somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘের খোঁজে মেঘের দেশ পাহাড় দানব কেওক্রাডং।

২০ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গাব্দ-১৪১৬
বর্ষাকাল, আষাঢ়ের শেষ দিনগুলোতে মেঘের আনাগুনা থাকলেও বৃষ্টির প্রকোপ তেমন নেই, সামনে শ্রাবণের হাতছানি তাই বোধহয় প্রকৃতি তার মেঘমালা সঞ্চিত করে রেখেছে বৃষ্টি রুপে অঝোর ধারায় ঝরবে বলে। প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র্যের বর্ষা এভাবেই ষড়ঝতুর এই বাংলায় প্রাণ সঞ্চার করে, যার আতিথেয়তা গ্রহণে সদা উন্মুখ একদল ভ্রমনপিপাসু।
লেট’স ট্রাভেল ভ্রমন দলটি এরকম সময়ে ভ্রমণে সদাপটু, প্রকৃতির পালাবদল এবং উৎসবের আমেজ পেলেই আমরা ছুটে বেড়াই বাংলার প্রকৃতির পথে-প্রান্তরে। শ্রাবণের আগমন ও পাহাড়-পর্বতে মেঘের আনাগুনা, তাইত লেট’স ট্রাভেলের বন্ধুরা মিলে এবারের লক্ষ ঠিক করলাম ঐ পাহাড় দানব কেওক্রাডং চূড়া। বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিন-পূর্বাংশে বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলার তিন নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নে এর অবস্থান। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় শৃঙ্গসমূহের মাঝে কেওক্রাডং এর অবস্থান তৃতীয় যার শৃঙ্গের উচ্চতা তিন হাজার একশত বাহাত্তর ফুট, সাকাহাফং ও ডুম-লং পাহাড় শৃঙ্গ আবিষ্কারের পূর্বে এটিই ছিল এদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতম স্থান।
ঊনত্রিশে আষাঢ়
আজ রাতের বাসে করে রওনা হব বান্দরবনের উদ্দেশ্যে, সকল প্রস্ততি সম্পন্ন কিন্তু বিপত্তি একটাই বান্দরবনগামী যে সকল বাস সার্ভিস রয়েছে তাদের কোনটিতেই দুদিন আগে থেকে চেষ্টা করেও ছয়টি খালি সিট পেলাম না। অগত্যা ভিন্ন পথে যেতে হবে তাইত বিকাল পাঁচটায় বাসা থেকে বের হয়ে ঠিক করলাম আরামবাগ যাব কমালাপুর হয়ে ট্রেনে, সেখানে শেষ চেষ্টা করব সরাসরি বান্দরবনের বাসের জন্য। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ট্রেনের টিকেট আনতে ফয়সাল, নোমান ও আনিস গেল কিন্তু এদিকে ট্রেন চলে এসেছে খুলনা থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস, উঠে পরলাম আমরা অপেক্ষা করছি ওদের জন্য, এলো কিন্তু ট্রেনে দেখি ওরা তিনজন আমাদের বগিতে নেই সাক্ষর বলে উঠল ঐতো পাশের বগিতে, টিল ঠাই জায়গা নেই তারপরেও ওরা ভীর ঠেলে চলে এল আমাদের বগিতে টিকেট ছাড়া অগত্যা বিনা টিকেটে ভ্রমন। কমলাপুর নেমে চলে এলাম ইউনিক,এস আলম,শ্যামলী বাস কাউন্টারে না টিকেট পেলাম না, তাহলে উপায় এখন চট্টগ্রাম হয়ে বান্দরবন, কমলাপুর-আরামবাগ বাস কাউন্টার ঘুরে চট্টগ্রামের ছয়টি টিকেট পেলাম না, তখন আমাদের বোধগম্য হল আজ বৃহস্পতিবার রোববার পবিত্র শবে-বরাত সুতরাং ঢাকা আজ থেকেই হয়ে যাবে ফাঁকা। আমাদের যেতেই হবে তাইত চললাম সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পথে, রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে রাত আটটা তিরিশে পৌঁছলাম, এখানেও চট্টগ্রামের টিকিট পেলাম না হঠাৎ চোখে পড়ল শাহ আমানত নামের বাস সার্ভিসের দিকে ওদের টিকিট আছে কিন্তু গাড়ির দশা বেহাল, উপায় নেই সবাই বলে উঠল তাই টিকেট নিয়ে উঠে পড়লাম। নয়টার বাস ছাড়ল সারে নয়টায়, একে একে ঢাকা পেরিয়ে নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী পারি দিয়ে ভোর চারটায় পৌঁছলাম চট্টগ্রাম।
ত্রিশে আষাঢ়
অন্ধকারে আচ্ছন্ন চট্টগ্রাম শহর ভোর না রাত বুঝতে পারছিলাম না তাইত নেমে পরলাম জি,ই,সি মোড়ে অপেক্ষা করছি ভোরের আলোর, পাশেই একটা রাতের টং দোকান চা-বিস্কিট খেয়ে রওনা হলাম রাইডারে করে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের উদ্দেশ্যে। ভোর পাঁচটায় পৌঁছলাম কিন্ত টার্মিনাল তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন, এখান থেকেই বান্দরবনের লোকাল বাস প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে যাতায়াত করে। পূরবী-পুর্বাণী বাস কাউন্টার, সকাল ছয়টায় বাস ছাড়ার সময় কিন্তু ছাড়ল সাতটায় আবার ছুটে চলা সারারাত কেউ ঘুমায়নি তার স্পষ্ট জলছাপ সবার চোখেমুখে দুইঘণ্টা বিশ মিনিট পরে পৌঁছে গেলাম বান্দরবন বাস টার্মিনালে। বান্দরবনে এর আগেও আমরা এসেছি তাই শহরটাকে অপরিচিত মনে হচ্ছে না। আমাদের পরিকল্পনা মতো এখন আমরা বান্দরবন শহর হতে রুমা বাজার যাব, না চান্দের গাড়িতে নয় আমরা যাব রোমাঞ্চকর এক নৌ-যাত্রায় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদ দিয়ে, এরকম রোমাঞ্চকর ভ্রমণ সাধারনত কেউ করে না কিন্তু আমাদের চিন্তা চেতনায় ছিল সাঙ্গু নদ-সাথে পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে নৌ-পথে যাব রুমা। আমরা একটা অটো নিয়ে রওনা হলাম বালাঘাটের উদ্দেশ্যে, কিন্তু চালক জানালো ঘাটে এখন নৌকা পাওয়া যায় কম তবে শহরের সাঙ্গু ব্রিজের পাশে হোটেল পাহাড়িকা এর পিছন থেকে সহজেই পাওয়া যাবে, তিনি আমাদের সেখানে নামিয়ে দিলেন ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই নৌকা পেয়ে গেলাম। এখান থেকেই নৌকা ভাড়া করে আমাদের যেতে হবে রুমা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা রির্জাভ ভাড়া চাইল সারে তিনহাজার টাকা দু’হাজারে যেত কিন্তু অন্য নৌকার মাঝি জনপ্রতি একশত টাকা চাইল ছাড়বে বারটায় ঘড়ির কাঁটায় তখন সোয়া এগারটা, আর্থিক ভাবেও সাশ্রয় তাইত সবাই রাজি হয়ে গেলাম। পথের ক্লান্তি দূর করে ভ্রমণের নব উদ্দীপনায় আমদের চিত্রগ্রাহক নোমান, আনিস ও সাক্ষর তাদের ডি,এস,এল,আর ক্যামেরায় ক্লিক করতে লাগল। মাঝি ইলিয়াস ভাই জানাল এখান থেকে রুমা যেতে চার ঘণ্টার বেশী লাগবে এবং তারা যাত্রীর সাথে দৈনন্দিন পন্য সামগ্রী পরিবহন করে যা বান্দরবনের দুর্গম পাহাড়ি জনপথে নৌ-পথে সহজেই নেয়া যায়। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর একটা, কয়েকজন আদিবাসী এবং আমরা সাথে কিছু মালামাল নিয়ে ইলিয়াস ভাই নৌকা ছেড়ে দিলেন রুমা বাজারের পথে। মাসুম যার কথা না বললেই নয় আরামপ্রিয় ও মিশুক একটা ছেলে এবারই প্রথম দুর্গম যাত্রায় কি যেন ভেবে আমাদের সাথে ভ্রমণে বেরিয়েছে, আমরা সবাই যখন নৌকার ছাউনির উপর সে তখন রোদের ভয়ে নীচে আদিবাসী যাত্রীদের সাথে গল্পে মশগুল। পাহাড়ের বুক চিরে সাঙ্গু বয়ে চলেছে সেই অনন্তকাল হতে আজ আমরাও চলেছি সেই পথে, সামনেই একটা ব্রিজ এপার হতে ওপার পর্যন্ত দুপাশে বাড়িঘর সাথে সবুজের সমারোহ। কর্মব্যাস্ত মানুষ কেউ মাছ ধরছে কেউবা গবাদি পশু গোসল করাচ্ছে, ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে মনের আনন্দে, কিছু দূর এগিয়ে দেখি একদল আদিবাসি মারমা মেয়ে একই রকম রঙিনসাজে সাঙ্গুর পাড়ে স্নান করছে। আশপাশের ছোট টিলার আঁকাবাঁকা সাঙ্গুর পথ পেরিয়ে হঠাৎ সামনেই দেখি দুপাশে সারিসারি পাহাড় মাঝ দিয়ে বুক চিরে বয়ে চলেছে সাঙ্গু, প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে গেল তাইত অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সবাই। আল্লাহু তা-আলার অপার সৃষ্টি যা গত বার দেখেছিলাম চিম্বুক পাহাড়ের উপর হতে এবার দেখছি সাঙ্গু নদ থেকে পার্থক্য বিশাল না দেখলে বিশ্বাস হবে না, ডান পাশের ঐ পাহাড় গুলোই নাকি চিম্বুক রেঞ্জ এর অংশ জানালেন ইলিয়াস ভাই, এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময় কিছুদূরে সামনেই চোখে পরল একটা আদিবাসি অধ্যুষিত গ্রাম যার সর্ব উপরে সবুজের মাঝে আর্মি ক্যাম্প, কয়েকজন যাত্রি নেমে পরল তারপর আবার ছুটে চলা। নৌকার ছাউনির উপরে তীক্ষ্ণ রোদের সাথে দুপুরের ক্ষুধার উত্তাপ এখন চরম তারপরও প্রকৃতি যেন নীচে যেতে দিচ্ছে না। এভাবেই তিনঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পর ইলিয়াস ভাই জানালো সামনেই নৌকা থামবে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা রয়েছে, রুমা যেতে এখানেই যাত্রা বিরতি নেয়া হয়। আমরা চলে এসেছি ঘ্রাউ ঘাট, পাহাড় ঘনজঙ্গল এর মাঝে সুন্দর একটা গ্রাম্য বাজার সত্তিই দারুন, নৌ-ঘাটটিও বেশ পরিপাটি চারধাপের পাকা সিঁড়ি উপরের বাম পাশেই ছোট একটা হোটেল, সামনেই ইউপি নির্বাচন পাহাড়ি আদিবাসি একদল তাই নিয়ে আলাপ করছে। আমরা খাচ্ছি ভাত, ডিম ও মুরগির মাংশ সাথে অসম্ভব ঝালের ছোট পাহাড়ি কাঁচা মরিচ, সবচেয়ে বেশী খেলাম আমি। নৌকা ছেড়ে দিল কিছুদূর যাবার পর বাতাসের গতিবেগ কেমন যেন মনে হল রোদ যেন কোথায় হারিয়ে গেল সাঙ্গুর পানিতে ঢেউয়ের গতিবেগ হঠাৎ বেরে গেল সামনে তাকাতেই দেখি ঝিরিঝিরি করে বর্ষার বারতা নিয়ে বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে দিল, সে এক দারুন অনুভূতি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি হচ্ছে। ইলিয়াস ভাই জানালো গত সপ্তাহ থেকে পাহাড়ে বৃষ্টির দেখা নেই তাইত পানি অনেকটা কম, আজ থেকে আবার শুরু হল পাহাড়ি ঢল না এলেই হল। নদীর মাঝে বৃষ্টি পাশে সুউচ্চ পাহাড় অট্টালিকা যার উপর সবুজের আবাসন দেখতে দেখতে আমরা পারি দিচ্ছি সাঙ্গু। বৃষ্টি এখন হচ্ছে না, এগিয়ে যাচ্ছি আমরা নদীর বাঁকের উপরে পাহাড় যার উপর হেলান দিয়ে রয়েছে একস্তুপ মেঘ, যার জন্য আমাদের সাঙ্গু দিয়ে আসা এই বর্ষায়। সাঙ্গু তার বাঁকে বাঁকে সৃষ্টি করেছে প্রাকৃতিক নৈস্ররগতা যার কিছুটা আমরা দেখছি এবং চেষ্টা করছি অন্তর থেকে অনুভব করার। পাহাড়ে বৃষ্টির পরে মেঘ দর্শন চমৎকার এক অনুভূতি কিছুদূর এগুলেই হয়ত পেয়ে যাব ঐ মেঘস্তুপকে, না পেলাম না চারিদিকে তখন মেঘের আনাগুনা কোথাও ভেসে যাচ্ছে না হলে স্তুপ হয়ে পাহাড়কে আঁকরে ধরে রয়েছে। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম আমরা চলে এলাম সাঙ্গুর যেখানে তৈরি হচ্ছে সেতু, যার ফলে আগামী কয়েক বছর পর হতে রুমা যাওয়া যাবে সরাসরি সড়ক পথে। ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টার কাছাকাছি কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের গন্তব্য রুমা বাজার। বান্দরবন সদর থেকে আমাদের প্রায় ছয়ঘন্টা লাগল রুমা পৌছতে, ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে দেনা-পাওনা পরিশোধ শেষে বিদায় নিয়ে নৌ-ঘাট থেকে উপরে উঠেই দেখি চারিদিকে মেঘের স্তুপ, ঠাণ্ডা শান্ত একটা পরিবেশ সন্ধা হয়ে পরছে তাই আমরা চলে এলাম হোটেল হিলটনের খোঁজে না বেশী দূরে নয় বাজারে প্রবেশের মুখে। হোটেল হিলটন নাম যাই হোক থাকার জায়গা বলে কথা, দ্রুত দুটা রুম নিয়ে প্রাচীন জমিদারী কাঠের পেঁচানো সরু সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদের রুমে ঢুকেই বিছানায় পরে রইলাম। বেশীক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই আগামীকালের যাত্রার কথা চিন্তা করে দ্রুত উঠে গোসল সেরে আধঘন্টার মধ্যেই ফয়সাল, সাক্ষর, আনিসকে সাথে নিয়ে বের হলাম বগালেক হয়ে কেওক্রাডং যাবার গাইডের খোঁজে কারন রুমা থেকে পরবর্তী যেকোন জায়গায় যেতে হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভ্রমনকারিদের জন্য গাইড বাধ্যতামূলক করেছে। হোটেল হিলটনের সামনেই গাইডের অফিস, গেলাম কথা বললাম কিন্তু সমস্যা একটাই বাঙ্গালি গাইড কিন্তু আমরা চাচ্ছি আদিবাসি, গাইড অফিসটি আসলে বাঙ্গালি একজনের মুদির দোকান তার উপর আমরা আবার চাচ্ছি আদিবাসি গাইড কেমন যেন একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম যার কারনে আমাদের রাত আটটায় আবার আসতে বলল কিন্তু আমরা পরিশ্রান্ত তাই খোঁজে বের করলাম ইয়ং বম এসোসিয়েশন নামের সংঘঠন। অফিসে তালা উপরে মোবাইল নাম্বার দেয়া ফোন দিলাম কথা হল আমাদের আসতে বললেন ঐ পথ ধরে সামনের এক ক্যারাম খেলার আড্ডায়, গেলাম কিন্তু পেলাম না ইতিমধ্যেই ফয়সালের সাথে দেখা হল এক আদিবাসির যিনি আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কিন্তু একই সাথে আদিপথে এখন যাওয়া যাবে না কারন হাতি-জোঁক ঐ পথে অনেক বেশী যার এক কামড়ে সপ্তাহ পর্যন্ত রক্ত ঝরে একই সাথে আর্মিদের কোন অনুমতির দরকার নেই এইসব বকে চলেছে সেই তখন থেকে, বিরক্ত হয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখা পেলাম নৌকা যোগে আমাদের সাথে আসা একজনকে যিনি আমাদেরকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হল। ভাগ্যপ্রসুন্ন তাই এক মহাপাগলের পিছু ছুটিয়ে চলে এসেছি ধন্যবাদ দিয়ে বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে আবার ফোন দিলাম জানালাম আমরা অপেক্ষায় রইলাম আপনার অফিসের সামনে, মিনিট পাঁচেকের মাঝেই মোটরসাইকেল যোগে হাজির হল বিটু বম, সাধারন সম্পাদক, ইয়ং বম এসোসিয়েশন। পরিচয় পর্ব শেষে অপেক্ষার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে তিনি আমাদের পরিকল্পনা শুনলেন এবং তাদের সংঘঠনের গাইড নেয়ার শর্তগুলো জানালেন দুপক্ষই রাজি সুতরাং কাল ভোর পাঁচটায় একজন বম গাইডকে সাথে নিয়ে আমরা রওনা দিব আদিপথে বগালেক। আমরা বিটুদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরছি পথে মাসুমের ফোন ভাই এখানে দুজন বন্ধু আমাদের সাথে যেতে চায়! হোটেলে ফিরে রুমে ঢুকে দেখি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত মায়াবী চেহারায় দুজন সাথে মাসুম ও নোমান। কামরুল ও হুমায়ুন পরিচয় শেষে জানতে পারলাম বাড়ি থেকে তাদের পালিয়ে আসার গল্প, অসম্ভব ভালো দুজন মানুষ তাই ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম বিটুদাকে ওরাও যাচ্ছে আমাদের সাথে, রাতের খাবার খেয়ে ছাদে দেখা হল কিছুক্ষন আগে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামিউল-মাহিনদের সাথে কথা হল তারা পাঁচজন যাবে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং। আমরা কজন জেগে আছি কিছু সময় ঠাণ্ডা এক নিভৃত পরিবেশে, অতপর রুমে এসে ঘুমিয়ে পরলাম খুব ভোরে উঠতে হবে।
পহেলা শ্রাবণ
আজ পহেলা শ্রাবণ, সারে চারটায় ঘুম থেকে উঠে সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে তৈরি হচ্ছি নতুন এক রোমাঞ্চকর দিনের প্রত্যাশায়, ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে তাই তারাতারি সবাই নিচে নেমে হোটেলে চাবি জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম রুমা বাজারে। ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা সামিউল-মাহিনরা বাঙ্গালি গাইড নিয়ে রওনা হয়ে গেল, আমরা সকালের নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করছি বিটুদার জন্য তিনি এলেন সাথে তরুণ একজন বম গাইড, আধঘণ্টা দেরি হল বলে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। বিটুদা ধ্রু ব্যাঙ্গ বম ওরফে রুবেল গাইডের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, দেখতে অনেকটা জ্যাকি চেং ক্ষিপ্র নকনকে শরীরের আদলে তৈরি তাই প্রথম দেখাতেই সকলের ভাল লেগে গেল। বিটুদা সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে, রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্প থেকে আমাদের বগালেক হয়ে কেওক্রাডং যাবার অনুমতি নিতে হবে, তাই ইয়ং বম এসোসিয়েশনের ছাপা পাতায় প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে আমরা চলে এলাম আর্মি ক্যাম্পে। আর্মি ক্যাম্পটি বাজারের সবচেয়ে উচু টিলার উপর স্থাপিত প্রবেশ মুখে বাঙ্কারে অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম দেখে মনে হল যুদ্ধময়দানে চলে এসেছি, তাই দ্রুত অনুমতি নিয়ে আমরা সোজা রওনা হলাম আদিপথ ধরে, আমরা যাচ্ছি বগালেক না চান্দের গাড়িতে নয়, যাব আদিপথে ছয় ঘন্টা পায়ে হেঁটে উচুনিচু পাহাড়ি পথে সাথে রুমা ক্যানেলের ঘন নীল জলরাশি পেরিয়ে। রুমা বাজার পেরিয়ে আমরা আটজন চলে এসেছি বম আদিবাসিদের লাইরাম্পি গ্রামে ধ্রু বমের বাড়ি এখানেই তারপর প্রথম পাহাড়, চলে এলাম কিন্তু পাহাড়ের উপরে উঠেই মাসুমের বমি সাথে শ্বাসকষ্ট সবাই চিন্তিত কিন্তু লেট’স ট্র্যাভেলের আইনশর্ত মোতাবেক ওকে হোটেলে ফিরে যেতে বলা হয় এবং আমাদের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। একজন বন্ধুকে হারিয়ে আমরা ছুটে চলেছি বগালেকের পথে সবার মনভারাক্রান্ত তারপরও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তাই ছুটে চললাম, পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই রুমা ক্যানেলের নীল জলরাশির দেখা পেয়ে গেলাম সবাই হঠাৎ মাসুমের আওয়াজ আমি চলে এসেছি, এখন অনেকটা ভাল বলে জানাল আমাদের তাই আমরা একসাথে রওনা হলাম। আমরা চলেছি আদিপথে বগালেক দুপাশে সারিসারি আঁকাবাঁকা পাহাড় সাথে বনাঞ্চল বন্যপ্রাণী রয়েছে হয়তবা কিছুদূর সামনেই চোখে পরল পাহাড়ের দুপাশ বেয়ে আদিবাসিদের জুম চাষ সাথে বিস্তির্ন ধানক্ষেত পাশের রুমা ক্যানেল থেকে জমিতে পানি দিচ্ছে কৃষক। রুমা ক্যানেলের স্বচ্ছ পানিতে পাথরের সাথে তীব্রস্রোত তাই পথ চলতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে তারপরও এগিয়ে চলেছি সবাই, কামরুল ও মাসুম ঠিক করেছে গণনা করবে কতবার আমাদের রুমা ক্যানেলের এপার হতে ওপার-পার হতে হবে বগামুখপাড়া পর্যন্ত পৌছতে। হঠাৎ আমার পাদুকা দুটোর একটা ছিঁড়ে গেল উপায় নেই ওটাকে ফেলে যাওয়া ছাড়া অগত্যা পানি-পাথুরে এই পথে খালি পায়ে যেতে হবে আমাকে পাহাড়ি মাটির স্পর্শ নিয়ে তাইত ছুটে চললাম। আমরা হাঁটছি রুমা ক্যানেলের পাশ দিয়ে এভাবেই দুঘণ্টা হাঁটার পরে ধ্রু বম জানালো সামনেই একটা উপজাতীয় বসতি সাথে বিকিকিনির দোকান পাওয়া যাবে পাহাড়ি কলা সাথে বিস্কিট পেয়েও গেলাম, পনের মিনিটের বিশ্রাম সাথে কলা ব্রেক। চিত্রগ্রাহকরা পুরো আদিপথধরেই মনের মত করে ছবি তুলছিল এখানেও চলল আদিবাসি ছোট ছেলে-মেয়েদের বিষয় একটু আলাদা কিছু, দেখা হল আদা বয়ে নিয়ে যাওয়া কৃষকদের একটা দল যাদের দেহের পরিবহন শক্তির দ্বারা দূর গ্রাম থেকে বাজারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া। দোকানের মালিকের সাথে কথা হল দুভাষীর মাধ্যমে জানা গেল পাহাড়ে তাদের জীবন ধারন, পরিবর্তন, সমস্যা সম্পর্কে যার ছোঁয়া আমরা সামনের পথে পথে দেখব বলে জানালেন। পথের পানে আবার ছুটে চলেছি ছোট ছোট ঘনজঙ্গল, ক্যানেলের পানি পেরিয়ে সামনেই দেখা পেলাম সামিউল-মাহিনদের দলকে কথা হল সবার সাথে তারপর ওদের পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে দেখা পেলাম তিন পাথরের ধাপে সৃষ্ট এক ছোট ঝরনার। চারিদিকে সবুজের সমারোহ নিশ্চুপ শান্ত পরিবেশ বর্ষায় তাই পানির উৎস অফুরন্ত কামরুলকে তাই সারা পথ ভিজতে দেখলাম রুমা ক্যানেলে। রুমা ক্যানেলের পানি যাত্রা পথে আমাদের তৃষ্ণা মিটাবার প্রধান উৎস ছিল যার স্বাদ এককথায় অমিয়, চলার পথে রুমা ক্যানেলের পানির কলকল ধ্বনি সারাক্ষণ আমাদের কানে বাজতে লাগল। এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছে গেলাম বগামুখপাড়া, ছোট আদিবাসি গ্রাম যার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে রুমা ক্যানেল। আদিবাসি মানুষ গুলো কাজে-কর্মে মশগুল ছোট ছেলেটা মাছ ধরছে বড় এক পাথরে বসে, স্লান করছে বউ-ঝি, বাকিরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত। পার্বত্য বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি জেলার সংযোগস্থল যার চারপাশে সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড়ের মাঝে বগামুখপাড়ার অবস্থান। চিত্রগ্রাহকদের কাজ শেষে বগামুখপাড়া থেকে আমরা বিদায় নিলাম, পাহাড় থেকে নেমে সামনেই ঝিরিপথ দুদিকে চলে গেছে আমরা ডান দিকের পতংঝিরি ধরে এগিয়ে চললাম বালি পাথর, পানি, জঙ্গল পেরিয়ে আমরা ক্রমশ বড় পাথরের দিকে চলে এলাম। পাহাড় এখানে সঙ্কুচিত আঁকাবাঁকা উপর-নীচ পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দেখি কাঁটা পাথর যার বুকে কাঁটা এক গুপ্ত পথ যার ভেতর দিয়ে আমি ও আনিস বাকিরা নীচ দিয়ে চলল সামনেই আরেকটা যাত্রা বিরতি সাথে আনা শুখনো খাবার ও অমৃত পানি দিয়ে চলল আমাদের ভোজন। ঘড়িরকাঁটায় তখন বারটা তাই দ্রুত আমরা হেঁটে চললাম এভাবে আধঘণ্টা হাঁটার পর গাইড জানালো আমরা চলে এসেছি পতং বা নাসাং ঝরনায়। সামনে দেখলাম দুজন আদিবাসি যুবক মাছ ধরছে ইলেকট্রিক বরশি দিয়ে বড় এক পাথরের উপর বসে তার সামনেই পতংঝিরি পানি পরছে অবিরত কিন্তু ঝরনা দেখতে পেলাম না তাই সামনে এগিয়ে গেলাম হুমায়ুনকে সাথে নিয়ে হঠাৎ বা পাশে পানির গর্জন, অসম্ভব সুন্দর এক ঝরনা লুকিয়ে রয়েছে পাথরের গভীরে। পানির প্রবাহ স্ক্রু এর মত তাইত নোমান এর নাম দিল স্ক্রু ঝরনা, সামনেই বৃহৎ জলাধার কোন ভয় নেই বলে জানাল ধ্রু বম অমনি হুমায়ুন নেই চেয়ে দেখি লাফ দিয়েছে আমার আগে তারপর আনিস, নোমান, স্বাক্ষর সবাই গোসল করছি আমরা পতংঝরনায়। পানির প্রবাহ ও স্রোত অত্যাধিক তাইত পতংঝরনা ছোঁয়ার জন্য কাছে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলাম না, একবার মাছের ঝাককে জোক ভেবে ভয়ই পেলাম। দুরন্তপনা শেষ হল ঘণ্টাখানেক পরে তাইত ছুটে চলতে হল আবার পতংঝরনার পাশে বয়ে চলা পতংঝিরির ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলের উপর দিয়ে উচু সমান পিচ্ছিল পানি পাথরের বুক চিরে। পতংঝিরির উপরে উঠার সময় ফয়সাল বলল অসম্ভব কামরুলও মনে মনে সায় দিল যা তার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল কিন্তু সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাই ব্যাগ থেকে রশি দিলাম ফয়সালের জন্য কিন্তু হামাগুরি দিয়ে চলে এল কামরুল, ফয়সাল আনিসের সহযোগিতায় বাকিরা আগেই ধ্রু বমের সাথে উপরে চলে এসেছে। বগালেক যাবার শেষ পাহাড়ের শুরু এখান থেকেই ডানদিকের পিচ্ছিল খাঁড়াসরু আঁকাবাঁকা ঝোপঝাড়ের পথ বেয়ে আমরা চলেছি আলো-অন্ধকারের মাঝ দিয়ে পথে আলো রয়েছে কিন্তু আলোদাতাকে দেখা এখানে সম্ভব নয়, এভাবে অনেকদূর এগুবার পর দেখা পেলাম আলোদাতার মনে হল কোন এক ঝোপ থেকে বেরিয়ে সবুজ আলোর মাঝে চলে এসেছি। পতংঝরনায় অতিরিক্ত লাফালাফির কারনে আমাদের কিছুটা শারীরিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যা কামরুলের মোটা দৈহিক গঠনকে বেশী আক্রান্ত করেছে, তাইত ওকে মাঝে মধ্যেই রশি দিয়ে টেনে তুলতে হল। আমরা সবাই পরিশ্রান্ত তাইত পাহাড়ের উপরে এসে বাতাসের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, পথের বাকি এক পাহাড় এখন শুধু নিচে নামতে হবে তাইত পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা চলেছি বগালেকের খোঁজে। পাহাড় পেরিয়ে স্বাক্ষর পৌঁছে গেল তারপর আমরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম বগালেক, চারিদিকে সবুজ পাহাড়ে বেষ্টিত মাঝে অথৈ পানির সমাহার এরই নাম বগালেক। বগালেকের উত্তরপারে বগালেকপাড়া যেখানে বম আদিবাসিদের অতিথি ঘরে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ধ্রু বম ঘরের মালিক নিথং বম ও দিদির সাথে আমাদের পরিচয় করে দিল। আমাদের অতিথি ঘরটি বগালেকের ঘাটপারে যার ডানপাশেই ক্যাথলিক গির্জা এছাড়া অন্য কোন ঘর বগালেকের ঘাটপারে নেই, মাটি থেকে চারফুট উচুতে মাচাং দিয়ে তৈরি যার অভ্যন্তরে দুটি কামরা সাথে পাঁচটি বড় বিছানা যেখানে পনের থেকে বিশ জনের আয়েশে রাত কেটে যাবে। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত দেহে আমরা নেমে পরলাম বগালেকের অথৈ পানিতে, স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে হুমায়ূন লাফ দিল ভাগ্য সুপ্রস্ন্য, না হলে নিচে লুকিয়ে থাকা বড় বড় কয়েক্টা পাথরের খন্ড রয়েছে যার সাথে সহজেই ধাক্কা খেয়ে অক্কা পাওয়া সম্ভব, সকলেই গোসল করছি কিন্তু বুঝতে পারলাম না পানি এত স্বচ্ছ কিভাবে হল ডুব দিয়ে নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পারছি। আমরা আধঘণ্টা ডুবিয়ে চলে এলাম পেটের ক্ষুধা মিটাতে, দিদি আমাদের জন্য দুপুরে খাবারের তালিকায় ভাত,আলু ভর্তা, ডিম ভাজি সাথে ডাল রেঁধেছেন খেলাম পেটপুরে কে জানে বাঙ্গালি খাবার যদি আর না পাই, দুপুরের খাবার শেষে মাচাং ঘরে সবাই যার যার জিনিসপত্র রেখে সামনেই মাচা দিয়ে তৈরি বারান্দায় বসে রইলাম। সারাদিনের ক্লান্তদেহ যেন ঘুমে আচ্ছন্ন তাইত কিছুক্ষণ পরে মাসুমের নেতৃতে নোমান, ফয়সাল ও কামরুল হাতিপোকার কামড়ের ভয়ে মশারির ভেতর একক্লান্ত নিদ্রায় শুয়ে পরল। আমরা বেরিয়ে পরলাম পড়ন্ত বিকালে বগালেকের অপরুপ রুপের খোঁজে পাড়ার সামনের রাস্তা ধরে আর্মি ক্যাম্প তারপর হেলিপ্যাড আবার ক্যাম্প, কথা হল সেনাসদস্যদের সাথে কথার যেন শেষ নেই বাঙ্গালি পেলেই হল এরই মাঝে ধ্রু বম সাথে তার বন্ধুরা মিলে চলে এসেছে ক্যাম্পের মাঠে ভলিবল খেলতে আমাদের আনিস ভাল ভলিবল খেলে তাই আমরাও তাদের সাথে নেমে পরলাম, পাহাড়ে এসে খেলাধুলা করে বেশ ভাল সময় পার করলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা হয়েছে তাই ফিরে চলেছি, পথে দেখা হল কয়েকজন পাহারিদের সাথে যারা বগালেক থেকে হরেক রকম মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, দেখা হয়ে গেল সামিউল-মাহিনদের সাথে ওরা ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে উঠেছে সিয়াম দিদির অতিথি ঘরে ক্লান্ত শরীর তাই দেখা হবে বলে ফিরে এলাম ঘরে। সন্ধ্যা হয়েছে ওরা চারজন এখনো ঘুমে বিভর তাই জাগিয়ে দিলাম, পেটে ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছে সবার তাই একসাথে বের হয়ে ধ্রু বমকে নিয়ে চলে এলাম তার মাশ্তুত ভাইয়ের দোকানে এদিকে স্বাক্ষর সামিউল-মাহিনদের নিয়ে এল, মুড়ি-চানাচুর সাথে ছোট পাহাড়ি ঝাল কাঁচামরিচ মাখিয়ে খেলাম তারপর এক কাপ গাড় রং চা, খাওয়া শেষে পা দুটোর সহায়তায় চলে এলাম বগালেকের ঘাটে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়েছে আমাদের আড্ডা চলছে বগালেকের ঘাটপাড়ে, আকাশের সাদা রংয়ের চাঁদ যেন তার মায়াবি আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নোমান, স্বাক্ষর এই সময়টুকু ধরে রাখছে তাদের ক্যামেরার সাহায্যে সেই সাথে আমাদেরকেও, মায়াবি এই নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে বগালেকের চারিদিকে জোস্নার আলোয় আলোকিত লেকের পানি ঝিলিমিলি অপরূপ সাজে ঢেউ খেলছে। সময়টুকু ভালই কাটছিল তবে রাতের খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে ধ্রু বম কয়েকবার ডেকে গেছে তাই দেরি না করে সবাই গিয়ে খেয়ে নিলাম দিদির হাতের বাঙ্গালি রান্না। পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম ঘাটপাড়ে গল্পে মশগুল সবাই আগামীকালের কেওক্রাডং অভিযান নিয়ে এরই মাঝে কামরুলের পেটে বড় ঘরের ডাক পরেছে টয়লেট চিনি না কেউ, ধ্রু বমও আমাদের সাথে নেই উপায় একটাই জঙ্গল, তাই একটা লাইট নিয়ে ভো-দৌরে চলে গেল চার্চ পেরিয়ে ফিরে এল অনেকক্ষণ পরে ওকে দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পরল সবাই। রাত গভীর তাই আড্ডাটাকে শেষ করে মাচাং ঘরে ফিরে এলাম মশারি লাগানো হচ্ছে কাল ভোরে উঠতে হবে শরীর ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পরলাম।
দু’শরা শ্রাবণ
ভোর হয়েছে তারপরও রাতের আঁধার কাটেনি ঘুমে বিভোর সবাই এরই মাঝে সাক্ষরকে সাথে নিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছি সবাইকে কিন্তু ঘুম যেন ক্লান্ত শরীরকে আচ্ছন্য করে রেখেছে তাইত উঠতে দেরি হচ্ছে, সবাই উঠেছে এরপর সকালের অতি জরুরি কাজ শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে রয়েছি কেওক্রাডংকে দেখার জন্য তাইত সময় হয়েছে আবার একসাথে বেরিয়ে পরার, ধ্রু বম জানালো দিদি আমাদের জন্য ভোরে উঠে রান্না করেছেন সুতরাং না খেয়ে যাওয়া যাবে না অগত্যা কিছুই করার নেই, এদিকে সামিউল-মাহিনরা আমাদের রেখে রওনা দিল সেনাবাহিনির টহল দলের সাথে সামনেই দেখা হবে বলে বিদায় দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় সাত’টা বেজে গেছে আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম সবাই, ধ্রু বম পথ সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দিল আমাদের তারপর থেকে পেছনে গাইড সামনে আমরা, এগিয়ে যাচ্ছি বগালেকের উত্তর দিক দিয়ে পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুপায়ো পথ বেয়ে। আমাদের আজ আনুমানিক দু’হাজার ফুট উপরে উঠতে হবে, যার শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে তাই এখন শুধু লক্ষে পৌছার পালা। বগালেকের উত্তরের সবচেয়ে উচু পাহাড়ের উপর থেকে লেকটিকে সত্যি অসম্ভব সুন্দর লাগছে যা না দেখলে অনুভব করা যাবে না, পাহাড়ের ঢালে চলার পথের দু-ধার প্রকৃতি তার আপন হাতে তৈরি করেছে যার মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমরা প্রায় একঘন্টা পথ হেঁটে এসেছি, ঘন জঙ্গল পাহাড়ি লাল মাটি পেরিয়ে সামনেই চিংড়ি ঝরনা জানালো ধ্রু বম পাহাড়ের উপর থেকে দেখে নিলাম একঝলক ফেরার পথে যাব বলে ঠিক করলাম, সামনেই নিচে বাম দিকে পাথরের পথ যার ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে অবিরাম সেই পথের শেষেই চিংড়ি ঝরনা। আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি ঢাল একবার উপরে উঠলে সামনেই নেমে যেতে হচ্ছে যার ফলে শারীরিক ভাবে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব হচ্ছে কিন্তু মনের দিক থেকে কিছুই যেন বুঝতে পারছি না শুধু মনে হচ্ছে আমরা চলে এসেছি প্রকৃতির মাঝে যেখানে ক্লান্তি বলে কিছু নেই আছে শুধু অফুরন্ত মুগ্ধতা। পথে দেখা পেলাম কয়েকটা ভাঙ্গা কাল্ভারট যার কিছুই অবশেষ নেই আছে শুধু পাহাড়ি খন্দকের মাঝে দুটো বাঁশের তৈরি সাঁকো পরে গেলে ওখানেই কবর হয়ে যাবে। আমরা দ্রুত হেঁটে চলেছি সামনেই লাল মাটির পাহাড়ি সমান্তরাল পথ যার উপরে একটা বিশ্রামাগার দেখা পেয়ে গেলাম সামিউল-মাহিনদের দলকে যারা আমাদের চেয়ে ঘণ্টাখানেক আগে রওনা করেছিল। বিশ্রামাগারে পাঁচ মিনিটের বিরতি নিলাম, চিত্রগ্রাহকগন পথের এইখানে দাঁড়িয়ে পূর্বের সীমান্ত পাহাড়মালা যার একপ্রান্তে ডুম-লং অন্যপ্রান্তে মদক মোয়াল যার মাঝখানে তিনমুখ সীমান্ত, যেন লেন্সের ভেতর দিয়ে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল। হুমায়ূনকে জোঁক ধরেছে লাল রক্ত ঝরছে কিন্তু জোঁকের দেখা নেই দেখা পেলাম আমার পায়ে সাথে সাথে ওঝা দিয়ে দিল একচিমটে লবন অমনি পলায়ন। আমরা দার্জিলিং পাড়া থেকে খুব বেশি দূরে নেই তাই দ্রুত পথের বাঁকে হারিয়ে গেলাম, পথ যেন দ্রুত ধরা দিচ্ছে আমাদের কাছে সেই সাথে প্রকৃতি পাহাড়ের দুপাশে সারি সারি গাছ মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে উপরে উঠেই পৌঁছে গেলাম বাংলার দার্জিলিং। পাহাড়ের উপরে সমতল ভূমিতে দার্জিলিং পাড়ার অবস্থান যার চারিদিকে দৈত্যকার দানবদের হাতছানি এরই মাঝে আমরা বিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি নিলাম। দার্জিলিং পাড়া স্বপ্নের মত আমাদের কাছে ধরা দিল তাই চিত্রগ্রাহকদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম একে জানার জন্য সামনেই দার্জিলিং পাড়ার বিখ্যাত চা’য়ের দোকান সুতরাং চা সাথে অন্যকিছু না হলে কি হয়, দেখা পেলাম আমাদের আগে রওনা করা সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে কিছুক্ষন পরেই সামিউল-মাহিন্রাও চলে এল। দার্জিলিং পাড়াটি আয়তনে বেশ বড় চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো আবাস্থল তবে বেশ গুছানো ও পরিচ্ছন্ন প্রবেশের মুখে ইন্ডিপেনডেন্ট ব্যাপটিস্ট চার্চ শেষে দার্জিলিং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঝে ঘর-বাড়ি সামনেই উঠান যেখান থেকে আমরা প্রথমবারের মত দেখা পেলাম কেওক্রাডং চূড়া। চারিদিকে কেমন যেন উৎসবের আমেজ ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে তরুণীরা নতুন পোশাকে ঘোরাফেরা করছে মানুষজন ব্যস্ত লোকজনও কেমন যেন বেশি মনে হচ্ছে, ধ্রু বম জানাল আজ রোববার উপাসনার দিন তাইতো দূর-দূরান্তের ধর্মীয় মানুষজন সাজসজ্জা করে চলে এসেছে, এদিকে ধ্রু বম নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সাপ্তাহিক উপাসনায় যোগ দিতে না পারায় তাই সবাইকে দ্রুত সকল কাজ শেষ করিয়ে রওনা হলাম আমাদের পথে ওই দৃপ্তমান কেওক্রাডং চূড়ার উদ্দেশ্যে। দার্জিলিং পাড়া থেকে সোজা পাহাড়ি পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনেই দুটো উঁচুনিচু পাহাড়ি বাঁক যার পথ ধরে দ্রুত ছুটে চলেছি , সামনেই উচু এক পাহাড় যার উপর থেকে পেছনে তাকিয়ে দেখি দার্জিলিং পাড়া সগৌরবে দাড়িয়ে রয়েছে যেখানে কিছুক্ষণ আগেও আমাদের পদচারনা ছিল। আমাদের দলের কয়েকজন পেছনে পরে গিয়েছে সামনে আনিস দূরে পেছনে মাসুম এমনই সময় হঠাৎ সামনের পাহাড় চূড়ায় দেখা পেলাম স্বপ্নে ভেসে আসা এক পাহাড় দানব কেওক্রাডং। আমরা পৌঁছে গিয়েছি কেওক্রাডং কিন্তু চূড়ায় যেতে এখনো কয়েকশ ফুট উপরে উঠতে হবে তাইত দু’মিনিট দাড়িয়ে চারিদিকের স্তব্দতা পেরিয়ে দেখি আনিস ও সাক্ষর চলে গিয়েছে সাথে মাহিন, তাই দেরি না করে ফয়সালকে সাথে নিয়ে আবার ছুটে চললাম। ঘড়ির কাঁটায় দশ ছুঁই ছুঁই জুম ক্ষেতের সবুজ পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তখন আমরা কেওক্রাডং চূড়া পৌঁছে গিয়েছি ততক্ষণে লেট’স ট্র্যাভেলের পক্ষ থেকে আনিস সর্বপ্রথম কেওক্রাডং চূড়া জয় করেছে। কেওক্রাডং চূড়ায় আমরা ক’জন পৌঁছে গিয়েছি কিন্তু বাকিরা এখনও পৌঁছায়নি, বিশ্রামাগারে অপেক্ষারত কিন্তু বাকিদের দেখা নেই তাই উঠে পড়লাম বিশ্রামাগারের ছাঁদে কিছুক্ষনের মাঝেই একে একে সবাই চলে এলো। ধ্রু বম মাসুমকে সাথে নিয়ে সর্বশেষে এসেছে তারপর থেকেই হইচই এক হজবরল আনন্দঘন পরিবেশ চূড়ার উপর, কিছুক্ষন পরেই সব শান্ত সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেছে কেওক্রাডং পাহাড় চূড়ার পরিবেশটাকে নিজের মত করে উপভোগ করার জন্য। পাহাড় দানব কেওক্রাডংয়ের বিশ্রামাগারের ছাঁদের উপর থেকে চারদিকের পরিবেশ যেন মায়াবী এক রুপ ধারন করেছে তাইত কামরুল ও মাসুম তাদের ওই ভারী দেহ নিয়ে উপরে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে আমাদের সহযোগিতায় উপরে উঠে এল। আমরা আজ দাড়িয়ে রয়েছি কেওক্রাডং পাহাড় চুড়ায় যেখানে শ্রাবণের এই মেঘ-রৌদ্রের দিনে উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলে এসেছি তিন হাজার একশত বাহাত্তর ফুট ভাবতেই শরীরে কেমন যেন শিহরনের সৃষ্টি হচ্ছে। কেওক্রাডং চূড়ার চারিদিকের পরিবেশের কেমন যেন পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে হঠাৎ স্তব্দতা ভেঙ্গে বাতাসের মোহমুহ গর্জন, মাথার উপর রৌদ্রতাপ কোথায় যেন হারিয়ে গেল তারপর সবাইকে অবাক করে দক্ষিনি-পশ্চিমি হাওয়ার সাথে ভেসে আসতে লাগল মেঘ, সারাদিনের রৌদ্রতাপের শেষে যেন তার বিন্দু বিন্দু জলে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোন জাগতিক গ্রহে। কেওক্রাডং রেঞ্জের চারপাশে যতদূর দৃষ্টিসীমা রয়েছে ততক্ষণে সবটুকু মেঘের রাজত্বে চলে এসেছে, আকাশে বাতাসে আজ শুধুই মেঘ মেঘ আর মেঘ অন্য কিছুর দেখা মিলা ভার। পাহাড়ে আজ মেঘের মেলা বসেছে তাই সেই মেলার দোলে জুম ক্ষেতের সবুজ অরণ্যে মেঘ আশ্রয় নিয়েছে, কেওক্রাডং রেঞ্জ মেঘে ভেসেই চলেছে আর মদক রেঞ্জতো মেঘের দেয়াল রুপে জানান দিচ্ছে এখানেই বাংলাদেশর সীমান্ত। লেট’স ট্র্যাভেলকে অসংখ্য ধন্যবাদ যার কল্যাণে আমরা আজ জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু পার করছি সেই সাথে এবারের দলের সকল সদস্যকে যারা প্রতিনিয়ত মেঘের ভেলার মত ভেসে বেড়াচ্ছি বাংলার পথে প্রান্তরে। পাহাড় দানব কেওক্রাডং চূড়ায় ঘন্টা দু’য়েক সময় কিভাবে যে জীবন থেকে চলে গেল বুঝে উঠার আগেই আমাদের ফিরে চলার সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাইত সবাই শেষ বিদায় জানিয়ে ঐ মেঘের রাজ্যকে ছেড়ে বগালেক পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পাহাড়ি পথ বেয়ে বাতাসের অনুকূলে এই মেঘলা আবহাওয়ায় যেন আমরা একরকম দৌড়েই ছুটে চলেছি, পথ যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে তাইত কিছুক্ষনের মাঝেই দার্জিলিংপাড়ায় পৌঁছে গেলাম। দার্জিলিংপাড়ায় পানি পানের বিরতি দ্রুত শেষ করে আবার হারিয়ে গেলাম পথের বাঁকে, কেওক্রাডং চূড়া থেকেই মেঘ আমাদের পিছু নিয়েছে মেঘলা পরিবেশ বৃষ্টি হবার অপার সম্ভাবনার কথা জানাল ধ্রু বম সেই সাথে সবাইকে দ্রুত হাঁটার পরামর্শ দিল। বৃষ্টির কথা বলার পর থেকেই আমার পা যেন সামনে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে না কারন একটাই পাহাড়ি পথে বৃষ্টির সাথে পথ চলার যে আনন্দ যেন কোনক্রমেই হাতছাড়া না হয় কিন্তু বাতাসের বাঁকে মেঘগুলো যেন ভেসেই চলেছে কোথাও স্থির হয়ে বৃষ্টি রুপে ঝরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ি উঁচুনিচু বাঁক পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি চিংড়ি ঝিরিতে যার পাথরের পথ পেরিয়ে ডানে ভেতরেই রয়েছে অনন্য এক পাহাড়ি চিংড়ি ঝরনা। সামিউল-মাহিন্রা কেওক্রাডং যাবার সময় দেখে গেছে কিন্তু মনের খোরাক না মিটার কারনে মাহিন আমাদের সাথে থেকে গেল। আমরা জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম অনন্য ঝরনাটাকে মনে পরল সৌম্য ভাইকে যিনি বর্ষায় চিংড়ি ঝরনাকে না দেখে ফিরতে নিষেধ করেছিলেন, আমরা নিচ থেকে ঝরনাকে দেখছি কিন্তু মন ভরছে না আমার তাইত পনের ফুটের পিচ্ছিল উচু পাথরের ধাপ পেরিয়ে সবাইকে উপরে এসে দেখার অনুরোধ করি স্বাক্ষর, আনিস ও মাহিন ভিজেপুরে চলে এসে দেখতে পেল এই অনন্যতা। ধ্রু বম ভিজতে মানা করেছিল কিন্তু উপরে উঠার সময়ই ভিজে গিয়েছি এদিকে বাকিরা বৃষ্টি নামছে আর আমাদের উপরে উঠতে দেখে বিরক্ত হয়ে বগালেকের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে। ধ্রু বমের সাথে নোমানকে নীচে দেখেছিলাম কিন্তু এখন কেউ নেই সবাই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে তাইত নিশ্চিন্তে ভিজতে লাগলাম কিন্তু আকাশের অবস্থা ভাল না চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে তাইত চিংড়ি ঝরনাকে বিদায় জানিয়ে ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে বাহিরে এসেই দেখি প্রকৃতি এক প্রবল মায়া কান্নার আয়োজন করে ফেলেছে। বৃষ্টি এখন সময়ের ব্যাপার মেঘ পরিপূর্ণ্যতায় বিদ্যমান চারিদিকে এ যেন মেঘকালো মায়ায় অন্ধকার, হঠাৎ মনে ভয় হচ্ছে জোঁকের কারনে পাহাড়ি বনে জঙ্গলে বৃষ্টির সময় বহমান পানির সাথে জোঁকের দল হরিনের মত লাফিয়ে বেরায় এজন্যই নিজের অজান্তেই পায়ের গতিটা দ্রুত এগিয়ে চলছে। কিছুক্ষনের মাঝেই সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে মেঘ বৃষ্টিতে তার রুপ পরিবর্তন করে অঝোর ধারায় আমাদের উপর বর্ষিত হল। এ যেন কল্পনায় এক অদেখা স্বপ্ন যার বাস্তবতা আমাদের সামনে, কি করব বুঝে উঠতে পারছি না শুধু প্রান ভরে দেখে চলেছি এই মেঘ বৃষ্টির মেলা। পাহাড়ি পথ বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাচ্ছে যার ফলে নীচে নামার সময় সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছি, বনের গাছ পাতার সংস্পর্শে এলেই মনে হয় জোঁক বুঝি ধরেছে এভাবে ভাঙ্গা কাল্ভারটের উপর বাঁশের দু’পায়ে সাঁকো পার হয়ে উপরে উঠেই বৃষ্টির ভিতর দিয়ে দেখা পেলাম বগালেক। আমরা পোঁছে গেছি বগালেকের উপর পাহাড় সারিতে যেখান থেকে লেকের সৌন্দর্য মনে থাকবে চিরকাল, এখন শুধু নীচে নামার পালা বাঁক পেরিয়ে কিছুক্ষনের মাঝেই চলে এলাম বগালেকপাড়ায়। বৃষ্টি অবিরত হয়ে চলেছে তাইত দলের সকলকে পেয়ে গেলাম বগালেকের পানিতে বৃষ্টির সাথে গোসল করা অবস্থায়, নোমান ছবি তুলতে ব্যস্ত শুধু বলল পেছনে দেখেন সত্যি অবিশ্বাস্য এই কিছুক্ষন আগে যেদিক দিয়ে নীচে ফিরলাম সেখানের পাহাড় সারি দখল করে নিয়েছে মেঘের ভেলা শুধু গাছপালা গুলো মেঘকে চিনিয়ে দেবার জন্য রয়েছে কিন্তু কোন পাহাড়ের চিহ্ন খোঁজে পেলাম না। ইতিমধ্যে নিজের চোখকে বিশ্বাস করিয়ে বুঝতে পারলাম পেটে ক্ষুধা লেগেছে বড্ড তাই দিদির কাছ থেকে এক ঝুরি পাহাড়ি কাঁচা আম নিয়ে বৃষ্টির মাঝেই সবাই বগালেকে বসে খেলাম। বগালেকের পানির স্বচ্ছতা যেন বৃষ্টির পানি থেকেও গভীর, এই বৃষ্টি ও লেকের পানিতে ঘন্টা খানেক ডুবিয়ে একে একে সবাই মাচাং ঘরে ফিরে এলাম। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দিদি ডাকছিলেন তাইত বৃষ্টির মাঝ দিয়ে ভোঁদৌড়ে চলে গেলাম, সবার পেটে ক্ষুধা তাই পেটপুরে খেয়ে নিয়ে চলে এলাম মাচাং ঘরে। আমাদের আজ বগালেকপাড়া থেকে রুমা বাজার ফিরে যাবার কথা কিন্তু প্রকৃতি যেন যেতে দিতে চাচ্ছে না তাইত বৃষ্টি এখনও ঝরছে অঝোর ধারায়, ততক্ষণে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আজ এখানেই থেকে যাবার। বৃষ্টি যেন থামতেই চাচ্ছে না অগত্যা গল্প গুজবে সময় কাটাতে লাগলাম মাচাং ঘরের বারান্দায়, বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যার উপক্রম বৃষ্টি এখন কমতে শুরু করেছে তাই বেরিয়ে পরলাম চিত্রগ্রাহকদের সাথে নিয়ে যারা এখন ঘুমিয়ে পরেনি। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি পাহাড় বেয়ে পাশের মুরং পাড়া হয়ে সৈকত পাড়ার রাস্তায় বৃষ্টির পরে প্রকৃতি চারিদিকে সবুজ সতেজ কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তাই ফিরে এলাম। বগালেকে মাছ ধরছে আধিবাসিরা স্বাক্ষরের মাছ ধরার ইচ্ছে প্রকাশ করল কিন্তু ধ্রু বম নেই তবে কলাগাছের বেউড়ার কাছে যেতে পারলে উপায় একটা হত তাই এবারের মত ইচ্ছেটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলে এলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ফয়সাল মাসুম ও কামরুলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে চলে এলাম ধ্রু বমের মাশ্তুত ভাইয়ের দোকানে আবার গতকালের মত মুড়ি চানাচুর সাথে পাহাড়ি ঝাল মরিচ নিয়ে চলে এলাম মাচাং ঘরে কারন বৃষ্টি আবার ঝিরিঝিরি করে ঝরতে শুরু করেছে। ধ্রু বম চলে এসেছে তাই এক সাথে বসে মাচাং ঘরে সোলারের আলোতে মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে সবাই খাচ্ছি আর দোয়া করছি আজ রাতের মধ্যেই যেন বৃষ্টি শেষ হয়ে যায়। রাতের খাবার খেয়ে নিথং বম ও দিদির সকল দেনা মিটিয়ে আবার আসব বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ঘরে কারন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পরব রুমা, বান্দরবন হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাত বার’টা পেরিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি চাঁদের আলোকে ঢেকে ফেলেছে কিন্তু ঘুমাতে যেতে পারছি না কামরুল মাসুম ও ফয়সালের যন্ত্রনায় তাই গল্পগুজবে সারাদিনের রোমাঞ্চকর এক সফল ট্রেকের পরিসমাপ্তির অভিজ্ঞতা একে অপরের সাথে বিনিময় করে কখন যে রাত দু’টা বেজে গেল কেউ বুঝতে পারলাম না। বর্ষাকাল বাংলার সবচেয়ে সুন্দর সময় যখন প্রকৃতি তার রুপের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে ধরা পরে পাহাড়-পর্বতে যার কিছুটা আমরা আজ দেখতে পেলাম এই ট্রেকে এসে, কাল বগালেক থেকে ভোরে উঠে ফিরে যেতে হবে চিরচেনা যান্তিকতায় তার কথা চিন্তা করতে করতে এই গভীর রাতে ক্লান্ত দেহ নিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পরলাম।
তে’শরা শ্রাবণ
ভোরের আলো চারিদিকে অন্ধকারের মত ছড়িয়ে রয়েছে, কাল দুপুর থেকে সারারাতের মত এখনো বৃষ্টি অঝোর ধারায় ঝরে চলেছে। আজ আমাদের ফিরে যেতে হবে বগালেক থেকে ঢাকার পথে তাইত ঘুম থেকে কাউকে জাগিয়ে দিতে হয়নি সবাই উঠে সবকিছু গুছিয়ে তৈরি হয়ে বসে রয়েছে মাচাং ঘরে, কখন বৃষ্টি থামবে অমনি বেরিয়ে পরব ফিরে চলার পথে এক অজানাকে জয় করে। ভোর হতে সকাল কিন্তু বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না তবে এখন অনেকটা কমতে শুরু করেছে অগত্যা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে গুরি গুরি বৃষ্টির মাঝেই সামিউল-মাহিনদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের সেনা ক্যাম্প পেরিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে কাদামাটির পাহাড়ি পথে, মাথার উপর বৃষ্টি গুরি গুরি বয়ে চলেছে রেইনকোর্ট গায়ে জড়িয়েও ভিজেপুরে সবাই একা-কার তারপরও এগিয়ে চলেছি ন্যাংলা পাড়ার উদ্দেশে। বগালেকের ঢাল পেরিয়ে হেঁটে চলেছি মাথার উপর বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে সবাই এগিয়ে ফয়সাল ও আমার পায়ের জুতার অবস্থা বেহাল কাদামাটি দিয়ে আরেকটি নতুন জুতু যেন প্রকৃতির ফ্রি উপহার কিছুক্ষন পর পরই পরিষ্কার করতে হচ্ছে নতুন জুতা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ সবাই প্রায় একসাথে এমন সময় ছাতা মাথায় কামরুল, মাসুম ও ধ্রু বমকে পেছনে ফেলে দু’জন আদিবাসী ললনার আগমন, না ওরাও চলেছে প্রয়োজনের তাগিদে খুব দ্রুত হেঁটে চলেছে, সামনেই হুমায়ূনকে দেখলাম ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে কিছুক্ষন পরেই দেখি ওরা মেঘে গা-ঢাকা দিয়েছে। এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ চারিদিকে পাহাড়, বৃষ্টি, মেঘ এরই মাঝে পাহাড়ি ললনাদের উঁকিঝুঁকি সেই সাথে আমরা ক’জন ছুটে চলেছি দুর্গম পথ পেরিয়ে, সামনেই পাহাড় ধস হয়ে পাথুরে মাটি দিয়ে অর্ধেক রাস্তা প্রায় বন্ধ পাশ কাটিয়ে এগিয়েই দেখি ইটের সলিং তাই বুঝতে কারো বাকি রইল না যে আমরা চলে এসেছি ন্যাংলা পাড়া। এখান থেকে রুমা বাকি এগার কিঃমিঃ রাস্তা আমরা পারি দিব ঐ চান্দের গাড়িতে করে, ধ্রু বম জানাল গাড়ির জন্য আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে তাই সবাই পাশের আদিবাসী দোকানে বসে সকালের ক্ষুধা নিবারন করতে বসে পরলাম, পাহাড়ি চাম্পা কলা সাথে বিস্কিট তারপর চা বেশ ভালই লাগল। আধঘন্টা পেরিয়ে গেল কিন্তু চান্দের গাড়ি এখনও বোধহয় পৃথিবীর কক্ষপথে এসে পৌঁছায়নি, পাহাড়ি পরিবেশটাও অন্য রকম তাই অপেক্ষার পালা শেষ করে রওনা হলাম নিজের পা দুটোকে সাথে নিয়ে, সবাই পরিস্রান্ত তাই বোধহয় কাউকে সঙ্গ দেয়ার মত পেলাম না, অগত্যা ন্যাংলা পাড়ার খাড়া পথ বেয়ে উপরে উঠে এলাম। আজ অনেক দিন পরে একা পথ চলা তাও আবার পাহাড়ে বৃষ্টির মাঝে তবে সবচেয়ে অবাক হলাম যখন পূর্বের মদক রেঞ্জের দিকে চোখ মেলে তাকালাম মেঘ যেন সারা পাহাড় দৌড়ে এখানে এসে পড়ে রয়েছে, মনে হল স্বর্গের কোন বাস্তব প্রতিচ্ছবি এখানে ভেসে উঠেছে। আমি হেঁটে চলেছি রুমা বাজারের পথে যতটুকু এগিয়ে যাওয়া যায় এভাবে ঘন্টাদেরেক চলে যাবার পর সেই চান্দের গাড়ির দেখা পেলাম চালককে ইশারা করতেই গাড়ি থামাল জানিয়ে দিলাম আমাকে ফেলে যেন না যায়। প্রকৃতির মায়া কাটিয়ে ঠিক বিশ মিনিট পরেই সবার দেখা পেয়ে গেলাম হাঁটা থামিয়ে চার চাকার ছাদে উঠে রুমা সদরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মনে হল বাধ ভাঙ্গার আওয়াজ সবার বুক থেকে মুখে ফুটে উঠেছে, ছাদে আমরা ক’জন যেন থামতেই চাচ্ছি না তারপর উঁচুনিচু রোলারকোস্টার সেই সাথে গাছের ডালপালার উঁকিঝুঁকি এভাবে ঘন্টাখানেক যাবার পরেই থামতে হল কারন চলে এসেছি রুমা থানার সামনে অমনি হুমায়ুনকে লক্ষ্য করে সামনে দাঁড়ানো দুই সিপাহির বাণী ‘‘এত উপরে কেন পড়ে মরে গেলে বাড়ি পাঠাইতেও হেলিকাপ্টার লাগবে’’ অমনি কে যেন ঠোঁটকাটা বলে উঠল ‘‘ভাই তাইলে তো ভালই হয় ওর হেলিকাপ্টারে উঠার শখটা বিনা পয়সায় পূরণ হয়’’ অমনি সবাই হেসে উটলাম। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে চলে এসেছি আমাদের গন্তব্যে-আজ রুমায় হাট দিন তাইত কিছু সময় এখানে কাটিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হব বান্দরবনের উদ্দেশ্যে। রুমা বাজারে আজকের হাট দিনে দূর-দূরান্তের পাহাড়িদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে, সবাই নিজেদের পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করছে কিন্তু বাজারে ক্রেতা সমাগম এখনো পুরোপুরি হয়নি বলে জানাল ধ্রু বম। রুমায় দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা তৈরি হচ্ছি ফিরে যাবার জন্য সময় হয়েছে বন্ধু ধ্রু ব্যাঙ্গ বমকে বিদায় জানানোর তাই একে একে সবাই আমরা আবার আসব জানিয়ে বিদায় নিলাম। ধ্রু বমের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব এই কয়েকদিনে একজন গাইডকে ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটে রুমা নৌ-ঘাটে ‘‘আগামীবার তোমরা আমার বাড়িতে এসো’’। রুমা থেকে ইঞ্জিন নৌকা ছেড়ে দিল কৈক্ষং বাজারের উদ্দেশ্যে দু-পাশে সাঙ্গুরপাড় সেই সাথে অপরূপ প্রকৃতি অজানা পথ পেরিয়ে ঘন্টাখানেকের মাঝেই আমরা পৌঁছে গেলাম। কৈক্ষং বাজার নৌ-ঘাটের পাশেই কৈক্ষং ঝিরি সেখানে অতি জরুরী এক প্রাকৃতিক কাজ সেরে সোজা কাদামাটির ঘাট পেরিয়ে উপরে কয়েকটি দোকান তার উপরেই রুমা-বান্দরবন রাজপথ। যাত্রী ছাউনিতে অপেক্ষমান যাত্রীদের নিয়ে একটি বাস চলে গেল আমরা টিকিট মাস্টারের কাছ থেকে পরের বাসের সিট নিয়ে বসে রইলাম বাস ছাড়ার অপেক্ষায় মিনিট বিশ পরেই যাত্রী বোঝাই বাস ছেড়ে দিল। সকাল থেকে দুপুর এখন বিকেল হবার উপক্রম আমাদের পথ যেন আজ শেষ হচ্ছে না তাইত সবাই বাসের সিটে হেলান দিয়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে কয়েকজন ঘুমিয়ে পরেছে। বাস চলছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কিছুদূর সামনেই জানালায় কেমন যেন মেঘের অনুভূতি বাইরে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম, এই বুঝি বর্ষায় পাহাড় দর্শন যার প্রতিটি বাঁকে সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আমার পাশেই স্বাক্ষর ও নোমান কয়েকবার চেষ্টা করলাম ওদের প্রকৃতির এই বৈচিত্রটাকে দেখানোর কিন্তু একবার উঁকি মেরেই পরক্ষনেই আবার আগের অবস্থায়, এদিকে ফয়সাল সামনের সিটে বসে দিব্যি উপভোগ করছে। আমরা চলে এসেছি চিম্বুক রেঞ্জের মধ্যে তাইত ডান পাশের গিরিখাদের নিচে মেঘের সমারোহের কারনে বয়ে চলা সাঙ্গুকে দেখতে কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে পাহাড়ে আজ মেঘের আগুন লেগেছে যার জ্বলজ্বল শিখা আমরা বাসে বসেই দেখতে পাচ্ছি। বাস ছুটে চলেছে আপন গতিতে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে কিছুদূর চলতেই আমরা চলে এলাম ‘ওয়াই’ জংশন, এখানে দশ মিনিটের জন্য বিরতি তাই নেমে পরলাম সবাই। চারিদিকে মেঘের রাজ্য যেন এক স্পর্শেই ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, যাত্রী ছাউনির আশপাশের জনগনকে দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছে কেন এই স্বর্গে আমাদের জন্ম হল না। ওয়াই জংশনের দশ মিনিটের বিরতি যেন বিশ মিনিটেও শেষ হচ্ছে না ঘুমিয়ে পরা চিত্রগ্রাহকদের লেন্সের আলোর ঝিলিক শেষ না হতেই বাস ছেড়ে দিল। সামনেই ওয়াই মোড় বা’য়ে রেখে বাস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে আপন গন্তব্যের পথে, এভাবে চলতে চলতে দূর পাহাড়ের মেঘে ভেসে এলো টাইগার হিল, মনে হল সারা দিনের ক্লান্তি শেষে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটা ঘনিয়ে এসেছে গাড়ি থামল রুমা-থানছি বাসস্ট্যান্ডে, নেমে পরলাম সবাই যেতে হবে সদর বাসস্ট্যান্ডে তাই হাঁটতে শুরু করলাম পুরনো সেই পরিচিত পথে, মিনিট দশ পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম। ইউনিক বাস ছাড়বে সন্ধ্যা সারে সাতটায় তাইত কাউন্টার থেকে বুকিং টিকিট নিয়ে বিকালের হালকা খাবার খেয়ে বাকি সময় কিভাবে পার করব, ফয়সাল বলল বাসে বসে থেকে পায়ে চর্বি জমে গেছে চলেন টাইগার পাড়ার দিকে হেঁটে আসি। বাস কাউন্টারে মাসুম ও সাক্ষরকে ব্যাগ পাহারায় রেখে আমরা বেরিয়ে পরলাম বান্দরবন-ঢাকা মহাসড়ক ধরে সামনেই দু’টো লোহার বেইলি ব্রিজ পেরিয়ে দেখা পেলাম বন প্রপাত, কিছুদূর এগিয়েই টাইগার হিল কিন্তু উপরে উঠার শক্তি পায়ে অনুভব না করায় সবাই ফিরে চললাম। পাহাড়ে সন্ধ্যা খুব দ্রুত নেমে পরে তাই দ্রুত ফিরে এলাম, বাস কাউন্টারে ওরা দুজন বসে গল্পে মশগুল সামিউল-মাহিনদের সাথে ওরা যাচ্ছে এই বাসে অগত্যা আমরাও যোগ দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় সারে সাত বাস ছেড়ে দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে সবাই কথাবার্তা বলছে রোমাঞ্চকর এই ভ্রমন নিয়ে, বাস ছুটে চলেছে কেরানিহাট পার হয়ে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ক্লান্ত দেহটিকে জাগিয়ে রাখা সম্ভব হল না তাই বাসের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
চৌঠা শ্রাবণ
রাত পেরিয়ে ভোর বাস চলে এসেছে কাঁচপুর ব্রিজ পেরিয়ে ঢাকা, সামনেই যাত্রাবাড়ী মোর বিদায় দিতে হবে কামরুল-হুমায়ূনকে তাইত একে একে সবাই এবারের মত বিদায় দিলাম। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল নেমে পরলাম সবাই এবার বিদায় দিতে হবে সামিউল-মাহিনদের তারপর আবার লোকাল বাসে আমরা পোঁছে গেলাম বিমানবন্দর। এবার বাড়ি ফেরার পালা দুঃসাহসিক এক অভিযান সফল ভাবে সম্পূর্ণ করায় একে অপরকে অভিনন্দন জানিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেলাম। লেট’স ট্রাভেল ভ্রমন দলটি বর্ষার এই দিনগুলোর কথা মনে রাখবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যা আমাদের এই দলটিকে সামনে পথ দেখাবে আরো অনেক অজানা গন্তব্যে।



























৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রান্ত নিথর দেহে প্রশান্তির আখ্যান..... (উৎসর্গঃ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগারদের)

লিখেছেন স্বপ্নবাজ সৌরভ, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪২



কদিন আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে
কুকুরের মত জিহবা বের করে বসবো
শুকনো পুকুর ধারের পাতাঝরা জামগাছের নিচে
সুশীতলতা আর পানির আশায়।

একদিন অদ্ভুত নিয়মের ফাঁদে নেতিয়ে পড়বে
আমার শ্রান্ত শরীর , ধীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×