১
একতলা বাসার চিলেকোঠার ঘরটা অব্যবহৃত জিনিসপত্রের তীর্থস্থান। দরজার ছিটকানি লাগিয়ে রুমটার জানালার একটা কপাট খুললেন রহমত সাহেব। মুহূর্তেই হুড়মুড় করে আলো ঢুকে রুমের আধাঁরকে ছুটি দিল। জানালার কপাটের গায়ে লেগে থাকা ধুলোরা আলোর মোহনায় উড়াউড়ি করছে অবিরত। ঘরের এক কোনায় অকেজো খাট আর কালসে রঙ-এর বুড়ো চেয়ারের সহাবস্থান। চেয়ারের বিপরীত পাশে একটা আয়না ঝুলানো। পিঠ এলিয়ে চেয়ারে বসলেন রহমত সাহেব। বিষন্ন মুখ। বিক্ষিপ্ত মন। সব চেষ্টা ব্যর্থ। সাহস নামের এই সাহসী গুনটি তিনি আজও অর্জন করে উঠে পারেননি। তবে কি তার জীবনের অন্তিম ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে যাবে। নানা প্রশ্নে জর্জরিত তার মস্তিষ্ক। এ কয়েকদিন মনের মত একটা গালিও কন্ঠস্থ করতে পারেননি রহমত সাহেব।
২
বস্তির মানুষজন নাকি ঝগড়ায় নানাবিধ বিশ্রী ভাষার শক্তিশালী গালি বিনিময়ে পটু। সেই শক্তিশালী গালি শুনতে কয়েকদিন ঝগড়ার সময় পাশে বসে থেকেও কাউকে গালি দেওয়ার মত একটা গালিও মনে ঠাঁই দিতে পারেননি। এই ৫২ বছরের তার সুপ্ত্, কোমল মন অনিচ্ছায়ও কাউকে গালি দেয়নি। রহমত সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনের আয়নার দিকে চোখ মেলে তাকালেন। এই আয়নার সামনে দাড়িঁয়ে বহুবার রিহার্সাল করেছেন। ব্যর্থ। সব ব্যর্থ।
কান লাগিয়ে শুনছেন বহুবার বাস ড্রাইভার আর হেল্পারের মধ্যকার গালিময় কথন। আবার কখনো সাদামাটা রেষ্টুরেন্টের মালিকের ওয়েটারের উপর চাওয়া হওয়ার সম্ভাষণ। চরম অকথ্য ভাষার গালিও রহমত সাহেবের মনকে নাড়া দেয়নি। ব্যর্থ! ব্যর্থ! ব্যর্থ! আয়নায় ভিতর তার ভেজা চোখের উপস্থিতি টের পান। উঠে দাঁড়ালেন রহমত সাহেব।
৩
হীরামন পল্লীর বস্তিতে সন্তপর্ণে পা এলিয়ে হাঁটছে রহমত সাহেব। জীবনের প্রথমবার আজ এ পল্লীতে। দু-চারজন গণিকার সাথে আলাপচারিতায় আলেয়াকে মনে ধরে, যার কিনা কথার তুবড়ি বেশ খটমট ও আক্রমণাত্মক। রুমে প্রবেশমাত্র বদমেজাজী আলেয়া রহমত সাহেবকে কর্কশ কন্ঠে শুধালো, যা করবেন তাড়াতাড়ি করবেন। ভাব নেয়ার টাইম নাইক্কা। আইজ রাতে আরো খদ্দর আছে।
আলেয়া প্রস্তুত। চোখে মুখে দেহে কামের আগুন। আলেয়ার দিকে রহমত সাহেব ক্যাবলা চোখে তাকিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রহমত সাহেব। আলেয়া একটু এগিয়ে পায়ের পাতা দিয়ে রহমত সাহেবের বুকে আঘাত করে শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালগালি। গালির তুবড়ি নিজের গায়ে উড়ে আসায় প্রচন্ড জেদ চাপে রহমত সাহেবের। মেজাজকে স্তিমিত করতে না পেরে প্রশমিত করতে আলেয়ার গালে কষে এক চড় বসালেন। সাথে সাথে বুক পকেট হাতড়িয়ে টাকা বের করে আলেয়ার কোলে ছুঁড়ে মেরে হুড়মুড় করে রুম থেকে বের হয় রহমত সাহেব।
৪
সজোরে পা দাপিয়ে হাঁটছেন রহমত সাহেব। চোখের সামনে ভাসতে লাগল ৪২ বছর আগের বাবার মুখ, স্কুল শিক্ষক নিরীহ বাবা। এক রাত্রিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল নিজ ঘরে। গ্রামের মাতবর হেকমত উল্লাহ শান্তি বাহিনী কমিটির প্রধান। এই খবর শুনে বাবাকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য গালাগালি আর চড় থাপ্পড়। স্কুলের ক্যাম্পে বাবার উপর অত্যাচার দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল ১০ বছরের বালক রহমত। সেই দিন থেকে রহমত সাহেবের একটাই প্রানন্তর ইচ্ছে-বিচার হোক না আর না হোক, অন্তত একটিবার হেকমত উল্লাহকে গালি দিবে প্রাণ খুলে। ক্ষোভের তোড়ে খুব দ্রুত পা চালায় রহমত সাহেব। আলেয়া ঘটনা আজ বুঝতে শিখিয়েছে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দরকার মনের শক্তি। রিয়েল পাওয়ার। আর তা আসে কাউকে ঘৃণা করা থেকে নয়, সত্য থেকে। সত্যের শক্তি থেকে।
৫
মৃতপ্রায় শয্যাশয়ী হেকমত উল্লাহ। আতুরালয়ে ঢুকে হেকমত মোল্লার পাশে বসলেন রহমত সাহেব। হেকমত উল্লাহ হয়ত ভাবছে তার কোন গুনগ্রাহী। চোখ মেলে তাকায় রহমত সাহেবের দিকে। রহমত সাহেব ক্রোধে কড়মড় করে ঊচ্চস্বরে বললেন - তুই রাজাকার। তুই রাজাকার।
====
১৭০৬২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৪৪