somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুয়েট ‘শেষ’ হয়ে যাবে না

১৪ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বুয়েট শেষ হয়ে গেল’ কিংবা ‘নিয়ম-নীতি মেনে চলে এমন একটাই প্রতিষ্ঠান ছিল, যা আর রইল না’—এ ধরনের হতাশাব্যঞ্জক কথা এখন অনেকের মুখে। আমার এই লেখা তাঁদের ভুল ভাঙানোর জন্য।
আমি নিজে খুব আশাবাদী একজন মানুষ, আর বুয়েটে শিক্ষকতার সুবাদে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ বেড়ে গেছে অনেকাংশে। নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা, উঁচু আদর্শের একটি প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত থেকে নিজেকে ধন্য মনে করি। আসলে আমার বুয়েটে ভর্তি হওয়া আর শিক্ষকতায় যোগদান, দুটোই বুয়েটের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে। আমি এইচএসসিতে ঢাকার বাইরের এক কলেজ থেকে উঁচু মানের কোনো ফল না করেও বুয়েটে ভর্তি হতে পেরেছিলাম এখানকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভর্তি পরীক্ষার কল্যাণে। আবার বুয়েটের শিক্ষাজীবনে যখন ভালো ফল করলাম, তখন অনেকটা নিশ্চিতই ছিলাম বুয়েটে শিক্ষক হতে পারব, কিন্তু বাদ সেধেছিলেন আমাদের তখনকার বিভাগীয় প্রধান। আমার মেধাস্থান চতুর্থ হওয়া সত্ত্বেও ১৩তম স্থানের একজন প্রভাবশালী ডাক্তারের তনয়কে আমার স্থলে নেওয়ার তাঁর জোর চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছিল বুয়েটের সিলেকশন বোর্ড।
বুয়েটের নিয়ম-নীতি কীভাবে এত দৃঢ়ভাবে অনুসৃত হয়, তা হয়তো অনেকের জানা নেই। ড. রশিদের হাতে গড়া এই বুয়েট গোড়া থেকেই এর পরিচালনা ব্যবস্থাগুলো এমনভাবে সাজিয়েছে, তা পূর্ণভাবে অনুসৃত হলে অনিয়ম, দুর্নীতির সুযোগ থাকে না। গোল বাধে তার ব্যত্যয় করলে। যেমন ধরা যাক, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়। পুরো ভর্তি-প্রক্রিয়ার খোঁজখবর রাখা ছাড়া উপাচার্যের ক্ষমতা নেই ভর্তি-ইচ্ছুক কোনো ছাত্রছাত্রীকে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-পদোন্নতি—সব বিষয়ে যদি নিয়মানুযায়ী নিয়োগ কমিটিগুলো গঠন করা হয় এবং তা পরিচালনায় বাধা দেওয়া না হয়, তাহলে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ/পদোন্নতি সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত সব প্রক্রিয়া কম্পিউটারায়ন করার ফলে কোনো স্তরে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব নয়। কম্পিউটারায়নের এমন সুবিধা বুয়েট ভোগ করছে, কোনো স্তরে যদি কেউ কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সুবিধা প্রদান করে, তা ধরা পড়ে যায়।
বর্তমান ভিসি ও প্রো-ভিসি এমন কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন, যা বুয়েটের ইতিহাসে ঘটেনি। এক প্রস্থ অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, বিষয়গুলো কতখানি গুরুতর। প্রথম বিষয়টি হলো, একজন ছাত্রের ফলাফল জালিয়াতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম না মেনে সেই দুজন ছাত্রের ‘এফ’ গ্রেড পাওয়া দুটি বিষয় ফলাফল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের মূল কাজই হলো পড়ানো এবং ছাত্রদের পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন করা। সেই মূল্যায়নে যদি আমরা পক্ষপাতিত্ব করি কিংবা জালিয়াতি করি, আমাদের আর থাকে কী? দ্বিতীয় গুরুতর অভিযোগ হলো, একজন পছন্দের ব্যক্তিকে রেজিস্ট্রার করার সংকল্প নিয়ে এগোতে গিয়ে সব নিয়মকানুন দলিত-মথিত করেছে এই প্রশাসন। এই দুটি বিষয়েই মাননীয় উপাচার্য দুটি কমিটি গঠন করেন এবং তারা রিপোর্ট প্রদান করে। দুটি রিপোর্টেই দুর্নীতির বিষয় প্রমাণিত হয়।
এমনি আরও সব অনিয়ম, দুর্নীতি ও সর্বোপরি স্বেচ্ছাচারিতা এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, বুয়েটের শিক্ষকসমাজসহ পুরো বুয়েট পরিবার তাঁদের অপসারণের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে। গুটিকয়েক, মুষ্টিমেয়, আংশিক কিংবা সরকারবিরোধী কিছু শিক্ষক এই দাবি করছেন, এসব যাঁরা বলেন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আদৌ কোনো খোঁজখরব রাখেন না। সর্বমোট ৪১৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩৬৭ জন শিক্ষক যদি অন্যায়ের প্রতিবাদে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে রাজি থাকেন, তবে এঁদের কি মুষ্টিমেয় বলা যায়?
আজ বুয়েটের অবস্থান অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানি জান্তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বাঙালি স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যার ফলে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধকালে আমাদের অনেক কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলেনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে ক্লাস হয়েছে, কোনো পড়াশোনা হয়নি। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই চলেছে অস্বাভাবিকতার মধ্যে। সেই সময় কেউ ভাবেনি যে অস্বাভাবিকতা দূর করার জন্য স্বাধীনতাসংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে, ফিরে যাই সামরিক জান্তার অধীনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। আজ বুয়েটেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের কিছু ক্ষতি মেনে নিতে হচ্ছে। ছাত্ররা কিছু সময় পড়াশোনা থেকে দূরে থাকছে, শিক্ষকেরা শিক্ষাদান ও গবেষণা করতে পারছেন না, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রয়েছেন। এ সবই সাময়িক ক্ষতি বৈকি। বৃহত্তর স্বার্থে আজ আমরা সবাই এই ক্ষতি মেনে নিচ্ছি।
এ ক্ষতি যেহেতু দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, তাই বুয়েট পরিবার এটাতেও বদ্ধপরিকর যে পরে তারা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে। আমরা দেখেছি, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও একদল মানুষ ছিল, যারা বাংলাতেই কথা বলত, কিন্তু সেই মহান যুদ্ধকে মেনে নেয়নি। তারা শত্রু বাহিনীকে সাহায্য করেছে, মুক্তিপাগল স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বা হত্যায় সাহায্য করেছে। এদের সংখ্যা কম হলেও আমাদের ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। জাতির বিবেককে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে বিরাট এক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সরিয়ে দিয়েছে। আজ বুয়েট পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কিছু লোক থাকবেই, যারা চাইবে না আমরা দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসি। তাদের সুবিধা বহাল রাখার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে আমরা বুয়েটকে অন্যায়-অনিয়ম থেকে মুক্ত করবই।
লেখার শুরুতে আমি হতাশাবাদীদের কথা লিখেছিলাম। লেখার শেষ পর্যায়ে আমার ধারণা, তাঁরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। বুয়েটের মূল অবস্থানে বুয়েটকে ফিরিয়ে নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান আমাদের, মিত্রবাহিনীর মতো সাহায্য করুন, অন্যায়কারীরা আত্মসমর্পণ করবেই, আর তা বেশি দূরে নয়।
এস এম লুৎফুল কবীর: অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইসিটি, বুয়েট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ৯:৪১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×