ানা হয়ে থাকা তার ছাত্রীকে(অভিনয়ে বিজরী)।বাকের ভাই-এর চামচা বদি ছন্দাকে বিয়ে করে বউ-এর চামচামি শুরু করে।জহিরের মা এসে মোনার মামীকে বুঝায় বকুলের এখন বিয়ে না হলে পরে চোরের মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে না।মোনা যখন বকুলকে বলে “আরো সময় নিতে” তখন বিয়ের জন্য উদ্গ্রীব বকুলের উত্তর “তুমিও তো সময় নিতে গিয়ে দেরী করে ফেলেছিলে আপা”।বিয়ে হয় বকুলের, বিয়ের সময়েই অসুস্থ হয়ে যায় বকুলের মা(তাকেও হাসপাতালে নেয় বাকের ভাই)।তারপর তিনি মারা যান, শওকত সাহেবের মামলার রায়ে তার জেল হয় দুই বছরের।বকুলের শ্বাশুরী এসে মোনার কাছ থেকে নিয়ে যায় লিনা আর বাবুকে,মোনা ঘরে একা।তার কোথাও যখন কেউ নেই,শুধু তার খোজখবর নিতে মাঝে মাঝে আসে বাকের ভাই।
বাকের ভাই বিরক্ত করতে থাকায় কুত্তাওয়ালী মতি আর তার বন্ধু কন্ট্রাক্ট কিলার সুরুজ মিয়াকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে।সুরুজ মিয়া খুন করে বাকের ভাই-এর ভক্ত চান মিয়াকে, কুত্তাওয়ালী পুলিশকে জানায় বাকের ভাই আর তার দুই চামচা মিলে খুন করেছে।তাদের পুলীশ ধরে নিয়ে যায়,আবার উকিল ইয়াকুব সাহেবকে নিয়ে বাকেরের হয়ে মামালা লড়ে মনা।আদালতে খুনের মিথ্যে সাক্ষী দেয় মতি।কিন্তু ইয়াকুব সাহেবের তার সাক্ষী মিথ্যে প্রমান করে।ওদিকে কুত্তাওয়ালির বৃদ্ধ উকিল আরো ঝানু।সে বদীর স্ত্রীকে দিয়ে বদিকে রাজি করায় রাজসাক্ষী হতে।নিজের সদ্য আগত সন্তানকে দেখতে মুক্তির লোভে বদী আদালতকে সাক্ষী দেয় বাকের ভাই খুন করেছে।রহস্যময় কারনে আসল খুনী সুরুজ মিয়া ইয়াকুব সাহবের কাছে এসে বাকের ভাই-এর পক্ষে সাক্ষী দিতে চায়।কিন্তু তাকেও সরিয়ে দেয়া হয়।বাকের ভাই-এর ফাসি হয়।মনার তখন কোথাও কিচ্ছু নেই।
নাটকের বিবরন লিখে যখ শেষ করলাম তখন খবর পেলাম হুমায়ন আহমেদকে নিয়ে আজ আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন তসলিমা নাসরীন।লেখাটি পড়ে হতবাক হলাম।তসলিমার ভাষায়,তিনি কিশোরী বয়সে হুমায়নের লেখা পড়তেন কিন্তু যখন থেকে তিনি বাংলায় উন্নতমানের সাহিত্য পড়তে শুরু করেন তখন থেকে হুমায়ুন পড়ার রুচি হারয়ে ফেলেন।হুমায়ুনের পাঠকদের সম্পর্কে তার অভিমত তারা অল্প শিক্ষিত,তাই সরল কৌতুক বুঝতে তাদের সুবিধে।বাংলাদেশের জনগণ যদি এত বিপুল পরমাণে অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত না হতো তাহলে বছরের পর বছর হুমায়ন পড়তে পারতো না।পশ্চিমবঙ্গে হুমায়ুন জনপ্রিয় নয় কারণ ঐ রাজ্যে শিক্ষিতের মানটা বাংলাদেশের চেয়ে বেশী।এবাংলা সাহিত্যে শংকরের চটি বই-য়ের মানও ভাষার দিক থেকে হুমায়ুনের উপরে।তিনি আরো অনেক কিছু বলেছেন ওইগুলো নিয়ে আর জল ঘোলা করতে চাই না।আমি নিজেও হুমায়ন হামেদের হার্ডকোর ভক্ত নেই।মিসির আলী আনসলভড পরে বিরক্ত হয়েছি,আমার আছে জল সিনেমা দেখতে বসেও শেষ পর্যন্ত দেখার প্রয়োজন মনে করিনি কিন্তু শুধু এটুকু বুঝি "কোথাও কেউ নেই" এর মতো ভালো নাটক এবং নন্দিত নরক বা দেবির মতো বই পড়ে আনন্দ পেতে বাংলা ভাষার উপর পিএইচডি নিয়ে উচ্চশিক্ষিত পাঠক হওয়া লাগে না।
তসলিমা নাসরিনের লেখার লিঙ্কঃ এইখানে ক্লিক করুন
হুমায়ন আহমেদময় একটি দিন (বাকের ভাই-কে দিয়ে শুরু,তসলিমা নাসরিনকে দিয়ে শেষ)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?
জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন
মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়
১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷
চলুন গল্পটা শুনে আসি৷
বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া
একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন
সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!
~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো
রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন