somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(মাসুদ রানা) দুর্গম দুর্গ কাজী আনোয়ার হোসেন ২////

১২ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৪:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

..................
৫২ মাসুদ রানা-৬
এই গুহায় ক্ষুধা তৃষ্ণায় আধমরা অবস্থায়। সেই থেকে এখানেই আছি।’
‘তাহলে ওরা মোট ছয়জন এসেছে কেটি বন্দর থেকে?’
‘না, হুজুর। চারজন। একজন মারা গেছে লঞ্চ ডুবির সময়। ওই দু’জন
জুটেছে কাল রাত থেকে।’
মৃদু হাসল অলোক রায়। রানা বুঝল, এ কথাটাও মিলে যাচ্ছে ওর জানা
তথ্যের সঙ্গে।
‘ওদের কোনও কথাবার্তা শুনতে পাওনি তুমি?’
স্পাব না কেন? সারাক্ষণই তো শুনছি। ওরা এসেছে দ্বারোকার কামান
আর রাডার ধ্বংস করতে।’
‘হাওয়া খেতে যে আসেনি তা আমাদেরও জানা আছে,’ বলল
লেফটেন্যান্ট।
‘দুর্গের প−্যান আছে ওই লোকটার পকেটে। এরা করাচির সাথে রেডিও
দিয়ে কথাবার্তা বলছে চারঘণ্টা অন্তর অন্তর। পাকিস্তান নৌবাহিনী রওনা
হয়ে গেছে দ্বারোকা বন্দর ধ্বংস করে দেবার জন্যে। এরা কামানগুলো ধ্বংস
করতে পারলেই এগিয়ে এসে চুরমার করে দেবে সবকিছু। কী জানি না
আমি...সব জানি।’
‘হয়েছে, হয়েছে। মস্ত খবর দিয়েছ তুমি, মটু সিং। এক্ষুণি জানাতে
হবে সব কথা কর্নেলকে। চমৎকার!’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল লেফটেন্যান্টের মুখ।
উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ওর শরীরের রক্ত। ‘তাড়াতাড়ি করতে হবে
আমাদের। কিন্তু একটা কথা, টিএনটি কোথায় রেখেছে?’
আলতাফ দুই হাতের তালু চিৎ করল। ‘হুজুর, সেটা আমি জানি না।
গুহাতে রাখা নিরাপদ না ভেবে ওরা দু’জন বাক্স দুটো নিয়ে গিয়ে কোথায়
যেন লুকিয়ে রেখেছে।’ রানা আর মিশ্রী খানের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল
আলতাফ। ‘ওই দিকে নিয়ে গেছে খুব সম্ভব।’ সম্পূর্ণ উল্টো দিকে আঙুল
নির্দেশ করল আলতাফ। আরীফের দুই চোখে নগড়ব বিস্ময় ফুটে উঠেই
মিলিয়ে গেল। ‘আমাকে দেখতে দেয়নি। কাউকে বিশ্বাস করে না ব্যাটারা!’
‘সেটা ওদের দোষের কিছু নয়। তোমাকে বিশ্বাস করলে ওদের কি
অবস্থা হত বোঝাই যাচ্ছে। যাক্। ব্রিগেডিয়ার খুব সম্ভব তোমাকে মাফ করে
দেবেন। ইনফরমারকে আমরা ভালমত পুরস্কৃত করি। কাজেই আরও
লোকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ দেয়া হবে তোমাকে খুব
সম্ভব।’
‘হুজুর মা-বাপ। আমি জানতাম, হুজুর...’
‘চোপ রাও!’ ধমকে উঠল তরুণ লেফটেন্যান্ট। ‘এখন নামগুলো বলো
সবার এক এক করে।’
‘ওর নাম নাজির বেগ, ও আরীফ, আর গুহার মধ্যে পড়ে আছে যে সে
হচ্ছে লেফটেন্যান্ট মাহবুব, এই মোচওয়ালা লোকটার নাম ক্যাপ্টেন মিশ্রী
দুর্গম দুর্গ ৫৩
খান আর এদের লীডার হচ্ছে ওই গুণ্ডার মত লোকটা- মেজর মাসুদ রানা।’
‘মেজর...কি বললে?’ হঠাৎ পাঁই করে ঘুরে টর্চের আলো ফেলল
লেফটেন্যান্ট রানার মুখের ওপর। ‘কি বললে? মাসুদ রানা? মাসুদ রানা!’
দুইবার দু’ভাবে উচ্চারণ করল সে নামটা। এগিয়ে এল কয়েক পা। ভাল
করে পরীক্ষা করল রানার মুখ। আপন মনে বলল, ‘মাসুদ রানা! পাকিস্তান
কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাসুদ রানা!’
এতক্ষণ হিন্দীতে কথা হচ্ছিল, হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে উঠল
লেফটেন্যান্ট। চাপা উত্তেজনা ওর কণ্ঠস্বরে।
‘আমার বোনের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল, মাসুদ রানা?’
‘তোমার বোন!’ অবাক হলো রানা।
‘হ্যাঁ। আমার বোন, সুলতা রায়। কিভাবে মারা গেছিল সে?’
রানা লক্ষ করল থর থর করে কাঁপছে অলোক রায়ের টর্চ ধরা হাতটা।
গলাটাও কেঁপে গেল শেষের দিকে। সুলতা। সেই সুলতা রায়ের ভাই এই
অলোক রায়?
‘কবীর চৌধুরী বলে এক বৈজ্ঞানিকের গুলিতে,’ বলল রানা।
‘কাপ্তাই রিজারভয়েরে ওর আস্তানা থেকে পালাবার সময়?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে ওই বইটায় ঠিকই লিখেছিল?’
‘কোন বইটা?’
‘ওই যে আপনার এক বন্ধু কি যেন এক ছদ্মনামে কতগুলো বই
লিখেছে। একটা বই কলকাতায় থাকতে হাতে এসেছিল- এক বর্ণও বিশ্বাস
করিনি। কি যেন নাম- ও, ধ্বংস-পাহাড়। ওই বইয়ের সব কথা তাহলে
সত্যি?’
‘তা কি করে বলব? আমি পড়ি না ওসব বই।’
‘সুলতা তাহলে সত্যিই মারা গেছে, বন্দী হয়ে নেই পাকিস্তানে?’ হঠাৎ
রানার কাঁধের ওপর হাত রাখল অলোক রায়। করুণ আকুতি ওর কণ্ঠে।
‘দয়া করে মিথ্যে কথা বলবেন না, মেজর। আপনার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে
পারবে না, আমিও না। কিন্তু ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে জ্যান্ত মরা থেকে
বাঁচাতে পারেন।’
রানা অনুভব করল একটি ভাইয়ের হƒদয়ে একমাত্র বোনের জন্যে
সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার যন্ত্রণা। কেন যেন মায়া হলো ওর ছেলেটির ওপর।
সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে বলল সে অল্প কথায়। মন দিয়ে শুনল অলোক রায়।
প্রতিটি কথা বিশ্বাস করল।
‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ সব শুনে ঘুরে দাঁড়াল অলোক রায়।
‘অনেক উপকার করলেন আপনি আমার। কিন্তু এই পরিবেশে আপনার সঙ্গে
পরিচিত হয়ে আমি সত্যিই দুঃখিত, মেজর রানা। অন্য কোনও অবস্থায় হলে
..........................
৫৪ মাসুদ রানা-৬
হয়তো প্রতিদানে আপনার কোনও উপকার করতে পারতাম, কিন্তু এখন
সেটা সম্ভব নয়।’
প্রত্যেকের হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো।
‘ওই মোটাকেও বাঁধো। পরে খুলে দেয়া যাবে। ওকে দিয়ে
অসুস্থ লোকটাকে বইয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে পোস্টে। সার্জেন্ট শান্তা, গার্ড
থাকো। বাকি সবাই চলো আমার সাথে। এক্সপে−াসিভের বাক্সগুলো খুঁজে
বের করতেই হবে আমাদের।’
‘ওদের দিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা করলে হয় না, স্যার?’ সার্জেন্ট শান্তা
জিজ্ঞেস করল। নির্যাতনের ছুতো খুঁজছে সে।
‘যে লোকটাকে দিয়ে বলানো সম্ভব ছিল সে যা জানে সব বলে
ফেলেছে। আর অন্যদের ব্যাপারে আমি মস্ত ভুল করতে যাচ্ছিলাম। এদের
মুখ থেকে একটি শব্দও বের করা যাবে না। এরা ভেঙে যাবে, তবু বাঁকবে
না। শুধু লক্ষ রাখবে এরা যেন পরস্পর কথা না বলে।’
অ্যাবাউট টার্ন করে চলে গেল লেফটেন্যান্ট। ওর পেছনে গেল সাতজন
সেন্ট্রি। তিন মিনিট পর সার্জেন্ট শান্তা ছাড়া ভারতীয় সৈনিকের চিহ্নও রইল
না আর।
কয়েকবার চেষ্টা করল রানা। নাহ্। ভেজা দড়ি আরও শক্তভাবে বসে যাচ্ছে
কব্জিতে। যে লোকটা বেঁধেছে সে সত্যিই বাঁধতে জানে। বাঁধন খুলবার
কোনও উপায় নেই। আধঘণ্টা ধরে বসে বসে পিঠটা ব্যথা হয়ে গেল রানার।
শুয়ে পড়ল মিশ্রী খানের পাশে।
আলতাফ একবারই চেষ্টা করেছিল দড়ি ছিঁড়বার। মাংসের ভেতর ঢুকে
গেছে দড়িটা। সেই থেকে সেন্ট্রির কাছে বসে বার বার ঘুরেফিরে অনুযোগ
করছে সে যে বেশি শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ওর হাত। কেটে বসে যাচ্ছে
বাঁধনটা। কারণ, একটু লক্ষ করলেই পরিষ্কার বুঝে ফেলবে অলোক রায় কী
অসাধারণ শক্তি আছে ওর গায়ে। নিজের যে চরিত্র সৃষ্টি করেছে সে, তার
সাথে খাপ খাবে না এই দানবিক শক্তি।
রানা ভাবছে, আলতাফ আজ মূডে আছে। স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে
চলেছে সে। অনেক সত্যি কথা বলে ফেলেছে সে লেফটেন্যান্টের কাছে,
কিন্তু এমন কিছুই বলেনি যা ওরা জানতে পারত না। পাকিস্তান নেভির
আগমনের সংবাদ ওরা এখনও যদি না জেনে থাকে তাহলে আগামী দু’ঘণ্টার
মধ্যেই জানতে পারবে। মিশ্রী খান, নাজির বেগ আর আরীফ বসে আছে
পাথরে হেলান দিয়ে।
ব্যথায় টনটন করছে রানার চোয়াল। নাজির বেগের কেমন লাগছে
ভাবার চেষ্টা করল সে। আর মাহবুবের? সেন্ট্রিকে ছাড়িয়ে দৃষ্টিটা চলে গেল
রানার গুহা-মুখের দিকে। হঠাৎ চমকে উঠল রানা। হিম হয়ে গেল ওর
দুর্গম দুর্গ ৫৫
বুকের ভেতরটা।
ধীরে চোখটা সরিয়ে আনল সে গুহা-মুখ থেকে, নিরাসক্ত ভাবে সেন্ট্রির
ওপর নিবদ্ধ হলো ওর দৃষ্টি। একটা পাথরের ওপর বসে সতর্ক নজর রেখেছে
শান্তা সবার ওপর। অটোমেটিক কারবাইনটা দুই হাঁটুর ওপর রাখা। ডান
হাতের তর্জনী ট্রিগারের ওপর। গুহার দিকে পেছন ফিরে বসে আছে সে।
রানা মনে মনে খোদার কাছে প্রার্থনা করল যেন লোকটা ঘুরে না তাকায়।
যেন আর কিছুক্ষণ যেমন বসে আছে তেমনি বসে থাকে পেছন ফিরে। আর
অল্প কিছুক্ষণ- খোদা! আবার দৃষ্টিটা চট করে ঘুরে এল গুহা-মুখ থেকে।
গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মাহবুব। বুক আর পেটের ওপর
ভর দিয়ে এগোচ্ছে সে অল্প একটু, তারপর ভাঙা পা-টা টেনে আনছে। দুই
হাতে ভর দিয়ে দেহের উপরের অংশটা উঁচু করছে সে, এগিয়ে আসছে ইঞ্চি
ছ’য়েক, তারপর উপরের অংশটাকে মাটিতে নামিয়ে নিচের অংশটা টেনে
আনছে। ব্যথায় আর অবসাদে ঝুলে পড়েছে মাথাটা। কুঁচকে যাচ্ছে গাল
দুটো। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে আবার এগোচ্ছে। ওর ব্যথার
কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে রানার নিজের মুখটাই বিকৃত হয়ে যাচ্ছিলসতক
র্
হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল সে। এত জ্বর গায়েও মাথা ঠিক
রেখেছে মাহবুব; একটা খয়েরী রঙের চাদর জড়িয়ে নিয়েছে দেহের ওপর,
যাতে কিছুটা ক্যামোফ্লেজের কাজ হয়। ডান হাতে একটা ছুরি ধরা। নিশ্চয়ই
সে অলোক রায়ের শেষের কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। বুঝতে পেরেছে পিস্ত
ল ছুঁড়লে লাভ নেই- ছুটে চলে আসবে লেফটেন্যান্ট দলবল সহ। তার আগে
কারও হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে পারবে না সে এতদূর এসে।
আর পাঁচ গজ, খোদা আর পাঁচটা গজ। সামান্য বাতাসের শব্দ ছাড়া
কোথাও কোনও শব্দ নেই। মাহবুবের এগোনোর শব্দ কানে যাবে সেন্ট্রির
আর একটু এগোলেই।
মাথা নিচু করে কাশতে আরম্ভ করল রানা। প্রমে একটু অবাক হয়ে
চাইল সার্জেট রানার দিকে, μমাগত কেশেই যাচ্ছে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল
সে।
‘অ্যাই, মেজর কা বাচ্চা। কাশি থামা!’ খ্যাঁক-খ্যাঁক করে ধমকে উঠল
সার্জেন্ট শান্তা।
‘থামতে পারছি না!’ কেশে উঠল রানা আবার। ‘আমার কি দোষ? খক্
খক্। তোমাদের লেফটেন্যান্টের খক্কর খক্ দোষ। গলার ভেতর রক্ত ঢুকে,
খক্ খক্ খক্ হ্যাঁচ্চো, সড়কে গেছে।’
আর পাঁচ ফুট। কিন্তু শক্তি ফুরিয়ে গেছে মাহবুবের। এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি
করে এগোচ্ছে সে এখন। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে। আধ মিনিট পড়ে থাকল
সে মাটিতে মুখ গুঁজে। না। শক্তি সঞ্চয় করছিল সে। এবার আবার দুই
হাতে ভর দিয়ে ছয় ইঞ্চি এগিয়ে এল মাহবুব। কিন্তু হঠাৎ একটা হাত
......................
৫৬ মাসুদ রানা-৬
পিছলে গিয়ে ধড়াশ করে পড়ে গেল। কেশে উঠল রানা। কিন্তু দেরি হয়ে
গেছে। একলাফে উঠে দাঁড়িয়েই পেছন ফিরল সার্জেন্ট। অটোমেটিক
কারবাইনের মুখটা স্থির হলো মাহবুবের মাথার দিকে চেয়ে। মাহবুবকে
চিনতে পেরে রাইফেলের মুখটা সরাল সে অন্য দিকে।
‘এরই জন্যে এত কাশি আসছিল মেজর বাহাদুরের!’
রাইফেলের বাঁটটা সাঁ করে নেমে আসছিল মাহবুবের মাথার ওপর।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। বোধহয় দয়া হলো ওর। মাহবুবের দুর্বল হাত
থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বহুদূরে। চাদরটা গায়ের ওপর
থেকে তুলে নিয়ে দলা পাকিয়ে গোল করল, তারপর ওর অজ্ঞান মাথার নিচে
গুঁজে দিল সেটা। মাথাটা নাড়ল এদিক-ওদিক বিষণড়বভাবে। আবার গিয়ে
বসল উঁচু পাথরের ওপর।
ফর্সা হয়ে গেছে চারদিক। দূরে কয়েকজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
দশ
কর্নেল রাম নারায়ণ বেঁটে-খাটো ছিমছাম চেহারার লোক। বয়স পঁয়তালি−শ।
চেহারায় একটা নিষ্ঠুর ভীতিকর ভাব জন্মগত ভাবেই আছে ওর মধ্যে।
পরিষ্কার বোঝা যায় এই লোকটার সংস্পর্শই অশুভ। ছোট্ট লম্বাটে মাথার চুল
ছোট করে ছাঁটা। ঠোঁটগুলো লালচে। হাসিটা চারকোনা- লেটার বক্সের
ফোকরের মত। ভয়ঙ্কর। ডান গালে একটা লম্বা কাটা চিহ্ন। হাসুক বা গম্ভীর
হয়ে থাকুক চোখের কোনও ভাব পরিবর্তন নেই। জুল-জুল করছে বিষণড়ব
দৃষ্টি। মুখের মসৃণ চামড়া টান টান হয়ে আছে। রানা বুঝল এ লোক
স্ায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে। মানসিক ভারসাম্য নেই।
টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে ছিল রাম নারায়ণ। অলোক
রায়ের রিপোর্ট শেষ হতেই হাসল সে রানার দিকে চেয়ে। চারকোনা একটা
গর্ত সৃষ্টি হলো মুখে- ভেতরটা অন্ধকার। নিস্পৃহ চোখ জোড়া সারাটা ঘরে
ঘুরে এল একবার। এক নজরেই সব কিছু দেখে নিল সে, কিছুই বাদ গেল
না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা গার্ড, হাত-বাঁধা বন্দীদের পেছনে
আছে দু’জন গার্ড, মাহবুবকে বেঞ্চির ওপর শুইয়ে রেখে ঘর্মাক্ত আলতাফ
রয়েছে বেঞ্চের এক ধারে। সব চোখে পড়ল কর্নেলের।
‘চমৎকার, অলোক! যথেষ্ট তৎপরতার সাথে কাজ করেছ।’ একটা ভুরু
উঁচু করে বন্দীদের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে চেয়ে বলল, ‘সামান্য কিছু
গোলমাল হয়েছিল মনে হচ্ছে। বন্দীরা প্রমে বোধহয় ঠিক সহযোগিতা
করতে চায়নি, তাই না?’
দুর্গম দুর্গ ৫৭
‘ওরা কোনও বাধাই দেয়নি। কোনও সুযোগই পায়নি বাধা দেবার।’
বলার ভঙ্গি দেখে বুঝল রানা, এই লোকটাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে অলোক
রায়।
‘ঠিক করেছ, লেফটেন্যান্ট। সুযোগ না দিয়ে ভালই করেছ। এরা
অত্যন্ত ভয়ঙ্কর লোক। এদের কোন রকম সুযোগ দিতে হয় না।’ চেয়ারটা
ঘরঘর করে পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল রাম নারায়ণ। টেবিল ঘুরে হেঁটে গিয়ে
দাঁড়াল আলতাফের সামনে। ‘এই সেই মোটা গর্দভটা, না? এ বোধহয়
অতখানি ভয়ঙ্কর না?’
‘এ-ও ভয়ঙ্কর- তবে শুধু ওর বন্ধুদের জন্যে। নিজের এক তিল সুবিধা
দেখলে নিজের বাপের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে,’ ঋজু ভঙ্গিতে
বলল অলোক রায়।
‘এ আবার আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে, অ্যাঁ?’ আলতাফের
দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিহে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো আবার?’ ডান
হাতটা মুঠি করে তুলল ওপর দিকে, তারপর ধারাল একটা আংটি দিয়ে
একটানে আলতাফের গাল চিরে দিল। দীর্ঘ একটা চিহ্ন মুহূর্তে লাল হয়ে
উঠল। ব্যথায় ককিয়ে উঠল আলতাফ, এক হাতে চেপে ধরল রক্তাক্ত গাল,
অন্য হাতটা মাথার ওপর উঠিয়ে নি®´ল আÍরক্ষার অভিনয় করল।
‘ঠিকই ধরেছ তুমি, লেফটেন্যান্ট। মাছ খেয়ে খেয়ে কেবল ঢোঁশকা
হয়েছে। ভীতুর ডিম। বিরাট শরীর দিয়ে প্রকৃতি সাহসটা নিল্ করে
দিয়েছে। এখানেও সেই ভারসাম্য। বেশির ভাগ মোটা লোকই এরকম। কি
নাম তোমার, বীরপুরুষ?’
‘মহাবীর,’ বলল আলতাফ ভয়ে ভয়ে। ‘আমার নাম মহাবীর নাত্থুরাম।’
হাতটা গাল থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরল আলতাফ। রক্ত দেখে ভয়ে
বিবর্ণ হয়ে গেছে ওর মুখ, চোখ দুটো বিস্ফারিত। প্যান্টের পেছনে মুছে
আবার হাত দিল সে গালে। রাম নারায়ণের মুখে চারকোনা গর্ত সৃষ্টি হলো।
‘রক্ত সহ্য হয় না তোমার, তাই না, মহাবীর? বিশেষ করে সে রক্ত যদি
নিজের হয়? কিন্তু এটা তো বীরের লক্ষণ নয়। মহাবীর নাম কে দিল
তোমার?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আলতাফ, তারপর হঠাৎ চাইল রাম নারায়ণের
দিকে। মুখের চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে দুঃখের চোটে। মনে হলো এক্ষুণি
কেঁদে ফেলবে সে।
‘হুজুর, আমি একজন গরীব জেলে। দিন আনি দিন খাই। রক্ত দেখিনি
কোনদিন, দেখতে চাই-ও না। হুজুর, অদৃষ্টে কি লেখা আছে সে কেবল
ভগবানই জানেন। আপনি হাসছেন, আমার কানড়বা পাচ্ছে। ভগবান!- আমাকে
এই বিপদের মধ্যে কেন ফেললে, ভগবান!’ টপ্ টপ্ করে দু’ফোঁটা পানি
পড়ল আলতাফের গাল বেয়ে। অভিনয়টা এত সুন্দর আর আন্তরিক হয়েছে
.............
৫৮ মাসুদ রানা-৬
যে ওর দুঃখে রানারই বুকটা উথলে উঠতে চাইল।
‘সবাই অদৃষ্টের দাস,’ বলল রাম নারায়ণ বিজ্ঞের মত। ‘তুমি তাহলে
জেলে একজন?’
‘মিথ্যাবাদী! ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক!’ গর্জে উঠল রানা। আলতাফের ওপর
থেকে কর্নেলের মনোযোগ সরিয়ে দিল সে। ঝট করে ঘুরে রানার সামনে
এসে দাঁড়াল কর্নেল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল বিষণড়ব দৃষ্টি মেলে।
‘মেজর মাসুদ রানা! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এত বুদ্ধি, এত সাহস,
এত বীরত্ব? অথচ শেষ পরিণতি কি? দ্বারোকা দুর্গের ফাঁসিকাঠ। কি
দুঃখজনক, তাই না?’
রানা জবাব দিল না কোনও। আবার জিজ্ঞেস করল কর্নেল, ‘কি ভাবছ,
মাসুদ রানা? ভাবছ বরাবরের মত এবারও আশ্চর্য ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরে
যাবে পাকিস্তানে?’
‘না। এসব কিছুই ভাবছি না আমি। তোমার মুখটা খুব পরিচিত লাগছে
আমার কাছে, ভাবছি কোথায় দেখেছি আগে।’
তুমি করে সম্বোধন করায় লাল হয়ে উঠল রাম নারায়ণের কান। চোখে
রাগের আভাস ফুটে উঠল। এতখানি ঊদ্ধত্য আশা করেনি সে বন্দীর কাছ
থেকে। কিন্তু সামলে নিল সে।
‘তাই নাকি? দেখেছ কোথাও আমাকে? হয়তো কলকাতায়...’
‘এইবার মনে পড়েছে স্পষ্ট,’ বাধা দিল রানা। আলতাফের ওপর থেকে
কর্নেলের মনোযোগ সরাবার জন্যে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেলল সে। ‘ঠিক বলেছ।
কলকাতায়। আলীপুর চিড়িয়াখানার বাঁদরের খাঁচায় লাফালাফি করতে
দেখেছি তোমাকে। আমার পরিষ্কার মনে আছে কলাও খাইয়েছিলাম একটা।
সেখানে...’
হঠাৎ থেমে মাথাটা সরিয়ে নিল রানা। রাগে দাঁত বেরিয়ে গেছে কর্নেল
রাম নারায়ণের। দেহের সর্বশক্তি দিয়ে ঘুসি চালিয়েছিল সে, কিন্তু রানা সরে
যেতেই শূন্যে ঘুরে গেল মুঠিটা রানার নাকের সামনে দিয়ে। দেহের
ভারসাম্য হারিয়ে হোঁচট খেলো সে একবার, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সাথে সাথেই রানার বুটের এক প্রচণ্ড লাথি পড়ল ওর হাঁটুর ওপর। ব্যথায়
আর্তনাদ করে পড়ে গেল কর্নেল মাটিতে। উঠে দাঁড়াল সে আবার।
চিতাবাঘের মত এগিয়ে যাচ্ছিল সে রানার দিকে ঘুসি পাকিয়ে, কিন্তু ব্যথা
পাওয়া পা-টা মাটিতে পড়েই ভাঁজ হয়ে গেল সামনের দিকে- আবার পড়ে
গেল সে মাটিতে।
ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়েছে, এমনি নিথর নিস্পন্দ হয়ে রইল
প্রত্যেকটি লোক। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন বুদ্ধি হারিয়ে থমকে
গেছে।
নড়ে উঠল রাম নারায়ণ। টেবিলের কোণা ধরে উঠে দাঁড়াল সে। মুখটা
দুর্গম দুর্গ ৫৯
রক্তশূন্য। কোনও দিকে না চেয়ে টেবিলের কিনারা ধরে ধরে নিজের আসনে
ফিরে যাচ্ছে সে এখন। ধ্বক্ ধ্বক্ করে জ্বলছে হিংস্র দুই চোখ।
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, পরিষ্কার
বুঝতে পারল ঘরের প্রতিটা লোক, রাম নারায়ণের চোখে হত্যার নেশা।
নিজের ওপরই রাগ হলো রানার- সত্যিই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে
সে। রানা বুঝল, দু’জনের মৃত্যু দেখতে হবে ওর আগামী পাঁচ সেকেণ্ডের
মধ্যে। রাম নারায়ণ আর আলতাফ দু’জনেই মারা যাবে। রাম নারায়ণ মরবে
আলতাফের ছুরিতে, আলতাফ মরবে গার্ডদের গুলিতে। কিছুই কি করবার
নেই রানার?
রানা দেখল জামার হাতায় গালের রক্ত মুছছে আলতাফ। অর্থাৎ ওর
হাতের দুই ইঞ্চির মধ্যে আছে ছুরিটার বাঁট। চোখটা কাত করে দেখল রানা
সবচেয়ে কাছের প্রহরীটা ওর থেকে ছয় সাত ফুট দূরে দাঁড়ানো। ওর কাছে
পৌঁছবার আগেই ওর হাতের সাব-মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে
ওর বুক। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে।
একটা ড্রয়ার টান দিয়ে পিস্তল বের করল কর্নেল। ল্যুগার। রিলিজ
বাটন টিপতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল গুলি ভর্তি ম্যাগাজিন। একবার
পরীক্ষা করে নিয়েই ক্লিক করে ঢুকিয়ে দিল সে ম্যাগাজিনটা যথাস্থানে।
একবার úাইড টানতেই চেম্বারে চলে এল একটা গুলি। এবার চোখ তুলে
চাইল সে রানার দিকে। আলতাফের দিকে চাইল রানা, পেছন দিকে ঝাঁপিয়ে
পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইল। এমন সময় রানা দেখল ঘাড়ের কাছ থেকে
হাতটা সরিয়ে আনল আলতাফ- ছুরি নেই সে হাতে।
টেবিলের কাছে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া গেল। চোখ ফিরিয়ে
রানা দেখল অলোক রায় চেপে ধরে আছে রাম নারায়ণের হাতটা। পিস্তলের
মুখ টেবিলের দিকে ফেরানো।
‘এভাবে মারবেন না, স্যার! মাথাটা ঠিক রাখুন, স্যার! আপনার বিপদ
হবে!’
‘হাত সরিয়ে নাও!’ হিস্ হিস্ করে উঠল কর্নেলের কণ্ঠস্বর। এক
মুহূর্তের জন্যেও চোখ জোড়া সরাল না রানার চোখ থেকে। ‘হাত ছাড়ো
বলছি, লেফটেন্যান্ট! নইলে তোমাকেও যেতে হবে ওই একই রাস্তায়।’
‘ওকে মারলে আপনি বিপদে পড়বেন, স্যার। ব্রিগেডিয়ারের অর্ডার
আছে দলপতিকে জ্যান্ত ধরে আনতে হবে। সমস্ত প−্যান বের করতে হবে ওর
কাছ থেকে।’
স্পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন গুলি খেয়ে মরেছে ও,’ বলল রাম নারায়ণ
কর্কশ গলায়।
‘এ যুক্তি টিকবে না। এদের সবাইকে তো আর মারতে পারবেন না।
এরা সাক্ষ্য দেবে আপনার বিরুদ্ধে।’ হাতটা ছেড়ে দিল সে রাম নারায়ণের।
..............
৬০ মাসুদ রানা-৬
চাপা গলায় বলল, ‘জ্যান্ত চেয়েছে ব্রিগেডিয়ার, কিন্তু কতখানি জ্যান্ত তা
বলেনি। যদি আমরা বলি তথ্য বের করতে গিয়ে আধমরা করতে হয়েছে,
সেটা যুক্তিসঙ্গত হবে।’
সামলে নিল নিজেকে কর্নেল। সৎ পরামর্শের জন্যে ভেতর ভেতর
কৃতজ্ঞতা বোধ করলেও কেন যেন সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওর অলোক রায়ের
ওপর।
‘দিলে তো সব পণ্ড করে। ওকে ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করবারই
চেষ্টা করছিলাম আমি। আমাকে আণ্ডারএস্টিমেট করাটা তোমার পক্ষে
ঊদ্ধত্য। মনে রেখো, লেফটেন্যান্ট আর কর্নেলের মধ্যে আসমান জমিন
তফাৎ আছে। ভবিষ্যতে আর একবার যদি নিজের ক্ষমতার সীমা লদঘন
করো, তবে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।’ পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে
রানার দিকে ফিরে চারকোনা হাসি হাসল রাম নারায়ণ। কিন্তু এইসব বাজে
কথায় রানা ভুলল না। পরিষ্কার বুঝল, ওর প্রাণ রক্ষা করেছে আজ অলোক
রায়।
আবার রানার সামনে এসে দাঁড়াল রাম নারায়ণ। এবার রানার পায়ের
আওতার বাইরে।
‘এবার কাজের কথায় আসা যাক, মেজর রানা। অঢেল সময় নেই
আমার হাতে।’
রানা চুপ করে রইল। একবার রাম নারায়ণের মুখের দিকে চেয়ে চোখ
ফিরিয়ে নিল। কর্নেলের চোখে অশুভ বার্তা। ভেতরের পশুটা বেরিয়ে
আসতে চাইছে বাইরে।
‘এক্সপে−াসিভ কোথায় রেখেছ?’
‘এক্সপে−াসিভ? সে আবার কি জিনিস?’
‘মনে পড়ছে না?’
‘কি বলছ ভাল করে বুঝতেই পারছি না। কিসের এক্সপে−াসিভ?’
‘তুমি?’ মিশ্রী খানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কর্নেল। ‘তুমি বুঝতে পারছ
আমার প্রশড়ব?’
স্পানির মত,’ জবাব দিল মিশ্রী খান।
‘কোথায় বাক্স দুটো?’
‘ওই যে ময়দানটা, যেখানে রোজ মরা গরুর নাড়ী টেনে বের করে খাও
তুমি আকাশ থেকে নেমে, ওইখানে রেখে দিয়েছি। গলা-ছেলা ধাড়ি শকুন
কোথাকার!’
হাত দুটো মুঠি করে সহ্য করে নিল নারায়ণ। অপদস্থতার যেন
পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্যে সরে গেল সে ঘরের মাঝখানে। এদের কাছ
থেকে কথা বের করা যাবে না।
‘এদের মধ্যে সহযোগিতার ভাব দেখা যাচ্ছে না মোটেও, তাই না,
দুর্গম দুর্গ ৬১
অলোক?’
‘এদের জিজ্ঞেস করার চাইতে ঘরের দেয়ালকে জিজ্ঞেস করাও ভাল,
স্যার। অন্তত অভদ্র ব্যবহার তো করবে না।’
‘ঠিক বলেছ, অলোক। এরা একটু অভদ্র। কিন্তু তথ্যটা আমার বের
করতেই হবে- এবং তিন মিনিটের মধ্যে। বলো দেখি কি করে বের করা
যায়?’ ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল সে। তারপর দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল
মাহবুবের দিকে। একটানে চাদর উঠিয়ে ফেলল সে মাহবুবের গায়ের ওপর
থেকে। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে একটা কিল মারল
মাহবুবের ভাঙা পায়ের ওপর। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল মাহবুবের দেহটা, কিন্তু
একবিন্দু শব্দ বেরোল না ওর মুখ থেকে। সম্পূর্ণ সজাগ আছে সে এখন,
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সহ্য করল সে এই অবর্ণনীয় ব্যথা। রক্ত
গড়িয়ে পড়ল ঠোঁট কেটে, কিন্তু টুঁ শব্দ করল না মাহবুব।
‘সাবধান, রাম নারায়ণ!’ রানার চাপা কণ্ঠস্বরে দারুণ উত্তেজনা প্রকাশ
পেল। ভয়ানক কঠোর হয়ে গেছে ওর মুখটা। ‘এর জন্যে কঠিন শাস্তি ভোগ
করতে হবে তোমাকে।’
‘কঠিন শাস্তি, তাই না?’ আবার ভাঙা পায়ে আঘাত করল কর্নেল নিষ্ঠুর,
নির্বিকার ভাবে। ‘তাহলে? শাস্তিটা আরও কঠিন হয়ে গেল, তাই না, মাসুদ
রানা?’ চারকোনা বীভৎস হাসি হাসল সে। ‘একটা জিনিস আমি বরাবর লক্ষ
করেছি মেজর, পাকিস্তানীরা যতই দুর্দান্ত আর দুর্ধর্ষ হোক না কেন, মনটা
তাদের খুবই নরম। কারও কষ্ট সহ্য করতে পারে না তারা।’ মাহবুবের
স্পি−ন্ট বাঁধা ব্যাণ্ডেজের কাছে চলে গেল কর্নেলের হাত। স্পাঁচ সেকেণ্ড সময়
দিলাম। টিএনটি-র বাক্স কোথায় আছে বলে ফেলো, নইলে... তোমার
আবার কি হলো, মোটা গাধা?’
কয়েক পা এগিয়ে এসেছে আলতাফ। কর্নেলের কাছ থেকে একগজ
দূরে দাঁড়িয়ে টলছে সে।
‘আমাকে...আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।’ দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে সে। একটা
হাত গলায় আরেক হাতে পেট চেপে ধরেছে সে। ‘বমি হয়ে যাবে। সহ্য
করতে পারছি না। ভগবান! বাতাস, বাতাস...’
‘বাইরে যাবে কেন, মহাবীর? মজা দেখো...সেন্ট্রি! জলদি ধরো!’
আলতাফের দুই চোখ কপালে উঠেছে, চোখের সাদা অংশ শুধু দেখা যাচ্ছে।
‘ব্যাটা ভীতুর ডিম অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাইরে নিয়ে যাও ওকে।’
রানা দেখল দু’জন প্রহরী ছুটে যাচ্ছে আলতাফের দিকে। ভয়ে বিবর্ণ
আরীফের মুখ। নাজির বেগ নির্বিকার। চট্ করে চাইল সে মিশ্রী খানের
দিকে। মিশ্রীর চোখের পাপড়ি দুটো সামান্য একটু নামল নিচে। রানা বুঝল
চতুর পাঞ্জাবী বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা- এবং প্রস্তুত আছে।
দু’জন গার্ড ছুটে এসে ধরল আলতাফকে। দুই জনের দুই কাঁধে দুই
..............
৬২ মাসুদ রানা-৬
হাত রাখল আলতাফ। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রানা ওর পেছনের সেন্ট্রিটা
এখন মাত্র চার ফুট দূরে। ওর সমস্ত মনোযোগ আলতাফের ওপরে, সাব-
মেশিনগানটা ঝুলছে নিচের দিকে মুখ করে। রানা বুঝল, কিছু আন্দাজ করার
আগেই আঘাত করতে পারবে সে ওকে।
আলতাফের হাত দুটো দুই সেন্ট্রির গলার কাছে ঝুলছে। হঠাৎ উঁচু হয়ে
ফুলে উঠল আলতাফের প্রকাণ্ড কাঁধের পেশী দুটো। সাথে সাথেই ঝাঁপ দিল
রানা। অসতর্ক সেন্ট্রির পেটের ওপর ভয়ঙ্কর বেগে আঘাত করল রানা ডান
কাঁধ দিয়ে। বুকের হাড়ের এক ইঞ্চি নিচে। তীক্ষè একটা আর্তনাদ করে
ছিট্কে পড়ল লোকটা কাঠের আলমারির ওপর, সেখান থেকে মাটিতে।
ঝাঁপ দেয়ার সময়ই দুটো মাথার প্রচণ্ড সংঘর্ষের শব্দটা শুনতে পেয়েছে
রানা। একটু ঘুরতেই চোখে পড়ল ওদের পেছনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় প্রহরীটা
ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে তলপেট বরাবর মিশ্রী খানের বুটের একটা বিশ্রী
লাথি খেয়ে।
আলতাফ ততক্ষণে বাম পাশের মূর্ছিত প্রহরীর হাত থেকে ছিনিয়ে
নিয়েছে একখানা অটোমেটিক কারবাইন। সোজা রাম নারায়ণের বুকের
দিকে সেটা ধরা এখন।
সবটা ব্যাপার এত দ্রুত এত অনায়াসে ঘটে গেল যে তাজ্জব বনে গেল
ঘরের প্রতিটা লোক। নিস্তব্ধতা থম থম করতে থাকল ঘরটার মধ্যে।
পরমুহূর্তে গর্জে উঠল অটোমেটিক কারবাইন। পর পর তিনটে গুলি করল
আলতাফ কর্নেলের হƒৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। দড়াম করে দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা
খেলো কর্নেলের দেহটা, তারপর পড়ে গেল মাটিতে। বেঞ্চের কোণায় ঠাস
করে বাড়ি খেলো কপালটা, কিন্তু ব্যথার বোধ তখন আর নেই কর্নেলের,
প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে আগেই। চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। চোখ
দুটো খোলা। তেমনি বিষণড়ব ভাবলেশহীন দৃষ্টি সে চোখে।
কারবাইনটা লেফটেন্যান্ট অলোক রায় আর তার পেছনে দাঁড়ানো শান্ত
ার দিকে ধরে থেকেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে আনল আলতাফ
একটা। রানার হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল, ‘কারবাইনটা একটু ধরবে,
মেজর?’
শক্ত বাঁধুনিতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া হাত দুটো বার দুই ঝাড়া দিয়ে
কারবাইনটা নিল রানা আলতাফের হাত থেকে। এই ঘরের পাশে আরেকটা
ঘর আছে। মাঝের দরজাটা ভেজানো, সেই দিকে এগোল আলতাফ।
দরজার কাছে গিয়েই হঠাৎ সরে গেল সে দেয়ালের গায়ে। ইশারায়
রানাকেও পিছিয়ে যেতে বলল।
হঠাৎ দু’পাট খুলে গেল দরজা। একটা রাইফেলের ব্যারেল দেখতে
পেল রানা।
দুর্গম দুর্গ ৬৩
‘লেফটেন্যান্ট! কোনও গোলমাল...’ আর কথা বেরোল না ওর মুখ
দিয়ে। আলতাফের বুটের লাথিতে দড়াম করে একটা কপাট লাগল ওর
কপালে। পড়ে যাচ্ছিল, আলতাফ ধরে নামিয়ে দিল মেঝেতে আস্তে করে।
রাইফেলটা তুলে নিল মাটি থেকে। দুই তিন সেকেণ্ডে ঘরটা অনুসন্ধান করে
ফিরে এল আলতাফ এ ঘরে।
‘কেউ নেই আর ও ঘরে, মেজর।’
‘বেশ। এবার বাকি সবার বাঁধন কেটে দাও, আলতাফ।’
‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ আলতাফকে অভিনন্দন জানাল মিশ্রী খান। এক
কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত বিস্তারিত হলো ওর হাসি। হাতের বাঁধন
কেটে দিতেই প্রমে গোঁফে তা দিল সে।
‘আরীফ!’ রানা ঘুরল আরীফের দিকে। ভক্তি আর শ্রদ্ধার ভাব ফুটে
উঠেছে আরীফের বিস্মিত আয়ত দুই চোখে। ‘সোলজাররা কোথায় থাকে,
আরীফ?’
‘এই কম্পাউণ্ডের মাঝামাঝি জায়গায়। এটা অফিসারদের কোয়ার্টার।’
‘কম্পাউণ্ডের সবটাই তার দিয়ে ঘেরা?’
‘হ্যাঁ। দশ ফুট উঁচু কাঁটা তার।’
‘বেরোবার রাস্তা?’
‘একটাই রাস্তা। গার্ড দু’জন।’
‘বেশ। আলতাফ সবগুলোকে পাশের ঘরে পাচার করো। না না, তুমি
থাকো, অলোক রায়। ওই চেয়ারটায় বসো। এক্ষুণি কোনও লোক ছুটে
আসবে গুলির শব্দ শুনে অনুসন্ধান করতে। তাকে বলবে আমাদের একজন
পালাতে যাচ্ছিল, তুমি গুলি করে মেরেছ। ওকে দিয়েই গেটের গার্ড
দু’জনকে ডেকে পাঠাবে।’
রাম নারায়ণের পিস্তলটা তুলে নিল রানা। অলোক রায় দেখছে
অবলীলাμমে দু’জন গার্ডের কলার ধরে ঝুলাতে ঝুলাতে নিয়ে যাচ্ছে
আলতাফ পাশের ঘরে। এবার ফিরল সে রানার দিকে।
‘আমার একটা ভুলের জন্যে কী আশ্চর্য ক্ষতি হয়ে গেল! কি বলছিলেন,
ও, আপনার আদেশ আমি পালন করব না।’
‘আলতাফ!’ ডাকল রানা।
‘বলো, মেজর।’ পাশের ঘরের দরজা জুড়ে দাঁড়াল আলতাফ।
‘আমি একজনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ছুটে আসছে এইদিকে।
পাশের ঘরে বাইরে বেরোবার দরজা আছে?’
‘আছে।’
‘বেরিয়ে যাও বাইরে। ছুরি নাও সাথে। যদি লেফটেন্যান্ট...’ ততক্ষণে
অদৃশ্য হয়ে গেছে আলতাফ। অলোক রায়ের দিকে ফিরল রানা।
‘যা বলছি তাই করতে হবে তোমাকে। যদি না করো তাহলে বাইরের
..................
৬৪ মাসুদ রানা-৬
লোকটাকে খুন করবে আলতাফ, তারপর তোমাকে এবং এখানকার গার্ড-
গুলোকে...’ কথা বলতে বলতে সরে গেল রানা পাশের ঘরে। রাইফেলটা
ধরাই আছে অলোক রায়ের দিকে। ‘তারপর গেটের সেন্ট্রি দু’জনকেও হত্যা
করা হবে ছুরি মেরে। আট নয়জন মারা যাচ্ছে- এদের সবার জীবন নির্ভর
করছে এখন তোমার ওপর। এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, যে করে হোক
পালাবই আমরা এখান থেকে। এসে গেছে...’ ফিস ফিস করে বলল রানা,
‘ভেবে দেখো, আটটা মৃতদেহ! কেবল তোমার অহঙ্কার চরিতার্থ করতে
গিয়ে!’ অলোক রায়ের রক্তশূন্য মুখের দিকে স্থির নি®পলক নেত্রে চেয়ে রইল
রানা। মনে মনে বুঝল জয় হয়েছে ওর।
ঝটাং করে খুলে গেল দরজার দুই পাট। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে
হাঁপাচ্ছে একজন সোলজার।
‘লেফটেন্যান্ট! গুলির শব্দ শুনলাম?’
‘ও কিছু নয়, সার্জেন্ট। বন্দীদের একজন পালাবার চেষ্টা করেছিল-
গুলি করে মেরেছেন ওকে কর্নেল।’
‘ডাক্তারকে খবর দিতে হবে?’
‘ডাক্তার এসে কিছুই করতে পারবে না। করবার কিছুই নেই। তুমি বরং
গেটের সেন্ট্রি দু’জনকে এক মিনিটের জন্যে ডেকে দিয়ে বিশ্রাম করতে
যাও। সারারাত তো তোমাদের কারও ঘুম হয়নি।’
‘অন্য দু’জনকে ততক্ষণ গার্ড দেবার জন্যে পাঠাব?’
‘না। এক মিনিটের ব্যাপার। তাছাড়া যাদের জন্যে গার্ডের ব্যবস্থা,
তারা এখন এই ঘরেই বন্দী।’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে আবার বলে উঠল
লেফটেন্যান্ট, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও জলদি।’
সার্জেন্টের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল দূরে। দরজার আড়াল থেকে
বেরিয়ে এল রানা।
‘ধন্যবাদ, লেফটেন্যান্ট। তোমাকে দিয়ে এই কাজটা করাতে হলো বলে
আমি দুঃখিত। আলতাফ, টেলিফোনের তারগুলো কেটে দেবার ব্যবস্থা করো
তুমি আর নাজির। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, রওনা হব আমরা একটু পরেই।’
ছুটে চলে গেল আলতাফ। প্রকাণ্ড শরীরটা যেন ওর পালকের মত
হালকা। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল অলোক রায় ওর গমন পথের দিকে।
ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ফেলল একটা। এমন বোকা বনেনি সে জীবনে কখনও
আর।
দশ মিনিটের মধ্যে গেটের সেন্ট্রি দু’জনের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বেঁধে
ফেলা হলো হাত-পা। কাপড় গুঁজে দেয়া হলো মুখের মধ্যে। অলোক
রায়েরও সেই একই অবস্থা। মাহবুবের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা।
‘রওনা হব এখন আমরা, মাহবুব, খুব কি কষ্ট হবে?’
‘কিছু না, স্যার। আপনারা তৈরি হলেই আমিও তৈরি। পায়ে আর
দুর্গম দুর্গ ৬৫
কোনও বোধই নেই- ব্যথা লাগবে কোথায়?’ হাসল মাহবুব। আরীফ আর
মিশ্রী খানের জোগাড় করে আনা স্ট্রেচারে শুয়ে আছে সে পরমানন্দে। ‘এবার
তো রীতিমত সৌখিন চালে চলব। আহত অফিসারের মত।’
বেরিয়ে এল ওরা মিলিটারি কম্পাউণ্ড থেকে। বাধা দিল না কেউ।
দ্বারোকা আর তিন মাইল।
হারিয়ে গেল ওরা রাজগড়ের জঙ্গলে।
এগারো
‘ওই পাহাড়ের ওপর একটা উপত্যকা আছে। ওখানেই একটা গুহা পাব
আমরা- পাহাড়টা আর ডিঙাতে হবে না আমাদের। ওপারে পৌঁছলেই
দ্বারোকা দুর্গের পৌনে এক মাইলের মধ্যে চলে যাব। কোনও মতে শহর
পর্যন্ত গেলেই আর চিন্তা নেই।’
‘আর পারব না হে, ছোকরা।’ মাটিতে বসে পড়ল মিশ্রী খান। ‘এঞ্জিনের
মধ্যে খানিক কয়লা না ভরলে চলবে না এটা আর এক পা-ও। সেই সকাল
থেকে মুখ বুজে আছি, আর না।’
‘সকাল থেকে মুখ বুজে আছেন?’ বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল আরীফ মিশ্রী
খানের দিকে। পরম তৃপ্তির সাথে গোঁফে তা দিচ্ছে সে। ‘আমি তো এক
মিনিটও মুখ বুজতে দেখলাম না আপনাকে। এক পিনে আশী রেকর্ড বাজিয়ে
চলেছেন সেই রওনা হবার পর থেকেই। এখন বরং খানিকটা মুখ বুজে
থাকুন। চোখও বুজতে পারেন ইচ্ছে করলে- কারণ সন্ধে না নামলে ওই
উপত্যকায় ওঠাই যাবে না।’
‘কিন্তু তুমি না বলেছিলে দ্বারোকা রাজকোট থেকে মাত্র তিন মাইল?
ঝাড়া ছয় ঘণ্টা হেঁটেও তিন মাইল পুরো করতে পারলাম না?’
‘তিন মাইল সোজাসুজি গেলে। আমরা বারো মাইল ঘুরে যাচ্ছি।’
‘কি বললে?’ শুয়ে পড়েছিল মিশ্রী খান, চট্ করে উঠে বসল। ‘বারো
মাইল হাঁটিয়েছ? সেরেছে রে, সেরেছে! বারো মাইল! শরীরের ভেতর
নিশ্চয়ই কিছু ভজঘট হয়ে গেছে। আমি তো তিন মাইল মনে করে...’
‘সন্ধে পর্যন্ত তাহলে রেস্ট?’ রানা আর আলতাফ বয়ে আনছিল
মাহবুবের স্ট্রেচারটা। সেটা নামিয়েই আদেশ দিল রানা, ‘এই খোলা
জায়গায় শুয়ে পড়ো না মিশ্রী খান, ওই ঝর্ণার ধারে গাছের তলায় বিশ্রাম নেব
আমরা।’
একটানা এতদূর আসেনি ওরা। মাঝে ভারতীয় সৈন্যদের ট্রেনিং-এর
জন্য খোঁড়া একটা ট্রেঞ্চের মধ্যে মাহবুবকে নামিয়ে লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে
.......................
৬৬ মাসুদ রানা-৬
কয়েকটা জরুরী কাজ সেরে নিয়েছে। আলতাফ আর আরীফ সেই পাহাড়ে
ফিরে গিয়ে এক্সপে−াসিভের বাক্স দুটো নিয়ে এসেছে, মিশ্রী খান মিলিটারি
গ্যারেজে ঢুকে ওদের ট্রাকগুলোর ইগনিশন্ কয়েল আর ডিস্ট্রিবিউটার নষ্ট
করে দিয়ে এসেছে, নাজির বেগ গ্রামে গিয়েছিল মাহবুবের জন্য কিছু ওষুধ
যোগাড় করে আনতে- কিন্তু বেচারা ভুল ওষুধ নিয়ে ফিরেছে। আর রানা
একটা টিলার মাথায় চড়ে দূরবীন লাগিয়ে মিলিটারিদের গতিবিধি লক্ষ
করেছে।
রানারা বেরিয়ে আসবার আধঘণ্টার মধ্যেই একজন পত্রবাহক সেন্ট্রি
অফিসারস কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হওয়ায় ছাড়া পেয়েছে লেফটেন্যান্ট
অলোক রায় ও অন্যান্য গার্ডরা। উত্তেজিত ভাবে প্রত্যেককে প্রস্তুত হয়ে
নেবার আদেশ দিয়েছে লেফটেন্যান্ট। গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেল সব ট্রাকই
অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মার্চ করে বেরিয়ে পড়েছে ওরা দ্বারোকা যাবার
সোজা পথ ধরে। সঙ্গে ফিল্ড টেলিফোনও নিয়েছে অলোক রায়।
রানার ঘড়িতে এখন বাজে বেলা একটা। আরও পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে
হবে সূর্যাস্তের জন্যে। মাহবুবের পা-টা একবার পরীক্ষা করে দেখেছে রানা ও
মিশ্রী খান, পরস্পরের দিকে চেয়ে হেসেছে, মাহবুবকে আশ্বাস দিয়েছেগু প্রায়
শুকিয়ে এসেছে ঘা-টা। আসলে কালো হয়ে গেছে সারাটা পা- বিশ্রী গন্ধ
ছুটেছে পচে ওঠায়। বেঁধে দিয়েছে আবার ব্যাণ্ডেজ। পালা করে প্রহরার
ব্যবস্থা হয়েছে। আলতাফ, মিশ্রী আর মাহবুব ঘুমাচ্ছে একটা ঝোপের
আড়ালে, আরীফ শুয়ে আছে বাঁকা একটা পাথরের চাঁইয়ের ছায়ায়। নাজির
বেগ জোর করে রানাকে বিশ্রাম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিক-ওদিক চেয়ে
আরীফের পাশে শুয়ে পড়ল রানা। অনেকক্ষণ জেগে রইল। ঘুম আসছে না
চোখে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে নাজির বেগ।
অলস চোখে চেয়ে দেখছে রানা। একটা লম্বা গাছে উঠে গেল নাজির বেগ
চারপাশটা ভাল ভাবে দেখবার জন্যে। নাহ্, খানিকটা ঘুমিয়ে নেয়া দরকার,
এমন সুযোগ আর না-ও আসতে পারে।
ঘুমের ঘোরে আরীফের গায়ে একটা হাত পড়তেই মুহূর্তে জেগে গেল
রানা। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সরে এল রানার হাতটা। অবাক চোখে চেয়ে রইল
সে কিছুক্ষণ আরীফের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ভাল করে লক্ষ করে দেখল
আরীফের কানের লতিতে ছোট্ট একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে। মৃদু হাসি ফুটে
উঠল রানার মুখে। তাহলে এই ব্যাপার! গতকাল বগল তলায় হাত দিয়ে ওর
জ্ঞানহীন দেহটা তুলতে গিয়ে কেমন খট্কা লেগেছিল- আজ বোঝা গেল।
পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
‘মেজর রানা! শিগগির ওঠেন!’ কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে আরীফ।
দুর্গম দুর্গ ৬৭
‘কি ব্যাপার, আরীফ?’ উঠে বসল রানা। দেখল উত্তেজিত উদ্বিগড়ব
আরীফের চোখ মুখ। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল সে।
‘পে−ন! অনেকগুলো পে−ন আসছে এইদিকে।’
ফাঁকা জায়গায় এসেই দেখতে পেল রানা পে−নগুলো। দশটা। পাঁচটা
পাঁচটা করে দুই সারিতে আসছে এদিকেই- মাত্র দু’হাজার ফুট উঁচু দিয়ে।
মিগ জেট। মুহূর্তে বিপদ টের পেল রানা। সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতে সে বুঝল
এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা ভারতীয়
পে−নের জানবার কথা নয়। কিন্তু বিচার-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে একটা বিশেষ অনুভূতি
আছে রানার- তাই যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ ব্যতিরেকেও ভয় পেল সে।
এবং বুঝল, বিপদ আসনড়ব। হঠাৎ চোখে পড়ল রানার, প্রায় দু’শো গজ দূরে
পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে আলতাফ আর মিশ্রী খান মাহবুবের স্ট্রেচারটা
বয়ে নিয়ে। আর অল্প কিছুদূর গেলেই পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়। ব্যাপার
কি? ওকে কিচ্ছু না জানিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে কেন?
‘তোমাকে কে ঘুম থেকে ওঠাল?’
‘কেউ না, এমনি জেগে গেছি। কই, চলুন, এক্ষুণি এসে পড়বে পে−ন।’
অসহিষ্ণুভাবে রানার হাত ধরে টান দিল আরীফ।
‘নাজির বেগ কোথায়? ও-ই তো ছিল পাহারায়?’
‘জানি না, জানি না। জল্দি করুন, মেজর রানা!’ অস্থির হয়ে উঠল
আরীফ। ‘আর আধ মাইলও নেই। এসে গেছে পে−ন।’
ছুটল ওরা পাহাড়ের দিকে। বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা পার হয়ে
পৌঁছতে হবে পাহাড়ী রাস্তায়। ওদের দেখতে পেলেই মেশিনগান চালাবে
পে−ন থেকে। কিন্তু উপায় নেই, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
ডাইভ দিয়ে নেমে এল সামনের পাঁচটা পে−ন। বাকি পাঁচটা উড়ে গেল
সোজাসুজি মাথার ওপর দিয়ে। শুয়ে পড়ল রানা মাটিতে, টেনে শোয়াল
আরীফকেও।
‘কানে আঙুল দাও, আরীফ। মাথা নিচু করে রাখো।’
পাঁচশো, চারশো, তিনশো ফুট নেমে এল জেটগুলো। এঞ্জিনের শব্দে
কানে তালা লাগার জোগাড়। আবার নাকগুলো উঁচু হলো পাঁচটা জেটের।
উঠে গেল ওরা ওপরে। পনেরো বিশটা বোমা নেমে এল ঝর্ণার ধারে ঠিক
যেখানটায় এতক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিল ওরা সেই জঙ্গলের ওপর। কিন্তু বোমা
যদি হবে তো শব্দ কোথায়? এমনি সময় কানে এল নাপাম বোমা ফাটবার
শব্দ। উজ্জ্বল আলো দেখা গেল। কয়েক সেকেণ্ডেই ঘন কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে
গেল জঙ্গলটা। ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে।
মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জঙ্গলটা। কিন্তু এত ঘন কালচে ধোঁয়া
কিসের?
একটু পরেই বোঝা গেল। টিয়ার গ্যাস। জঙ্গলের মধ্যে থেকে ওদেরকে
.....................
৬৮ মাসুদ রানা-৬
ফাঁকা জায়গায় বের করে নিয়ে আসতে চাইছে। ওরা জানে জঙ্গলের মধ্যে
অন্য কোনও রকম বোমা ফেলে লাভ নেই।
দু’জনেই কাশতে আরম্ভ করল ভয়ানক ভাবে- দরদর করে পানি পড়ছে
চোখ দিয়ে, কনকন করে উঠছে দু’চোখ বিষাক্ত ধোঁয়ার স্পর্শে।
পশ্চিমের বাতাসে ভেসে আসছে ধোঁয়াটা। অল্পক্ষণেই পার হয়ে যাবে।
কিন্তু রানা বুঝল পার হতে দিলে চলবে না। এই ধোঁয়াই এখন ওদের
বাঁচবার একমাত্র ভরসা। ধোঁয়া সরে গেলে ফাঁকা ময়দানে গুলি খেয়ে মরতে
হবে, নয়তো পুড়ে মরতে হবে আগুনে। উত্তাপ বেড়েই চলেছে μমে।
স্পালাও, আরীফ! আমার হাত ধরে রাখো। ধোঁয়ার মধ্যেই দৌড়াতে
হবে।’ ভয়ঙ্কর কাশি এসে বন্ধ করে দিল রানার কথা।
কিছু দেখা যাচ্ছে না চোখে, অন্ধের মত ছুটে চলেছে ওরা দু’জন।
হোঁচট খাচ্ছে, পড়ছে, আবার উঠছে, আবার ছুটছে। ফুঁপিয়ে উঠছে দু’জন
একটু বাতাসের জন্যে। একটু মুক্ত বাতাস। আর পারা যায় না। আবার
এঞ্জিনের গর্জন শোনা গেল। ঠিক মাথার ওপর তিনশো ফুট উঁচুতে! ফিরে
এসেছে ওরা আবার বম্বিং-এর জন্যে। এবার বম্বিং হলো সামনে। থমকে
দাঁড়াল রানা। কেঁপে উঠল পৃথিবীটা। ঢলে পড়ল আরীফ।
হঠাৎ একটা কুলুকুলু শব্দে কান খাড়া হয়ে গেল রানার। বাম দিকে
ফিরল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না চোখে। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল
সামনের জঙ্গলটায়। আর ভাববার সময় নেই। পাঁজাকোলা করে তুলে নিল
রানা আরীফের জ্ঞানহীন দেহ। পাগলের মত ছুটল বামে। হালকা হয়ে
এসেছিল পশ্চিমের টিয়ার গ্যাস, কিন্তু পা পিছলে ঝর্ণার মধ্যে পড়ে না যাওয়া
পর্যন্ত টের পেল না রানা যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেছে।
অগভীর ঝর্ণা। কোমর পানি। গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে ঠাণ্ডা পানি ছিটাল
রানা আরীফের চোখে মুখে, নিজেও ধুয়ে নিল মুখটা। ভয়ঙ্কর গরম হয়ে
উঠছে চারদিকের বাতাস। অনায়াসে পার হয়ে এল সে বারো ফুট চওড়া
ঝর্ণাটা। ধোঁয়া সরে গেছে পুবে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে রানা চেয়ে দেখল
চলে যাচ্ছে পে−নগুলো দ্বারোকা এয়ারফিল্ডের দিকে। আবার বোমা নিয়ে
ফিরবে বোধহয়।
উঠে এল রানা ঝর্ণা থেকে। শুইয়ে দিল আরীফের জ্ঞানহীন দেহটা
শুকনো মাটিতে। অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিচ্ছে সে এখন। আঁজলা
ভরে পানি এনে জোরে চোখে-মুখে ছিটাতেই কেঁপে উঠল আরীফের চোখের
পাতা। বার কয়েক মিট মিট করেই চোখ মেলে চাইল সে রানার দিকে,
তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। দাউ দাউ করে জ্বলছে কয়েক জায়গায়
টুকরো টুকরো জঙ্গল। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে
চেয়ে বলল, ‘ওরা কোথায়? চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এক্ষুণি আবার ফিরে আসতে পারে। কেমন বোধ করছ,
দুর্গম দুর্গ ৬৯
আরীফ, হাঁটতে পারবে?’
‘নিশ্চয়ই,’ বলেই উঠে দাঁড়াল আরীফ। দাঁড়িয়েই ঢলে পড়ে যাচ্ছিল,
চট্ করে ধরে ফেলল রানা।
‘ব্যাপার কি, আরীফ? তুমি আমাদের মধ্যে কেন? এই ভয়ঙ্কর গ্র“পের
মধ্যে তো তোমাকে ঠিক মানায় না?’
চমকে গেল আরীফ, তারপর হাসল। বুঝল, ধরে ফেলেছে রানা। ‘আমি
আজ তিন বছর ধরে পুরুষের ছদ্মবেশে এই এলাকায় স্পাইং করছি।
আহমেদাবাদ পর্যন্ত আমার এলাকা। জুনাগড়, মানবদ্বার, দ্বারোকা, জামনগর,
রাজকোট...’
‘বুঝলাম, বুঝলাম। কিন্তু পুরুষের ছদ্মবেশ কেন?’
‘মেয়েলোকের অনেক রকমের বিপদ আছে, সেসব থেকে বাঁচবার
জন্যে।’
‘কি নাম তোমার? মানে আসল নাম?’ ঠেলা দিল পেছন থেকে রানা
ওকে এগোবার জন্যে। হাঁটতে আরম্ভ করল দু’জন।
‘ইশরাত জাহান।’
‘নামটা তো খাসা, নওয়াব ফ্যামিলির নাম মনে হচ্ছে!’
‘আমি নওয়াব ফ্যামিলিরই মেয়ে।’
ঘাড় কাত করে একবার ইশরাত জাহানের মুখটা দেখল রানা। তারপর
বলল, ‘এখন জলদি আমাকে দলের আর সবার কাছে নিয়ে চলুন,
নওয়াবজাদী।’
‘ওদের কাছে আমার আসল পরিচয় বলে দেবেন না যেন আবার!’
‘নাজির বেগ তো জানেই...’
‘না। যদি ভবিষ্যতেও আমার এই অঞ্চলে থাকতে হয় তাহলে
জানাজানি না হওয়াই ভাল।’
‘এত কাণ্ডের পরও? আমার মনে হয় না এত সব ঘটনার পর তোমার
এদেশে থাকা আর উচিত হবে। যাই হোক, পরের কথা পরে, এখন একটু
জলদি পা চালাও, জাহান। ওই দেখো আবার আসছে পে−ন।’
একটা অস্টার পে−ন আসছে এইদিকে। পড়িমরি করে ছুটল ওরা।
হৈ-হৈ করে এগিয়ে এল মিশ্রী খান ওদের দিকে।
‘ওস্তাদ! কোথায় ছিলেন, ওস্তাদ! আমরা এদিকে...’
‘আমাকে ফেলে পালিয়ে এলে কেন তোমরা? আসবার সময় জাগিয়েও
তো দিতে পারতে!’ রানার কণ্ঠে তীব্র তিরস্কার।
থ হয়ে গেল মিশ্রী খান। জবাব পেল না খুঁজে। আলতাফই প্রম কথা
বলল।
‘ঘুমিয়েছিলে তোমরা? আমরাও ঘুমিয়ে ছিলাম। একমাত্র মাহবুব জেগে
ছিল। পে−নের শব্দ পেয়েই ডেকেছে আমাদের। ঘুম থেকে জেগেই দেখলাম
.............
৭০ মাসুদ রানা-৬
নাজির বেগ উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে। হুইস্ল্ দিয়ে সিগন্যাল দিতেই
আমাদেরকে ডাকল ইশারায়। মনে করলাম তোমরাও উঠে গেছ পাহাড়ে...’
‘নাজির বেগ কোথায়?’
জিজ্ঞেস করবার সাথে সাথেই দেখল রানা খোঁড়াতে খোঁড়াতে নামছে
নাজির বেগ পাহাড় থেকে। ডান পা-টা জখম হয়েছে ওর।
‘ওই যে আসছে, ওস্তাদ। আপনারা আমাদের সঙ্গে আসেননি দেখে
ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ছুটে নেমে গেল ও নিচে- তখনও আমরা জানি না যে
আপনারা ঝর্ণার ধারে পরম সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। কিছুদূর নেমেই গুলি
খেয়েছে ও পায়ে। নিজেই ব্যাণ্ডেজ করে উঠে এসেছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে।’
‘কি ব্যাপার, নাজির?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপার খুবই খারাপ, স্যার।’ রানাদের আবির্ভাবে বিস্ময়ের ধাক্কা সে
দূর থেকেই সামলে নিয়েছে।
‘কি হয়েছে?’
‘ছ’টা আর্মার্ড কার আর দশটা কামান ফিট করা হাফ ট্রাক আসছে
দ্বারোকা থেকে। আধ মাইলও নেই এখন। আর ওই দেখুন, একখানা অস্টার
পে−নে আমাদের গতিবিধি লক্ষ করা হবে।’
ভ্রƒ কুঁচকে গেল রানার। পাহাড়ের গুহার ছায়ায় পে−ন থেকে রক্ষা পাওয়া
সম্ভব কিন্তু ল্যাণ্ডফোর্স এলে ঠেকাবে কি করে? তার আগে কয়েকটা ব্যাপারে
আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
‘নাজির, তুমি আমাকে আগেই ঘুম থেকে জাগাওনি কেন?’
‘কাউকেই জাগাইনি আমি। গাছের মাথা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম
কি যেন এগোচ্ছে আমাদের দিকে, তাই ভাল করে দেখবার জন্যে পাহাড়ে
উঠছিলাম। আমি যখন পাহাড়ের প্রায় মাথায় উঠে গেছি তখন দেখলাম পে−ন
আসছে এদিকে। তখন আর কাউকে কিছু জানাবার উপায় নেই। কিন্তু যখন
দেখলাম মিশ্রী খান আর ক্যাপ্টেন আলতাফ ঘুম থেকে উঠেছে তখন মনে
করলাম ওরা আপনাদের নিশ্চয়ই জাগিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা বলছে আমাকে
পাহাড়ের ওপর দেখে ওরা মনে করেছিল আপনি, আমি, আরীফ তিনজনেই
পে−নের শব্দে ওদের ফেলেই পালিয়ে এসেছি পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়ে।’
‘তাই বলো। সবটা মিলেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যাক্, এখন
সবাই হারি আপ্! আরীফ তোমার সেই উপত্যকা আর কতদূর?’
স্পনেরো মিনিটের পথ। কিন্তু পা চালাতে হবে। একটা শর্টকাট রাস্তা
আছে বড় রাস্তা থেকে ওই উপত্যকার গোড়া পর্যন্ত আসবার। ওরা যদি ওই
পথে আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছে যায় তাহলেই সব শেষ হয়ে যাবে।’
দ্রুত পা চালাল ওরা। মাহবুব আর নাজির বেগের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে,
কিন্তু এদের কেউই পরাজয় স্বীকার করবে না। কারও মুখ থেকে একটি টুঁ
শব্দ বেরোল না।
দুর্গম দুর্গ ৭১
ঠিকই বলেছিল আরীফ। এই উপত্যকার উপরই নির্ভর করছে সব
কিছু। ওখানে পৌঁছেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। মিশ্রী খান পাহাড়ের গা
বেয়ে উঠে গেল ওপরে ভারতীয় সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ করবার জন্যে।
মাহবুবকে একটা গুহার মধ্যে শুইয়ে রেখে চারপাশে চেয়ে প−্যান ঠিক করে
ফেলল রানা। বুঝিয়ে দিল আলতাফকে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল আলতাফ।
হঠাৎ একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে এল এদের। নাকটা কুঁচকে রানা জিজ্ঞেস
করল, ‘মাহবুবের এখন কি অবস্থা, আলতাফ?’
‘মিশ্রী বলছে আজ রাত কাটবে না ওর। ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে
গ্যাংগ্রিন। রাত পোহাবার আগেই মারা যাবে।’
‘বড় কষ্ট পাচ্ছে বেচারা।’
‘সকাল থেকে একবারও চোখের পাতা এক করেনি। অসাধারণ
মানসিক শক্তি না থাকলে এতক্ষণ টিকতে পারত না। মরবে না, প্রতিজ্ঞা
করেছে যেন ছেলেটা।’
মিশ্রী খান ফিরে এল প্রায় ছুটতে ছুটতে।
‘ওস্তাদ! এসে গেছে ওরা। ওই যে নিচে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে,
ওখানটায় এসেই রাস্তা শেষ। হাফ-ট্রাকের কামানগুলো একেকটা লাইট
পোস্টের সমান! আর দুই মিনিটেই দেখতে পাবেন।’
চমৎকার জায়গা বেছে নিয়েছে আরীফ। পাথরের আড়ালে একজন
মেশিনগান নিয়ে বসলেই আর কারও সাধ্য নেই এগোবার। সাব-মেশিনগান
আর ব্রেনগান নিয়ে প্রস্তুত হলো ওরা চারজন। পাশাপাশি শুয়ে পড়ল
মাটিতে। এমনি সময় জঙ্গলের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল আর্মার্ড কার আর
হাফ-ট্রাকগুলো। লাফিয়ে নামল জনা পঞ্চাশেক সৈন্য। রাইফেল, মেশিনগান
আর বাজুকা নিয়ে উঠে আসতে আরম্ভ করল ওরা পাহাড়ের গা বেয়ে
উপত্যকার দিকে।
‘ওস্তাদ, আমার কারবার বারুদ নিয়ে। কোনও ব্রিজ উড়িয়ে দিলাম, কি
কোনও রাস্তা ড্যামেজ করে দিলাম- কিংবা হয়তো একমুঠো বালু ছেড়ে দিয়ে
এলাম শত্র“পক্ষের গাড়ির এঞ্জিন বিয়ারিং-এ। যুদ্ধের কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি
আমার সহজ সরল বুদ্ধি বিবেচনার বাইরের ব্যাপার। কিন্তু সেই আমার
কাছেও মনে হচ্ছে ওই সৈন্যগুলো জেনে-শুনে আÍহত্যা করতে যাচ্ছে। কষ্ট
করে আরেকটু ওপরে উঠে গুলি খাওয়ার চাইতে ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের
বুকে গুলি করলেই তো পারে ব্যাটারা?’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে, মিশ্রী,’ বলল রানা। চেয়ে দেখল কোনও
কিছুর আড়ালে গিয়ে প্রাণ বাঁচাবার উপায় নেই ওদের, সোজা বুক পেতে
দিয়ে উঠে আসছে ওপরে। ‘আর সে কথা ওরাও জানে।’
‘তাহলে আসছে কেন শালারা, ওস্তাদ?’
‘এছাড়া আর কোনও উপায় নেই বলে। এই জায়গায় আসবার অন্য
..................
৭২ মাসুদ রানা-৬
কোনও পথ নেই সামনা-সামনি আμমণ করা ছাড়া। ভাল জায়গাই বেছে
নিয়েছ, আরীফ। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। সন্ধ্যার
অন্ধকার নামলে আমরা সরে যাব এখান থেকে। কিন্তু ওদের এই মরিয়া
আμমণ দেখেই বুঝতে পারছি কি পরিমাণ ভয় পেয়েছে ওরা। আরও
খানিকটা এগিয়ে নিক, আরীফ আর আমি মাঝখান থেকে আরম্ভ করব।
আমি ডাইনে যেতে থাকব, আরীফ যাবে বাঁয়ে, আলতাফ আর মিশ্রী দুই ধার
থেকে শুরু করে মাঝের দিকে আসতে থাকবে।’
‘আমার বড় খারাপ লাগছে, ওস্তাদ,’ বলল মিশ্রী খান।
‘আমারই যে খুব আনন্দ হচ্ছে তা ভেব না। এটা যুদ্ধ তো নয়, নিছক
হত্যাকাণ্ড। দ্বারোকা দুর্গের নিরাপদ আশ্রয়ে ডেস্কের পেছনে বসে হুকুম
চালানো সহজ; তাই এদের বাধ্য করা হয়েছে মৃত্যু বরণ করতে। কিন্তু
আমরা যদি ওদের বাধা না দিই তবে আমাদের কি অবস্থা হবে সেটাও ভেবে
দেখো, মিশ্রী।’
‘জানি, ওস্তাদ। এটাকে টারগেট প্র্যাকটিস মনে করবার চেষ্টা করব।
কিন্তু এতগুলো ছাগল মারতেও আমার দুঃখ হত- আর এরা তো মানুষ।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা।
‘লাইট পোস্ট যে এত তাড়াতাড়ি সাইজ বদলাতে পারে তা আমার
জানা ছিল না কিন্তু, মিশ্রী।’
সবাই হেসে উঠল। আসলে গোটা কয়েক ছয় ইঞ্চি মর্টার এনেছে ওরা
সঙ্গে। সেগুলোর দিকে চেয়ে দেখল মিশ্রী একবার ভাল করে, তারপর
বেহায়ার মত বলল, ‘দূরবীন দিয়ে দেখেছিলাম কিনা; তাই বড় লেগেছিল।
কিন্তু, ওস্তাদ, ভাতিজারা ফ্র্যাগমেন্টেশন বম্ব ব্যবহার করবে বলে মনে হচ্ছে।
একটা টুকরো গায়ে লাগলেই হাওয়া হয়ে যাবে শরীরটা। কখন চালাবে
ওগুলো?’
‘আমরা ফায়ার করলেই আরম্ভ করবে।’ বিনকিউলারটা চোখে লাগাতে
যাচ্ছিল রানা, হঠাৎ হাতটা ধরে ফেলল আলতাফ। অবাক হয়ে চাইল রানা
আলতাফের মুখের দিকে।
‘ওটা আর ব্যবহার কোরো না, মেজর। অনেক চিন্তা করে দেখেছি
আমি, খুব সম্ভব ওটার জন্যেই আমাদের অবস্থান জানতে পেরেছে
ভারতীয়রা। তাই নির্ভুল ভাবে বিমান হামলা চালিয়েছে। সূর্যের আলো
লেন্সগুলোয় প্রতিফলিত হয়েছিল...’
এতক্ষণে রানা বুঝল এই অতর্কিত বিমান হামলার কারণ। মাথা নাড়ল
সে কয়েকবার। ভয়ানক রাগ হলো নিজের ওপর। একমাত্র ওর কাছেই ছিল
বিনকিউলার- ও-ই ব্যবহার করেছিল সেটা চারদিকে নজর রাখবার কাজে।
ও নিজেই কুমীর এনেছিল খাল কেটে। কিন্তু এখন আÍগ−ানির সময় নেই।
অনেক কাছে চলে এসেছে সৈন্যরা। খুব খারাপ লাগছে রানার- নিরুপায়
দুর্গম দুর্গ ৭৩
অসহায় লোকগুলোকে এভাবে হত্যা করতে হবে ভেবে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে
মনটা। কিন্তু স্থির অকম্পিত কণ্ঠে হুকুম দিল সে।
‘ফায়ার!’
গর্জে উঠল চারটে মৃত্যুবর্ষী সাব-মেশিনগান। অসহায় সৈন্যগুলো থম্কে
গেল। কি ঘটছে ভাল করে বুঝবার আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল তিন চর্তুাংশ
সৈন্য। কেউ বা দুই হাত শূন্যে তুলে একপাক ঘুরে মাটিতে পড়ল মুখ
থুবড়ে, গড়াতে গড়াতে নিচে চলে গেল কেউ কেউ, কয়েকজন মূর্তির মত
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুই তিন সেকেণ্ড, তারপর ঢলে পড়ল ঠিক পুতুলের
মত। মাটিতে শুয়ে পড়ল অবশিষ্ট সৈন্যরা, গুলিবৃষ্টি থেকে একটু আড়াল
খুঁজছে ওরা।
একসাথে থেমে গেল চারটে মেশিনগান। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল
চারপাশ। মিলিয়ে গেল ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। এই হঠাৎ নিস্তব্ধতা কয়েক
সেকেণ্ডের বিকট শব্দের চাইতেও অনেক বেশি শব্দময় বলে মনে হলো। যেন
গমগম করছে চারদিক। একটা কনুই সরিয়ে আলতাফের দিকে চাইল রানা।
ভাবলেশহীন স্থির দৃষ্টি মেলে চেয়ে রয়েছে সে নিচের মৃতদেহগুলোর দিকে।
ইশরাত? চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে, পাছে ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে হয়। হঠাৎ
মিশ্রী খানের দিকে নজর পড়ল রানার। বিড় বিড় করে কি যেন বলছে সে।
‘খোদা! শুধু একজন! আর একজন মাত্র। শুধু ওই হারামজাদাকে শেষ
করবার সুযোগ দিয়ো- আর কিছু চাই না আমি!’ বলছে মিশ্রী খান।
‘কি ব্যাপার, মিশ্রী?’ রানা কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল ওকে।
রানার দিকে লাল চোখ মেলে কট্মট্ করে চাইল মিশ্রী খান। যেন
চিনতেই পারছে না। তারপর বার কয়েক চোখ মিটমিট করে মৃদু হাসল।
গোঁফে একবার তা দিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘দিবা-স্বপড়ব দেখছিলাম,
ওস্তাদ।’
‘কাকে শেষ করতে চাইছিলে? যে পাষণ্ডটা এই বেচারাদের আমাদের
পিছু ধাওয়া করতে বাধ্য করেছে, তাকে?’
হাসি মিলিয়ে গেল মিশ্রী খানের ঠোঁট থেকে। মাথা ঝাঁকাল সে।
তারপর একটু এগিয়ে মাথা বাড়িয়ে নিচের দিকে দেখল সে। আবার হাসি
ফুটল ওর মুখে।
‘শালারা উটপাখির মত করছে, ওস্তাদ। মার্বেলের সমান পাথরের
আড়ালে লুকাবার চেষ্টা করছে। ওদের মাফ করে দিই, কি বলেন, ওস্তাদ?’
‘দাও, মাফই করে দাও।’ রানা ভাবল, আর খুন খারাবি নয়। ‘ওরা
আর সাহস পাবে না এগোবার।’ কথাটা বলেই ঝট্ করে মাথা নিচু করল
রানা। কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। পেছনের
একটা পাথরে লেগে দূরে চলে গেল বিঙ্ঙ্ আওয়াজ তুলে।
একটা স্প্যাণ্ডাও মেশিনগান থেকে গুলি আসছে মুষলধারে। কোনও
........................
৭৪ মাসুদ রানা-৬
ট্রাকের পেছনে ফিট করা আছে খুব সম্ভব। ব্রীচের মধ্যে দিয়ে বেল্ট যাওয়ার
শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ওরা। আপন মনেই কথা বলে উঠল রানা।
‘আপাতত মেশিনগানে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, আসল ভয় এখন ওই
মর্টারগুলো।’
‘ওগুলো তো চুপচাপ আছে,’ বলল মিশ্রী খান।
‘এখনও আছে। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আর থাকবে না। ওই দেখো
আবার আসছে পে−নটা আমাদের খুঁজতে। আমাদের পজিশন জানাবে ওরা
নিচের সৈন্যদের ওয়্যারলেসে।’
প্রায় ওদের মাথার ওপর এসে গেল পে−নটা। দেখতে পেয়েছে ওদের।
মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে। একটা পাথরের ফাঁকে চোখ দিয়ে নিচের
দিকে চাইল মিশ্রী খান।
‘ওস্তাদ!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মিশ্রী। ‘কামানগুলো আমাদের দিকে
র্ফিরছে। এক্ষুণি কেটে পড়া দরকার!’
পে−নটা মাথার ওপর থেকে সরল না। মর্টার ট্রাকগুলোর কাছে ওদের
অবস্থান তো জানাচ্ছেই, অবশিষ্ট সৈন্যদেরও জানানো হয়েছে যে ওরা সরে
গেছে অনেকখানি পশ্চিমে- নিরাপদে উঠে আসতে পারে তারা এখন।
রানাদের আগের পজিশনে এসে গেছে ভারতীয় সৈন্য। ফ্র্যাগমেন্টেশন বম্ব
পড়ছে ওদের কাছাকাছি। তাই মাঝে মাঝে ছোট ছোট গুহার মধ্যে আশ্রয়
নিতে হচ্ছে ওদের। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। কারণ, ভারতীয়
সৈন্য μমেই এগিয়ে আসছে- দূরত্ব বজায় না রাখলে যদি কোনও সুযোগে
একবার বেশি কাছে এসে পড়ে তাহলে গুহাতেই পচে মরতে হবে ওদের,
বেরোতে পারবে না।
ছুটে এক গুহা থেকে অন্য গুহায় সরে যাচ্ছে ওরা ইশরাত জাহানের
নির্দেশিত পথে। মাঝে মাঝে গুলি চালিয়ে হটিয়ে দিচ্ছে পেছনের সৈন্যদের।
কিন্তু মর্টারের ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে সব সময়। খোলা জায়গায় কাছাকাছি
একটা পড়লেই হয়েছে। একবার একটা বোমা ওদের গজ বিশেক সামনে
এসে পড়ল। মাটিতে শুয়ে পড়ল সবাই। কিন্তু কপালগুণে ফাটল না সেটা।
ভয়ে ভয়ে রোমাঞ্চিত শরীরে পা টিপে পার হয়ে গেল ওরা বোমাটার পাশ
দিয়ে।
সূর্যাস্তের পর হঠাৎ পাহাড়ের একটা তীক্ষè কোণা ঘুরে দক্ষিণে চলে এল
ওরা। ঢাকার নবাবপুর রোডের মত একটা অসমতল পথ পাওয়া গেল।
দু’পাশে তার পাহাড়। মর্টার বন্ধ হয়ে গেছে। পে−নটা এখনও আছে, কিন্তু
বেকার চক্কর দিচ্ছে। সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে পাহাড়ের গভীর অঞ্চলেরানাদে
রকে আর দেখতে পাচ্ছে না পাইলট। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যগুলো বড়
বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। ওদের প্রত্যেকের মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার
আগুন। অনেক এগিয়ে এসেছে ওরা। নিজের অপরিসীম ক্লান্তিবোধ থেকেই
দুর্গম দুর্গ ৭৫
অনুভব করতে পারল রানা দলের আর সবার কেমন লাগছে। আহার নেই,
বিশ্রাম নেই, পুরোপুরি ঘুমও হয়নি কারও গত চারদিন। ভারতীয় সৈন্যরা
μমেই এগিয়ে আসছে আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে।
রাস্তার তীক্ষè বাঁকটার কাছেই একটা পাথরের ওপর চড়ে বসল রানা।
ওখান থেকে ভারতীয় সৈন্যদের কার্যকলাপের ওপর চোখ রাখা যাবে- সেই
সাথে বিশ্রামও পাবে একটু দেহটা। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল
মাটিতে।
আনমনে দেখছে রানা নিজের ছোট্ট দলটাকে, আর মনে মনে হিসেব
কষছে, কি পরিমাণ সম্ভাবনা আছে ওদের টিকে থাকার। খুব ভরসা পেল না
সে। নাজির বেগ রীতিমত গুরুতর জখম হয়েছে। ইশরাত জাহান তার
সাধ্যের অতীত পরিশ্রম করেছে- মুখ দিয়ে ফেনা উঠতেই কেবল বাকি। আর
তেমনি সজাগ সচেতন আছে মাহবুব, কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে অতি দ্রুত।
মিশ্রী খান মাটিতে শুয়ে পড়ে গোঁফে তা দিচ্ছে আর পরম তৃপ্তির সঙ্গে বক
সিগারেট টানছে একটা। রানারই মত ক্লান্ত হয়েছে, কিন্তু রানারই মত আরও
বহুক্ষণ ধরে ক্লান্ত হতে পারবে সে। আর দুর্ধর্ষ আলতাফ যেমন ছিল তেমনি
আছে- অক্লান্ত, অদম্য, অটল।
চারপাশে আর একবার চোখ বোলাল রানা। নীল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে
দূরে। লাইট হাউসের উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল। ওপাশে দ্বারোকা বন্দরেও
একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে সন্ধ্যা-বাতি।
হঠাৎ দেহের সমস্ত পেশী শক্ত হয়ে গেল রানার। দক্ষিণ দিকে চোখ
পড়তেই দেখা গেল ছয়শো গজ দূরে শেষ হয়ে গেছে রাস্তাটা, সামান্য উঁচু
পাহাড়। এক লাফে উঠে দাঁড়াল রানা।
‘আরীফ? কোথায় নিয়ে এসেছ আমাদের? জায়গাটা চেনো তো তুমি
ভাল মত?’
‘নিশ্চয়ই, মেজর। এই পাহাড়ের সব কিছু আমার নখ-দর্পণে।’
‘কিন্তু এই রাস্তা তো ওখানে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। ফাঁদের মধ্যে চলে
এসেছি আমরা। এখন কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরতে হবে ওদের হাতে।’
‘না, মেজর। হাতের বাঁয়ে একটা গুহা আছে। সেই পথে আমরা এই
পাহাড় থেকে বেরিয়ে আরেকটা উপত্যকায় চলে যাব। তার পাশেই দ্বারোকা
যাবার পাকা সড়ক- মাইল খানেক গেলেই দ্বারোকা দুর্গ। কিন্তু আমরা আধ
মাইল গিয়েই নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়ব আজকের রাতটার জন্যে।’
শান্ত হলো উদ্বিগড়ব রানা। মিশ্রী খানও কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে
শুনছিল কথাগুলো, এবার সটান শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে।
‘গুহাটা ঠিক খুঁজে পাবে তো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চোখ বেঁধে দিলেও।’ দৃঢ় আÍপ্রত্যয় ইশরাত জাহানের কণ্ঠে।
‘আচ্ছা, বেশ...’ কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু কথা থামিয়ে হঠাৎ
...............................
৭৬ মাসুদ রানা-৬
পাথরের ওপর থেকে লাফ দিল সে। মাহবুবের ওপর পড়তে যাচ্ছিল, শূন্যে
থাকতেই শরীরটা বাঁকিয়ে মিশ্রী খান আর আলতাফ ব্রোহীর মাঝখানে পড়ে
দেয়ালের গায়ে জোরে ধাক্কা খেলো সে। উঠে এসেছে ভারতীয় সৈন্য-
দেড়শো গজ দূরে একটা বাঁকের কাছে এসেই রানাকে দেখতে পেয়ে গুলি
ছুঁড়েছে। আর একটু হলেই সাঙ্গ হয়ে যেত রানার ভবলীলা। গুলিটা বাম
কাঁধের কাপড় ছিঁড়ে খানিকটা চামড়া চিরে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এক
ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে ধরল রানাকে মিশ্রী খান। বিনা বাক্য ব্যয়ে শার্টের
ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করল জখমের পরিমাণ।
‘অসাবধান থাকার এই ফল,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি
এত কাছে চলে এসেছে ওরা।’
‘ওস্তাদ, জখম তো খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় লেগেছে?’
‘ব্যাটাদের হাতের সই নেই। ছুঁয়ে গেছে কেবল, লাগাতে পারেনি।’
সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। ‘কিন্তু এক্ষুণি রওনা হওয়া দরকার। কতদূর আছে
গুহার মুখটা, আরীফ?’
হঠাৎ মুখে কথা জোগাল না ইশরাত জাহানের। রানার দিকে অপরাধীর
মত একবার চেয়েই চোখ নামাল সে মাটির দিকে।
‘আরীফ!’ ডাকল রানা।
‘গুহাটা বেশ দূরে, মেজর। আসলে ওটা এই পাথুরে রাস্তার শেষ
মাথায়।’
‘একেবারে শেষ মাথায়?’ চোখ কপালে উঠল রানার।
মাথা নাড়ল আরীফ মাটির দিকে চেয়ে।
‘বাহ্! চমৎকার! এতক্ষণে বলছ সে কথা?’ খেঁকিয়ে উঠল রানা।
‘আমি...আমি, মানে...’
‘থাক থাক, হয়েছে। এখন চুপ করো।’ মাটিতে বসে পড়ল রানা।
এখন উপায়? আলতাফ ওর ব্রেনগানটা পাথরের ফাঁকে রেখে কয়েক রাউণ্ড
গুলি বর্ষণ করল শত্র“পক্ষের ওপর। কোন কিছু লক্ষ্য করে নয়- শত্র“পক্ষকে
কেবল এটুকু জানিয়ে দেবার জন্যে যে আর এগোলে ভাল হবে না।
নিঃশব্দে পার হয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ড। মৃদুকণ্ঠে কথা বলে উঠল
ইশরাত জাহান, ‘আমি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মেজর। ভয়ানক ভুল হয়ে
গেছে। আমি মনে করছিলাম ওরা এখনও অনেক পেছনে আছে।’
‘এটা তোমার কোনও ভুল নয়, আরীফ।’ ইশরাতের কাঁধের ওপর
একটা হাত রাখল রানা। ‘দোষটা তোমার নয়। আমিও তাই মনে
করেছিলাম। নিজেকে অপরাধী ভাবার কোন দরকার নেই। তাছাড়া যা
হবার...’
‘স্যার!’ রানার জামার আস্তীন ধরে টান দিল মাহবুব। ‘কি হয়েছে?
কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।’
দুর্গম দুর্গ ৭৭
‘খুবই সহজ ব্যাপার, মাহবুব। এই সোজা পথ ধরে ঝাড়া আধমাইল
যেতে হবে এখন আমাদের। কোথাও এতটুকু আড়াল নেই। অথচ শ’
দেড়েক গজ এগোলেই ভারতীয় সৈন্যরা পৌঁছে যাবে এখানে। আর এখানে
পৌঁছানো মানেই ওদের যেমন অসহায় অবস্থায় ফেলে গুলি চালিয়েছিলাম
আমরা, ঠিক তেমনি অনায়াসে খুন করবে ওরা আমাদের।’ আলতাফ আরও
কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাল। শব্দটা থামতেই আবার আরম্ভ করল রানা। ‘ওরা
এগোবার চেষ্টা করছে। একেকবার খানিকটা এগিয়ে দেখছে আমরা এখনও
এই কোণটা দখল করে বসে আছি কিনা। যে-মুহূর্তে ওরা বুঝবে যে, আমরা
আর এখানে নেই, সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে এসে উপস্থিত হবে। আমরা
অর্ধেক রাস্তা পার হবার আগেই ওরা পৌঁছে যাবে এখানে। কুকুরের মত গুলি
করে খুন করবে আমাদের সবাইকে।’
‘কিন্তু, স্যার, একজনকে পেছনে গার্ড রেখে...’
‘তারপর গার্ডটার কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা ওকে বাধা দিয়ে।
‘ওহ্-হো। বুঝলাম এখন। একথা তো চিন্তা করিনি।’
‘তুমি করোনি। কিন্তু যাকেই পেছনে গার্ড হিসাবে রেখে যেতে চাইব সে
প্রমে এই কথাটাই চিন্তা করবে।’
‘আমার মনে হয় এ নিয়ে বৃা সময় নষ্ট না করাই ভাল,’ হঠাৎ কথা
বলে উঠল ইশরাত জাহান। ‘দোষ আমার। আমার জন্যেই দলের সবার এই
অবস্থা হলো। আমিই...’
‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ প্রকাণ্ড এক চাপড় বসাল মিশ্রী খান ইশরাতের
কাঁধে। ‘কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ পাবে না। ওস্তাদ
তো বলেইছে দোষ তোমার নয়।’ এক ঝটকায় ইশরাতের সাব-মেশিনগানটা
কেড়ে নিয়ে মাটিতে নামিয়ে রাখল মিশ্রী খান। রানা বুঝল মিশ্রীর ব্যবহারটা
কেমন যেন বদলে গেছে। কি যেন চিন্তা করছে গভীর মনোযোগের সাথে।
তাই তার ব্যবহার কথাবার্তা অসংলগড়ব।
নাজির বেগ বলল, ‘রাত্রির অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তো আমরা এখানেই
অপেক্ষা করতে পারি। তারপর অন্ধকারের মধ্যে...’
‘ভুলে যাচ্ছ একটা কথা, নাজির। আজ পূর্ণিমা। আকাশে ছিটে ফোঁটা
মেঘও দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া আজ সন্ধ্যার পরপরই যদি শহরে পৌঁছতে
না পারি তাহলে কোনও দিনই আর পারব না পৌঁছতে। আজই আমাদের
শেষ সুযোগ।’
এক মিনিট কেউ কোও কথা বলল না। তারপর হঠাৎ সবাইকে চমকে
দিয়ে কথা বলে উঠল মাহবুব চানন্।
‘ঠিকই বলেছে, আরীফ,’ দুর্বল কণ্ঠে বলল সে। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বরে
এমন একটা আশ্চর্য দৃঢ়তা প্রকাশ পেল যে প্রত্যেকে ওর দিকে ফিরে চাইতে
বাধ্য হলো। আরীফের সাব-মেশিনগানটা এখন ওর হাতে। বাম কনুইয়ে ভর
.
৭৮ মাসুদ রানা-৬
করে মাথাটা রেখেছে সে হাতের ওপর। ‘সমস্যাটা অত্যন্ত সহজ, এবং এর
সমাধানও খুবই সরল। গ্যাংগ্রিনটা আমার সারা পা ছেয়ে ফেলেছে, তাই না,
মেজর?’
থতমত খেয়ে গেল রানা। কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এত
আকস্মিক ভাবে এমন মারাÍক প্রশড়ব করে বসবে মাহবুব ভাবতেও পারেনি সে।
কেন কথাটা জিজ্ঞেস করছে সে, বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর। চেয়ে দেখল
রানা, মিশ্রী খানের দুই চোখে নিষেধ- সত্যি কথাটা বলতে বারণ করছে সে।
‘সত্যি করে বলুন, স্যার। হ্যাঁ, কি না?’ স্থির নিষ্কম্প মাহবুবের গলা।
হঠাৎ রানা পেয়ে গেল সঠিক উত্তরটা। এছাড়া আর উপায়ই বা কি?
‘হ্যাঁ।’ রানা দেখল ভীত, বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে মিশ্রী
খানের চোখ।
‘ধন্যবাদ,’ মাহবুবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা। ‘আমি জানতাম। কাজেই আমি
থাকছি এখানে। এই দুঃসাহসী গ্র“পের মেম্বার হিসেবে আমারও একটা
ভূমিকা আছে। আমার কর্তব্যটুকু আমি সম্পাদন করব। করুণ বিদায়
সম্ভাষণের কোনও প্রয়োজন নেই। কয়েক বাক্স গুলি আর গোটা দুই-তিন
হ্যাণ্ড গ্রেনেড রেখে চলে যান আপনারা।’
‘খোদার কসম বলছি, মাহবুব...’ দুই পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল মিশ্রী
খান। মাহবুবের হাতের মেশিনগানটা সোজা ওর বুকের দিকে ধরা।
‘আর এক পা সামনে এগোলেই গুলি করব, ক্যাপ্টেন!’
অনেকক্ষণ চেয়ে রইল মিশ্রী খান মাহবুবের নি®পলক চোখের দিকে।
তারপর পিছিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
‘আচ্ছা, খোদা হাফেজ। আমার জন্যে অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন
আপনারা- সেজন্যে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। যান, রওনা হয়ে
যান।’
পুরো এক মিনিট পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সবাই। তারপর
কাছে এগিয়ে এল মিশ্রী খান। ছেঁড়া, নোংরা জামা গায়ে, সন্ধ্যার আধো
আলো আধো ছায়ায় বিকট দেখাল মিশ্রী খানের হািিডসার দেহটা। নিচু
হয়ে মাহবুবের একটা হাত ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিল সে।
‘শাব্বাশ, ভাতিজা!’ হাসবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু কানড়বার মত দেখাল
হাসিটা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কি ভেবে বলল না। ‘আচ্ছা, চলি,
মাহবুব। আবার দেখা হবে।’ কোনও মতে দ্রুত কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল
সে। হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করল। নাজির বেগ আর ইশরাত জাহান
নিঃশব্দে চলে গেল ওর পেছন পেছন। আলতাফ কি যেন বলল মাহবুবের
কানে কানে। মৃদু হেসে মাথা নেড়ে ওর কথাটা যেন সমর্থন করল মাহবুব।
তারপর একা দাঁড়িয়ে রইল রানা। মনের মধ্যে ঝড় বইছে ওর। ওর দিকে
চেয়ে ম−ান হাসল মাহবুব।
দুর্গম দুর্গ ৭৯
‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার। মিথ্যে কথায় না ভুলিয়ে আপনি আমাকে
সম্মানিত করেছেন।’
‘তোমার... তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো, মাহবুব?’ রানা ভাবল, ছি
আর কোনও কথা কি পেল না সে খুঁজে?
‘না, স্যার। সত্যি বলছি, কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না আমার। কোনও ব্যথাই
অনুভব করতে পারছি না। চমৎকার আছি।’
‘তোমার জন্যে আমি গর্বিত, মাহবুব।’ কেন যেন কেঁপে গেল রানার
গলার স্বর।
‘আপনার এখন রওনা হওয়া উচিত, স্যার। আর সবাই অপেক্ষা করবে
আপনার জন্যে। তার আগেই ওই পাথরটার আড়াল থেকে নিচের দিকে
গোটা কতক এলোপাতাড়ি গুলি করে দিলে ভাল হয়।’
কয়েক রাউণ্ড গুলি চালিয়ে এসে দাঁড়াল রানা মাহবুবের পাশে।
‘কোনও কিছু লাগবে তোমার, মাহবুব?’
‘না, স্যার। হ্যাঁ। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে যান। আর...আর, যদি
সম্ভব হয়, আমার মায়ের সাথে দেখা করে বলবেন, আমি কষ্ট পেয়ে মরিনি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দলের আর সবাইকে ধরে ফেলল রানা। আর
পনেরো মিনিটেই পৌঁছে গেল ওরা গুহা মুখে। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে
থেকে কান পেতে শুনল ওরা, অবিরাম গুলি চালাচ্ছে মাহবুব। ওর প্রাণের
বিনিময়ে দলটা পেল এগিয়ে যাবার ছাড়পত্র। এই মহান আÍত্যাগকে বিফল
হতে দিতে পারে না ওরা।
বারো
আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা দ্বারোকায়। দুর্গ-তোরণের পঁচিশ গজের
মধ্যে।
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেই ভরসা পেল না রানা। সত্যিই তাহলে এত
বাধা বিপত্তির পর পৌঁছেচে ওরা গন্তব্যস্থলে? এটা কি তাহলে সত্যিই
একেবারে অসম্ভব ছিল না? তাহলে কি বাকি কাজটুকুও সম্ভব?
গুহামুখে ঢোকার পরেই সবকিছু এত সহজ এবং স্বচ্ছন্দে ঘটে গেল যে
.
৮০ মাসুদ রানা-৬
অবিশ্বাসের ঘোরটা কিছুতেই কাটতে চাইছে না রানার। দোতলা বাড়ির
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চাইলেই দেখা যাচ্ছে দুর্গ-তোরণ। উজ্জ্বল বাতি
জ্বলছে সেখানে।
গুহার মধ্যে ঢোকার পরই নাজির বেগ পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। জখম
পায়ে বহুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিকূল অবস্থার সাথে যুদ্ধ করেছে সে, আর
পারল না। সেখানেই রয়ে যেতে চেয়েছিল সে। মাহবুবকে হত্যা করে
সৈন্যরা এগিয়ে এলে ঠেকাতে পারবে সে। কিন্তু রাজি হয়নি রানা। কঠোর
ভাবে বকা দিয়েছে ওকে। বুঝিয়ে কথা বলবার সময় ছিল না তখন। আপত্তি
করবার সাহস পায়নি নাজির বেগ। আলতাফ আর মিশ্রী খানের সাহায্যে
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতেই হয়েছে ওকে ওদের সঙ্গে। রানা বুঝল, আর কিছু
নয়, ছুতো খুঁজছে সে আরও কিছু ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করবার।
প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে ওর মনের মধ্যে সর্বক্ষণ।
গুহা থেকে বেরিয়ে রাস্তার কাছাকাছি এসেই ঠোঁটে আঙুল রেখে
সবাইকে চুপ করবার ইঙ্গিত করল ইশরাত। রানাও শুনতে পেল কয়েকজন
লোকের কথাবার্তা। কয়েকটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে কারা যেন কথা
বলছে। হাত তুলে থামতে বলল রানা দলের সবাইকে। কিন্তু ঠক্ করে
একটা শব্দ এল কানে- অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দও পেল সে। রেগে গেল
রানা। পেছনে ফিরে এল সে কারণ অনুসন্ধান করবার জন্যে। দেখল মাটিতে
পড়ে আছে নাজির বেগের জ্ঞানহীন দেহ। মিশ্রী খান বলল যে এত হঠাৎ
থামতে বলায় ও টাল সামলাতে না পেরে ধাক্কা খেয়েছে নাজির বেগের সাথে,
হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেছে তাই নাজির বেগ, এবং মাথাটা একটা পাথরের
ওপর পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে। অজ্ঞান হওয়ার ভান করছে কিনা পরীক্ষা করে
দেখল রানা নিচু হয়ে। হত্যার নেশা ওর রক্তে। ছুতো ধরে পিছিয়ে পড়বার
চেষ্টা করতে পারে হয়তো। কিন্তু না। মাথার পেছনে ফোলা জায়গাটা
দেখেই বুঝল রানা সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে সে।
দশজন ভারতীয় সেপাই হেঁটে চলে গেল গল্প করতে করতে। রানাদের
উপস্থিতি টের পায়নি ওরা। ইশরাত বলল এদিক থেকে যাতে ওরা বেরোতে
না পারে খুব সম্ভব সেজন্যে পাঠানো হয়েছে ওদের। দ্বারোকার ব্রিগেডিয়ার
ওদের সমস্ত সম্ভাব্য পথ বন্ধ করবার ব্যবস্থা করেছে। রানার কাছে কথাটা
তেমন যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। কিন্তু তর্ক না করে এগিয়ে গেল সে সামনে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রাস্তার ওপর দাঁড়ানো ট্রাক দেখতে পেল ওরা।
দু’জন গার্ডের হাত-পা বেঁধে ঝোপের আড়ালে ফেলে দিতে লাগল আরও
এক মিনিট, তারপর ছুটল ট্রাক চওড়া রাস্তা ধরে।
পথে কোন বাধা পায়নি ওরা। মিলিটারি ট্রাকটা পেয়ে ভালই হয়েছে।
রাত সাড়ে আটটা থেকে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে দ্বারোকায়। সাড়ে
আটটার অবশ্য দেরি আছে অনেক, তবু পায়ে হেঁটে এগোলে ধরা পড়বার
দুর্গম দুর্গ ৮১
সম্ভাবনা ছিল। ইশরাত বসেছে ড্রাইভিং সীটে, হেড লাইট অন করে দক্ষ
হাতে চালিয়ে এসেছে সে এই মাইলখানেক রাস্তা। ছোট্ট শহর দ্বারোকা। সব
কিছু ইশরাতের মুখস্থ। অনেকগুলো গলি-ঘুঁচি পেরিয়ে প্রায়-নির্জন একটা
রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে থেমেছে ওরা দোতলা এই বাড়িটার সামনে।
লেফটেন্যান্ট আরীফের গোপন আস্তানা। নাজির বেগ টলতে টলতে পথ
দেখিয়ে নিয়ে এসেছে ওদের দোতলায়। ইশরাত চলে গেছে ট্রাকটার একটা
সুব্যবস্থা করতে।
রানা ভাবল ইশরাতের কোনও বিপদ না হলেই হয়। দ্বারোকা পৌঁছে
আÍবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে সে। সবই তার চেনা। রানাদের গাইড করবার ভার
এখন ওর। ওকে ছাড়া এখন রানারা অন্ধের মত। তাই নিজের দায়িত্ব এবং
ক্ষমতা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে সে দ্বারোকা পৌঁছেই। ট্রাকটাকে
নিয়ে কি করতে যাচ্ছে তা-ও রানাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে।
ডাঙায় তোলা মাছকে আবার পানিতে ছেড়ে দিলে তার যেমন অবস্থা হয়,
তেমনি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছে ইশরাত দ্বারোকা পৌঁছে।
রানা ভাবছে ইশরাতের কথা। ওর জন্যে উদ্বেগ অনুভব করল সে।
ওকে ছাড়া চলবে না, বা ওর সাহায্যের এখন খুব প্রয়োজন, সেজন্যে নয়।
কেন জানি এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছে রানা ওর প্রতি। মেয়ে বলে নয়,
প্রম দর্শনেই এই মিষ্টভাষী, সদা চঞ্চল, উৎসাহী মানুষটা ওর মনের মধ্যে
একটা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। নাজিরের জন্যে সে ভাবটা হয়নি।
কোথায় যেন ইশরাতের সঙ্গে তার মস্ত তফাৎ আছে। দোষটা অবশ্য
নাজিরের নয়- অবস্থার চাপে পড়ে সে ওরকম হয়েছে। ইশরাতের স্বতঃস্ফূর্ত
প্রাণচাঞ্চল্য ক’জনের মধ্যেই বা আছে? ইশরাতের উপস্থিত বুদ্ধিরও তুলনা
হয় না। দুটো আস্তানা আছে ওর দ্বারোকায়। ইচ্ছে করেই সে দুর্গের
একেবারে গায়ে লাগানো একটা বাড়িতে এনে তুলেছে ওদের, ভারতীয়
সৈন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন হবে যে দুর্গের এত কাছে এসে উঠতে
পারে ওদের কম্যাণ্ডো গ্র“প। অথচ এখান থেকে দুর্গরক্ষীদের গতিবিধি
অনায়াসে লক্ষ করতে পারবে ওরা।
বহুদিনের পুরানো বাড়ি। দেয়ালের চুন-সুরকি খসে লাল ইঁট দেখা
যাচ্ছে জায়গায় জায়গায়। দোতলায় মস্ত একটা খালি ঘর। আলো জ্বালাবার
উপায় নেই, জানালা দিয়ে যেটুকু বাইরের আলো আসছে তাতেই সন্তুষ্ট
থাকতে হচ্ছে ওদের।
নাজির বেগের সাহায্যে একতলায় ভাঁড়ার ঘর খুঁজে বের করে চিঁড়ে গুড়
আর খাবার পানি জোগাড় করে নিয়ে এল মিশ্রী খান। পাশের বাড়ি থেকে
এক ছড়া কলা চুরি করে নিয়ে এল নাজির বেগ পায়ের ভয়ানক জখম
সত্ত্বেও।
একরাত একদিন পর এই সাধারণ খাদ্যদ্রব্যগুলোর মধ্যেই অসাধারণত্ব
.
৮২ মাসুদ রানা-৬
আবিষ্কার করে পরম বিস্ময় প্রকাশ করল সবাই। মাটির কলসের ঠাণ্ডা
পানিতে অমৃতের স্বাদ পেল ওরা।
সটান মেঝেতে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। বক সিগারেট ধরাল একটা।
এই প্রম স্পষ্ট এবং বিস্তারিত ভাবে ভেঙে বলল রানা সবাইকে দ্বারোকার
দুর্গম দুর্গে প্রবেশের প−্যানটা। গলার স্বর খাটো করবার দরকার হলো নারা
স্তার ঠিক অপর পাশের বাড়িটায় ঘটাং ঘট্ খটাং খট্ মেশিন চলছে। একটা
ডিমাই ফ্ল্যাট বেড আর একটা হাফ-μাউন ট্রেডল্ প্রিন্টিং মেশিন যেন পাল−া
দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে- কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। ধীরে সুস্থে
প্রত্যেককে বুঝিয়ে দিল রানা প−্যানটা, কাজ ভাগ করে দিল প্রত্যেকের মধ্যে,
জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিল সবাই সব কথা ঠিক মত বুঝেছে কিনা।
‘এইবার খানিক বিশ্রাম নিয়ে নেয়া যাক। এই আমাদের শেষ সুযোগ।
আরীফ না আসা পর্যন্ত যে যত পারো গড়িয়ে নাও। আমি পাহারায়
থাকলাম,’ বলল রানা।
‘আমি পাহারায় থাকব,’ তড়াক করে উঠে বসল মিশ্রী খান।
‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মিশ্রী...’
‘আপনার নিজের চেহারা নিজে দেখতে পাচ্ছেন না বলে এই কথা
বলছেন, ওস্তাদ। দয়া করে কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়থন ভালয় ভালয়,
নইলে এই খোকাটা (আলতাফকে দেখিয়ে) জোর করে শোয়াবে। না, ওস্ত
াদ, নিজের ওপর এভাবে অত্যাচার করবার কোনও অধিকার নেই আপনার।’
রানা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, আলতাফ বলল, ‘ঠিকই বলেছে মিশ্রী
খান, আমাকে কি সত্যিই উঠতে হবে, মেজর?’
হেসে ফেলল রানা। পরাজয় স্বীকার করে নিল। মেঝের ওপর পিঠ
ঠেকিয়েই উপলব্ধি করল সত্যি সত্যিই কতখানি পরিশ্রান্ত হয়েছে সে। ঠাণ্ডা
মেঝেতে শুয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইল ওর চোখ। সাইলেন্সার ফিট্ করা
পিস্তলটা নিয়ে উঠে গেল মিশ্রী খান জানালার পাশে। তিন মিনিটের মধ্যেই
মিশ্রী খান ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে পড়ল গভীর ঘুমে।
কিন্তু কপালে যাদের বিশ্রাম নেই তারা শুধু শুধু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা
করলে পাবে কেন? পঁচিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল ইশরাত জাহান।
দরজায় মৃদু টোকা পড়তেই রানার ঘুম ভেঙে গেল। পিস্তল হাতে সন্তর্পণে
এগোচ্ছিল মিশ্রী খান, রানাকে উঠে বসতে দেখে বলল, ‘দরজায় কে যেন
টোকা দিল, ওস্তাদ।’
‘খুব সম্ভব আরীফ। আমি দরজা খুলব নিচে গিয়ে, তুমি আড়ালে
লুকিয়ে থাকবে প্রস্তুত হয়ে।’
হাঁপাচ্ছে ইশরাত জাহান। ঢক ঢক করে প্রমেই এক গ−াস পানি খেলো
সে।
‘বেঁচে আছ তাহলে এখনও, ছোকরা?’ মিশ্রী খানের কণ্ঠস্বরে স্হে ঝরে
দুর্গম দুর্গ ৮৩
পড়ল। ‘ব্যাপার কি, হাঁপাচ্ছ কেন? তাড়া করেছিল কেউ?’
‘কে তাড়া করবে? আমার ছায়াও তো দেখতে পায়নি কেউ। মনে
করলাম আমার জন্যে উদ্বিগড়ব হয়ে থাকবেন আপনারা, তাই সারাটা পথ দৌড়ে
চলে এসেছি।’
‘কোথা থেকে সারা পথ দৌড়ে এসেছ, আরীফ?’ জিজ্ঞেস করল
আলতাফ। জেগে গেছে সে-ও।
‘সোমনাথের মন্দির থেকে। ডান দিকের রাস্তা ধরে দেড় মাইল
দক্ষিণে। জঙ্গলের মধ্যে বহুকালের পুরানো ভাঙা একটা মন্দির। সাপের
দৌরাÍ্যে কেউ আর ঘেঁষে না ওইদিকে।’
‘ওখানে গিয়েছিলে কেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চিন্তা করে দেখলাম, গুহামুখে আমাদের জন্যে যে-সব সৈন্যরা অপেক্ষা
করছে, ওরা যখনই টের পাবে যে ট্রাকটা খোয়া গেছে অমনি বুঝে ফেলবে
যে কাজটা আমাদের। ঝোপের ধারের হাত-পা বাঁধা লোকগুলোও সেই
সাক্ষ্যই দেবে। ওরা পরিষ্কার জেনে যাবে যে আমরা আর ওখানে নেই, চলে
এসেছি শহরের দিকে।’
একটু থেমে সবার দিকে চাইল আরীফ। রানা বলল, ‘তা জেনে যাবে।
তারপর?’
‘তারপর সমস্ত দ্বারোকার প্রতিটা বাড়ি সার্চ করে খুঁজবে আমাদের।
দ্বারোকায় না পেলে শহরের আশেপাশে খুঁজতে আরম্ভ করবে হন্যে হয়ে।
কিন্তু আগে খুঁজবে দ্বারোকায়। বাতাসের গন্ধ শুঁকেই বুঝলাম বৃষ্টি আসছে।
অল্পক্ষণেই মেঘে ঢেকে যাবে চাঁদ।’
‘তাড়াতাড়ি কথা শেষ করো, আরীফ- তোমার সাত-কাণ্ড রামায়ণ
শুনবার সময় নেই,’ রানা বলল নীরস কণ্ঠে।
আহত হলো ইশরাত। বলল, ‘কথা প্রায় শেষ। যাতে প্রমেই শহরে
সার্চ না ক’রে গ্রামের দিকে সার্চ করে তার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছি।’
‘কি করে?’ অবাক হলো রানা।
‘সে অনেক কথা, শুনবার সময় হবে কি?’
হেসে ফেলল রানা। বুঝল রাগ করেছে ইশরাত। ওর কাঁধে একটা হাত
রেখে বলল, ‘আমাদের অবস্থা তো বুঝতেই পারছ, ইশ...আরীফ। সব কথা
জানা-ও চাই, আবার সংক্ষেপ হওয়াও চাই। এখন প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান।
যে-কোন মুহূর্তে আমাদের সমস্ত প−্যান বদলাতে হতে পারে। কাজেই মান
অভিমান...’
‘না। মান-অভিমানের কিছুই নেই। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, সব কথা
সংক্ষেপে হয় না। সংক্ষেপে বললে সেটাকে আবার ব্যাখ্যা করতে হয়। যাক,
যা বলছিলাম, আমি ভেবে দেখলাম, ওদের মনোযোগ যদি শহর থেকে দূরে
সরিয়ে নিতে পারি তাহলে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে অন্তত আমরা নিশ্চিন্তে
.
৮৪ মাসুদ রানা-৬
থাকতে পারব। তাই ট্রাকটা সোমনাথের মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে গিয়ে ওটার
ট্যাঙ্ক থেকে সমস্ত পেট্রল বের করে সারাটা গাড়ি আচ্ছামত ভেজালাম।
তারপর আগুন ধরিয়ে দিলাম ওতে।’
‘আগুন ধরিয়ে দিয়েছ! কেন?’ আলতাফ জিজ্ঞেস করল।
‘কারণটা খুবই সহজ। উপত্যকার সৈন্যরা এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে
যে ট্রাকটা চুরি করেছি আমরা। আগুন দেখতে পাবে ওরা ওখান থেকে।
সাথে সাথেই ছুটবে সোমনাথের মন্দিরের দিকে। আগুন না নেভা পর্যন্ত
অপেক্ষা করবে। তারপর ট্রাকের মধ্যে মৃতদেহ বা হাড়গোড় কিছু না পেয়ে
মন্দিরটা খুঁজবে তনড়ব তনড়ব করে। সেখানেও যখন কিছু পাবে না তখন
আশেপাশের গ্রামগুলোতে খুঁজবে। সেখানেও নেই আমরা। তখন ওরা
বুঝতে পারবে যে বোকা বানিয়েছি আমরা ওদের- আসলে শহরের মধ্যেই
কোথাও আছি। শহরের দিকে তখন আসবে ওরা ধেয়ে, একটি বাড়িও বাদ
দেবে না, এবং সারা শহর তনড়ব তনড়ব করে খুঁজে কি দেখবে ওরা? দেখবে,
এখানেও নেই আমরা।’
‘ততক্ষণে খোদার কাছে চলে গেছি?’ টিটকারি মেরে বলল মিশ্রী খান।
‘না। সশরীরে বেঁচে আছি। বৃষ্টি নামবে অল্পক্ষণেই, মেঘে ঢেকে যাবে
চাঁদ। এই অন্ধকারের মধ্যে বেমালুম গায়েব হয়ে যাব আমরা। টিএনটি
লুকিয়ে রেখে আমরা সরে যাব এখান থেকে।’
‘কোথায়?’ চমৎকৃত রানা জিজ্ঞেস করল।
‘কোথায় আবার? সোমনাথের মন্দিরে। কাল সকালের আগে ওরা
কিছুতেই ওখানে আবার খোঁজ করবে না। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারব
আমরা সেখানে।’
সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা ইশরাতের দিকে। তারপর বলল,
‘এই কম্যাণ্ডো গ্র“পের নেতৃত্বের ভার তোমার ওপর না দিয়ে আমাকে দেয়া
ভুল হয়ে গেছে কমোডোরের। চমৎকার প−্যান হয়েছে, আরীফ। জয়ের
সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার।’
তীরের মত চোখে মুখে এসে বিঁধছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। মাথাটা এক
ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের ওপর এসে পড়া একগুচ্ছ ভেজা চুল সরিয়ে দিল রানা।
বাম হাতটা তুলে চোখ আড়াল করল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সর্বাঙ্গ। দশ
বারো ফুট উঁচুতে দুর্গ-প্রাচীরের মাথা।
‘মরে যাব, ওস্তাদ! এইটা ডিঙাতে হলে ঠিক মরে যাব। দেয়ালের সারা
গায়ে কাঁচের টুকরো বসানো,’ কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বলল মিশ্রী খান।
গায়ে-গায়ে লেগে থাকা বাড়িগুলোর ছাত ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে দেয়ালের
সবচেয়ে কাছের বাড়িটার ছাতে এসে উপস্থিত হয়েছে রানা আর মিশ্রী খান।
দুর্গ রক্ষার স্বার্থে কোনও বাড়িকেই দোতলার বেশি বাড়তে দেয়া হয়নি,
দুর্গম দুর্গ ৮৫
প্রত্যেকটা বাড়িই দোতলা পর্যন্ত এসে ঠেকে গেছে। তাই কোন অসুবিধেই
হয়নি ওদের এখানে পৌঁছতে। কিন্তু দেয়াল দেখেই দমে গেল মিশ্রী খান।
‘কিচ্ছু ভয় নেই, মিশ্রী। দেয়াল টপকাতে হবে না আমাদের। কাজের
সুবিধার জন্যে এক্সপে−াসিভের বাক্সদুটো শুধু দেয়ালের ওপর লুকিয়ে রাখব।
ভয় নেই, আমিই যাব। তুমি বাক্সদুটো আমার পিঠে বাঁধবার আগে একবার
ভাল করে চেক করে নাও, আমি হুকটা ততক্ষণে বাধিয়ে ফেলছি দেয়ালের
মাথায়।’
কিছুটা আশ্বস্ত হলো মিশ্রী খান। বলল, ‘কিন্তু, ওস্তাদ, দেয়ালটা কম
হলেও পনেরো ফুট দূরে। রশিতে ঝুলে ওখানে যাবেন কি করে? ফিরবেনই
বা কি করে?’
‘সে-সব তোমাকে ভাবতে হবে না। যা বলছি তাই করো।’
মিশ্রী খান ঝুঁকে পড়ল বাক্সগুলোর ওপর। রানা হুক লাগানো রশিটা
ছুঁড়ে দিল দেয়ালের দিকে। খটাং শব্দ করে আটকে গেল সেটা দেয়ালের
মাথায়।
হঠাৎ প্রায় অস্ফুট একটা বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল মিশ্রী খানের মুখ
থেকে। রানা ছুটে এল কাছে।
‘কি ব্যাপার, মিশ্রী?’
‘ওস্তাদ। বাক্সটা আমি নিজের হাতে গুছিয়েছিলাম। এটা সেই বাক্সই
নয়!...এই যে, দাঁড়ান।’ কয়েক সেকেণ্ড ঘাঁটাঘাঁটি করে চাপা μুূ স্বরে
বলল, ‘নেই। úো-বার্নিং ফিউজটা নেই।’
‘কি যা-তা বলছ!’ ঝুঁকে পড়ল রানা। হাত চালিয়ে দিল বাক্সের মধ্যে।
‘অসম্ভব কথা। যাবে কোথায়? তুমি তো নিজের হাতে প্যাক করেছিলে?’
‘করেছিলাম। কিন্তু কোনও শুয়োরের বাচ্চা খুলেছিল এটাকে। নিশ্চয়ই
কেউ...’
‘অসম্ভব! আজই দুপুরে তুমি খুলে সাজিয়েছ সব কিছু। তারপর থেকেই
ওটা আরীফের পিঠে আছে সর্বক্ষণ। আরীফ কিছুতেই...’
‘এটা আরীফের কাজ নয়,’ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল মিশ্রী খান।
‘তাহলে? নিশ্চয়ই আছে। আবার খুঁজে দেখো, মিশ্রী।’
‘হাজার খুঁজলেও আর পাওয়া যাবে না, ওস্তাদ।’ মিশ্রীর কণ্ঠে অদ্ভুত
একটা হতাশা ফুটে উঠল। ‘আমারই দোষ। আমারই সাবধান হওয়া উচিত
ছিল।’
‘কি পাগলামি করছ, মিশ্রী। তোমার দোষ মানে? আমার সামনে
প্যাকেট করেছ...’ থেমে গেল রানা কথার মাঝখানে। চট করে উঠে দাঁড়াল
সে। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। দক্ষিণ দিক থেকে একটা গুলির
শব্দ ভেসে এসেছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল শব্দটা। চারদিক
আবার নিস্তব্ধ।
.
৮৬ মাসুদ রানা-৬
এতক্ষণে আলতাফ আর নাজির বেগের রওনা হয়ে যাওয়ার কথা।
সাগর পারে ইশরাতের দ্বিতীয় আস্তানা থেকে করাচির সাথে কথা বলে চলে
যাবে ওরা সোমনাথের মন্দিরে। ইশরাত খাওয়া সেরে খানিকটা বিশ্রাম
নেবে, রানা আর মিশ্রী খানের কাজ হয়ে গেলে ওদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে
সেখানে- কথা ছিল এই রকম। তাহলে গুলির শব্দ কিসের? আলতাফরা গুলি
ছুঁড়ল? কিংবা ধরা পড়ে গেল? নাকি কোনও রকম ফাঁদ? ওরা খোঁজ নিতে
গেলেই ধরা পড়বে সেই ফাঁদে?
এমনি সময় একটা মেশিনগান গর্জে উঠল। কান পেতে শুনবার চেষ্টা
করছে রানা। বৃষ্টির জন্যে সব ঝাপসা হয়ে গেছে, কিছু দেখার উপায় নেই।
এবার আরেকটা হালকা মেশিনগানের শব্দ কানে এল। তিন-চার সেকেণ্ড
পরেই হঠাৎ এক সাথে থেমে গেল দুটো মেশিনগানই। কি ঘটছে ওখানে
কিচ্ছু বুঝবার উপায় নেই। আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না রানা।
‘জলদি, মিশ্রী!’ ফিসফিস করে বলল রানা। ‘আর সময় নেই। এগুলো
সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। বেঁধে ফেলো। ওদিকে কিছু গোলমাল হয়েছে।’
আধ মিনিটের মধ্যে দেয়াল থেকে হুক খুলে রশি পেঁচিয়ে ফেলল রানা।
এক্সপে−াসিভের বাক্স দুটো ব্যাগের মধ্যে ভরে তুলে নিল কাঁধে। নিঃশব্দ পায়ে
দৌড়ে চলল ওরা ছাদ টপকে টপকে আস্তানার দিকে। ইশরাতও নিশ্চয়ই
শুনতে পেয়েছে গুলির শব্দ?
ছাতের ওপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল একটা ছায়ামূর্তি। মাত্র ছয় ফুট
দূরে। ইশরাত কোথায়? এই লোক কিছুতেই ইশরাত হতে পারে না।
ইশরাতের চেয়ে অনেক লম্বা। চওড়াও। চিতাবাঘের মত অতর্কিতে লাফিয়ে
পড়ল রানা লোকটার ওপর। প্রচণ্ড এক ঘুসি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল
ছায়ামূর্তিটা। সাথে সাথেই ওর বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরল মিশ্রী
খান।
মারাই যেত, কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতেই ঝুঁকে মুখটা দেখবার চেষ্টা করল
রানা। বিকৃত হয়ে গেছে মুখটা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে বাইরেকিন্তু
চিনতে পারল রানা।
‘মিশ্রী! থামো, থামো! ছাড়ো ওকে- ও নাজির বেগ।’
রানার কথা শুনতে পেল না মিশ্রী খান। অদ্ভুত একটা জিঘাংসা জ্বলজ্বল
করছে ওর দুই চোখে। আঙুলগুলো μমেই বসে যাচ্ছে নাজির বেগের
গলায়। দাঁতে দাঁত চেপে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে টিপে ধরেছে মিশ্রী খান,
বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যেন ও।
‘ছাড়ো, মিশ্রী। আরে গর্দভ, ও নাজির বেগ। ছেড়ে দাও।’ মিশ্রী খানের
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল রানা। দুই হাতে মিশ্রীর কব্জি ধরে সরাবার
চেষ্টা করছে সে হাত দুটো নাজিরের গলা থেকে। এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ
করল রানা, নইলে আর কয়েক সেকেণ্ডেই মৃত্যু ঘটবে নাজির বেগের।
দুর্গম দুর্গ ৮৭
হঠাৎ বুঝতে পারল মিশ্রী খান। উঠে দাঁড়াল ওর বুকের ওপর থেকে।
ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে ওর। নীরবে চেয়ে আছে সে নাজির বেগের দিকে।
‘কি হয়েছে তোমার, ক্যাপ্টেন মিশ্রী খান? কালা হয়ে গেছ, নাকি অন্ধ
হয়ে গেছ?’ তিরস্কার করল রানা তীক্ষè কণ্ঠে।
‘কিছু একটা হয়েছিল হয়তো।’ ডান হাতে গাল ঘষল মিশ্রী খান। ‘আমি
দুঃখিত, মেজর।’
‘আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ না করে বরং ওর কাছে মাফ চাওয়া উচিত
তোমার।’ নাজির বেগের দিকে চাইল রানা। উঠে বসেছে সে। গলার ওপর
হাত বুলাচ্ছে।
‘মাফ চাওয়া-চাওয়ি পরেও হতে পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করুন ও
এখানে কেন, আর আরীফের কি হয়েছে।’
রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা মিশ্রী খানকে। কি মনে করে
সামলে নিল।
‘আরীফ কোথায়, নাজির?’
বহু কষ্টে কথা বলল নাজির বেগ। থেমে থেমে ঢোক গিলে গিলে। সব
শুনে সমাধি-পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেল রানা।
ওকে আর আলতাফকে একটু এগিয়ে দিতে গিয়েছিল আরীফ, কিন্তু
ডানধারের গলিটা পেরিয়েই সামনে পড়ে সাত-আটজন সৈন্য। আরীফ
ওদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে পথ মুক্ত করবার চেষ্টা করতে গিয়েছিল-
মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ওর বুক। আলতাফ সব ক’জন
সৈন্যকে হত্যা করে আরীফের দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে চলে গেছে
সোমনাথের মন্দিরের দিকে। ও এসেছে খবর দিতে। বাঁচবে না আরীফ।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই মারা গেছে।
তেরো
খেত-খামার ডিঙিয়ে চলছে ওরা তিনজন সোমনাথের মন্দিরের দিকে। রাস্তা
থেকে বেশ খানিকটা তফাতে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগোচ্ছে
‘ওরা। পিচ্ছিল ভেজা মাটির ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে পতন থেকে বাঁচবার
জন্যেই বেশি মনোযোগ ব্যয় হচ্ছে। মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে এখন।
হঠাৎ একটা মাটির তৈরি পোড়ো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মিশ্রী খান।
কথা বলে উঠল সে এতক্ষণ পর।
‘আর পারছি না, ওস্তাদ। একটু বিশ্রাম না নিলে নির্ঘাত মারা পড়ব।
.......
৮৮ মাসুদ রানা-৬
এই ঘরের মধ্যে মিনিট কয়েক বিশ্রাম নিয়ে নিলে কেমন হয়? বেশিক্ষণ না,
এই একটা সিগারেট খেতে যতক্ষণ লাগে।’
অবাক হলো রানা। এত সহজে কাহিল হবার মানুষ তো মিশ্রী খান
নয়। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়ে গেল রানা। সে নিজেও অত্যন্ত ক্লান্তি
বোধ করছে।
‘ঠিক আছে, মিশ্রী। চলো, ঢুকে পড়ি।’
ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন ছোট্ট ঘরটার মধ্যে। ফসল পাকলে মাঠ
পাহারা দেয় কৃষকরা এই ঘরে শুয়ে-বসে। একটা বাঁশের মাদুর পাতা আছে
ঘরের এক কোণে। মাদুরে বসে পড়ল রানা। চোখ তুলেই অবাক হয়ে গেল
সে। সারা ঘরে দেয়াল ধরে ধরে কি যেন পরীক্ষা করছে মিশ্রী খান।
‘কি হে, কি করছ? এই কি বিশ্রাম নেয়ার নমুনা?’
‘না, ওস্তাদ। বিশ্রাম নিতে আসলে আসিনি। এই ঘরের মধ্যে ঢুকবার
জন্যে ওই ছুতো ধরেছিলাম। আসলে আমি আপনাকে তিনটে অদ্ভুত জিনিস
দেখাতে চাই।’
‘অদ্ভুত জিনিস! কি অদ্ভুত জিনিস দেখাবে তুমি আমাকে?’
‘একটু ধৈর্য ধরুন, ওস্তাদ। আপনার সময় আমি শুধু শুধু নষ্ট করব না।
মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।’
রানা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু মিশ্রী খানের ওপর থেকে ওর আস্থা
টলল না একবিন্দুও। বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু বেশি দেরি করিয়ে দিয়ো না
আবার।’
‘দেরি হবে না। জানালা নেই এ ঘরে একটাও। নির্বিঘেড়ব আলো জ্বালা
যাবে। কিন্তু তাও আগে বাইরে থেকে একবার দেখা দরকার আলো দেখা
যাচ্ছে কিনা।’
‘আমি বাইরে গিয়ে দেখছি,’ বলল নাজির বেগ।
‘না না। আপনি খোঁড়া মানুষ, বসুন। আমি টর্চ জ্বালাচ্ছি, ওস্তাদ বাইরে
থেকে ঘরটা একপাক ঘুরে দেখে আসবেন?’ বলল মিশ্রী খান।
রানা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাইরে। মিশ্রী খানের ব্যবহারটা রহস্যজনক
মনে হচ্ছে। মতলব কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কি দেখাতে চায় সে ওকে?
বাইরে দিয়ে একপাক ঘুরে ফিরে গেল রানা ঘরের মধ্যে।
‘এক বিন্দু আলোও যাচ্ছে না বাইরে।’
‘বেশ,’ কাঁধ থেকে ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখল মিশ্রী খান। কিন্তু
বসল না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। বোধহয় মনে মনে গুছিয়ে
নিল কথাগুলো।
একবার ঘড়ির দিকে চেয়ে মিশ্রীর দিকে চাইল রানা আবার। ‘কি
দেখাবে বলে আমাকে, মিশ্রী?’ তাড়া দিল রানা।
‘ঠিক। তিনটে জিনিস।’ পকেট থেকে ম্যাচ বাক্সের সমান একটা ছোট্ট
দুর্গম দুর্গ ৮৯
কালো বাক্স মত কি যেন বের করল মিশ্রী খান। বলল, ‘প্রম এইটে দেখুন,
ওস্তাদ।’
‘কি ওটা?’ জিজ্ঞেস করল বিস্মিত রানা।
‘ক্লকওয়ার্ক ফিউজ।’ পেঁচিয়ে বাক্সটার পেছন দিকটা খুলতে আরম্ভ
করল মিশ্রী খান। ‘বিশ্রী জিনিস। কিন্তু টিএনটি-র জন্যে অত্যন্ত দরকারী।’
বাক্সটা খোলা হয়ে গেছে ততক্ষণে। টর্চের আলোর সামনে ধরল সেটা।
‘কিন্তু এটা দিয়ে আর কোন কাজ হবে না। ঘড়ি ঠিকই আছে, কিন্তু কন্ট্যাক্ট
আর্ম বাঁকিয়ে তুলে দেয়া হয়েছে ওপরে। টিক্ টিক্ বাজতে থাকবে ঠিকই,
কিন্তু ম্যাচ বাতিও জ্বলবে না এটা দিয়ে।’
‘আশ্চর্য! কিন্তু কিভাবে...’
‘দুই নম্বর জিনিস,’ মিশ্রী খান যেন রানার কথাটা শুনতেই পায়নি
এমনভাবে নিজের কথাই বকে যেতে থাকল। ডিটোনেটার বক্স খুলল সে।
ফেল্ট আর তুলোর ওপর থেকে আলতো করে দুই আঙুলে তুলল একটা
ফিউজ। এটাও পরীক্ষা করল টর্চের আলোয়। তারপর সোজাসুজি রানার
দিকে চেয়ে বলল, ‘মারকারির ফাল্মিনেট, ওস্তাদ। মাত্র সেভেন্টি সেভেন
গ্রেন, কিন্তু কারও আঙুল ক’টা উড়িয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। খুবই নাজুক
জিনিস। সামান্য একটু টোকা লেগেছে কি ফাঁৎ করে জ্বলে উঠবে।’ মাটিতে
ফেলে দিল ওটাকে সে, তারপর বুটসুদ্ধ একটা পা তুলে জোরে ফেলল ওটার
ওপর। নিজের অজান্তেই চোখ বুজল রানা আধ সেকেণ্ডের জন্যে। কিন্তু
কোনও বিস্ফোরণ হলো না।
‘এটাও ঠিক কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না, তাই না, ওস্তাদ?’
এতক্ষণে একটা বক সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল মিশ্রী খান। আগুন
ধরিয়ে কিছুক্ষণ টানল চুপচাপ। রানার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে
আসছে এবার।
‘তৃতীয় আরেকটা কি দেখাতে চেয়েছিলে?’ শান্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল
রানা।
‘হ্যাঁ। আরেকটা জিনিস দেখাব আপনাকে। আমি আপনাকে একটা
বিশ্বাসঘাতক, নীচ, বিষাক্ত, দুই-মুখো সাপ দেখাব।’ কথাটা বলতে গিয়ে
চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল মিশ্রী খানের কণ্ঠে। বিস্মিত রানা দেখল চক্ চক্
করছে মিশ্রী খানের হাতে ওর সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা। লোলুপ দৃষ্টিতে
চেয়ে আছে সেটা নাজির বেগের বুকের দিকে। ‘জামাটা খুলে ফেলো, নাজির
বেগ।’
‘কি করছ, মিশ্রী? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার?’ এগিয়ে
যাচ্ছিল রানা। থেমে গেল মিশ্রী খানের ইঙ্গিতে। বলল, ‘কি গোলমাল শুরু
করলে তুমি?’
‘গোলমাল অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, ওস্তাদ। রাজগড়ের কাছে
.
৯০ মাসুদ রানা-৬
গুহার মধ্যে আমরা ধরা পড়লাম কি করে? তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ব−াড হাউণ্ডের
বাপ এলেও তো গন্ধ শুঁকে আমাদের বের করতে পারত না। যদি ব−াড
হাউণ্ডই ওদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসবে, তাহলে সেগুলো গেল কোথায়-
আমরা বেরিয়ে তো ব−াড হাউণ্ডের ছায়াও দেখতে পাইনি? চিন্তা করে দেখুন,
ওস্তাদ, আমাদের ঘুমন্ত অবস্থায় কে ছিল গার্ড? নাজির বেগ। ওই নেড়ি
কুত্তার বাচ্চাই পথ চিনিয়ে এনেছিল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়ের দলকে।
কি, বুঝতে পারছেন, ওস্তাদ? কাপড় খুলে ফেলো। তিন সেকেণ্ড সময়
দিলাম, নইলে গুলি করব কব্জিতে।’
মিশ্রী খানকে নিরস্ত করবার জন্যে এগোতে যাচ্ছিল রানা। হঠাৎ চোখ
পড়ল ওর নাজির বেগের ওপর। শ্বাপদের মত জ্বলছে তার চোখ জোড়া।
দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। বন্য একটা হিংস্রতা ফুটে উঠেছে তার মিশকালো
মুখে। পরমুহূর্তেই বিকৃত হয়ে গেল ওর মুখটা। ‘দুপ্’ করে একটা মৃদু শব্দ
তুলে ওর বাম হাতের কব্জিতে প্রবেশ করল একটা পয়েন্ট থ্রী-টু ক্যালিবারের
বুলেট। দুই চোখে ওর অবিশ্বাস।
‘আরও তিন সেকেণ্ড সময় দিলাম। এবারে যাবে ডান হাতের কব্জি।’
স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল মিশ্রী খান। পিস্তলটা তেমনি লোলুপ
দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। দ্রুত খুলে ফেলল নাজির বেগ
গায়ের জামা। ওর চোখ জোড়া যেন বিষোম্ফগার করছে মিশ্রীর চোখের দিকে
চেয়ে।
‘ঘুরে দাঁড়াও।’
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল নাজির বেগ।
‘বাহ্! চমৎকার! দেখুন, ওস্তাদ। চাবুক মেরে মেরে এই লোকটারই
পিঠের চামড়া তুলে নিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। কি বীভৎস সাদা সাদা দাগ
পড়ে গেছে- চাওয়া যায় না! এই না ছিল ওর বানানো গল্প? এরই জন্যে না
সুযোগ পেলেই সে পাগলের মত খুন করে বেড়াচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের? দাউ
দাউ করে জ্বলছে ওর মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন?’
রানার মাথার মধ্যে সব গোলমাল পাকিয়ে গেল। চক্চকে কালো মসৃণ
পিঠে একটা দাগও নেই।
স্প্যান্টের পা’টা ওপর দিকে তোল, নিমকহারাম। তিন সেকেণ্ড সময়
দিলাম।’
কথা মত কাজ করল নাজির বেগ। প্যান্টের পা গুটিয়ে তুলে ফেলল
হাঁটুর ওপর।
‘আরও একটু। হ্যাঁ। চমৎকার! এবার ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলো। জলদি!’
কয়েক সেকেণ্ড পার হয়ে গেল। উল−সিত কণ্ঠে বলল মিশ্রী খান, ‘আহা-হা।
কি সাদঘাতিক জখম, তাই না, ওস্তাদ?’
কোনও রকম ক্ষতচিহ্ন নেই নাজিরের পায়ে।
দুর্গম দুর্গ ৯১
‘বুঝলাম, মিশ্রী খান। এবার বুঝতে পেরেছি।’ চিন্তিত রানা বলল
মৃদুস্বরে। ‘কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন...’
‘সহজ ব্যাপার। ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত আর হারামী। আÍসম্মান-জ্ঞান সম্পনড়ব
কোনও জাত-গোক্ষুর সাপও ওর আধমাইলের মধ্যে আসবে না। এই জখমপাে
য়র দোহাই দিয়ে পড়ে থাকল ভাতিজা একটা গুহার মধ্যে আমরা যখন
প্রম গুলি চালালাম ভারতীয় সৈন্যদের ওপর। আমাদের অনুপস্থিতির
সুযোগে চিঠি লিখে ফেলল। আমাদের সাথে চলবার সময় খোঁড়াতে
খোঁড়াতে পিছিয়ে পড়ে চিঠিটা ফেলে দিল চোখে পড়বার মত কোনও
জায়গায়। তাতে খুব সম্ভব লেখা ছিল আমরা অমুক সময়ের দিকে অমুক
জায়গায় আসছি, আমাদের অভ্যর্থনার যেন সুবন্দোবস্ত থাকে। অভ্যর্থনা
কমিটি তৈরিই ছিল- আমরা গুহা-মুখ থেকে বেরিয়ে প্রায় ধরা পড়তে
যাচ্ছিলাম, খেয়াল নেই? ওদের ট্রাক নিয়েই ঢুকেছি আমরা শহরে। তখনই
প্রম সন্দেহটা হলো আমার। বুঝলাম, গুহা মুখে ওকে ফেলে রেখে আসবার
জন্যে যে করুণ মিনতি জানিয়েছিল ভাতিজা, সেটা আসলে পেছনের
সৈন্যদের ঠিক গুহাটা চিনিয়ে দেবার জন্যেই- মহান আÍত্যাগ নয়। তাই
উপত্যকায় বেরিয়েই সৈন্য দেখে মাথার পেছনে টোকা মেরে অজ্ঞান করে
ফেলেছিলাম ওকে, যাতে নতুন কোনও বিপদ ঘটাতে না পারে।’
‘সব পরিষ্কার হয়ে আসছে আমার কাছে। কিন্তু আরও আগে আমাকে
জানানো উচিত ছিল তোমার। এভাবে চেপে গিয়ে...’
‘আমি বলতে চেষ্টা করেছি, ওস্তাদ, কিন্তু সুযোগ পাইনি। ও কিছুতেই
সঙ্গ ছাড়েনি। সব সময় সাথে লেগে ছিল আঠার মত। ছাতের ওপর তখন
বলতে যাচ্ছিলাম, অমনি গোলাগুলি আরম্ভ হয়ে গেল।’
‘এখন বুঝতে পারছি, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের
মত আমাদের ওপর বোমা ফেলতে আরম্ভ করেছিল কেন পে−নগুলো আজ
দুপুরে।’
‘হ্যাঁ। আয়না দেখিয়ে আমাদের পজিশন জানিয়েছিল ও এই দুর্গকে।
এবং সময় থাকতে নিজে সরে গিয়েছিল নিরাপদ দূরত্বে। তার আগেই সে
আরীফের ব্যাগ থেকে বের করে ক্লক ফিউজ, úো বার্নিং ফিউজ আর
ডিটোনেটার নষ্ট করে দিয়েছে ওর ঘুমন্ত অবস্থায়। শুধু দুঃখ, ভাতিজা শেষ
রক্ষা করতে পারল না।’
‘নিজেকে রক্ষা করতে পারল না, কিন্তু আরীফকে শেষ করে দিয়ে গেল,’
বলল রানা।
‘আমার মনে হয় আরীফ ঠিকই আছে। নিজে রয়ে গিয়ে আরীফকে ওই
পাঠিয়েছে আলতাফের সঙ্গে আহত পায়ের ছুতো দেখিয়ে। ওরা বেরিয়ে
যেতেই খবর দিয়েছে দুর্গের গেটে যেন সোমনাথের মন্দিরে ডজন খানেক
সৈন্য পাঠানো হয়, এবং যাবার সময় যেন গোটা কয়েক ফাঁকা আওয়াজ করে
.
৯২ মাসুদ রানা-৬
মেশিনগানের। আমাদের দু’জনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যেই আসলে ছাতে
উঠেছিল ও। ওর পকেট সার্চ করলেই সিগন্যাল টর্চ বেরিয়ে পড়বে আমার
যতদূর বিশ্বাস।’
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা টর্চ বের করে আনল রানা।
‘মৃত্যুর আগের মুহূর্তে কেমন লাগছে, নাজির বেগ? জানতে ইচ্ছে
করছে আমার। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ তোমাকে খুন করব আমি, এবং
এক্ষুণি। কিছু বলবার আছে তোমার?’
আহত হাতটা অন্য হাতে চেপে ধরে আছে নাজির বেগ। কোনও কথা
বলল না। তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠল ওর দৃষ্টিতে, তেমনি চেয়ে রইল সে মিশ্রীর
চোখে চোখে।
‘ভাতিজা বুঝেছে, কিছু বলে কোনও লাভ নেই। তাই চুপ করে আছে।
ওস্তাদ, আপনার মূল্যবান সময় আর নষ্ট করতে চাই না। কি বলেন? দোষী?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। সিগারেটটা মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে পিষে ফেলল
মিশ্রী খান। তারপর যতেড়বর সাথে পর পর দুটো গুলি করল নাজির বেগের
হƒৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। মৃতদেহটা মাটির ওপর আছড়ে পড়বার আগেই ব্যাগ
দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে টর্চ নিভিয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।
স্পারছি না, ক্যাপ্টেন আলতাফ, গিঁঠগুলো খুব শক্ত,’ হতাশ কণ্ঠে বলল
ইশরাত।
‘তাতে কি হয়েছে? ভেজা রশি দিয়ে বেঁধেছে তো, না কেটে খোলা
মুশকিল। দেখা যাক অন্য কোনও বুদ্ধি বের করা যায় কিনা।’ আশ্বস্ত করল
আলতাফ ইশরাতকে। দুই মিনিট আগে যে সে হাত-বাঁধা অবস্থাতেই
লোহার মত শক্ত আঙুল দিয়ে ইশরাতের হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে কয়েক
টানে, সে-কথা বেমালুম চেপে গেল আলতাফ।
ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলাল আলতাফ। একটা হারিকেন
জ্বলছে মিটমিট করে। মন্দিরের শান বাঁধানো মেঝেতে পড়ে আছে ওরা
দু’জন। নিজেদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে হাসি পেল আলতাফের। একই
দিনে দ্বিতীয়বার বন্দী হয়েছে ওরা। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এবারও বিনা
বাধায় আÍসমর্পণ করতে হয়েছে ওদের। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে
পৌঁছেচে ভারতীয় সৈন্য। অনায়াসে বন্দী করেছে ওদের। ক্যাপ্টেনের মুখেই
শুনেছে ওরা নাজির বেগের ভূমিকা। বিশ্বাস করেনি। কিন্তু অবিশ্বাসই বা
করবে কোন্ ভরসায়? সব ব্যাপার যে মিলে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কথা যদি
সত্য হয়, তাহলে এতক্ষণে রানা আর মিশ্রী খানও ধরা পড়ে গেছে। তবে কি
এখানেই সব আশা সব ভরসা শেষ? পরাজিত হলো ওরা? কথাটা কিছুতেই
স্বীকার করে নিতে পারল না সে মনে মনে।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঝট্ করে ফিরল সে ইশরাতের দিকে।
দুর্গম দুর্গ ৯৩
কাছেই জ্বলছে হারিকেনটা।
‘আরীফ!’ ডাকল সে মৃদুস্বরে।
‘বলুন।’ ইশরাত ফিরল ওর দিকে।
‘হাতে একটা কাপড় জড়িয়ে হারিকেনের কাঁচটা খুলে ফেলো। মেঝেতে
একটা টোকা দিয়ে ভেঙে ফেলো কাঁচটা। ওটা দিয়ে অনায়াসে কেটে দিতে
পারবে আমার হাতের বাঁধন।’
অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল
ইশরাত। এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যেও বুদ্ধি হারায়নি লোকটা। একটা না
একটা ফন্দী ফিকির বের করবার চেষ্টায় আছে। আশ্চর্য এই দলের প্রত্যেকটি
লোক!
মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল ইশরাত হারিকেনের কাছে। পা
দুটো এখনও বাঁধাই আছে ওর। হারিকেনের দিকে হাত বাড়িয়ে হঠাৎ কি
একটা শব্দ কানে যেতেই থমকে গেল ও। মাথাটা তুলে দেখল দরজার
শিকের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে এসেছে একটা রাইফেলের ব্যারেল। আবার
ব্যারেল দিয়ে খটাখট বাড়ি মারল অসহিষ্ণু প্রহরী শিকের ওপর।
‘আর এক ইঞ্চি হাত বাড়িয়েছ কি ছাতু করে দেব কব্জিটা।’
‘থাক, আরীফ, ফিরে এসো এখানে,’ বলল আলতাফ।
ফিরে এল ইশরাত। কিন্তু প্রহরীকে অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখা
গেল। রাইফেলটা বের করে নিল সে শিকের ফাঁক থেকে। একজোড়া বুটের
শব্দ দ্রুত চলে গেল ডান দিকে।
এমনি সময় একটা শব্দ কানে এল ওদের। গজ বিশেক দূরে যেন কেউ
কপাট বন্ধ করল একটা। এবার একাধিক পায়ের শব্দ শোনা গেল। দ্রুত
এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে। বোধহয় প্রহরী ইশরাতের হাত বাঁধন-মুক্ত
দেখে আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছে। চাবি ঘুরিয়ে ক্লিক করে তালা
খোলার শব্দ এল। বিচিত্র ক্যাঁচকুঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজা। দু’জন সৈন্য
এসে ঢুকেছে মন্দিরে। প্রমেই ইশরাতের চোখ পড়ল দু’জোড়া কাদা মাখা
ভেজা বুটের ওপর। পরমুহূর্তে ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর।
‘ছাগলের মত বেঁধে রেখেছে, ওস্তাদ! কোরবানির খাসী! ইয়া আল−া, দুই
ভাতিজারই অবস্থা কাহিল!’
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেল ইশরাত ও আলতাফ। কয়েক
সেকেণ্ড কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। ইশরাতই প্রম সামলে নিল।
‘ওই বিশ্রী গোঁফ-ওয়ালা লোকটা বেঁচে আছে তাহলে? আর কোনদিন
দেখা হবে বলে ভাবতে পারিনি।’
‘ঠিক বলেছ, আরীফ,’ বলল আলতাফ। ‘ব্যাপার কি, রানা? দিব্যি
বহাল তবিয়তেই আছ দেখছি!’
‘হ্যাঁ, আছি। এর জন্যে সবটুকু কৃতিত্ব মিশ্রী খানের সন্দেহপ্রবণ বিশ্রী
......
৯৪ মাসুদ রানা-৬
মনের। আমরা যখন নাজির বেগ বলতেই অজ্ঞান, ও তখন ভেতর ভেতর
প্যাঁচ কষছে।’
‘কোথায় নাজির বেগ?’ জিজ্ঞেস করল ইশরাত।
‘নাজির বেগ?’ জবাব দিল মিশ্রী খান। ‘ওকে রেখে এসেছি মাঠের মধ্যে
একটা ঘরে। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বেচারার।’
মনের আনন্দে বেসুরো শিস দিতে দিতে বাঁধন কাটতে থাকল সে একটা
ছুরি দিয়ে। রানা নিজেদের ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বলল ওদের এবং ওদের
সব কথাও শুনল মন দিয়ে। উঠে দাঁড়াল প্রকাণ্ডদেহী আলতাফ ব্রোহী।
হাতের কব্জি দুটো ঘষল অল্পক্ষণ, তারপর বলল, ‘শিসটা বড় বিশ্রী লাগছে
মিশ্রী খান। একে তো বেসুরো, তার ওপর অত্যন্ত তীক্ষè। বাইরে গার্ড...’
‘ওসব তোমার চিন্তা করতে হবে না, ভাতিজা। ওরা কল্পনাও করতে
পারেনি যে আমরা এসে উপস্থিত হব। মাত্র দু’জন দুর্বল চরিত্রের গার্ড
রেখেই নিশ্চিন্তে ফিরে গেছে দ্বারোকায়।’
‘তোমরা করাচিকে পেয়েছিলে, আলতাফ?’ রানা কাজের কথায় এল।
‘হ্যাঁ। খবর অত্যন্ত গরম। চমৎকার রিসেপশন। খোদ কমোডোর
জুলফিকার ছিলেন সেটের সামনে। উত্তেজনায় তোতলাচ্ছিলেন তিনি।
সারাদিন আমাদের সংবাদ না পেয়ে ভয়ঙ্কর উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে ওঁর।
জিজ্ঞেস করলেন আমাদের অবস্থা। বললাম, এখনও দুর্গে ঢুকতে পারিনি,
তবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ঢুকতে পারব আশা করছি।’ দম নেয়ার জন্যে
থামল আলতাফ।
‘তারপর?’
‘উনি বললেন আমাদের জাহাজ আজ রাত বারোটায় আμমণ করবে
দ্বারোকা দুর্গ। তার আগেই শেষ করতে হবে দুর্গের চারটে কামান। নইলে
মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে পাকিস্তানের। বললাম, কিছু একটা তো এখনও
গোলমাল হয়ে যেতে পারে। উনি বললেন, মেজর মাসুদ রানা আর ক্যাপ্টেন
মিশ্রী খান থাকতে উনি সেসব নিয়ে ভয় পান না। বারোটার আগে সব কাজ
শেষ করা চাই।’
‘সবাই রেডি?’ রানা জিজ্ঞেস করল। ‘আমাদের সরে পড়তে হবে এখান
থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নাজির বেগের সিগন্যাল না পেয়ে ওরা বুঝতে
পারবে, হয় নাজির আমাদের খুঁজে পায়নি, নয় ওকে শেষ করে দিয়েছি
আমরা। কিন্তু যে-কোনও অবস্থাতেই আমরা যে সোমনাথের মন্দিরের
দিকেই এসেছি তাতে ওদের নিশ্চয়ই কোনও সন্দেহ নেই। এতক্ষণে অর্ধেক
পথ চলে এসেছে ওরা। দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যে করে হোক
আজই রাত বারোটার মধ্যে কাজ সারতে হবে আমাদের। আজই দ্বারোকায়
আমাদের শেষ রাত। পা চালাও সবাই।’
দুর্গম দুর্গ ৯৫
চোদ্দ
রাত আটটা। সাড়ে-আটটা থেকে কারফিউ। দ্রুত তৈরি হয়ে নিচ্ছে
সবাই।
ইশরাত একটা লম্বা রশিতে এক হাত পর পর গিঁঠ দিয়ে ফেলেছে,
এখন একটা বাঁশের কঞ্চির মাথায় বাঁকানো লোহার হুক বাঁধছে শক্ত করে।
কঞ্চিটা সোমনাথের মন্দির থেকে ফিরবার পথে ভেঙে এনেছে ওরা। তিনটে
ট্রাক ভর্তি সোলজার দেখে একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছিল ওরা।
ওখান থেকেই কঞ্চিটা জোগাড় করেছে ইশরাত।
ট্রাকের ভারি বারো ভোল্টের ব্যাটারি নিয়ে এসেছে ওরা ছাতের ওপর
তিরপল ঢেকে। ব্যাটারিটা চুরি করে এনেছে মিশ্রী খান। একটা গুদাম ঘরের
সামনে দাঁড়ানো সাতটনের মাল-টানা ট্রাক থেকে। úো বার্নিং ফিউজ, ক্লকওয়াক
র্
ফিউজ, সব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে এখন একমাত্র ভরসা ব্যাটারি।
দুর্গ প্রাচীরের উত্তর দিকে চলে এসেছে ওরা। অফিসারস্ কোয়ার্টারের
ছাতের ওপর ওরা এখন। দুর্গের সামনে সমুদ্রের দিকে অন্ধকার জেটি দেখা
যাচ্ছে আবছা। বাড়িতে একটি প্রাণীও নেই। দুর্গের মধ্যেও বিশেষ লোকজন
আছে বলে মনে হলো না রানার। কয়েকশো সৈন্য অফিসারদের অধীনে ভাগ
ভাগ হয়ে সারা শহর চষে ফেলছে এখন রানাদের খোঁজে। একদল আবার
গেছে সোমনাথের মন্দিরের দিকে।
‘চমৎকার জায়গা বের করেছ, আরীফ। গাঁজা খেয়েও ওরা কল্পনা
করতে পারবে না যে ওদের অফিসারস্ কোয়ার্টারের ছাতে আমরা এখন
নিশ্চিন্তে বৃষ্টিতে ভিজছি,’ বলল মিশ্রী খান।
‘হ্যাঁ। কেউ কসম খেয়ে বললেও ওরা বিশ্বাস করবে না,’ বলল
আলতাফ।
ছাতের কিনারে দাঁড়িয়ে দুর্গের দিকে চেয়ে দেখল রানা। মাত্র চলি−শ ফুট
দূরে তিরিশ ফুট উঁচুতে দেখা যাচ্ছে চারটে প্রকাণ্ড কামানের মুখ। পাহাড়ী
এলাকায় তৈরি করা হয়েছে এই দুর্গ। পাহাড়ের একটা গুহামুখে বসানো
হয়েছে কামানগুলো। কোনও দিক থেকেই এগুলো ধ্বংস করবার উপায়
নেই- জাহাজ তো ভিড়তেই পারবে না কাছে, পে−ন থেকে বম্বিং করলে হয়
পাহাড়ের ওপর পড়বে, নয় সাগরে। রীতিমত মাথা খাটিয়ে দুর্ভেদ্য করা
হয়েছে এই দুর্গকে।
চারপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে ফিরে এল ওরা ঘরের ভেতর।
‘চলো, মিশ্রী। আজকের নাটকে তুমিই নায়ক। সময় হয়ে এসেছে
আমাদের।’
....................
৯৬ মাসুদ রানা-৬
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রানা আর মিশ্রী খান পৌঁছে গেল ইশরাতের নির্দেশিত
কাফেতে। কাফের চাইতে ‘বারে’র আর্কষণই গ্রাহকদের কাছে বেশি।
কয়েকজন বুঁদ হয়ে বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, সামনে টেবিলের ওপর
আধ-খাওয়া গেলাস।
কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগল কাফেটা রানার কাছে। আসনড়ব কারফিউ এর
কারণ হতে পারে। বসে পড়ল ওরা কোণের টেবিলে। বেয়ারা এসে
দাঁড়াতেই দুটো ব্র্যাণ্ডি আনতে বলল রানা।
কাফের বাঙালী মালিক রুচিসম্পনড়ব লোক মনে হলো। একটা
রেডিয়োগ্রামে ওস্তাদ আবদুল করিম খানের থারটি থ্রী স্পীড লং-পে− রেকর্ড
বাজছে। ঠুমরী। সময়টা বর্ষণ মুখর সেপ্টেম্বর মাস হলেও ‘ফাগুয়া ব্রিজ
দেখন কো চালোরী’ একটা অপূর্ব আবেশ ছড়িয়েছে অনতিপ্রশস্ত কাফের
মদির অভ্যন্তরে। ইশরাতের কথা মনে পড়ে গেল রানার। রওনা হবার
আগের মুহূর্তে আড়ালে ডেকে নিয়ে হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরেছে সে রানার,
ফিসফিস করে বলেছে, ‘নিজের প্রতি লক্ষ রেখো, রানা। কথা দাও, কোনও
রকম অনাবশ্যক ঝুঁকি নেবে না!’
কথাগুলো বারবার ঘুরে ফিরে আসছে ওর মনের মধ্যে। ওদিকে
ফাগুনের গান ছেড়ে ভৈরবী ধরেছেন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ। মেয়েলী
গলায় গাইছেন ‘যমুনা কে তীর...।’ রানা ভাবছে এটা কি তিন-তিনবার ওর
প্রাণ রক্ষা করার জন্যে ইশরাতের কৃতজ্ঞতা? গালের ওপর ওই দু’ফোঁটা
পানি কি বৃষ্টির পানি?’
এক মিনিট, দুই মিনিট করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আটটা পঁচিশ।
পেটের মধ্যে পাকস্থলীতে অদ্ভুত এক ধরনের বিজাতীয় অনুভূতি হলো
রানার। ইশরাতের চিন্তা আপনা-আপনি সরে গেল ওর মন থেকে। পর পর
দুই আউন্স ব্র্যাণ্ডি খেয়ে অনেকখানি চাঙ্গা বোধ করছে সে এখন। সেই
তিনজন সামরিক পোশাক পরা লোক তেমনি বসেবসে গল্প করছে আর কফি
খাচ্ছে। খুব সম্ভব দুর্গে কেরানিগিরি জাতীয় কোনও কাজ করে। ইশরাত
বলেছে ঝড় হোক বৃষ্টি হোক রোজ সন্ধ্যার পর এখানে এসে বসে আডিা
মারা ওদের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাক্ষিণাত্যের লোক ওরা।
‘আর কতক্ষণ, ওস্তাদ?’ অধৈর্য হয়ে উঠছে মিশ্রী খান।
স্পাঁচ মিনিট,’ আশ্বাস দিল রানা।
কাফেটা বন্ধ করবার জোগাড় করেছে দোকানদার। জানালাগুলো
লাগিয়ে দিয়ে কয়েকটা বাতি নিভিয়ে খরিদ্দারদের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে
যে এবার গাত্রোত্থান করতে হবে। একজন দু’জন করে সবাই বেরিয়ে গেল,
কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে, কেউ রেইন-কোট গায়ে। উত্তেজনায় মিশ্রী খানের
কপালের একটা শিরা ফুলে উঠেছে। হাত দুটো কাঁপছে অল্প অল্প- চোখ
দুর্গম দুর্গ ৯৭
দুটো যেন বসে গেছে আরও খানিকটা। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যে
নির্ধারিত হয়ে যাবে ওদের ভাগ্য। এই ক’দিনের এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব
কিছুর সার্থকতা নির্ভর করছে আগামী দুই মিনিটের মধ্যে যে কাজটা ওরা
করতে যাচ্ছে তার সাফল্যের ওপর। রানা ভাবল আজ রাত মিশ্রী খানের
রাত। কিন্তু সময় কাটছে না কিছুতেই।
আটটা বেজে আটাশ মিনিট হতেই উঠে দাঁড়াল রানা। মিশ্রী খান বসে
রইল। দরজার কাছে গিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখল রানা। আরও দেখল, রাস্তার
ওপর কাছে-কিনারে একটি জন-প্রাণীও নেই। পকেট হাতড়ে কি যেন খুঁজছে
রানা। ভ্রƒ-কুঁচকে গেছে। কাউন্টারের দিকে না এগিয়ে আবার টেবিলের
দিকে যাচ্ছে সে। চোখে পড়ল, উঠে দাঁড়িয়েছে মিশ্রী খানও। হঠাৎ থেমে
দাঁড়াল রানা সামরিক পোশাক পরা লোকগুলোর টেবিলের তিনফুট তফাতে।
হাতটা বেরিয়ে এল পকেট থেকে।
‘একটুও নড়াচড়া করবে না!’ পরিষ্কার হিন্দীতে বলল রানা। ওর ডান
হাতে শোভা যাচ্ছে পয়েন্ট থ্রী-টু ক্যালিবারের ওয়ালথার পি. পি. কে। ওস্তাদ
আবদুল করিম খান তখন গাইছেন ঝিঁঝিট ঠুমরী। ‘পিয়া বিনে ন্যহি আওত
চ্যয়ন’-এর পরিবেশ পাল্টে গেল এক মুহূর্তে। গমগম করে উঠল আবার
রানার গম্ভীর কণ্ঠস্বর। ‘একচুল নড়লে স্রেফ খুন করে ফেলব! আমরা
বেপরোয়া লোক!’
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল লোকগুলো কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ একজন নড়ে
উঠল ওদের মধ্যে, ডান কাঁধটা ওপর দিকে উঠল, পরমুহূর্তেই একটা
আর্তধ্বনি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ডান বাহুতে এসে প্রবেশ করল মিশ্রী
খানের সাইলেন্সড্ পিস্তল থেকে খানিকটা তপ্ত সীসা। বাম হাতে চেপে ধরল
ডান বাহু- রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেল আঙুলগুলো।
‘অতএব, সাবধান!’ গোঁফে তা দিল মিশ্রী খান।
কাফের ম্যানেজারের দিকে ফিরল রানা। পাতলা লম্বা লোক, চিবুকে
চুটকি দাড়ি। গোঁফ জোড়া ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে- ঠোঁটের ওপর
মাঝামাঝি জায়গা খানিকটা কামানো। মাথায় বাবরি। চোখে সুরমা। অষ্টম
শতাব্দীর বোগদাদী ফল বিμেতার মত চেহারা। পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস
করল রানা, ‘এদের মধ্যে কেউ বাঙালী আছে?’
‘না। হ্যাতারা বাঙ্গালোরের লোক- হিন্দীই জানে ন সই মতন।’ সামলে
নিয়েছে সে। কথার টানে রানা বুঝল খাস নোয়াখালীর লোক।
‘বেশ। এদের কোথায় লুকানো যায় বলতে পারবেন?’
‘ঠাইট মারি লাইব আঁরে, হুজুর।’
‘না, মারবে না।’ পিস্তল ধরল রানা ওর পাঁজরের সাথে ঠেসে। একবার
চোখ টিপে বলল, ‘ওদের সাথে আপনাকেও বেঁধে রেখে যাব। ভয় নেই।
তাহলে হবে তো?’
.............................
৯৮ মাসুদ রানা-৬
‘সারব। কাউন্টারের ফিছনে হিঁয়ান দি আংগোর গুদাম গর। দরোজা
খুলি হিঁয়ানেই আংগোরে বান্দি রাখতো ফারেন।’ চোখে মুখে স্পষ্ট ভীতির
চিহ্ন ফুটিয়ে তুলল ম্যানেজার। বুঝে ফেলেছে সে ব্যাপারটা। দু’জন বেয়ারা
এসে দাঁড়িয়েছিল। হাতের ইশারায় কেটে পড়তে বলল ওদের রানা। মুহূর্তে
অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা কিচেনের দরজা দিয়ে। ফিরে এল রানা সামরিক
পোশাক পরা লোকগুলোর টেবিলে।
‘জামা কাপড় সব খুলে ফেলো!’ আদেশ দিল রানা।
স্পাকিস্তানী কুত্তা!’ গাল দিল গুলি খাওয়া লোকটা।
‘আধ মিনিট সময় দিলাম, শার্ট-প্যান্ট খুলে ফেল।’ একই সুরে বলল
রানা।
আবার অকথ্য গালি দিল লোকটা। আদেশ পালনের ভাব প্রকাশ পেল
না ওদের কারও মধ্যে। ‘দুপ’ করে আরেকটা শব্দ হলো। একজনের হাতের
তালু ফুটো করে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। তাজ্জব হয়ে হাতের ফুটোর
দিকে চেয়ে রইল লোকটা, ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ।
‘ইউনিফরমটা আর নষ্ট করলাম না। ওগুলোই আমাদের দরকার কিনা!’
যেন স্বাভাবিক আলাপ-আলোচনা করছে এমনি ভাবে বলল মিশ্রী খান। পিস্ত
লের মুখটা এবার কপাল বরাবর উঠল। ‘কিন্তু এবার দুই চোখের ঠিক
মাঝখানটায় তাক করব। তখন কাপড় খুলে নিতে আমাদের খুব বেশি কষ্ট
পেতে হবে না।’
কথা শেষ হবার আগেই জামা কাপড় খুলতে আরম্ভ করেছে তিনজন।
রাগে অপমানে আর ব্যথায় ফোঁপাচ্ছে আহত দু’জন। বেঁটে একজন লোকের
কাঁধের ওপর একটা চাপড় লাগাল মিশ্রী খান।
‘তোমার খুলতে হবে না, ভাতিজা। ওই জামা আমার দশ বছরের
ছেলের গায়েও লাগবে না।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামনের সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে এল ওরা নির্জন
রাস্তায় ভারতীয় সামরিক পোশাক পরে। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। একটি জনপ্রাণীর
চিহ্ন দেখা গেল না লম্বা রাস্তায়। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলল
ওরা বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে। পঞ্চাশ গজ গিয়ে হাতের ডাইনে মোড় নিল ওরা।
ইশরাতের আস্তানার পাশ দিয়ে আসবার সময় কয়েক সেকেণ্ড থামল কেবল।
দরজা দিয়ে একটা ফর্সা হাত বেরিয়ে এল। দুটো মিলিটারি ব্যাগের ভারে
নুয়ে আছে হাতটা। ব্যাগের মধ্যে আছে রশি, ফিউজ আর অত্যন্ত শক্তিশালী
এক্সপে−াসিভ। ব্যাগদুটো কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা আর মিশ্রী খান। হুক
লাগানো কঞ্চিটা এগিয়ে দিল ইশরাত এবার, মৃদু চাপ দিল রানার হাতে।
চাপা গলায় বলল, ‘সব ঠিক আছে। ক্যাপ্টেন আলতাফ চলে গেছে ওর
পজিশনে। আমি এক্ষুণি ফিরে যাচ্ছি অফিসারস্ কোয়ার্টারে। সব কিছু
রেডি। খোদা হাফেজ।’
দুর্গম দুর্গ ৯৯
এগিয়ে গেল ওরা রাস্তা ধরে দুর্গের দিকে। একটা বন্ধ হেয়ার-কাটিং
সেলুনের বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়াল। ইঙ্গিত পেলেই রওনা হবে। তিরিশ
গজ দূরে দেখা যাচ্ছে দুর্গ তোরণে দাঁড়ানো দু’জন সশস্ত্র প্রহরীকে।
অ্যাটেনশন্ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
দেড় মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। শহরের মাঝামাঝি
এলাকায় একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। চারশো গজও হবে না ওখান
থেকে। সাথে সাথেই শোনা গেল একটা মেশিনগানের গর্জন। আবার পরপর
কয়েকটা বিস্ফোরণের শব্দ এল। হ্যাণ্ড গ্রেনেড আর মিশ্রী খানের তৈরি
গোটা কতক বোমা নিয়ে মেতে গেছে আলতাফ নকল যুদ্ধে।
তীব্র একটা সার্চ লাইটের আলো জ্বলে উঠল দুর্গ তোরণের খিলানে।
সমস্তটা রাস্তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল এক মুহূর্তে।
আরও আধ মিনিট অপেক্ষা করে লাফিয়ে রাস্তায় পড়েই পাগলের মত
ছুটল ওরা দুর্গের দিকে। হুক লাগানো কঞ্চিটা বগলে চেপে রেখেছে রানা।
কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল ওরা গেটের কাছে। কয়েক পা এগিয়ে এল গার্ড
দু’জন ব্যাপার কি জানার জন্যে।
‘ছোটো সবাই আলিবাবা স্ট্রীটে!’ চিৎকার করে বলল রানা। স্পাকিস্তানী
কুত্তাগুলো আটকা পড়েছে একটা বাড়িতে! মর্টার নিতে ফিরে এসেছি
আমরা। জল্দি ছোটো তোমরা। জল্দি!’
‘কিন্তু গেটে থাকবে কে?’ হতবুদ্ধি গার্ডদের একজনের চেতনা ফিরল।
কিন্তু বিন্দুমাত্র সন্দেহ করল না সে রানাদের। বিস্ফোরণের শব্দ, অঝোর
বৃষ্টি, সামরিক পোশাকে ওরা দু’জন- সন্দেহের কথা মনে আসাটাই
অস্বাভাবিক। বলল, ‘গেট ছেড়ে যাব কি করে?’
‘বুদ্ধু কাহিঁকে!’ ধমকে উঠল রানা। ‘এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষে
লাভ কি? হারামজাদারা এখন আলিবাবা স্ট্রীটে। ওদের ধ্বংস করতে হবে!
ভগবানের দোহাই লাগে, ছোটো, এবারও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় আমাদের
সব ক’জনের হাতে হাতকড়া পড়বে।’
কথা শেষ হবার আগেই ছুটল গার্ড দু’জন আলোকিত রাস্তা ধরে। আধ
মিনিটের মধ্যেই দ্বারোকা দুর্গের মাঝখানে চলে এল রানা ও মিশ্রী খান।
চারদিকে হট্টগোল বেধে গেছে দুর্গের মধ্যে। কেউ চিৎকার করে হুকুম
করছে, কেউ হুইসল্ বাজাচ্ছে, কেউ বা সগর্জনে ট্রাকের এঞ্জিনে স্টার্ট দিচ্ছে,
কয়েকজন সার্জেন্ট ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক ব্যস্ত ভাবে। রানা আর
মিশ্রী খানও দৌড়াচ্ছে সমানে। খুব যে তাড়াহুড়ো আছে ওদের তা নয়, কিন্তু
দুর্গের অভ্যন্তরে আর সবার গতিবিধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে
সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, তাই ওদেরকে দৌড়াতে হচ্ছে ব্যস্ত-সমস্ত
হয়ে।
.........................
১০০ মাসুদ রানা-৬
হাতের বামে দুটো ব্যারাক পড়ল, ডাইনে পাওয়ার হাউস। তারপর
একটা অস্ত্রের গুদাম, তারপর মস্ত ওয়াটার ট্যাঙ্ক। সিনিয়র অফিসারস্
কোয়ার্টারের সামনে চলে এল ওরা। দুর্গের সবকিছু রানার মুখস্থ, প্রত্যেকটা
জিনিসই চিনতে পারছে সে অক্লেশে। ব্রিগেডিয়ারের কোয়ার্টারের সামনে
থামল রানা। মনস্থির করে নিয়েই হুড়মুড় করে উঠে এল চার-পাঁচটা সিঁড়ির
ধাপ। জোর-ধাক্কায় দু’পাট দরজা খুলে গেল। কী-বোর্ডের সামনে দাঁড়ানো
প্রহরী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওদের দিকে। হাতের ব্রেনগানটা সোজা
রানার বুকের দিকে ধরা।
‘ওটার মুখটা অন্য দিকে সরাও, উল−ুক!’ গর্জে উঠল রানা। ‘ব্রিগেডিয়ার
কোথায়? জল্দি বল, গর্দভ! ভয়ানক ব্যাপার!’
‘বিগ্...বিগ্...ব্রিগেডিয়ার নেই। ও...ও...ও...ওরা সবাই,
দুঃ...দুঃ...দু’মিনিট আগে বে...ব্বে...ব্বে...’
‘কি বললে? বেরিয়ে গেছে?’ চোখ পাকিয়ে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করল
রানা।
‘আগ্...আগ্ আজ্ঞে, হ্যাঁ। সঙ্গে আর স...স...’
চট্ করে প্রহরীর ঘাড়ের ওপর দিয়ে ওর পেছন দিকে চাইল রানা।
তারপর বলল, ‘তাহলে পেছনে কে?’
কৌশলটা বুঝতে পারল না তোতলা প্রহরী। পেছন ফিরে চাইল।
পরমুহূর্তেই ঢলে পড়ল কানের পেছনে পিস্তলের বাঁটের প্রচণ্ড একটা আঘাত
খেয়ে। কী-বোর্ডে ঝোলানো সব ক’টা চাবি খুলে নিয়ে পকেটে পুরল রানা।
হাত-পা-মুখ বেঁধে টেনে এনে সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে রাখল ওরা প্রহরীর
জ্ঞানহীন দেহ, তারপর ছুটল আবার রাস্তার মাঝখান দিয়ে।
কামান চারটের কাছে পৌঁছতে আরও একটা বাধা আছে। কয়জন গার্ড
থাকবে কে জানে। দু’জনের হাতের শক্তিশালী টর্চ জ্বলে উঠল। দৌড়ানোর
সাথে সাথে লাফালাফি করছে টর্চের আলো। দূর থেকে যে-ই দেখুক বুঝবে
দু’জন লোক ছুটে আসছে কামান ঘরের দিকে, আÍগোপন করার কোনও রকম
চেষ্টা নেই ওদের মধ্যে- কাজেই সন্দেহের কিছু নেই।
ম্যাগাজিন গেটের কাছাকাছি আসতেই রানার চোখে পড়ল দু’জন প্রহরী
দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত। পিস্তলটা বের করল রানা। টর্চটা
বাম হাতে চলে গেছে ওর। এগিয়ে এল উদগ্রীব উদ্বিগড়ব প্রহরী দু’জন।
চারদিকে হট্টগোল শুনতে পাচ্ছে ওরা কেবল, ব্যাপার কি বুঝতে পারছে না।
‘তোমরা সব ঠিক আছ তো?’ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘কেউ এসেছিল এখানে? বোবা বনে গেলে কেন, জলদি বলো!’
‘কেউ আসেনি তো! আমরা ঠিকই আছি। এত গোলাগুলির আওয়াজ
কিসের?’ জিজ্ঞেস করল একজন শিরস্ত্রাণ পরা প্রহরী।
‘ওই পাকিস্তানী কুত্তাগুলো। গেটের গার্ড দু’জনকে খুন করে ঢুকে
দুর্গম দুর্গ ১০১
পড়েছে দুর্গের ভেতর। ঠিক বলছ তো কেউ আসেনি এখানে? দাঁড়াও, আমি
নিজে চেক করে দেখি।’ টর্চটা ঘুরিয়ে প্রকাণ্ড স্টীলের দরজার তালা দেখল
রানা পরীক্ষা করে। আশেপাশে দেখল, কেউ কোথাও নেই। ‘যাক বাঁচা
গেল। সাবধানে থেকো তোমরা।’ চট করে টর্চের তীব্র আলোটা একবার
প্রহীর চোখের ওপর ফেলে ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েই নিভিয়ে দিল রানা।
পরমুহূর্তে ঢলে পড়ল প্রহরী জুলফির কাছে পিস্তলের বাঁটের একটা ভয়ঙ্কর
আঘাত খেয়ে। খট্ করে আরেকটা শব্দ হলো পাশেই। দ্বিতীয় প্রহরীটাও
পড়ল প্রম জনের ওপর।
‘বেঁধে ফেল ওদের, মিশ্রী। আমি তালাটা খুলছি।’
পঞ্চম চাবিটা লাগল। প্রকাণ্ড স্টীলের দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। দূরে
আলতাফের মেশিনগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গেটের কাছ থেকে একটা
ট্রাকের এঞ্জিনের শব্দ এল- শেষ ট্রাকটাও বোধহয় বেরিয়ে গেল দুর্গ থেকে।
মিশ্রী খানকে জ্ঞানহীন দেহ দুটো ভেতরে টেনে এনে দরজা লাগিয়ে
ওপরে উঠবার আদেশ দিয়ে এগিয়ে গেল রানা। খাড়া একটা স্টীলের মই
বেয়ে উঠে এল সে কামান বসানো গুহায়।
সাবধানে এগোল রানা। ম্যান-ট্র্যাপ থাকতে পারে। এখন প্রম কাজ
ভেতরে আরও কোনও গার্ড আছে কিনা দেখে নেয়া, দ্বিতীয় কাজ এখান
থেকে বেরোবার বন্দোবস্ত ঠিক রাখা। সব কাজ দ্রুত সারতে হবে, কিন্তু
তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।
চারদিকে টর্চের আলো ফেলে বুঝল রানা স্বাভাবিক গুহাকে কেটে
আরও বড় করে নেয়া হয়েছে কাজের সুবিধার জন্যে। শত শত টন
শক্তিশালী এক্সপে−াসিভ আর অসংখ্য কামানের শেল থরে থরে সাজানো।
এগিয়ে গেল রানা সামনে। বিশ গজ গিয়েই গুহাটা বাঁয়ে মোড় নিয়েছে।
ঘুরেই চোখ পড়ল গুহামুখে বসানো বিশাল চারটে কামানের ওপর। অন্ধকারে
যেন খাপ পেতে বসে অপেক্ষা করছে কারও জন্যে চারটে ভয়ঙ্কর দৈত্য।
টর্চ নিভিয়ে দিল রানা। বোঝা গেছে কেউ নেই আর। এখন টর্চ জ্বালা
থাকলে কারও চোখে পড়তে পারে গুহামুখের এই আলো।
কাছে গিয়ে একটা কামান স্পর্শ করে দেখল রানা। স্বপড়ব দেখছে, না
সত্যি সত্যিই এসে গেছে সে? যেগুলো ধ্বংস করতে এতদূর এসেছে সে
ঢাকা থেকে, সত্যিই কি সে এত কাছে এসে পৌঁছেচে সেগুলোর? কেমন যেন
অবাস্তব লাগল ওর কাছে সবকিছু। নিঃশব্দে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে
আছে মস্ত চারটে কামান। কমপক্ষে বারো ইঞ্চি বোর হবে। এ যেন অন্য
জগতের অবাস্তব কোনও জিনিস।
হঠাৎ চমকে উঠল রানা। কিসের যেন শব্দ হলো? কান পেতে রইল সে
কিছুক্ষণ। নাহ, কোনও শব্দ নেই। বুঝল শব্দ নয়, শব্দের অভাবই ওকে
চমকে দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বাস্তবে। চারদিক নিস্তব্ধ। আলতাফের গুলির
............................
১০২ মাসুদ রানা-৬
শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর।
আলতাফ মারা গিয়ে থাকুক আর গুলি চালনা বন্ধই করে থাকুক, সময়
ফুরিয়ে আসছে। আর অল্পক্ষণেই টের পেয়ে যাবে ভারতীয়রা যে বোকা
বানানো হয়েছে ওদের। ছুটে আসবে ওরা এখানে। দ্রুত সারতে হবে সব
কাজ। প্রম, পালাবার ব্যবস্থা।
এগিয়ে গিয়ে রেলিং-এর ধারে বসে পড়ল রানা। ব্যাগ খুলে বের করল
লম্বা রশি। গুহামুখের ডানধারে চলে গেল রানা। রশির একমাথা শক্ত করে
বাঁধল রেলিং-এর সঙ্গে। রেলিংটা ঝাঁকিয়ে দেখল ওর ভার সহ্য করতে
পারবে কিনা। বুঝল পারবে। নামিয়ে দিল রশিটা নিচে। রেলিং টপকে
সামনের দিকে ঝুঁকে চারদিকে দৃষ্টি বুলাল রানা একবার।
নিচে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। কামানগুলো থেকে সোয়াশো ফুট
নিচে। ডান পাশে দুর্গ প্রাচীর এসে মিশেছে পাহাড়ের গায়ে। অফিসারস্
কোয়ার্টারের ছাত আবছা দেখা যাচ্ছে তিরিশ ফুট নিচে গজ পনেরো দূরে।
দ্বারোকা শহরটা দেখা যাচ্ছে আবছা মত। ফিরে এল সে মিশ্রী খানের সাথে
দু’একটা কথা সেরে নিতে।
ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে ফিউজ, ডিটোনেটার, এক্সপে−াসিভ আর সরু তামার
তার ঘাঁটাঘাঁটি করছে মিশ্রী খান। রানাকে আসতে দেখে চোখ তুলল।
‘এই বোমাগুলোর মধ্যেই ব্যবস্থা করি, কি বলেন, ওস্তাদ?’ কয়েক
সারি বাক্সের দিকে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখাল মিশ্রী খান। ক্লক ওয়ার্ক
ফিউজের কাঁটা ঠিক করে ফেলেছে সে।
‘যেখানে খুশি রাখো। শুধু লক্ষ রেখো, সহজেই যেন খুঁজে বের করতে
না পারে। ওদের তো জানবার কথা নয় যে আমরা বুঝে ফেলেছি যে
আমাদের ফিউজগুলো নষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তাই না?’
‘ঠিক, ওস্তাদ। ওরা যদি কোনও μমে খুঁজে বের করতে পারত
আমাদের বসানো বোমা তাহলে হেসে খুন হয়ে যেত। কিন্তু হাসিয়ে নয়,
বোমা মেরে খুন করতে চাই। তাই ভাল করে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি।
কিন্তু ব্যাটারি?’
‘আনছি। তুমি নিচের দরজা ঠিকমত তালা দিয়েছ তো?’
‘বিলকুল। এ সব ব্যাপারে আমার...’
কথাটা শেষ হলো না। হঠাৎ করে একটা জোর ধাতব শব্দ হলো
নিচে। গমগম করতে থাকল শব্দটা গুহার মধ্যে। চমকে দু’জন চাইল
দু’জনের দিকে। আবার ভেসে এল শব্দ, আবার, আবার।
‘এসে গেছে ওরা। হাতুড়ি নিয়ে এসেছে। পিটাচ্ছে স্টীলের দরজা
ভাঙবার জন্যে,’ ফিসফিস করে বলল রানা। বলেই ছুটল কামানগুলোর
দিকে। মিশ্রীও ছুটল পেছন পেছন।
‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা টের পেল কি করে যে আমরা ঢুকে পড়েছি
দুর্গম দুর্গ ১০৩
এর মধ্যে?’ প্রশড়ব করল মিশ্রী খান ছুটতে ছুটতে।
‘নাজির বেগ!’ কর্কশ শোনাল রানার গলাটা। ‘দুর্গের সব কথাই
বলেছিল সে আমাদের, কেবল নিচের দরজা খোলার সাথে সাথে যে
গার্ডরূমে অ্যালার্ম বেল বেজে ওঠে সেই কথাটা চেপে গিয়েছিল।’
পনেরো
গুণে গুণে ষাট ফুট নামল রানা রশি বেয়ে। দাঁতে কামড়ে ধরে আছে সে
ইশরাতের দেয়া এক মাথায় হুক বাঁধা কঞ্চিটা। রশিতে দুইবার থাবড়া
দিয়ে ইঙ্গিত করল সে মিশ্রী খানকে। দোলাতে আরম্ভ করল মিশ্রী খান রশিটা
রেলিং-এর ধারে শুয়ে পড়ে। রশি ধরে ঝুলে থেকে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত
দুলতে আরম্ভ করল রানা। ধীরে ধীরে বেড়ে চলল গতি, সেই সাথে ঝুলনের
দূরত্ব। μমেই এগিয়ে যাচ্ছে রানা অফিসারস্ কোয়ার্টারের দিকে। ইশরাত
ছুঁড়ে দেবে একটা রশি। যে করেই হোক ধরতে হবে রানাকে সেই রশি।
এরই ওপর নির্ভর করছে এখন সবকিছু।
দাঁতে দাঁত চেপে দু’হাতে ধরে আছে রানা দড়ির শেষ প্রান্ত। কিছু
দেখা যাচ্ছে না। আবার চেপে এসেছে বৃষ্টি। প্রম দিকে পাহাড়ের গা থেকে
বেরিয়ে আসা একটা পাথরে বার তিনেক ঠোকর খেয়েছিল রানা, কায়দা করে
সরে গেছিল সে। তখন গতি কম ছিল বলে ধাক্কাটা বিশেষ আমল দেয়নি।
কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে সে পাথরটার
দিকে। সর্বনাশ! এবার একবার বাড়ি খেলে ছাতু হয়ে যাবে সে। অন্ধকারে
ঠিক দেখা যাচ্ছে না কিছু। আর কতদূরে আছে পাথরটা? এইবারেই কি ধাক্কা
খেতে যাচ্ছে সে? বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল রানার। প্রতিবার যখনই ওদিকে
যাচ্ছে, পাগলের মত হুক লাগানো কঞ্চিটা দিয়ে খুঁজছে সে ইশরাতের ছুঁড়ে
দেয়া রশি। আর প্রতিবারেই যখন বিফল হয়ে ফিরে আসছে, চোখ বুজে দম
বন্ধ করে প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রচণ্ড এক ধাক্কার জন্যে। পাথরটার কথা ভুলে যাবার
চেষ্টা করল রানা, কিন্তু কিছুতেই আতঙ্ক গেল না মন থেকে। এই গতিতে
ধাক্কা খাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। μমে কাছে এগিয়ে আসছে ওর মৃত্যু।
কিন্তু কি হয়েছে ইশরাতের? রশি কোথায়? ধরা পড়ে গেল না তো!
হাত দুটো ব্যথা হয়ে গেছে রানার ঝুলে থাকতে থাকতে। আর কতক্ষণ সে
পারবে এভাবে ঝুলে থাকতে? আবার সাঁ করে পার হয়ে গেল সে পাথরের
দুই ফুট দূর দিয়ে। ঝিক্ করে একবার বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই পরিষ্কার
দেখতে পেল রানা পাথরটা। এই-ই শেষ চেষ্টা- বুঝল রানা পরিষ্কার। এবার
রশি না পেলে ওর নিশ্চিত মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না কেউ। প্রচণ্ড আঘাতের
.............................
১০৪ মাসুদ রানা-৬
কথা চিন্তা করে গাল দুটো কুঁচকে গেল ওর একবার।
কঞ্চিটা বাড়াল রানা সামনের অন্ধকারে, এদিক ওদিক হাতড়াল, কিছু
নেই। খোদা! হঠাৎ লাফিয়ে উঠল রানার হƒৎপিণ্ড। পেয়েছে সে রশিটা!
একটানে কাছে নিয়ে এল রানা রশিটা। শক্ত করে চেপে ধরে কমিয়ে
ফেলল গতি। ধীরে ধীরে এসে ঠেকল ওর দেহটা পাথরে, ওটা পার হয়ে
চলে গেল আরও ছয় সাত ফুট। ইশরাতের রশিটা কোমরে বেঁধে নিয়ে ভেজা
রশি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে এল সে ওপরে। রেলিং পার হয়েই শুয়ে পড়ল
মেঝের ওপর। হাপরের মত শ্বাস পড়ছে ওর তখন।
বিনা বাক্য ব্যয়ে ওর কোমর থেকে খুলে নিল মিশ্রী খান ইশরাতের
পাঠানো রশিটা। লম্বা রশির দু’মাথাই রয়েছে ইশরাতের কাছে। এখন শক্ত
মসৃণ কোনও একটা জিনিস দরকার যেটা পুলির কাজ করবে। একটা
কামানের গায়ে পরিয়ে দিল মিশ্রী খান রশিটা, দুটো টান দিল রশি ধরে।
ওদিকে ছাতের ওপর ওয়াটার ট্যাঙ্কে পানি তোলার একটা মোটা পাইপের
ওপাশে টেনে গিঁট দিয়েছে ইশরাত রশির দুই মাথা।
দুই মিনিটে চলে এল ভারি ব্যাটারিটা রশিতে ঝুলতে ঝুলতে। আর
দু’মিনিটে নাইট্রো, প্রাইমার এবং ডিটোনেটারের ক্যানভাস ব্যাগ পৌঁছে গেল
ওপরে। এমনি সময় থেমে গেল হাতুড়ির ঘা। তড়াক করে উঠে বসল রানা।
থামল কেন হাতুড়ি-পেটা? ভেঙে ফেলল ওরা দরজা? অটোমেটিক কারবাইন
হাতে ঢুকে পড়েছে ভারতীয় সৈন্য?
উঠে দাঁড়াল রানা। কাঁধে তুলে নিল মিশ্রী খান ব্যাটারিটা। এখন আর
কিছু চিন্তা করবার অবসর নেই। ওরা মরুক বাঁচুক, কাজটা সমাধা হওয়াই
আসল কথা।
গুহার মধ্যে একটি প্রাণীও দেখতে পেল না ওরা। টর্চ ধরল রানা
দরজার দিকে। যেমন ছিল তেমনই আছে সেটা। অটল, অনড়। মিশ্রী
খানকে নিজের কাজ করবার হুকুম দিয়ে নেমে গেল রানা মই বেয়ে। দরজার
বাইরে কারা যেন কথা বলছে। কি বলছে শুনবার জন্যে দরজায় কান
লাগাতে গিয়ে চমকে উঠল রানা। অসম্ভব গরম দরজাটা। সোঁ সোঁ একটা
শব্দ আসছে বাইরে থেকে। টর্চ নিভাতেই দেখতে পেল তালার কাছটায় লাল
হয়ে উঠছে দরজাটা। অক্সি-অ্যাসেটিলিন টর্চ দিয়ে তালা গলাবার চেষ্টা
করছে ওরা এখন। দরজাটা আর্মার্ড স্টীলের তৈরি- গলতে দেরি আছে,
বুঝল রানা। এখনও অন্তত সাত মিনিট সময় আছে ওদের হাতে। উঠে এল
রানা ওপরে। মিশ্রী খানকে বলল ব্যাপারটা।
‘কিচ্ছু ভাববেন না, ওস্তাদ। পাঁচ মিনিটের কাজ। ওরা পৌঁছবার দুই
মিনিট আগেই কেটে পড়ব আমরা এখান থেকে।’
ঠিক পাঁচ মিনিটেই কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল মিশ্রী খান। টর্চ জ্বেলে
এপাশ ওপাশ থেকে ভাল করে দেখল কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা। তারপর
দুর্গম দুর্গ ১০৫
সন্তুষ্টচিত্তে একটা বক সিগারেট ধরিয়ে বেসুরো শিস দিতে আরম্ভ করল।
‘হয়ে গেছে, মিশ্রী খান?’ ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ, ওস্তাদ। যে-কাজে এসেছিলাম সে-কাজ শেষ। ঠিক রাত
বারোটায় সেট করে দিলাম । ওদের বাপেরও ক্ষমতা নেই এখন এটাকে বন্ধ
করে। কেউ স্পর্শ না করলে বারোটায় ফাটবে- কিন্তু যদি তার আগেই কেউ
ধরে তবে সঙ্গে সঙ্গে ফাটবে। এখন দেখা যাক পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে দেশে
ফেরা যায় কিনা। আবার কি সমুদ্র দিয়ে যেতে হবে, ওস্তাদ?’
রানা কোনও জবাব দিল না। দরজায় বেশ খানিকটা ফুটো করে
ফেলেছে ওরা। দ্রুত চলে এল ওরা গুহামুখের কাছে। একে একে চলে গেল
অফিসারস্ কোয়ার্টারের ছাতে। রশিটা ছুরি দিয়ে কেটে একদিক ধরে টেনে
সরিয়ে আনল কামানের ওপর থেকে। ব্যস। কাজ শেষ ওদের।
রাত বারোটা বাজতে দশ।
ইশরাতের দ্বিতীয় আস্তানার বারান্দায় বসে আছে রানা। পাল−া দিয়ে
নাক ডাকাচ্ছে আলতাফ আর মিশ্রী খান গেস্টরূমে পাশাপাশি দুটো খাটে
শুয়ে। রাত সোয়া বারোটায় আসবে পাকিস্তানী সাবমেরিন থেকে রেসকিউ
বোট।
স্ান সেরে পরিষ্কার শুকনো কাপড় পরে বেশ ঝরঝরে লাগছে
শরীরটা। বারান্দায় একটা আরাম কেদারায় আরাম করে শুয়ে আকাশপাতাল
ভাবছে রানা। ব্রেনগানটা পাশেই মাটিতে রাখা। নিজেই যেচে
পাহারার ভার নিয়েছে সে।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ অনেকক্ষণ হয়। পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে
আকাশটা। সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে এক-আধবার উঁকি দিয়েই আবার গা
ঢাকা দিচ্ছে চাঁদ। দশ হাত দূরে আরব সাগরের ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে
তীরে। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। শহরটা নিস্তব্ধ। চারদিকে একটা শান্ত
সমাহিত ভাব। রানার মনের মধ্যেও কোনও উদ্বেগ নেই। কাজ ফুরিয়েছে।
যে-কাজে পাঠানো হয়েছিল ওদের, সেটা সুসম্পনড়ব হয়েছে। অদ্ভুত এক নির্মল
আনন্দে ভরে আছে হƒদয়। কান পেতে শুনছে সে সমুদ্রের কলে−ালধ্বনি আর
তরঙ্গের উচ্ছ্বাস।
রানার চুলের মধ্যে প্রবেশ করল ইশরাত জাহানের নরম আঙুল।
নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
‘কি ভাবছ, মেজর?’
‘কিচ্ছু না। বসে বসে পাহারা দিচ্ছি।’
‘এখানে কে আসবে যে পাহারা দিচ্ছ? দু’ঘণ্টা আগেই একবার সার্চ
করে গেছে। আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যে এখানে খোঁজ করবার কথা কারও
মাথায় আসবে না।’
..........................
১০৬ মাসুদ রানা-৬
‘তবু, সাবধানের মার নেই। তাছাড়া বসে থাকতে ভালই তো
লাগছে।’
‘কফি খাবে এক কাপ? পানি চড়িয়ে দিয়েছি স্টোভে।’ একটা চেয়ার
টেনে নিয়ে বসল ইশরাত।
‘ব্যাপার কি, জাহান?’ অবাক হয়ে গেল রানা। ‘শাড়ি পরেছ যে?’
হাসল ইশরাত। ঝকঝক করে উঠল সুন্দর দু’পাটি দাঁত। বলল,
স্পাকিস্তানেই যখন যেতে হচ্ছে তখন ছদ্মবেশের আর কি দরকার?’
খুঁটিয়ে দেখল একবার রানা ইশরাতকে। কপালে লাল টিপ পরেছে
সে, কানে ছোট্ট দুটো ঝুমকো। ডান হাতে কয়েকগাছি সোনার চুড়ি, বাঁ হাতে
একটা লেডিস্ ঘড়ি কালো ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধা। লম্বা নখে নেইল পলিশ।
আঁটসাঁট করে পেঁচিয়ে পরেছে সে একটা কমলা রঙের শিফন শাড়ি। মাথার
চুল পুরুষের মত করে ছাঁটা। শাড়ি ব−াউজের সঙ্গে চুলের এই অসামঞ্জস্য
বিদঘুটে দেখালেও কেন জানি ভাল লাগল রানার।
‘খারাপ লাগছে দেখতে?’ জিজ্ঞেস করল ইশরাত।
‘অপূর্ব লাগছে।’
‘কফি খাওয়াবার কথা শুনে বলছ, না সত্যিই?’
‘সত্যি।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
চুপচাপ সাগরের গান শুনল কিছুক্ষণ ইশরাত, তারপর আবার জিজ্ঞেস
করল, ‘আর কতক্ষণ, রানা?’
ঘড়ি দেখে জবাব দিল রানা, ‘তিন মিনিট।’
অস্থির পায়ে চলে গেল ইশরাত কফি আনতে। দুই মিনিট পর রানার
হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে জানতে চাইল ইশরাত, ‘আর আছে এক
মিনিট। ওদের জাগাবে না?’
‘কি দরকার? ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ভয়ানক খাটুনি গেছে ওদের ওপর
দিয়ে।’ কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘বাহ, দারুণ হয়েছে তো!’
ঘড়ির ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না ইশরাত।
ঠিক বারোটায় কেঁপে উঠল রানার হাতে ধরা কাপ। প্রমবার মৃদু, দুই
সেকেণ্ড পর প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল গোটা এলাকা- তারপর পৌঁছল এসে
বিস্ফোরণের আওয়াজ।
মৃদু হাসি ফুটল রানার মুখে।
* * * *
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×