somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হলুদ আর লাল সবুজে জীবনের গল্প

১৩ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

মাগরিবের আজান দিতে আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে । অন্য সময় এটা কোন ব্যাপার না কিন্তু রোজার মাসে মাগরিবের আযানটা শোনার জন্য চাতক পাখির মত চেয়ে থাকে মইন। সে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট । কিছুদিন হল ডিউটি পড়েছে ফার্মগেট, তার আগে ছিল মগবাজার সিগন্যাল । ঢাকা শহরের সবচেয়ে দরকারী জায়গা বোধ হয় ফার্মগেট । অফিসযাত্রী, হকার, কোচিং এর ছাত্রছাত্রী, কেনাকাটা করতে আসা মানুষ সবার ভিড় এইখানে। আর এইজন্য বোধ হয় ইফতারির সময়টুকুতেও ডিউটি থেকে রেহাই পায়না মইন।

হুইসেল দিয়ে আর হাত দেখিয়ে গাড়ির ড্রাইভারগুলাকে সিধা করতে করতেই আযান দিয়ে দেয় । কিন্তু তাতে কি ! আযান দিয়েছে বলে তো আর গাড়িগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েনি। ঠিক ই এদিক ওদিক টান মেরে ড্রাইভারগুলা কে কার আগে যাবে,এই চেষ্টায় ব্যস্ত। একটু অসতর্ক হইলেই বড়সড় এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে আর পুরা দোষ এসে পড়বে মইনের ঘাড়ে যে সে ডিউটিতে ফাঁকি দিয়েছে। তাই এক হাতে একটা আলুর চপ মুখে পুরে আরেক হাতে সিগন্যাল দেয় মইন। এভাবেই ইফতার সারে। ইফতারের কিছু আগ দিয়ে গাড়িতে করে সরকারি ইফতারির প্যাকেট আসে। এইবার সবার জন্য বরাদ্দ ২৫ টাকা। একটা বেগুনি,একটা পেঁয়াজু,একটা আলুর চপ, ছোলা মুড়ি,খেজুর আর জিলাপি, ইফতার বলতে এই। সারাদিন কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে ডিউটি করে পেট ভরে ইফতারটাও করতে পারেনা! এই হল কপাল। কিন্তু চাকরিটা পেতে বেশ কিছু জমি হোমরা চোমরা মানুষের পেটে গেছে । দিন নাই,রাত নাই যখন তখন শিফটের ডিউটি করে মাস শেষে যখন ডি গ্রেড সরকারী কর্মচারীর বেতনটা হাতে পায়, তখন মাঝে মাঝে মইনের মনে হয় এর চেয়ে গ্রামে হাল চাষ করা অনেক শান্তির। কিন্তু সেইখানেও লোকলজ্জার ভয়। ডিগ্রি পাস করে হাল চাষ করলে পেট চলে যেত ঠিক ই কিন্তু গাঁয়ের মানুষের হাজার রকম কথা শুনতে হত ।

গত বছর ঈদে ছুটি পায়নি মইন। এবার পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে । শুধু যে ঈদে বাড়ি যেতে পারবে এই আনন্দেই একগাদা কেনাকাটা করে ফেলে সে সবার জন্য। আব্বা,আম্মা, ছোট ভাই মমিন, ছোট বোন মনিকা, বড় বুর মেয়ে স্বর্ণা সবার জন্য। আরও একজনের জন্য ও থ্রী পিস কিনেছে অবশ্য মইন, কিন্তু সেই কথা কাউকে এখুনি জানাবেনা সে। মইনদের পাশের পাড়ায় থাকে লতা, মনিকার বান্ধবী। বাড়িতে মনিকার সাথে আসলে মইন অনেকবার দেখেছে। সেই শুরু ভাললাগার। চাকরী পাওয়ার পর সাহস করে লতা কে তার ভাললাগার কথা জানিয়েছিল। লতা প্রথমে বাপ মা কি বলবে এটা ভেবে গাইগুই করলেও পরে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে মইন তার মাকে লতার কথা জানালে মা একবাক্যে রাজি হয়ে যান আর কথা দেন ঈদের ছুটিতে মইন বাড়িতে এলে লতাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। আর লতাদের পরিবার মইনকে জামাই হিসাবে মেনে না নেয়ার কোন কারণ ই নেই বলে মনে করে মইনের মা। মায়ের কাছে এই কথা শুনেই মইন কল্পনায় হাজার স্বপ্নের বসতি গড়তে থাকে ।

২।

ডিউটি শেষে মেসে ফিরেই মইন দেখে সবাই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগিয়েছে। কার মিষ্টি, কে খাওয়াচ্ছে, কেন খাওয়াচ্ছে এত কিছু ভাবার সময় পায়না সে ।তার আগেই সবার দেখাদেখি কাড়াকাড়ি করে তার প্রিয় দুটো চমচম টপাটপ মুখে পুরে দেয় মইন। তারপর ধীরে সুস্থে চিবুতে চিবুতে বাকিদের জিজ্ঞেস করে,কাহিনী কি। তখন আশরাফ দুনিয়ার সবথেকে খুশি খুশি চেহারা নিয়ে বলে," মইন , আমার মেয়ে হয়েছে ঘন্টা দুয়েক আগে, বাড়ি থেকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছে। " মইন আশরাফের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, " শালা, এতবড় খুশির খবর ! তুই এইখানে কার ডিমে তা দিচ্ছিস ? এক্ষুনি গাবতলী যা, বাড়ি যাওয়ার টিকিট কাট।" আশরাফ মুখ কাল করে বলে, " নারে দোস্ত, কদিন আগে টাইফয়েড হওয়ার কারণে দশদিন ছুটি নেয়া হয়েছে, এখন আর ছুটি পাওয়া যাবেনা।এক সপ্তাহ পর ঈদের ছুটিতে তো বাড়ি যাচ্ছি ই "। এই কথা শুনে কেউ আর কিছু বলেনা, আশরাফের এই আনন্দের খবরে সবার ই আজ অনেক আনন্দের দিন। এরকম দিন সচরাচর ওদের এই মেসজীবনে আসেনা !

আজকে নোটিশ দিয়েছে কারা ঈদে ছুটি পাবেনা।তালিকায় নিজের নাম খুঁজতে গিয়ে মইন আবিষ্কার করে তার নাম নেই কিন্তু আশরাফের নামটা ঠিক ই আছে। নিজে ছুটি না পেলে যতটা মন খারাপ হত,তার চেয়ে বেশি মন খারাপ হয়ে যায় তার। রাতের ডিউটি শেষে মেসে ফিরে আশরাফের চেহারা দেখে সত্যি ই কষ্ট লাগে মইনের। একবার ভাবে আশরাফের ডিউটি টা প্রক্সি দেবে যাতে সে তার প্রথম বাচ্চার মুখটা দেখতে পারে। আবার ভাবে, কতদিন বাড়ি যাওয়া হয়না,মায়ের কোলে কতদিন মাথা রাখেনা।লতার সাথেও কতদিন দেখা হয়না। আর তাছাড়া এবার মা বলেছিল বিয়ের কথা। এসব চিন্তা করে দোনামনা করতে থাকে। একসময় নিজের স্বার্থপর রূপটা প্রকট হয়ে উঠতে দেখে বিস্মিত হয় । আশরাফ তো তার জন্য কম করেনি। গতবছর বাবার চোখে ছানি অপারেশনের সময় হন্যে হয়ে যখন টাকার খোঁজ করছিল,তখন আশরাফ ই যোগাড় করে দিয়েছে তাকে টাকাটা। এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মইন। আশরাফ কে গিয়ে বলে, "দোস্ত ভাবীর হাতের রান্না খাওয়ার খুব ইচ্ছা হল, আমি তোর ডিউটি করে দিব কিন্তু বাড়ি থেকে আসার সময় আমার জন্য ভুনা মাংস আর সেমাই না নিয়ে আসলে খবর আছে তোর শালা । আর ভাল কথা ,আমাদের মামনিটাকে আমার পক্ষ থেকে ও অনেক আদর করে দিবি । " এই কথা শুনে আশরাফের চোখে খুশির পানি দেখে মইন আবার বলে উঠল, " শালা, পুরুষমানুষ হয়ে কাঁদিস ! তুই মানুষ নাকি কোলাব্যাং ? দূরে গিয়ে মর ।"

৩.

আশরাফ দের বাড়ি মইনদের পাশের গ্রামে। তাই আশরাফের হাতে বাড়ির সবার জন্য কেনা জামাকাপড় পাঠিয়ে দিয়েছে । শুধু লতার টা পাঠায়নি। নিজ হাতে পরেরবার বাড়িতে গিয়ে দেবে সে। লতা কত খুশি হবে এটা ভাবতেই মনে মনে হাসে। এই ঈদের সময় ঢাকা শহর পুরাটা প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। আগামীকাল ঈদ। সন্ধ্যায় ডিউটি করতে করতে খুব মন খারাপ লাগে তার । ধুর, মানুষের জীবন টা এমন কেন। পঞ্চাশ ষাট বছরের ছোট্ট একটা জীবনের বেশিরভাগ সময় মানুষের আপনজনদের কাছ থেকে দূরেই থাকা লাগে। ইচ্ছে হলেই প্রিয়তমার গাল ছুঁয়ে একটা বিকেল মায়াবী করে তোলা যায়না, ইচ্ছে হলেই নিজের নবজাতক শিশুর মুখটাও দেখা যায়না, প্রবল মন খারাপের সময় মায়ের পাশে চুপচাপ বসে থাকা যায়না !! এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ অদূরে ফুটপাতের দিকে চোখ যায়।ওইখানে হকারদের কাছে চাঁদ রাতের শেষ কেনাকাটা করতে আসা লোকের ভিড়ে চোখে পড়ে চার পাঁচ বছরের একটা ছেলের নতুন জামা হাতে নিয়ে খুশির ঝিলিক। ছেলের খুশিতে বাবার আত্মতৃপ্তি টাও চোখ এড়ায় না মইনের। মুহূর্তেই নিজেকে মনে মনে কষে একটা রামধমক লাগায় ।কিসব আজেবাজে কথা চিন্তা করছিল সে এতক্ষণ। নিজের প্রিয়তমার গোমড়া মুখকে আড়াল করে কল্পনার চোখে একটা ছবি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। একটা বাবার ছবি, আশরাফের ছবি । আত্মজ কে প্রথমবার কোলে নিতে পেরে খুশিতে আত্মহারা এক বাবার ছবি ! আর এই সারাজীবনের প্রতীক্ষিত খুশির মুহূর্তটার অনেকখানি অংশীদার মইন নিজে। নিজেকে অনেক সুখী মনে হতে থাকে মইনের। রাতের রঙ্গিন ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়ে সত্যিই মনে হতে থাকে জীবনটা আসলেই রঙ্গিন, ট্রাফিক সিগন্যালের ওই লাল, সবুজ আর হলুদ ছাড়াও অনেক রঙ আছে তাতে,আমাদের শুধু খুঁজে নেবার পালা!!

৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শৈল্পিক চুরি

লিখেছেন শেরজা তপন, ০১ লা জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭


হুদিন ধরে ভেবেও বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছে না ভয়ে কিংবা সঙ্কোচে!
কিসের ভয়? নারীবাদী ব্লগারদের ভয়।
আর কিসের সঙ্কোচ? পাছে আমার এই রচনাটা গৃহিনী রমনীদের খাটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×