somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(মাসুদ রানা) দুর্গম দুর্গ কাজী আনোয়ার হোসেন এক////

১২ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঢাকা থেকে করাচি। করাচি থেকে টু-সীটার সী-পে−নে করে চলেছে রানা
কেটি বন্দর।
আবোল তাবোল ভাবছে রানা। কী এমন ব্যাপার যেজন্যে এমন
স্পেশাল ভাবে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এত তাড়াহুড়োই বা কিসের?
ঢাকার পি. সি. আই. হেড অফিস জানিয়েছে পাকিস্তান ন্যাভাল
ইন্টেলিজেন্সের বিশেষ অনুরোধে তাকে পাঠানো হচ্ছে করাচি। একটা অত্যন্ত
জরুরী কাজে ছোট্ট একটা কম্যাণ্ডো গ্র“পকে লীড করতে হবে। আর কিছুই
জানা যায়নি। অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। ওখানে পৌঁছে জানা যাবে সব।
করাচি পৌঁছে টি-থারটি থ্রী জেট থেকে নেমে সী-পে−নে ওঠা ছাড়া আর
তেমন কিছুই ঘটল না। একজন মাঝ-বয়সী নেভী ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে
হ্যাণ্ডশেক করলেন রানার সঙ্গে, বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে গেলেন এঞ্জিন স্টার্ট
দিয়ে রাখা সী-পে−নের কাছে, কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে।
আবার হ্যাণ্ডশেক করে উঠে গেল রানা সিঁড়ি বেয়ে।
কয়েকটা ডোশিয়ে। বোধহয় ওর গ্র“পের আর সবার। দেখা হওয়ার
আগেই তাদের সম্পর্কে রানার যাতে মোটামুটি একটা ধারণা হয় সেজন্যে
ওকে এগুলো দেয়া। সাথে প্রত্যেকের ছবি আছে একটা করে।
প্রমেই আছে পেশোয়ারী এক ছোকরার ছবি। মাহবুব চানন্। নেভির
লেফটেন্যান্ট। রেডিও এক্সপার্ট। উর্দু, পশতু, ইংরেজি এবং কচ্ছ ভাষায়
অনর্গল কথা বলতে পারে। হবি- মোটর এঞ্জিনিয়ারিং। গেরিলা ফাইটার
হিসেবেও কৃতিত্ব আছে। দাড়ি গোঁফ কামানো পাতলা ছিমছাম চেহারা।
চোয়ালের হাড় দুটো উঁচু। কিন্তু কম্যাণ্ডো মিশনে যাওয়ার জন্যে বয়সটা
একটু কম বলে মনে হলো রানার। বাইশ কি তেইশ।
তারপর আছে পাঞ্জাবী মিশ্রী খান। প্রকাণ্ড একজোড়া কালো গোঁফ।
.
২ মাসুদ রানা-৬
.দেখলেই বোঝা যায় বহু ঘাটের পানি খেয়েছে। হািিডসার মস্ত কাঠামো
শরীরের। ফিফ্্ ডিভিশনের আর্মি ক্যাপ্টেন। বয়স পঁয়তালি−শ।
এক্সপে−াসিভের ব্যাপারে অদ্ভুত এক প্রতিভা। পোয়াটেক বারুদ হাতে ধরিয়ে
দিলেই বোম বানিয়ে ফেলবে। কর্মঠ এবং ভয়ঙ্কর লোক।
আর তৃতীয় ছবিটা দেখে চমকে উঠল রানা। আলতাফ ব্রোহী! আর্মিতে
থাকতেই পরিচয় ছিল রানার সঙ্গে। সিন্ধী। বয়স চলি−শ বছর। করাচি পি.
সি. আই.-এ কাজ করছে এখন। কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টে একসাথে কাজ
করেছে ওরা। পরিচয়টা এখন বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রকাণ্ড চেহারা-
যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। তেমনি করিৎকর্মা। পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ গেরিলা
ফাইটার। ‘রান অভ কাচে’র যুদ্ধে শত্র“ লাইনের পেছনে চলে গিয়ে ভারতীয়
সৈন্যদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাল করেই চেনে ওকে রানা।
ওকে দেখলে অসম্ভব শক্তিশালী একটা যুদ্ধের মেশিন ছাড়া আর কিছুই মনে
হয় না রানার।
শেষ ছবিটা লেফটেন্যান্ট আরীফের। মেয়েলী চেহারা। ন্যাভাল
ইন্টেলিজেন্সের স্পাই। ওর সম্পর্কে ডোশিয়ে দেখে তেমন বিশেষ কিছু জানা
গেল না।
প্রত্যেকটি লোক যুদ্ধ সংμান্ত কাজ করেছে। এই সব এক্সপার্টদের
এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে একটা কম্যাণ্ডো গ্র“প তৈরি করা
হয়েছে। কিন্তু কোথায়, কি কাজে, কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে জানা নেই
ওর। কেটি বন্দরে পৌঁছলে হয়তো জানা যাবে। জানালা দিয়ে বাইরে চাইল
মাসুদ রানা।
সিন্ধু নদের মোহনায় কেটি বন্দর। সমুদ্রের কাছাকাছি নদীর বিশাল বিস্তার।
কেটি বন্দর মাইল খানেক থাকতেই নেমে পড়েছে পে−ন নদীতে। ডান ধারে
তীরের ওপর কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা লোক দাঁড়ানো। একটা
তাঁবুও দেখা গেল মাঠের মধ্যে।
‘দিস ইজ কমোডোর জুলফিকার অভ ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্স।’
হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। শক্ত সমর্থ শক্তিশালী একটা হাত।
বয়সের ভাঁজ পড়েছে গালে। ক্লিন শেভ্ড্।
‘আপনার সহকারীদের সাথে দেখা হবে পরে, তার আগে আমরা
দু’চারটে কথা সেরে নিতে চাই আপনার সঙ্গে। আসুন এদিকে।’
রানার পেছন পেছন বাকি তিনজন অফিসারও এল তাঁবুর মধ্যে। সী-
পে−নটা ফেরত চলে গেল করাচি।
‘দ্বারোকা যেতে হচ্ছে আপনাকে,’ বললেন কমোডোর জুলফিকার একটা
চেয়ারে বসে। রানাও বসল। তাঁবুর মধ্যে একটা টেবিল আর তার চারপাশে
ক’টা চেয়ার ছাড়া আসবাব নেই আর। কমোডোরের টেম্পোরারী অফিস।
দুর্গম দুর্গ ৩
স্থির দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে আবার আরম্ভ করলেন কমোডোর, ‘করাচি
থেকে দুশ দশ মাইল দূরের এই নৌ-ঘাঁটিটা বরাবর আমাদের মাথা-ব্যথার
কারণ। অত্যন্ত শক্তিশালী রাডারে ওরা ওখানে বসে করাচিতে পাকিস্তান
এয়ার ফোর্সের গতিবিধি লক্ষ করছে এবং চারদিকে ইনফরমেশন দিচ্ছে।
ওদের এয়ার ফিল্ড থেকে উঠে ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচিতে বম্বিং
করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ওপর ওখানে জমা হচ্ছে ওদের নৌবাহিনী-
অতর্কিত আμমণে পাকিস্তান ন্যাভাল ফোর্সকে ছিনড়ব ভিনড়ব করে দেয়ার জন্যে।
কাজেই স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে অবস্থিত এই নৌ-ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়া ছাড়া
আর কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না আমরা। দেরি হলেই হার হয়ে যাবে
আমাদের।’
‘আমরা পাঁচজন গিয়ে...’
‘আপনাদের কাজ কেবল ওদের দুর্গম দুর্গে প্রবেশ করে চারটে অব্যর্থ
কামান ধ্বংস করে দেয়া। ওগুলোর জন্যে দ্বারোকার আধমাইলের মধ্যে
যাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলোকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে বাকি কাজ নির্বিঘেড়ব
সেরে আসতে পারবে পাকিস্তান নেভি। একাজের জন্যে শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পনড়ব
তিনজন সহকারী পাচ্ছেন আপনি, দ্বারোকা পৌঁছে লেফটেন্যান্ট আরীফের
সাহায্য পাচ্ছেন, কাজেই আমরা আশা করতে পারি সফল হতে পারবেন
আপনি। গোটা দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করছে এই কম্যাণ্ডো গ্র“পের নেতার
ওপর, তাই আপনাকে বেছে নিয়েছি আমরা। আশা করি এই সম্মানের
মর্যাদা রক্ষা করবেন।’
‘চেষ্টার ত্র“টি হবে না, স্যার,’ বলল রানা বিনীত ভাবে।
এবার ম্যাপ বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপার আলোচনা
করলেন কমোডোর। রানা অবাক হলো ভদ্রলোকের নিপুণ প−্যানিং এবং
পরিচ্ছনড়ব চিন্তা দেখে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারও দৃষ্টি এড়ায়নি ওঁর। দুই ঘণ্টা
কখন পার হয়ে গেল বুঝতেই পারল না সে। কমোডোর জুলফিকারের
প্রতিটি কথা স্রেফ হাঁ করে গিলে নিল মাসুদ রানা। পুরো প−্যানটা ভালভাবে
বসিয়ে নিল মাথার মধ্যে।
‘উইশ ইউ বেস্ট অভ লাক, ইয়ংম্যান।’ রানার কাঁধের ওপর রাখলেন
কমোডোর ডান হাত। ‘কাজটা ভয়ঙ্কর, দুঃসাধ্য এবং বিপদজনক। কিন্তু
শুনেছি, কারও পক্ষে যদি সম্ভব হয় এ মিশন সফল করা, সে হচ্ছেন আপনি।
আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন।’
মাইল খানেক তফাতে একটা ডাক-বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়িতে নিয়ে
আসা হলো রানাকে জীপে করে। পাঁচ মাইল দূরে আরব সাগরের বুকে
ঝিলিমিলি এঁকে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা। চারদিকে কুয়াশা-কুয়াশা ধোঁয়াটে ভাব।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাস। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল
.
৪ মাসুদ রানা-৬
রানা বাড়ির ভেতর কমোডোর জুলফিকারের পেছন পেছন।
সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কমোডোর। এখন সব
কিছুর ভার রানার ওপর। লেফটেন্যান্ট আরীফের সঙ্গে তার নিজেকেই
পরিচয় করে নিতে হবে দ্বারোকায়।
টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। খাওয়া শেষ করে ওদের যেটুকু বলা
দরকার বলবে রানা। তারপর নৌকোয় উঠে বাকি কথা হবে। আধঘণ্টার
মধ্যে রওনা হতে হবে ওদেরকে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ একমনে খেল রানা। বুঝতে পারল আলতাফ ছাড়া
আর সবাই লক্ষ করছে তাদের নতুন দলপতিকে। বুঝবার চেষ্টা করছে,
মূল্যায়নের চেষ্টা করছে চোখে দেখে যতটুকু সম্ভব। এমন সময় ঘরে এসে
ঢুকল একজন অপরিচিত সামরিক অফিসার। কাঁধের ওপর তিনটে স্টার
দেখে বোঝা গেল আর্মি ক্যাপ্টেন, সদ্য প্রমোশন পেয়েছে। ফর্সা চেহারা,
চাল চলনে একটা উদ্ধত ভাব। দেখেই আন্দাজ করা যায়, সেপাইদের যম।
‘কি ব্যাপার? এখনও খাওয়াই হয়নি আপনাদের? অথচ আপনাদের এই
কোয়ার্টার ভ্যাকেট করবার কথা ছিল ছ’টার সময়। আমাকে আমার
কোয়ার্টার থেকে বের করে দিয়ে যদি এ রকম অত্যাচার...’
‘আপনাকে চিনলাম না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। লোকটার গলাটা
খোনা, আর ব্যবহারে এমন একটা বিরক্ত বেপরোয়া তাচ্ছিল্যের ভাব রয়েছে
যে দেখেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল রানার।
ঝট্ করে ফিরল অফিসার রানার দিকে। ‘ও, আপনি বুঝি নতুন
এসেছেন? তা আপনি কে শুনি?’
‘গেট আউট!’ আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে দিল রানা। ‘আমরা যতক্ষণ
আছি কোন পঞ্চম ব্যক্তি চাই না। বেয়ারাকে পর্যন্ত ওই গেটের বাইরে
দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম দিয়েছি। আপনি এখন যেতে পারেন।’
‘কি? আমার বাড়িতে বসে আমাকে গেট আউট?’ কট্মট্ করে চেয়ে
রইল ক্যাপ্টেন রানার দিকে। রাগে লাল হয়ে গেছে সারা মুখ। আবার
হাতের ইশারায় দূর হয়ে যেতে বলল ওকে রানা। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল
সে ঘর ছেড়ে।
‘আজ আমরা কেন সমবেত হয়েছি জানার জন্যে নিশ্চয়ই আপনারা
সবাই উৎসুক হয়ে আছেন। আমরা কেউ কাউকে চিনি না, পাকিস্তানের
বিভিনড়ব জায়গা থেকে আমাদের টেনে আনা হয়েছে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
কাজের জন্যে। শত প্রশড়ব উঁকি দিচ্ছে সবার মনে। আমি আপনাদের সমস্ত
প্রশেড়বর উত্তর দিচ্ছি একে একে। সম্মিলিত চেষ্টায় আমাদেরকে একটা অসাধ্য
সাধন করতে হবে। খুলে বলছি, শুনুন...’
‘গেছি রে গেছি, বাবা, নির্ঘাত মারা পড়েছি!’ ককিয়ে উঠল মিশ্রী খান। ‘এই
দুর্গম দুর্গ ৫
সেপ্টেম্বরের তুফানের দিনে সামুন্দার? নৌকায়? উহ্!’ ফস্ করে দেশলাই
জ্বেলে কিংস্টর্ক সিগারেট ধরাল সে একটা।
‘ক্যাপ্টেন খান ঠিকই বলেছেন,’ বলল মাহবুব চানন্। ‘মস্ত বড় ঝুঁকি
নিচ্ছেন আপনি, মেজর রানা। হুকুম করলে আমি নেভিগেট করব, কিন্তু
পৌঁছতে পারব কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
‘ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে। অন্য কোনও পথে আমাদের বিপদ
আরও বেশি। আলতাফ, তুমি কোথায় চললে?’ কথাটা শেষ হবার আগেই
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আলতাফ ব্রোহী। দেখা দেখি তড়াক করে
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিশ্রী খান। হাতে একটা পিস্তল।
‘মাহবুব, পাশের ঘর থেকে টর্চটা নিয়ে এসো। কুইক!’ বলে রানাও এক
লাফে বেরিয়ে এল বাইরে।
কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল, টর্চ আনতে
আনতে বেড়া টপকে একশো গজ দৌড়ে চলে গেছে সে। দুটো গুলি ছুঁড়ল
মিশ্রী খান- লাগল না একটাও। বেয়ারা দৌড়ে এগিয়ে এল। আলতাফকে
দেখা গেল না কোথাও।
‘লোকটাকে চেনো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘চিনি, হুজুর! ক্যাপ্টেন সাহেবের খানসামা, করিম। বোবা আর কালা।’
‘বোবা-কালা যদি হবে তো লুকিয়ে লুকিয়ে কি শুনছিল সে কান পেতে?’
কোনও জবাব দিল না বেয়ারা। ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে রইল ওদের
দিকে।
‘কোথায় গেছে তোমার ক্যাপ্টেন সাহেব?’
‘অফিসারস্ ক্লাবে।’
‘ডেকে আনো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে বলবে।’
বেয়ারা চলে যেতেই ফিরে এল ওরা ডাইনিং রূমে। একটা ইজি চেয়ারে
শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। বলল, ‘ওকে ধরা না গেলে আমাদের রওনা হওয়ার
কোনও মানে হয় না, ওস্তাদ। ব্যাটা স্পাই। আমার কোনও সন্দেহ নাই।’
গম্ভীর মুখে পায়চারি করল রানা কিছুক্ষণ। আবার চেয়ারে এসে বসে
অপেক্ষা করছে আলতাফের। এমনি সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল একটা
মিশমিশে কালো লোক। গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরনে। পেছনে ওর একটা
হাত মুচড়ে ধরে ঢুকল আলতাফ ব্রোহী। অপর হাতে একটা ছোরা।
‘ব্যাটা ছোরা তুলেছিল! ওর কব্জিটা ভেঙেই ফেলেছি কিনা জানি না,’
বলল আলতাফ।
‘কি নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা লোকটাকে। ‘কি করছিলে তুমি
এখানে?’
কোনও জবাব দিল না লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। খটাং করে
মাথার পেছনে আলতাফের হাতের এক গাঁট্টা পড়তেই ককিয়ে উঠল।
.
৬ মাসুদ রানা-৬
তারপর ‘আঁউ-আঁউ’ করে বোবার মত বিকট শব্দ বের করল মুখ থেকে।
‘তোমাকে একটা প্রশড়ব করা হয়েছে, তার উত্তর দাও। তোমার অভিনয়
দেখতে চাওয়া হয়নি।’ উঠে বসল মিশ্রী খান। ধীরে সুস্থে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে
সে একটা সাইলেন্সার লাগাচ্ছে ওর পিস্তলের মুখে।
আবার খানিকক্ষণ বিকট আওয়াজ বের করল সে মুখ দিয়ে। ওর পেছন
দিকে কানের কাছে একটা শব্দ করল আলতাফ তুড়ি দিয়ে, কিন্তু যেন
শুনতেই পায়নি এমন ভাবে সামনের দিকে চেয়ে রইল লোকটা। মাহবুবের
মনে হলো নিশ্চয়ই লোকটা বোবা এবং কালা। বলেই ফেলল, ‘লোকটা
সত্যি বোবা-কালা।’
‘হতে পারে, না-ও হতে পারে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ও যে আড়ি
পেতেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া নিরপরাধ লোক এমন হঠাৎ
ছোরাই বা বের করবে কেন? কাজেই আমরা যে বিরাট কাজে হাত দিয়েছি
তাতে ঝুঁকি নেয়া চলবে না।’ হঠাৎ নিষ্ঠুর নির্দয় হয়ে উঠল রানার কণ্ঠস্বর,
‘আলতাফ!’
‘বলো, মেজর।’
‘ছুরি তো আছেই। ঝটপট কাজ সেরে ফেল। ঠিক হƒৎপিণ্ড আন্দাজ
করে চালাবে।’
একটা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মাহবুবের মুখ থেকে। লাফিয়ে
উঠে দাঁড়াল সে। দড়াম করে উল্টে গেল চেয়ারটা। ‘কি করছেন, মেজর...’
মুখের কথা বেধে গেল মাহবুবের। অবাক হয়ে দেখল ছুটে গিয়ে ধাক্কা
খেল লোকটা কাঠের দেয়ালে। প্রাণভয়ে একটা হাত তুলে রেখেছে সে
ওপরে। ঘরের কোণের দিকে সরে যাচ্ছে সে গুটিসুটি মেরে। সারা মুখে
আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। চোখ ফিরিয়ে দেখল বিজয়ীর হাসি আলতাফের মুখে,
মিশ্রী খানও বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। হঠাৎ নিজেকে আস্ত গর্দভ মনে হলো
ওর। স্বভাবতই বেশি কথা বলে মিশ্রী খান। হা-হা করে হেসে উঠে বলল,
‘বোবা কালারও জানের ভয় আছে, বাবা। ভাল কায়দা করেছেন, ওস্তাদ।’
এমনি সময় ঘরে ঢুকল ক্যাপ্টেন বেয়ারার সাথে। ভুরু জোড়া কুঁচকে
আছে। আμমণাওক ভঙ্গি। ঢুকেই তীক্ষè কণ্ঠে বলল, ‘কি পেয়েছেন আমাকে,
মি. মাসুদ রানা? যখন-তখন ডেকে পাঠাবার আপনি কে? ঘরটা আবর্জনামুক্ত
হলো কিনা দেখতে এসেছি। আপনার কথা শুনতে আসিনি।’
‘এই লোকটা কে?’ কোণের দিকে ইঙ্গিত করল রানা।
কোণের দিকে চেয়েই মুখের ভাব পাল্টে গেল ক্যাপ্টেনের। ‘আরে!
করিম! আমার খানসামা। ও ওখানে কেন?’
‘দেয়ালে কান ঠেকিয়ে বাইরে থেকে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
‘খবরদার, ক্যাপ্টেন!’ মিশ্রী খানের পিস্তলটা ক্যাপ্টেনের দিকে ধরা।
দুর্গম দুর্গ ৭
‘আমরা সবাই দেখেছি। ও কি আপনার স্পাই না ভারতের, কেবল তাই
জানতে চাই আমরা।’
অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাপ্টেন মিশ্রী খানের পিস্তলের
দিকে। জোর করে হাসবার চেষ্টা করল সে। লাল হয়ে উঠল ওর ফর্সা মুখ।
বলল, ‘বিশ্বাস করি না, তার কারণ লোকটা বোবা ও কালা।’
‘বোবা কিনা জানি না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু কালা যে নয় তার প্রমাণ
আছে আমাদের কাছে।’ একটা হাত তুলে ক্যাপ্টেনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনার সাথে এ ব্যাপারে তর্কাতর্কি করবার সময় আমাদের নেই।
লোকটাকে এক্ষুণি অ্যারেস্ট করুন এবং অন্ততপক্ষে আগামী এক সপ্তাহের
মধ্যে যেন সে কারও সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে না পারে সেজন্যে
নির্জন সেলে আটকে রাখুন। কথা বলতে পারুক আর না পারুক, লোকটা
ভয়ঙ্কর।’
‘চমৎকার, চমৎকার!’ তিক্ত হাসি হাসল ক্যাপ্টেন। ‘একজন
সিভিলিয়ানের হুকুম তামিল করতে হবে আমাকে। কোথাকার মাতব্বর
এসেছেন আপনি...’
রানাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল সে। টেবিলটা
ঘুরে হেঁটে এসে ক্যাপ্টেনের এক ফুট দূরে থামল রানা। কঠোর দৃষ্টি ওর
চোখে।
‘আপনার এই ব্যবহারের জন্যে ইচ্ছে করলেই কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা
করতে পারতাম- কিন্তু তা করব না। সময় নেই আমাদের হাতে। যা বলছি
তাই করবেন আপনি, নইলে ডিমোশন তো হবেই, কোর্ট মার্শালও হতে
পারে। কি? কর্নেলের সাথে দেখা করতে হবে, না আমার হুকুম তামিল
করবেন?’
বেত্রাহত কুকুরের মত কুঁকড়ে গেল ক্যাপ্টেন। বুঝল, মুখে যা বলছে
কাজেও সেটা করে দেখাবার ক্ষমতা আছে এই লোকের। সবার সামনে এই
চরম অপমান আর পরাজয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল সে বাঁশপাতার
মত। কিন্তু অল্পক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে।
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। অত সব ভয় না দেখালেও চলত। যা
বলছেন তাই হবে। জানি, বেহুদা আপনার সন্দেহ, তবু...। বেয়ারা, দু’জন
গার্ড ডেকে নিয়ে এসো।’
‘আপনার অপমানিত বোধ করবার কিছুই নেই, ক্যাপ্টেন,’ চট করে
বলল মিশ্রী খান। ‘যাঁর হুকুম পালন করতে যাচ্ছেন তিনি বর্তমানে
সিভিলিয়ান হলেও আর্মিতে আপনার চেয়ে এক র‌্যাঙ্ক ওপরে ছিলেন।’
.
৮ মাসুদ রানা-৬
দুই
আধঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র সব নৌকোয় তুলে তৈরি হয়ে নিল ওরা।
কমোডোরের পার্সোনাল পিক্-আপে মালপত্রসহ ওদের সমুদ্রের ধারে নামিয়ে
দেয়া হয়েছে। নৌকার চার্জে যে গার্ডটা ছিল তাকে তুলে নিয়ে ফিরে গেছে
পিক্-আপ।
গয়না-নৌকোর সমান বহুদিনের পুরানো একটা জেলে নৌকা। এখানে-
ওখানে কাঠ দিয়ে তালি মারা। পাটাতনের নিচেই এঞ্জিনরূম। এঞ্জিনের
অবস্থাও নৌকার মতই।
নৌকার মধ্যে ওদের জন্যে পুরানো নোংরা কাপড়, খাবার, একটা
স্টোভ, রশি, রিসিভারসহ একখানা রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার, দুটো বেরেটা সাব-
মেশিনগান, দুটো মাউজার ব্রেনগান, তাছাড়া আয়না, টর্চ ইত্যাদি টুকিটাকি
জিনিস আগে থেকেই রাখা আছে। পিক্-আপ থেকে নামানো হয়েছে দুটো
বাক্স। একটায় টিএনটি, অ্যামাটোল, ডিনামাইট স্টিক, গান কটন প্রাইমার,
এমারি ডাস্ট, গ্রাউণ্ড গ−াস আর একটা জারে করে পটাশিয়াম আছে। অন্যটার
মধ্যে আছে ডিটোনেটার। পারকাশন আর ইলেকট্রিক দু’রকমই।
এঞ্জিন রূমের মধ্যে থেকে বাইরে মাথা বের করল মাহবুব। মাস্তুলটার
দিকে চেয়ে বলল, স্পাল আছে না, স্যার, সঙ্গে?’
‘আছে বোধহয়, কেন?’
‘কারণ আমি হলপ করে বলতে পারি, দরকার হবে।’
‘কেন, এঞ্জিন?’
‘ওটা ‘‘এন’’-ও নয় ‘‘জিন’’-ও নয়। ঠাকুরদার আমলের একটা টু
সিলিণ্ডার ভট্ভটি। প্রপেলার শ্যাফটের সাথে যে জায়গাটা মিশেছে ওখানে
দুই মণ রাস্ট পড়ে আছে। এ জিনিসের ওপর নির্ভর করলে আর পৌঁছতে
হবে না আমাদের।’
রানা বুঝল এই এঞ্জিন পেয়ে ভেতর ভেতর যার-পর-নাই খুশি হয়ে
উঠেছে মাহবুব। ওর কারিগরী মাথা খেলাবার সুযোগ পেয়েছে সে এইবার।
কিন্তু এ ধরনের একটা নৌকায় ওদের এত গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাঠানো হচ্ছে
বলে মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট না হয়ে পারল না সে।
ছেড়ে দিল নৌকা। সোজা এগোল ওরা দক্ষিণে। দ্বারোকা আর ওখা-র
মাঝামাঝি পাহাড়ী জায়গায় উঠবে। আধঘণ্টার মধ্যেই সামরিক পোশাক
খুলে জেলে পোশাক পরে নিল ওরা। সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হলো পাকিস্তানী
পোশাকগুলো পাথর বেঁধে। প্রকাণ্ড গোঁফে বার কয়েক তা দিয়ে পাটাতনের
ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। পালা করে রাত জাগতে হবে। প্রমে
জাগবে আলতাফ আর মাহবুব।
দুর্গম দুর্গ ৯
রানা শুয়ে পড়ল মিশ্রী খানের পাশে। এঞ্জিনের শব্দ আর সাগরের
কুলুকুলু। বাতাস নেই। নিস্তরঙ্গ আরব সাগরে ভেসে চলেছে ওরা অজানার
উদ্দেশে।
‘ওস্তাদ!’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় ডাকল মিশ্রী খান।
‘কি?’
‘আমার অবশ্য মাথা ঘামানো উচিত না, তবু জিজ্ঞেস করছি, যদি ওই
ছোকরা ক্যাপ্টেন আপনার হুকুম না শুনত, তাহলে কি করতেন আপনি?’
‘কর্নেলকে বলতাম। কর্নেল না শুনলে গুলি করে মেরে ফেলতাম
করিমকে।’
‘আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন যদি আপনার কথা না
শুনত তাহলে কি ওর কোর্ট মার্শাল হত সত্যি করে?’
‘না। আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই। এমনি ভয় দেখিয়েছিলাম।
ধমকেই কাজ হয়ে গেল- কাজেই ওসব কথা ভাবার কোনও দরকার নেই।’
ঘুমে জড়িয়ে এল রানার কথাগুলো।
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। আসলে আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই।
কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে করিমকে মেরে রেখে আসাই উচিত ছিল।
ওই ক্যাপ্টেনটার মুখের চেহারা দেখেছিলেন? আপনি দেখতে পাননি, আমি
দেখেছি। আপনি যখন ওর দিকে পেছন ফিরলেন তখন কেউ উপস্থিত না
থাকলে আপনার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করত না ও। ওর অহঙ্কার
গুঁড়ো হয়ে গেছে, ওস্তাদ। আÍম্ভরী লোকের কাছে এর চাইতে বড় অপমান
আর কিছুই নেই।’
রানার তরফ থেকে জবাব এল না কোনও। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে
পড়েছে সে। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল মিশ্রী খানও। কিন্তু মন থেকে অস্বস্তি
গেল না ওর।
ঠিক ভোর ছ’টার সময় বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। ছুটে গেল রানা এঞ্জিন রূমের
দিকে। ঘুম ভেঙে উঠে বসল আলতাফ আর মিশ্রী খান। মাহবুব ঘুমাতে
অস্বীকার করায় মিশ্রী খানকে আর ওঠানো হয়নি।
‘কি হলো, ওস্তাদ? পৌঁছে গেছি?’
জবাব দিল মাহবুব। মাথা বের করল সে এঞ্জিন রূমের ভেতর থেকে।
‘প্রায়। তিনভাগের দুই ভাগ চলে এসেছি। বাকিটা পাল টাঙিয়ে যেতে
হবে। এক্জস্ট লিক।’
‘মেরামত হবে না?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘অসম্ভব। ওয়েলডিং দরকার। হাবিজাবির মধ্যে একটা স্পেয়ার এঞ্জিন
খুঁজে পাওয়া গেছে, দেখি চেষ্টা করে লাগানো যায় কিনা।’
‘কতক্ষণ লাগবে, মাহবুব?’
.
১০ মাসুদ রানা-৬
‘ঠিক বলতে পারছি না, স্যার। আদৌ হবে কিনা তা-ও বলা যায় না।
একদম রাস্ট পড়ে আছে। আপনি পালটা ওঠাবার ব্যবস্থা করুন, আমি চার্ট
দেখে হাল অ্যাডজাস্ট করে দিয়ে লাগব এঞ্জিনের পেছনে।’
মাথার ওপর দিয়ে দুটো মিগজেট উড়ে চলে গেল। কিছুদূর গিয়ে কি
মনে করে ঘুরে এল আবার। ডাইভ দিয়ে অনেক নিচে নেমে দেখল ওদের-
তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে চলে গেল যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই।
পাল তুলে দেয়া হলো নৌকায়। বেশ ফর্সা হয়ে গেছে চারপাশ। মিশ্রী
খান নেমে গেল মাহবুবের সাথে এঞ্জিনরূমে, সাহায্য করবে বলে। বড়
সাইজের একটা মশুরির ডালের মত সূর্য উঠল পুব সমুদ্র থেকে।
দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। মন্থর গতিতে চলেছে নৌকা গন্তব্যস্থলের
দিকে। হঠাৎ পেছন দিকে চেয়েই চিৎকার করে উঠল রানা।
‘দেখেছ, আলতাফ?’
‘দেখেছি, মেজর। এখনও তিন মাইল আছে। ঘণ্টাখানেক আগে যেটা
পাশ কাটিয়ে চলে গেল, খুব সম্ভব সেটাই। ওদের টহলদারী লঞ্চ।’
‘সোজা আসছে আমাদের দিকে! মিশ্রী আর মাহবুবকে শিগগির
ডাকো।’
জরুরী বৈঠক বসল।
‘আমাদের থামিয়ে সার্চ করবে ওরা। কিছু একটা সন্দেহ করেছে
নিশ্চয়ই। কিংবা কোন সংবাদ জানতে পেরেছে, তাই ফিরে আসছে। বিপদ
আশা করবে ওরা, এবং সাবধান থাকবে। কাজেই মাঝামাঝি কোনও ব্যবস্থা
চলবে না। হয় ওরা ডুববে, নয় আমরা- এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
আমাদের অস্ত্রশস্ত্র আমরা কিছুতেই পানিতে ফেলব না। কাজেই, সার্চ করলে
সব বেরিয়ে পড়বে।’
খুব দ্রুত প−্যান ঠিক করে সবাইকে বুঝিয়ে দিল রানা। সব চাইতে
অনভিজ্ঞ মাহবুব। জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়নি সে কখনও আগে।
যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা হয়নি ওর। হঠাৎ বলে উঠল, ‘অসম্ভব! আপনি যা
করতে যাচ্ছেন সেটা মানুষ খুন। এভাবে হত্যা করবার কোনও অধিকার...’
‘খবরদার!’ চিৎকার করে উঠল মিশ্রী খান। ‘তুমি দুধের বাচ্চা, তুমি কি
বোঝ? চুপ করে থাকো।’
‘হয়েছে, মিশ্রী খান!’ তীক্ষè কণ্ঠে বলল রানা। কয়েক সেকেণ্ড তীব্র
দৃষ্টিতে ওর দিকে বিরক্তি বর্ষণ করে ফিরল মাহবুবের দিকে। ‘লেফটেন্যান্ট,
এটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধের নিয়মই হচ্ছে শত্র“পক্ষকে সমান সুযোগ না দিয়ে
কোনও না কোনও অসুবিধার মধ্যে রাখা। কারণ আমরা যদি ওদের মারতে
না পারি, ওরা আমাদের মারবে। এটা অত্যন্ত সহজ যুক্তি- হয় ওরা তলিয়ে
যাবে, নয় আমরা। আমাদের মিশনের উদ্দেশ্য হাজার হাজার পাকিস্তানী
সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা, বিশ্বের চোখে আমাদের যোগ্যতা তুলে ধরা।
দুর্গম দুর্গ ১১
এখন এই মুহূর্তে বিবেকের প্রশড়বই ওঠে না।’
মাথা নিচু করে রইল মাহবুব। রানার যুক্তির অকাট্যতা হƒদয়ঙ্গম করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যে হত্যাকাণ্ড ওর নিজ চোখে দেখতে হবে সেটা কল্পনা
করে শিউরে উঠল একবার। বুঝল, রানাকে বিচার করবার ক্ষমতা এখনও
হয়নি ওর। বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, মেজর। ক্যাপ্টেন খান ঠিকই
বলেছেন, আপনাদের তুলনায় আমি দুধের বাচ্চা ছাড়া কিছুই নই। আমার
চুপ করে থাকাই উচিত।’ একবার ফিরে চাইল সে মোটর লঞ্চটার দিকে।
‘আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন, স্যার।’
‘বেশ, বেশ,’ মৃদু হাসল রানা মাহবুবের দিকে চেয়ে। ‘তোমার ওপর
নির্ভর করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেইআলতাফ
আর তুমি ছাড়া কচ্ছ ভাষা আর কেউ জানে না। কিন্তু সেজন্যে
নয়। আমাদের এই ছোট্ট গ্র“পের প্রত্যেকের ওপর প্রত্যেকে নিশ্চিন্তে নির্ভর
করতে না পারলে সাফল্য আসবে না। মিশ্রী খান, জিনিসটা রেডি করো।
স্বাভাবিক, সহজভাবে চলাফেরা করবে। ওদের দূরবীন এখন পরিষ্কার
দেখতে পাচ্ছে আমাদের।’
সামনের দিকে হেঁটে চলে এল রানা। আলতাফ এল পিছু পিছু। এঞ্জিন
সারতে বসল মাহবুব। মিশ্রী খান ব্যস্ত হয়ে পড়ল একটা বিশ্রী কাজে।
লঞ্চটা যখন ছয়ফুট দূরে এসে পড়ল তখন পাটাতনে বসে একটা ছেঁড়া
চাদর কোলের ওপর বিছিয়ে সেলাই করছে রানা। জনা ছয়েক ভারতীয়
ন্যাভাল অফিসার দেখা গেল রেলিং-এর ধারে। তিনজনের হাতে অটোমেটিক
কারবাইন, দু’জনের হাতে রিভলভার। একধারে ট্রাইপডের ওপর বসানো
একটা মেশিনগান চেয়ে আছে ওদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। হুইল-হাউস থেকে
মাথা বের করল অল্প বয়সী এক লেফটেন্যান্ট। দুই হাত মুখের কাছে তুলে
চিৎকার করে বলল, স্পাল নামাও।’
মনেমনে চম্কে উঠল রানা। হিম হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। কথাটা
পশতু ভাষায় বলেছে লেফটেন্যান্ট। মাহবুব একে ছেলেমানুষ, তার ওপর
অনভিজ্ঞ। ঠিক ধরা পড়ে যাবে। রানা পরিষ্কার বুঝল, এই প্রম কথাতেই
ধরা পড়ে যাবে ওরা।
কিন্তু মাহবুব এই ফাঁদে পা দিল না। মাথাটা কাত করে কানের কাছে
হাত তুলে হাঁ করে কিছু শুনবার চেষ্টা করল। ঠিক মাথা মোটা জেলেদের
চমৎকার অনুকরণ। কথাটা যেন বুঝতেই পারেনি এমন ভাবে কচ্ছ ভাষায়
জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলছেন গো?’
স্পাল নামাও। তোমাদের নৌকা সার্চ করব।’ রানা লক্ষ করল এবারেও
পশতু ব্যবহার করছে লেফটেন্যান্ট।
বোকার মত চেয়ে রইল মাহবুব ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ, তারপর রানা
এবং আলতাফের দিকে চাইল অসহায় দৃষ্টিতে। ওদের চেহারা দেখেও বোঝা
.
১২ মাসুদ রানা-৬
গেল একটি বর্ণও বুঝতে পারেনি ওরা। হতাশ ভাবে দুই হাতের তালু চিৎ
করল সে।
‘মাদ্রাজী ভাষা আমরা বুঝি না,’ চিৎকার করে বলল সে। ‘কচ্ছের ভাষা
বলতে পারেন না?’
এক বিশেষ ধরনের মুখভঙ্গি করল লেফটেন্যান্ট। ভাঙা-ভাঙা কচ্ছ
ভাষায় বলল, ‘এক্ষুণি নৌকা থামাও, আমরা সার্চ করব।’
‘কি? নৌকা থামাব? কেন নৌকা থামাব, কিসের সার্চ? আমরা চোর, না
ডাকাত? লাইসেন্স আছে আমাদের...’ খেপে উঠল যেন মাহবুব। হাত-পা
ছুঁড়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তীক্ষè কণ্ঠে বাধা দিল লেফটেন্যান্ট।
‘দশ সেকেণ্ড সময় দিলাম। তারপর গুলি করব।’
আহত-পরাজিত মাহবুবের মুখের চেহারা। তিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘নামাও
পাল।’
পাল নামিয়ে ফেলল আলতাফ। নামিয়ে বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে
রইল। খালি দুই হাত ঝুলছে দেহের দুই পাশে। রানাও সেলাই বন্ধ করে
বিরক্ত মুখে চেয়ে রইল লঞ্চের অফিসারদের দিকে। ডিজেল এঞ্জিনের শব্দটা
একটু গভীর হলো। কাছে সরে এসে নৌকার গায়ে গা ঠেকাল লঞ্চটা।
রিভলভার আর অটোমেটিক কারবাইন হাতে নেমে এল তিনজন
অফিসার মেশিনগানের লাইন অফ ফায়ার থেকে গা বাঁচিয়ে। ঝট করে প্রম
জন সরে এল মাস্তুলের কাছে। ঘুরে দাঁড়িয়েই রানা ছাড়া বাকি সবাইকে
কন্ট্রোলে রাখার জন্যে রিভলভারের মুখটা বুলিয়ে নিল ওদের ওপর। রানাকে
লঞ্চের স্প্যানডাও মেশিনগানটার হাতেই ছেড়ে দিল সে।
মাথা ঘুরিয়ে নির্বোধ দৃষ্টিতে চারদিকে চাইল রানা। মাহবুব ডেকের
ওপর সাইলেন্সার মেরামতের কাজে লেগেছে। মিশ্রী খান ওর থেকে দেড়
গজ দূরে কাতানি দিয়ে একটা টিন কাটছে মনোযোগের সঙ্গে- মেরামতের
কাজে লাগবে। রানা লক্ষ করল কাতানিটা বাম হাতে ধরেছে মিশ্রী খান।
অর্থাৎ, ডান হাতটা মুক্ত আছে রানার আদেশের অপেক্ষায়। আলতাফ তেমনি
দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত। মাস্তুলের কাছে দাঁড়ানো লোকটা নি®পলক
চোখে চেয়ে রয়েছে সবার দিকে। বাকি দুজন ধীর পায়ে হেঁটে আলতাফের
পাশ দিয়ে যাচ্ছে, কারবাইন দুটো ঢিল করে ধরা। সমস্ত নৌকাটা যে ওদের
আয়ত্তে এসে গেছে, তাতে ওদের কোন সন্দেহ নেই। গোলমালের কথা
ভাবাও এখন হাস্যকর।
ঠিক এই সময় চাদরের তলা থেকে ঠাণ্ডা মাথায় সযতেড়ব প্রম গুলিটা
করল রানা। সোজা গুলি গিয়ে লাগল স্প্যানডাও মেশিনগানারের হƒৎপিণ্ডে।
পর মুহূর্তে ঢলে পড়ল মাস্তুলের পাশে দাঁড়ানো অফিসারটা রানার দ্বিতীয়
গুলিতে। অফিসারটা ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়বার আগেই তিনটে জিনিস
ঘটল একই সঙ্গে। ঝট্ করে বল-সাইলেন্সারের পাশে লুকানো মিশ্রী খানের
দুর্গম দুর্গ ১৩
পিস্তলটা তুলেই পরপর চারটে গুলি করল মাহবুব। কাতানি দিয়ে থ্রী-সেকেণ্ড
কেমিক্যাল ফিউজটা একটু কুঁকড়ে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সেটা মিশ্রী খান পাশে
দাঁড়ানো লঞ্চের এঞ্জিনরূমের ভেতর। আর সঙ্গে সঙ্গে আলতাফের দুটো
গরিলা সদৃশ প্রকাণ্ড হাত ওর পাশের দু’জন অফিসারের মাথা দুটো ভয়ঙ্কর
জোরে ঠুকে দিল। ঠাস্ করে দুটো খোসা ছাড়ানো নারকেলে বাড়ি লাগল
যেন। পরমুহূর্তে চারজনেই ওরা শুয়ে পড়ল পাটাতনের ওপর।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে ধোঁয়া আর আগুনের হল্কা উঠল
আকাশের দিকে। ভারতীয় টহলদারী লঞ্চের একটা রেলিং মাথার ওপর দিয়ে
উড়ে গিয়ে পড়ল দশগজ তফাতে। জোর ঝাঁকুনি খেল নৌকাটা। ধাক্কা খেয়ে
কিছুটা সরে এল জ্বলন্ত লঞ্চ থেকে। তারপর সব চুপ।
কানে তালা লেগে গেছে রানার। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সে
পাটাতনের ওপর। ডুবে যাচ্ছে লঞ্চটা। মিশ্রী খানের বোমায় এঞ্জিনরূমের
তলা নিশ্চয়ই খসে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে লঞ্চ। শুকনো কাঠ জ্বলছে,
তাই ধোঁয়াও নেই, আর ধোঁয়া দেখে অনুসন্ধিৎসু পে−নের আশঙ্কাও নেই।
আধ মিনিটেই চলে যাবে লঞ্চটা পানির তলায়। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল রানার
একজন লোকের ওপর। ছুরির মত কোনও লোহার পাত লেগে চিরে গেছে
পেটটা। নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে ডেকের ওপর। বেঁচে আছে এখনও।
এক হাতে পেট চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে আগুন থেকে সরে আসতে চাইছে
সে। বীভৎস সে দৃশ্য। চোখে-মুখে তার মৃত্যুর আতঙ্ক। ভাঙা-চোরা ডেকের
ওপর উঠে এল পানি। দপ্ করে নিভে গেল আগুন। ধীরে ধীরে ডুবে গেল
লঞ্চটা। খানিকটা সাদা ফেনা আর তৈলাক্ত বুদ্বুদ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল
না। শান্ত আরব সাগরে মৃদু হাওয়া- চারদিক নিস্তব্ধ। একটা উল্টানো
হেলমেট ভেসে যাচ্ছিল, ডুবিয়ে দিল রানা সেটাকে। চিহ্নমাত্র রইল না আর
এতবড় লঞ্চটার।
নিজেদের নৌকার দিকে ফিরল এবার রানা। প্রকাণ্ড দেহী আলতাফ
আর বাচাল মিশ্রী খান উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহবুবও উঠে বসবার চেষ্টা করছে।
ওর জুলফির কাছে একটা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। মিশ্রী খান এগিয়ে গেল
সবচেয়ে আগে। ক্ষতটা পরীক্ষা করে ডাক্তারী চালে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি।
সামান্য বাড়ি লেগেছে কাঠের টুকরোর।’ ইমার্জেন্সী মেডিকেল কিট খুলে
ডেটল দিয়ে ধুয়ে জায়গাটায় সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল সে।
আলতাফ ব্রোহী বিষণড়ব মুখে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। ওর পায়ের কাছে
পড়ে আছে কারবাইন-ধারী অফিসার দুজন। ওর দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওর
মানসিক অবস্থাটা।
‘শেষ?’ জিজ্ঞেস করল সে মৃদুকণ্ঠে।
মাথা নাড়ল আলতাফ ব্রোহী।
‘হ্যাঁ! অতিরিক্ত জোরে মেরেছিলাম।’ ভারি শোনায় ওর কণ্ঠস্বর।

১৪ মাসুদ রানা-৬
রানা জানে বহু লোক প্রাণ দিয়েছে আলতাফ ব্রোহীর হাতে। যখনই সে
মেরেছে; দক্ষ হাতে নির্দয়ভাবে মেরেছে। কিন্তু প্রতিবারই অনুশোচনায়
নিজেকেও সেই সাথে দগ্ধে মেরেছে। ওর ধারণা কারও প্রাণ নেবার তার
কোনও অধিকার নেই। খোদা এভাবে অপঘাতে মরবার জন্যে প্রাণ সৃষ্টি
করেননি। কিন্তু বেশি লোকের বেশির ভাগ ভাল-র জন্যে অসংখ্য প্রাণ শিখা
নিজ হাতে নিভিয়ে দিতে হয়েছে ওকে। প্রতিবারই বিবেক দংশন করেছে
ওকে- প্রতিবারই ওর মনে হয়েছে, হয়তো অন্য কোনও উপায় ছিল, হয়তো
এদের মৃত্যুর সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবারই ওকে অনেক
যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে হয়েছে যে সে হত্যা করেছে
প্রতিশোধের জন্যে নয়, ঘৃণার জন্যে নয়, জাতীয়তাবাদ কিংবা ‘ইজম্’ তো
নয়ই- অন্যায়কে দমন করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্যে।
‘আর কারও কিছু লাগেনি তো? মিশ্রী?’
‘না, ওস্তাদ।’
‘বেশ। আলতাফ, পাল তুলে দাও। নয়টা বাজতে যাচ্ছে। সিগন্যালের
সময় হয়ে গেছে। মাহবুব হাল অ্যাডজাস্ট করে করাচি টিউন করবার চেষ্টা
করে দেখো।’ আকাশের দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘ওদের ফোরকাস্টটাও
শোনা দরকার। এখন আপাতত যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যাওয়া
যায় ততই মঙ্গল।’
রেডিও রিসিপশন ভাল হলো না। মাঝে মাঝে ঘর্ড়-র্ঘ করে বিকট
শব্দ হচ্ছে। পশ্চিম আকাশের খানিকটা জায়গা কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে।
মাহবুব বলল ওর মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তাই এই আওয়াজটা। আওয়াজটা
একবার বেড়ে যাচ্ছে, একবার কমে যাচ্ছে।
‘স্যামসন কলিং ডেলায়লা।’ করাচি আর কম্যাণ্ডো গ্র“পের কোড। ‘ক্যান
ইউ হিয়ার মি লাউড অ্যাণ্ড ক্লিয়ার?’
মাহবুব হাঁ-বাচক টোকা দিল।
‘স্যামসন কলিং ডেলায়লা। এনি ট্রাবল্?’
আবার হাঁ-বাচক টোকা।
‘এঞ্জিন ট্রাবল্?’
আবার টোকা।
‘এনিমি ট্রাবল্?’
রানার দিকে চাইল মাহবুব। রানা মাথা নাড়তেই আবার হাঁ-বাচক
টোকা দিল মাহবুব। রানা স্পষ্ট মানসচক্ষে দেখতে পেল কমোডোরের
কুঞ্চিত ভ্র, উদ্বিগ্ন চেহারা।
‘অল ক্লিয়ার নাউ?’
আবার টোকা।
‘নাউ ওয়েদার ফোরকাস্ট ফর ডেলায়লা। হেভি রেনফল
দুর্গম দুর্গ ১৫
অ্যাসোশিয়েটেড উইথ থাণ্ডার অ্যাণ্ড স্টর্ম এক্সপেক্টেড বিফোর নূন।
টেম্পারেচার ফলিং, ভিজিবিলিটি পুওর। ডেঞ্জার সিগন্যাল- এইট।’
ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে মিশ্রী খানের মুখ। এই ভয়ই সে
করেছিল। সাঁতার জানে না সে। জানলেও কোন লাভ হত না, কিন্তু কিছুক্ষণ
তো অন্তত ভেসে থাকা যেত। বেশ খানিকটা উঠে এসেছে পশ্চিমের মেঘ।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই চুকে যাবে সব লীলা খেলা।
রানাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। উঠে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল মাহবুবের ম্যাপের
ওপর। ছ’মাইল দূরে আছে একটা ছোট্ট দ্বীপ। ঝড়ের আগে গিয়ে পৌঁছতে
পারবে সেখানে? চোখ তুলেই দেখল মাহবুব বুঝতে পেরেছে ওর মনের
কথা। বলল, ‘বৈঠা চালালে অসম্ভব না-ও হতে পারে, স্যার।’
‘ঠিক বলেছ। তুমি এঞ্জিনটার পেছনে লাগো। আমরা শেষ চেষ্টা করে
দেখি।’
‘কিন্তু ওই দ্বীপটায় ভারতীয় সৈন্য থাকার সম্ভাবনা আছে।’
‘জানি। কিন্তু ডুবে মরার চেয়ে বন্দী হওয়া ভাল। যাও, কুইক।’
আধঘণ্টা পরই তুমুল জোরে বৃষ্টি নেমে গেল। চারদিক অন্ধকার হয়ে
এসেছে। তীরের মত বৃষ্টির ফোঁটা এসে বিঁধছে তিনজনের চোখে-মুখে।
হাওয়ার বেগ বাড়ছে μমেই। অক্লান্ত ভাবে বৈঠা চালাচ্ছে তিনজন।
এঞ্জিনের কাজ ছেড়ে হাল ধরে বসেছে মাহবুব। হঠাৎ উল−সিত কণ্ঠে চিৎকার
করে উঠল মাহবুব।
‘এসে গেছি!’
তিন
সন্ধ্যা নামার আধঘণ্টা আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। সারা আকাশ
মেঘে ঢাকা। অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না রানা।
ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে নৌকাটা। এখান-ওখান থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে
নড়বড়ে অংশগুলো ঢেউ আর বাতাসের অবিরাম ধাক্কায়। সামনের গলুই আর
মাস্তুলের কাঠ ভেঙে পড়ে গেছে একঘণ্টা আগেই। এখন যে-কোনও মুহূর্তে
মড়মড় করে খসে যাবে তলিটা।
ঠিক দুটোর সময় দ্বীপটা ছেড়ে রওনা হতে হয়েছে ওদের। ঝড়ের বেগ
কমে গেলেও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ শান্ত হতে অনেক দেরি আছে, কিন্তু
পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল ওরা, আট-দশজন সৈনিক এগিয়ে আসছে ওদের
দিকে। নিশ্চিত কোনও সংবাদ পেয়ে আসছে, না এটা রুটিন চেক বুঝবার
উপায় নেই। এক সেট নকল কাগজপত্র আছে ওদের কাছে, কাপড়-চোপড়ও
.
১৬ মাসুদ রানা-৬
বদলে খাঁটি ভারতীয় নাগরিক হয়ে গেছে ওরা- কিন্তু ঝুঁকিটা নিল না রানা।
উত্তাল তরঙ্গে ভাসিয়ে দিল নৌকা নোঙর তুলে। বিশ মিনিটের মধ্যেই ঠিক
হয়ে গেল এঞ্জিন। চালু করে দিয়ে হাল ধরে বসল মাহবুব। বিশ গজ দূরেও
কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাই কম্পাস আর চার্টের ওপর ছুটাছুটি করতে থাকল
ওর চোখ জোড়া। এমনি সময় মাস্তুলটা ভেঙে পড়ল ওর ওপর। বাম কাঁধে
ভয়ানক চোট পেয়েছে সে। কিন্তু হাল থেকে নড়ানো গেল না ওকে।
গত চারটি ঘণ্টার ইতিহাস প্রকৃতির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কয়েকটি
দুর্ধর্ষ মানুষের একটানা অবিরাম যুদ্ধের ইতিহাস।
পিঠটা সোজা করে দাঁড়াল রানা। কাঁধের পেশী অবশ হয়ে গেছে,
মেরুদণ্ডে অসম্ভব ব্যথা। গত দুই ঘণ্টা ধরে সে কেবল একবার বাঁকা হচ্ছে,
একবার সোজা হচ্ছে। কয়েক হাজার গ্যালন পানি তুলেছে মিশ্রী খান নিচ
থেকে বালতি করে, ঝুঁকে সে বালতি ধরে রানাকে ফেলতে হয়েছে পানি।
পানি উঠছে নৌকায়। আলতাফের হ্যাণ্ড পাম্পে ঠেকানো যাচ্ছে না, তাই
নৌকার নিচে নামতে হয়েছে মিশ্রী খানকে। সী-সিক্নেস সহ্য করতে না
পেরে অনর্গল বমি করছে বেচারা মিশ্রী খান, তাই নিয়ে অক্লান্তভাবে বালতির
পর বালতি পানি তুলে যাচ্ছে সে। রানা ভাবল, আশ্চর্য মনের বল না থাকলে
কি আর এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ওকে বাছাই করা হয়েছে? সমস্ত
মানসিক শক্তি একত্রীভূত করে ভূতের মত খেটে চলেছে সে। ঘণ্টার পর
ঘণ্টা।
এক হাতে চোখ মুছল রানা। দেখল পাগলের মত পাম্প করে চলেছে
আলতাফ ব্রোহী। কোনদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই, হাত দুটো ঠিক এঞ্জিনের
পিস্টনের মত উঠছে-নামছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। কেবল উঠছে আর
নামছে। বিশ মিনিট করেই পরিশ্রান্ত রানা আলতাফের হাতে দিয়েছিল
পাম্পটা। সেই থেকে এক নাগাড়ে পাম্প করে যাচ্ছে আলতাফ, যেন কিছুই
হয়নি। ক্লান্তি নেই। শ্রান্তি নেই। মৃদু হাসল রানা। একটা কথাই কেবল মনে
হলোগু ইনডেস্ট্রাকটিব্ল্!
মাহবুবের দিকে ফিরে চাইল রানা। ফুলে আছে কপালটা। মাস্তুলটা
প্রমে কপালে বাড়ি লেগে তারপর কাঁধের ওপর পড়েছিল। স্থির হাতে হাল
ধরে আছে সে। একবার কম্পাস দেখছে, পরমুহূর্তেই চোখ যাচ্ছে ওর চার্টের
দিকে। মাঝে মাঝে নেমে গিয়ে পরীক্ষা করছে এঞ্জিন। এখন একমাত্র ভরসা
জং ধরা ওই এঞ্জিনটাই। ওটা বন্ধ হলেই সব শেষ। আর কোন আশা থাকবে
না।
আবার বালতি উঠল ওপরে। ঝপাৎ করে ফেলল রানা পানিটুকু, আবার
নামিয়ে দিল সেটা গর্ত দিয়ে। গর্ব হলো ওর। কি আশ্চর্য সব দুঃসাহসী
লোক জুটেছে এখানে! নিজেকে এদের নেতা ভাবতে সত্যিই গর্ব বোধ করল
রানা। এদেরকে ঠিক মত বর্ণনা করবার ভাষা নেই। এরা দেশের গৌরব।
দুর্গম দুর্গ ১৭
পৃথিবীর গৌরব।
হঠাৎ একটা মস্ত ঢেউ লেগে দুলে উঠল নৌকাটা ভয়ানক ভাবে।
কোনও মতে টাল সামলে নিল রানা। পাটাতনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল
একরাশ পানি। চারদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আরেক
বালতি পানি উঠাল মিশ্রী খান। কিন্তু রানা সেটা ধরল না। রানার মাথায়
তখন দ্রুত চিন্তা চলছে। কিছু একটা স্মরণ করবার চেষ্টা করছে সে। অত্যন্ত
জরুরী কোন কথা। কিন্তু মনে আসছে না সেটা কিছুতেই। এবার আগের
চেয়েও বড় আরেকটা ঢেউ এসে বয়ে গেল ডেকের ওপর দিয়ে। হঠাৎ
বুঝতে পারল রানা ব্যাপারটা। তীর থেকে পনেরো গজ দূরেও নেই ওরা
এখন।
‘মাহবুব, জলদি ব্যাক গিয়ার দাও! নইলে এখুনি পারে গিয়ে ধাক্কা
খাবে!’
বিদ্যুৎ চমকে উঠল একবার। উঁচু পাড় দেখা গেল পরিষ্কার। আলতাফ
গিয়ে হাল ধরেছে, মিশ্রী খান উঠে এসে নৌকার একপাশে পুরানো
একজোড়া ট্রাকের টায়ার বেঁধে দিল, প্রম ধাক্কাতেই যেন নৌকাটা গুঁড়িয়ে
না যায়। বাতাসের ঠেলায় এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা- মাহবুব চেষ্টা করছে
গতিরোধ করবার।
আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুতের আলো। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু পাড়, কিন্তু
আট-দশ ফুট উঁচুতে সিঁড়ির মত একটা তিন ফুট চওড়া তাক আছে। হুক
লাগানো একটা রশি গলায় পেঁচিয়ে নিল রানা। প্রমবার নৌকাটা পারের
পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেতেই লাফিয়ে ধরল রানা আট ফুট উঁচু ধাপের
কিনারা। কিন্তু পিচ্ছিল পাথরে হাত পিছলে নেমে আসছে সে নিচে। আঁকড়ে
ধরে থাকতে পারছে না। এখন পড়ে গেলে নৌকা আর পাড়ের মাঝখানে
চাপ খেয়ে চেপ্টা হয়ে যাবে। এমনি সময় নিচ থেকে আলতাফের হাতের
এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে অর্ধেক শরীর উঠে এল রানার ওপরে। বেল্টের সাথে
বেধে গেল একটা চোখা পাথর। প্যান্টটা বুকের কাছে উঠে এসেছে দেহের
ভারে। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে চারদিকে দেখল রানা ঝুলন্ত অবস্থায়।
কব্জির সমান মোটা একটা শিকড় বাধল হাতে। তিন সেকেণ্ডের মধ্যে উঠে
দাঁড়াল সে প্রম ধাপের ওপর। রশিটা শক্ত করে শিকড়ের সাথে বেঁধে
ঝুলিয়ে দিল নিচে। একটা হুড লাগানো টর্চ জ্বেলে ধরল।
ঢেউগুলো তুলে এনে একবার আছড়ে ফেলছে নৌকাটাকে পারের ওপর,
আবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাত পেছনে। মাহবুব এঞ্জিনটা একবার
সামনে একবার পেছনে চালিয়ে স্থির রাখবার চেষ্টা করছে নৌকা। কিন্তু
ইতিমধ্যেই চুর চুর হয়ে ভেঙে যাবার উপμম হয়েছে নৌকাটা। আলতাফ
আর মিশ্রী খান দাঁড়িয়ে আছে কোনও রকমে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে।
ডুবে যাচ্ছে নৌকা।
.
১৮ মাসুদ রানা-৬
‘রশি বেয়ে উঠে এসো সবাই। মাহবুবকে ডাকো, আলতাফ!’ চিৎকার
করে উঠল রানা।
রানা দেখল আলতাফ আর মিশ্রী খান নিচু গলায় কিছু বলল নিজেদের
মধ্যে। ছুটে গিয়ে মাহবুবকে টেনে বের করল আলতাফ এঞ্জিনরূম থেকে।
কিছু বলবার আগেই ওর হাতে রশি ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে রওনা করিয়ে দিল
ওকে ওপর দিকে। রানা একহাতে ধরে ফেলল মাহবুবের হাত, টেনে তুলল
ওপরে।
‘এবার তুমি, মিশ্রী খান,’ আবার বলল রানা। ‘জলদি করো, ডুবে যাবে
নৌকা।’
রানা দেখল মিশ্রী খান হাসছে ওর দিকে চেয়ে। রশির দিকে ভ্রƒক্ষেপ না
করে ছুটল সে তিরপল ঢাকা ছাপড়ার দিকে।
বলল, ‘এক মিনিট, ওস্তাদ, আমার জর্দার কৌটোর কথা ভুলে
গিয়েছিলাম।’
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ফিরে এল সে এক্সপে−াসিভের বাক্স নিয়ে।
আলতাফের হাতে বাক্সটা দিয়েই ছুটল সে ছাপড়ার দিকে। প্রায় আধমণ
পাউডার ভর্তি বাক্সটা ছুঁড়ে দিল আলতাফ ওপরে। ধরে ফেলল রানা,
ব্যালান্স হারিয়ে ফেলছিল, পিঠের কাছে জামা ধরে টেনে সোজা করে দিল
মাহবুব।
‘এই সব জঞ্জাল রাখো তো!’ ধমকে উঠল রানা। ‘নিজেরা উঠে এসো
ওপরে। এক্ষুণি।’
দমাদম ছুঁড়তে থাকল ওরা নিচ থেকে সমস্ত জিনিসপত্র। খাবার,
কাপড়, অস্ত্রশস্ত্র। মাহবুব সেগুলো গুছিয়ে রাখছে।
‘শুনতে পাচ্ছ না তোমরা আমার কথা?’ গর্জে উঠল রানা। ‘এই মুহূর্তে
ওপরে উঠে এসো বলছি! এটা আমার অর্ডার। আরে, নৌকাটা ডুবে যাচ্ছে
যে, গর্দভ কোথাকার!’
নৌকাটা ডুবছে সত্যিই, কিন্তু পেটটা পানি ভরে ঢোল হয়ে যাওয়াতে
ঢেউয়ের ধাক্কা খুব বেশি আর দোলাতে পারছে না ওকে। পারের সাথে
ধাক্কাও লাগছে অপেক্ষাকৃত আস্তে। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল মিশ্রী
আর আলতাফ।
‘আপনার একটা কথাও শুনতে পাচ্ছি না, ওস্তাদ।’ এক হাত কানে তুলে
না শোনার ভান করল মিশ্রী খান। ‘তাছাড়া ডুবতে এখনও দেরি আছে।’
এক দৌড়ে অদৃশ্য হলো সে আবার তিরপলের নিচে।
এক মিনিটের মধ্যে বাকি জিনিসপত্র উঠে এল ওপরে। মিশ্রী খান যখন
ওপরে উঠে এল তখন ডেকের ওপর উঠে হুড়মুড় করে ঢুকছে পানি এঞ্জিন
রূমের মধ্যে। সামনের দিকটা অদৃশ্য হয়েছে পানির তলায়। এবার পেছন
দিকটাও গেল তলিয়ে। আলতাফ যখন রশি ধরল তখন নৌকার চিহ্নমাত্র
দুর্গম দুর্গ ১৯
নেই, এক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। উঠে এল আলতাফও।
সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, যে নৌকায় করে গত চব্বিশ ঘণ্টায়
একশো পঁয়ত্রিশ মাইল এল ওরা, ডিউটি শেষ হতেই তলিয়ে গেছে সেটা।
ভোজ-বাজির মত অলৌকিক মনে হচ্ছে এখন ওটার অস্তিত্ব। যেন ঠিক উবে
গেছে- একটা বুদ্বুদও নেই ওটার অস্তিত্ব প্রমাণ করবার জন্যে।
পা ছড়িয়ে পাথরের ওপর বসে পড়ল মিশ্রী খান। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে না
গায়ে। ভেতরের পকেট থেকে কিং স্টর্কের প্যাকেট বের করে সবাইকে
একটা করে দান করল সে। বুক ভর্তি করে একরাশ কড়া ধোঁয়া নিয়ে পরম
তৃপ্তির সাথে ছাড়ল নাক-মুখ দিয়ে। তারপর বলে উঠল, ‘ইয়া আল−া! সত্যিই
বেঁচে আছি এখনও!’
চার
‘আমি আর আলতাফ আগে উঠে যাব ওপরে। জিনিসপত্র ওপরে তোলা হয়ে
গেলে তোমরা দু’জন আসবে।’ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল
রানা।
মস্ত বড় কোনও গাছের অসংখ্য শিকড় বেরিয়ে আছে বিশ ফুট প্রায়
খাড়া হয়ে থাকা পাহাড়টার গা থেকে। দড়িটা কয়েকবার ছুঁড়ে দিয়েও যখন
কোনও কিছুর সঙ্গে বাধাতে পারল না, তখন এই শিকড় বেয়ে ওঠাই স্থির
করল রানা। যে-কোনও মুহূর্তে শিকড় ছিঁড়ে পাথরের ওপর পড়ে হাড়গোড়
ভাঙবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কি।
হাত ছাড়া আর কিছুর সাহায্য নিতে পারছে না ওরা। পা রাখার কোনও
জায়গা নেই। অনেকটা রশি বেয়ে ওঠার মত। একটা করে শক্ত মত শিকড়
ধরছে, টেনে দেখছে ছিঁড়ে যাবে কিনা, তারপর এক হাতের ওপর ভর দিয়ে
উঠছে ছয় ইঞ্চি, অপর হাত খুঁজছে আরেকটা শিকড়। অতি সাবধানে
এইভাবে একফুট-দুইফুট করে উঠে যাচ্ছে ওরা ওপরে। সাত মিনিটের
মধ্যেই দুই হাত ব্যথা হয়ে গেল রানার। বাইসেপের পেশী দুটো কাঁপছে
থর-থর করে। হাতে আর শক্তি নেই। দুই হাতে শিকড় ধরে ঝুলে থাকল সে
কিছুক্ষণ। আরও পাঁচ ফুট উঠতে হবে। হাঁপাচ্ছে রানা। হƒৎপিণ্ডটা ফেটে
বেরিয়ে আসতে চাইছে বুকের ভেতর থেকে। মাথাটা কাৎ করে দেখল,
আলতাফ হাসছে ওর দিকে চেয়ে।
.
২০ মাসুদ রানা-৬
‘আলতাফ!’ ফিস্ ফিস্ করে বলল রানা, ‘বাকিটুকু খুব সাবধানে উঠতে
হবে। কিসের যেন শব্দ পেলাম!’
মাথা ঝাঁকাল আলতাফ। আবার উঠতে থাকল ওরা। দুই মিনিট পর
দুই হাতে ধরল রানা কিনারের একটা পাথর।
ধীরে, অত্যন্ত সাবধানে মাথাটা উঁচু করল রানা। চোখ জোড়া ওপরে
উঠতেই থেমে গেল সে। চারদিকের অন্ধকারে একবার চোখ বুলাল। প্রকাণ্ড
একটা বট গাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে। এই বটেরই
শিকড় ধরে উঠেছে ওরা। তীক্ষè দৃষ্টিতে চাইল সে চারদিকে। সমস্ত অনুভূতি
শ্রবণেন্দ্রিয়ে একত্রীভূত করবার চেষ্টা করল। নাহ্, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।
বাতাসের শন্শন্ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনাও যাচ্ছে না। যতদূর দেখা
যাচ্ছে অন্ধকার আর অন্ধকার। কোথাও একটু বেশি গাঢ়, কোথাও হালকা।
নিজের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে হাসি পেল রানার। এই মুহূর্তে কেউ
যদি লাথি মেরে ওর আঙুলগুলো সরিয়ে দেয় তাহলেও কিছু করবার উপায়
নেই ওর। এক ঝাঁকিতে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বুক পর্যন্ত উঠে এল সে
ওপরে।
হঠাৎ চমকে উঠল রানা। লাফিয়ে উঠল ওর হƒৎপিণ্ড। বেশ কিছুটা দূরে
বড় বড় গোটা কয়েক পাথরের চাঁই পড়ে ছিল- একটা পাথর নড়ে উঠল।
উঠে দাঁড়াল একজন লোক। দশ গজও হবে না। এগিয়ে আসছে ছায়ামূ
র্তিটা এদিকে। এই অন্ধকারেও পরিষ্কার চিনতে পারল রানা- আর্মি গার্ড।
গায়ে রেইনকোট, পায়ে গাম বুট, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ। সেনা বাহিনীর
লোক- ভুল নেই তাতে।
দুই সেকেণ্ড পাথরের মত নিশ্চল হয়ে রইল রানা। বুকের রক্ত হিম হয়ে
জমে গেছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে আর। এইভাবে মৃত্যুই তাহলে
কপালে লেখা ছিল! কয়েক পা এগিয়ে এসেছে সেন্ট্রি। রাইফেল প্রস্তুত।
মাথাটা একপাশে সরিয়ে কিছু শুনবার চেষ্টা করছে যেন সে। বাতাসের সাঁই
সাঁই শব্দ আর সমুদ্র তরঙ্গের উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে আরও কিছু যেন শুনবার
চেষ্টা করছে সে।
রানা সামলে নিয়েছে নিজেকে। এখন ওপরে উঠবার চেষ্টা করা
আÍহত্যারই সামিল। কিছুটা শব্দ হবেই, এবং বিনা দ্বিধায় গুলি করবে প্রহরী।
আবার নিচে নামতে হবে তাকে। অত্যন্ত সাবধানে নামতে হবে। এক ইঞ্চি
দুই ইঞ্চি করে। দ্রুত কিছু করতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে ওর চোখে।
অতি যতেড়বর সঙ্গে ধীরে ধীরে মাথাটা নামাল রানা নিচে। প্রহরীটা
এগিয়ে আসছে। রানার গজ পাঁচেক ডাইনে ওর লক্ষ্যবিন্দু। মাথাটা অদৃশ্য
হয়ে গেল রানার। দুই হাতের আটটা আঙুল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না
ওপরে। আলতাফ দুই ফুট নিচে থাকতে আর শিকড় পায়নি হাতের কাছে।
কিছুটা নেমে আবার উঠল সে রানার পাশে। কানে কানে জিজ্ঞেস করল, ‘কি
দুর্গম দুর্গ ২১
ব্যাপার, রানা?’
‘সেন্ট্রি!’ ফিস ফিস করে জবাব দিল রানা। ‘ও কিছু শুনেছে। খুঁজছে
আমাদের।’
হঠাৎ দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল রানা। আলতাফও তাই করল। ঝলসে
উঠল এক ঝলক আলো। ওদের অনভ্যস্ত চোখ আঁধার হয়ে গেল। টর্চ জ্বেলে
সেন্ট্রিটা এবার পাড়টা পরীক্ষা করছে মনোযোগের সাথে। কিনার থেকে
কয়েক ফুট দূর দিয়ে হাঁটছে সে। এই ঝড়ের রাতে পা পিছলে নিচে পড়ে
যাওয়ার ভয়েই বোধহয়। কিংবা কিনার দিয়ে হাঁটলে হঠাৎ একটা হাত
এগিয়ে এসে খপ করে পা ধরে টেনে ফেলে দিতে পারে নিচে, সেই ভয়ে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আলোটা। রানা বুঝল ওর আঙুলগুলো
সেন্ট্রি দেখতে পাবেই। কারণ সে পরিষ্কার উপলব্ধি করল, কেবল
সন্দেহপ্রবণ হয়েই যে লোকটা খুঁজছে তা নয়, লোকটা স্থির নিশ্চিত যে কিছু
না কিছু সে দেখতে পাবেই। এবং যতক্ষণ খুঁজে না পাচ্ছে ততক্ষণ থামবে
না। এই অবস্থায় বাদুড়-ঝোলা হয়ে ওর হাতে ধরা পড়া ছাড়া আর কোনও
উপায় নেই। এমনি সময় এক হাতে স্পর্শ করল আলতাফ রানার হাত।
‘একটা পাথর!’ ফিসফিস করে বলল আলতাফ। ‘ওর পেছন দিকে
ফেলতে হবে।’
ডান হাতে খুঁজল রানা কিনারটা, কাদা আর ঘাসের গুচ্ছ ছাড়া কিছুই
ঠেকল না হাতে। একটা মার্বেলের অর্ধেক সাইজ পাথরও পেল না সে। হঠাৎ
মনে পড়ল ওর অফিসের একটা চাবি রয়ে গেছে ওর পকেটে। আলোটা
তখন তিন ফুট দূরে। চাবিটা বের করে ছুঁড়ে মারল সে বাম দিকের অন্ধকারে
আন্দাজের ওপর কয়েকটা পাথর লক্ষ্য করে। এক সেকেণ্ড পার হয়ে গেল,
তারপর দুই সেকেণ্ড, রানার মনে হলো পাথরে লাগেনি চাবিটা- হয়তো
কাদায় পড়েছে। আলোটা আলতাফের কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে আছে।
এমনি সময় ঠং করে পাথরের ওপর চাবির শব্দ হলো। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল
সেন্ট্রি। একবার অনেকখানি জায়গার ওপর টর্চটা বুলিয়ে দেখে নিয়ে আলো
ফেলল সে পাথরগুলোর ওপর। তারপর ছুটল সেদিকে। রাইফেলটা টর্চের
সাথে চেপে ধরেছে সে। চকচক করছে ব্যারেলটা আলো পড়ে।
গার্ডটা দশ গজও যায়নি, চিতাবাঘের মত নিঃশব্দে উঠে গেল আলতাফ
ওপরে। ছুটে গিয়ে ঝড়ে পড়া গাছটার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
বিশ গজ দূরে সেন্ট্রিটা তখন ভয়ে ভয়ে এ-পাথর, ও-পাথরের ওপর
আলো ফেলছে। আলতাফ ওর ছুরির বাঁট দিয়ে একটা পাথরের ওপর দুটো
টোকা দিল। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল সেন্ট্রি। গাছটার দিকে আলো ফেলল,
তারপর পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে আনাড়ির মত দৌড় দিল গাছের
দিকে। হাঁটুর কাছে রেইনকোটের ফ্ল্যাপ দুটো বাড়ি খাচ্ছে। দৌড়ের ফলে
টর্চটা দুলছে ওপর নিচে। রানা এক নজর দেখতে পেল সেন্ট্রির বিভ্রান্ত
.
২২ মাসুদ রানা-৬
চেহারাটা। অল্পবয়সী- মাহবুবের সমান হবে। ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে দুই
চোখ। রানা ভাবল, একমাত্র খোদাই জানে বেচারার মনের মধ্যে এখন ভয়
আর আতঙ্কের কি প্রবল আলোড়ন চলেছে। নির্জন সমুদ্রের উঁচু পাড়ের ওপর
ঠুং-ঠাং খুট-খাট শব্দ, অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না; নিঃসঙ্গ, একাকী সে।
ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার রাতে বাতাসের সাঁই-সাঁই শব্দ আর সাগরের μুূ
গর্জন। ভয় পেয়েছে ছেলেটা। রানার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা মমত্ববোধ
জাগল। রানারই মত সে-ও মানুষ, কারও আদরের সন্তান, কিংবা ভাই,
অথবা স্বামী, প্রিয়তম। কর্তব্য পালন করতে এসেছে সে, ওপরওয়ালার হুকুম
তামিল করছে মাত্র। দুঃখ হলো রানার এই একাকী, উদ্বিগড়ব, আতঙ্কিত
ছেলেটির জন্যে। অথচ মরতেই হবে একে। আর দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই
মৃত্যু হবে ওর। ধীরে ধীরে মাথা তুলল রানা ওপরে।
‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ককিয়ে উঠল রানা। স্পড়ে যাচ্ছি, ধরো!’
থমকে দাঁড়াল আতঙ্কিত সেন্ট্রি আলতাফ যেখানটায় লুকিয়ে আছে তার
চার ফুটের মধ্যে। ঘুরে দাঁড়াল রানার দিকে। এক সেকেণ্ড এদিক ওদিক
খুঁজে স্থির হলো আলোটা এসে রানার মুখের ওপর। একমুহূর্ত মূর্তির মত
দাঁড়িয়ে থেকে রাইফেল তুলল সে কাঁধে। পরমুহূর্তেই একটা চাপা আর্তনাদ
বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ঢলে পড়ল সে মাটিতে।
উঠে এল রানা ওপরে। মৃত সেন্ট্রির দিকে চাইল একবার। রক্ত মাখা
ছুরিটা সেন্ট্রির রেইনকোটে মুছে নিয়ে বেল্টে বাঁধা খাপের মধ্যে রেখে দিল
আলতাফ।
‘এতে কি প্রমাণ হয়, রানা?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ। লোকজনের
সামনে মেজর বলে ডাকে সে রানাকে। স্পর পর অনেকগুলো দৈব-সংযোগ।
সন্দেহজনক, তাই না?’
‘হ্যাঁ। লঞ্চে করে তাড়া, দ্বীপে সৈনিক, এখানে পৌঁছে গার্ড! কেটি
বন্দরের সেই ক্যাপ্টেনের কপাল খারাপ। কমোডোর জুলফিকার আর
আমাদের বুড়ো মিষা, কেউ ছাড়বে না ওকে। আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।’
মাথা ঝাঁকাল আলতাফ।
‘ও নিশ্চয়ই করিমকে ছেড়ে দিয়েছিল।’
‘নিশ্চয়ই, তাছাড়া আর কে জানবে আমাদের গন্তব্যস্থল? এরা আমাদের
পৌঁছানোর অপেক্ষায় প্রস্তুত আছে। এই ঝড়ের রাতেও অন্ততঃপক্ষে তিরিশ-
চলি−শটা গার্ড মোতায়েন করে দিয়েছে এই পাহাড়ী সমুদ্র-তীরে।’ গলার
স্বরটা নিচু করে প্রায় আপন মনে বলল রানা, ‘এখন যত শিগগির সম্ভব সরে
যেতে হবে এখান থেকে।’
‘সিগন্যাল, তাই না?’ বলল আলতাফ। ‘ওরা পরস্পরের সঙ্গে
যোগাযোগ রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোনও সিগন্যালের ব্যবস্থা করেছে।
হয়তো ফ্লেয়ার...’
দুর্গম দুর্গ ২৩
‘না। তাহলে ওদের অবস্থান জেনে ফেলার সম্ভাবনা আছে আমাদের।
খুব সম্ভব টেলিফোন। ফিল্ড টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছে ওরা। ফ্লেয়ার
নয়।’
মাথা ঝাঁকাল আলতাফ। মাটি থেকে মরা সেন্ট্রির টর্চটা তুলে নিয়ে
চারদিক খুঁজল। আধ মিনিটের মধ্যেই তার পাওয়া গেল খুঁজে, আর আধ
মিনিটের মধ্যেই সেই তার ধরে গিয়ে দেখা গেল পাথরের আড়ালে রাখা
আছে একটা টেলিফোন সেট।
‘এখন পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না। যদি রিং হয়,
জবাব দিতে হবে, নইলে সব ব্যাটা ছুটে আসবে এখানে। কিন্তু ব্যাটাদের
কোনও কোড সিগন্যাল থাকলেই গেছি।’ কয়েক পা এগিয়েই থামল রানা।
‘কিন্তু আলতাফ, আর কিছুক্ষণের মধ্যে কেউ না কেউ এসে পড়বেই। হয়তো
কোনও সার্জেন্ট, নয়তো কোনও রিলিফ, কিংবা হয়তো একে পনেরো মিনিট
পর পর রিপোর্ট করবার আদেশ দেয়া হয়েছিল। যে-কোনও মুহূর্তে বিনা
নোটিসে কেউ এসে হাজির হতে পারে। ধরো, লাশটা ছুঁড়ে ফেলে দিই
সমুদ্রে।’
গাছের একটা মোটা ডালের সাথে শক্ত করে রশিটা বেঁধে ঝুলিয়ে দিল
রানা নিচে। এক্সপে−াসিভের বাক্সটা এল প্রম, তারপর একে একে আসতে
থাকল অন্যান্য জিনিসপত্র। আলতাফ টেনে তুলছে মালগুলো, রানা বসে
আছে টেলিফোনের পাশে। হঠাৎ ‘আহ্হা’ বলে উঠল আলতাফ। তিন লাফে
কাছে চলে এল রানা।
‘কি ব্যাপার, আলতাফ?’
‘কি যেন একটা জিনিস খসে পড়ে গেল। ভালমত বাঁধতে পারেনি।’
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রানা, কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কাছেই
কোথাও। পোড়া তামাটে গন্ধ এল নাকে।
‘সেরেছে। আর একটু হলেই মাথায় পড়ত। যাক, কি জিনিস খোয়া
গেল?’
প্রশড়বটা করেই রানা বুঝতে পারল জিনিসটা কি। ও নিজেই সাজিয়ে
রেখেছিল ওগুলো গুরুত্ব অনুসারে।
‘খাবার,’ বলল আলতাফ। ‘খাবার, স্টোভ- সব।’
দমে গেল রানা। খাবার ছাড়া এই অজানা অচেনা শত্র“দেশে চলবে কি
করে? বৃষ্টির ছাঁট লেগে এতক্ষণ শীত লাগেনি, এবার হঠাৎ শিউরে উঠল
রানার সর্বশরীর। কাঁধের ওপর হাত রাখল আলতাফ। মুখে মৃদু হাসি।
‘এতে কিছু এসে যায় না, রানা। বয়ে নিয়ে যাবার বোঝা তো কমল।
ভেবে দেখো, ক্লান্ত ক্যাপ্টেন মিশ্রী খান কত খুশি হবে এই বোঝা হালকা হয়ে
যাওয়ায়!’
এমন সময় তীক্ষè একটা শব্দে একসাথে চমকে উঠল আলতাফ ও
.
২৪ মাসুদ রানা-৬
রানা।ক্রিং ক্রিং বেজে উঠেছে টেলিফোন। শক্ত হয়ে গেল রানার
মুঠি, আড়ষ্ট হয়ে শুনল সে টেলিফোন রিং। তারপর এগোতে গিয়েও থেমে
দাঁড়াল। ফিরল আলতাফের দিকে।
‘মত পরিবর্তন করলে?’ জিজ্ঞেস করল আলতাফ।
মাথা ঝাঁকাল রানা। মুখে কিছুই বলল না। আলতাফই বলল, ‘উত্তর না
পাওয়া পর্যন্ত বাজতেই থাকবে। যখন কিছুতেই উত্তর পাবে না তখন আসবে
ওরা, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
‘ভেবে দেখলাম ওই ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে। কিন্তু কতক্ষণ
লাগবে ওদের পৌঁছতে সেটাই প্রশড়ব।’ চারদিকে একবার চোখ বুলাল রানা।
‘টেলিফোন ধরা ঠিক হত না। ধরা পড়ে যাবার শতকরা পঁচানব্বই ভাগ
সম্ভাবনা। হয়তো গলার স্বরে ধরা পড়ব, কিংবা ভাষায় ধরা পড়ব, কিংবা
হয়তো কোড সিগন্যালে ধরা পড়ব- কিন্তু বোঝার উপায় নেই ধরা পড়েছি
কিনা। তাছাড়া মিশ্রী আর মাহবুব ছাড়া সবকিছু উঠে এসেছে আমাদের।
কেউ জানে না যে আমরা পৌঁছে গেছি। সেন্ট্রিটাকে যখন পাওয়া যাবে না
ওরা মনে করবে বেশি কিনারে চলে গিয়েছিল নিষেধ সত্ত্বেও এবং পা পিছলে
পড়ে ডুবে গেছে সমুদ্রে। এখন ওদের দু’জনকে নিয়ে কেটে পড়তে পারলেই
এই মিশনের প্রম অর্ধেক সফল হয়।’
‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ তুমি। এত কষ্টের পর যেটুকু অর্জন করেছি আমরা
সেটুকু সামান্য ভুলে নষ্ট করার মত বোকামি আর নেই। কিন্তু এতক্ষণে ওরা
রওনা হয়ে গেছে। ফোন থেমে গেছে। নিশ্চয়ই দৌড়ে আসছে ওরা
এদিকে।’
আলতাফের কথা শেষ হবার আগেই দু’জনের চোখে পড়ল কয়েকটা টর্চ
এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। প্রায় চার-পাঁচশো গজ দূরে আছে। চলার
বেগে টর্চের আলো নাচানাচি করছে এদিক-ওদিক।
দ্রুত রশিটা নামিয়ে দিল আলতাফ। মিশ্রী খান উঠে এল ওপরে-
অর্ধেকটা নিজের চেষ্টায়, বাকি অর্ধেক আলতাফের টানে। মাথাটুকু
বেরোতেই থেমে গেল। রানা জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে রাখছিল পাহাড়ের ঢাল
বেয়ে কিছুদূর নেমে বড় বড় কয়েকটা পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে। ফিরে
আসতেই দেখল মিশ্রী খানের মাথা। অবাক হয়ে ঝুঁকে দেখল রানা দাঁতে
দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে আছে মিশ্রী খান।
‘পৌঁছে গেছ, ক্যাপ্টেন। এবার উঠে পড়ো।’ ওর কাঁধে দুটো চাপড়
দিল রানা আস্তে করে।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল মিশ্রী খান। তারপর আছড়ে-পাছড়ে উঠে
পড়ল ওপরে। রানা অবাক হয়ে দেখল ওকে, রেইনকোট থাকা সত্ত্বেও ভিজে
চুপচুপে ওর জামা-কাপড়। জিজ্ঞেস করল, ‘ওপরে উঠে চোখ বন্ধ করে
রেখেছিলে কেন?’
দুর্গম দুর্গ ২৫
‘ওপরে উঠে তো চোখ বন্ধ করিনি, ওস্তাদ!’
‘তবে?’
‘নিচেই চোখটা বন্ধ করে নিয়েছিলাম, ওপরে উঠে খুলেছি।’
‘এই বিশ ফুট চোখ বন্ধ করে উঠেছ?’
‘ঠিক তাই। ঝোলাঝুলির কারবারে আর যাব না বাবা, ভারি ভয় লাগে।
একবার শিয়ালকোটে...’
‘থাক, ক্যাপ্টেন, ওসব তোমার আÍজীবনীর জন্যে সঞ্চয় করে রাখো।
এখন ওই দেখো কারা আসছেন, আমাকে একটু সাহায্য করো মালপত্রগুলো
সরাবার কাজে।’
অনেক কাছে চলে এসেছে প্রহরীগুলো। মাহবুব এখনও অর্ধেক উঠতে
পারেনি। আলতাফ আর মিশ্রী খানকে সাব মেশিনগান নিয়ে তৈরি থাকতে
বলল রানা নিচের ওই পাথরের আড়ালে। নিজে শুয়ে পড়ল মাটির ওপর।
মাথাটা বের করে দেখছে সে মাহবুব কতটা এল। বিশ গজের মধ্যে এসে
গেছে প্রহরীরা।
পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা এখন যদি মাহবুব ওপরে ওঠে তাহলে ঠিক
ওদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হবে ওকে। মাহবুব যদি না-ও মরে
প্রহরীগুলো প্রত্যেকে মরবে মিশ্রী আর আলতাফের হাতে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি
খেলে গেল ওর মাথায়। দুই হাত মুখের কাছে এনে মৃদুস্বরে ডাকল একবার,
‘মাহবুব!’
চট করে ওপর দিকে চাইল মাহবুব।
‘নেমে যাও, মাহবুব! কয়েকজন সেন্ট্রি আসছে এদিকে। আমরা সরে
যাচ্ছি, কাছেই লুকিয়ে থাকব। নিচে নেমে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকো মরা
মানুষের মত। নেমে রশি ধরে দুটো টান দেবে, আমি উঠিয়ে নেব রশিটা।
বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে কথাগুলো বুঝবার চেষ্টা করল রক্তক্ষরণে দুর্বল,
ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মাহবুব। বুঝতে পারল। নেমে যাচ্ছে সে এখন। আর
পনেরো গজ দূরেই সেন্ট্রিদের বুটের শব্দ। হঠাৎ হাত ছেড়ে দিল মাহবুব। ও
যে কতখানি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে ধারণাই ছিল না রানার। দাঁতে দাঁত চেপে
অপেক্ষা করল সে ভারি কিছু পতনের। বোধহয় কোনও শিকড়ে পা বেধে
গেছে। মড়াৎ করে কিছু ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল। বুকে হেঁটে সরে এল রানা
উপড়ে যাওয়া বট গাছটার আড়ালে। আর অপেক্ষা করা যায় না। একবার
পাঁচ ফুটের মধ্যে এসে পড়ল একটা টর্চের আলো। মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে
রইল রানা আলোটা সরে না যাওয়া পর্যন্ত। রানা জানে ওর ওপর টর্চের
আলো পড়া মানেই পাঁচটি সেন্ট্রির মৃত্যু। আর তাহলে ওদের আগমন আর
গোপন থাকবে না কারও কাছে।
গাছের আড়ালে পৌঁছেই রশিটা উঠিয়ে ফেলল রানা, লুকিয়ে রাখল
একটা ডালের নিচে।
.
২৬ মাসুদ রানা-৬
এসে গেছে সেন্ট্রিরা।
পাঁচ
প্রমেই টেলিফোনটা খুঁজে বের করল ওরা। ঘাঁটিতে ফোন করল। তারপর
খুঁজতে আরম্ভ করল তনড়ব তনড়ব করে। আশে পাশে কোথাও ঘুমিয়ে আছে কিনা
দেখবার জন্যে দু’জন গেল দুইদিকে। আর বাকি তিনজন সাগরের দিকটা
দেখছে। একজন কিনার ধরে হাঁটছে, ওর কোমরের বেল্ট ধরে আরেকজন
কিনার থেকে একটু দূরে। আর তৃতীয়জন দ্বিতীয়জনের হাত ধরে আছে শক্ত
করে নিরাপদ দূরত্বে। টর্চ জ্বেলে ধীর পায়ে হাঁটছে প্রম লোকটা। প্রতিটা
পাথর পরীক্ষা করছে নিচের।
হঠাৎ থেমে দাঁড়াল প্রমজন, কি যেন বলল। আরেকটু ঝুঁকে আলো
ফেলে ভাল মত পরখ করবার চেষ্টা করছে সে কি যেন। রানা বুঝল কি
দেখতে পেয়েছে লোকটা। শোল্ডার হোলস্টার থেকে ওয়ালথার পি. পি. কে.
চলে এল ওর ডান হাতে। কেউ রাইফেল তুললেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে
তার।
বৃষ্টি আর হাওয়ার শব্দ ছাড়া পনেরো সেকেণ্ড আর কিছুই শোনা গেল
না। তারপর পরিষ্কার কণ্ঠে কেউ বলল, ‘হ্যাঁ, ওটা শ্রীধরেরই দেহ। বেচারা!
আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম ওকে যেন বেশি কিনারে না যায়, ফসকা
মাটি এখানকার।’ কয়েক পা পিছিয়ে এল সে কিনার থেকে। ‘ওই দেখো।
ওইখানটায় পা ফসকেছে, দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।’
রশির দাগটার ওপর টর্চ ফেলে দেখাল সে সাথীদের।
‘মরে গেছে, না জ্যান্ত?’ একটা কম্পিত কণ্ঠ শোনা গেল।
‘ঠিক বলতে পারছি না, দেখো না, বুঝতে পারো কিনা?’
প্রত্যেকেই একবার করে দেখল মাহবুবের দেহটা। একজন বলল,
‘ঠিকই বলেছেন, শ্রীধরই। আমার মনে হয় বেঁচে আছে, ওয়াটারপ্রƒফটা একটু
নড়ল মনে হলো।’
‘বাতাসেও নড়তে পারে।’
‘না, আমার মনে হয় বেঁচে আছে।’
‘যাই হোক, আমাদের নামতে হবে নিচে। দড়ির সিঁড়ি আনতে হবে,
ওই গাছটায় বেঁধে নামা যাবে, স্ট্রেচার লাগবে। চলো, হারি আপ্।’
‘আমাদের একজন এখানে থাকলে ভাল হয় না?’
‘না। একশো জন দাঁড়িয়ে থাকলেও ওর কোনও উপকারে আসবে না।
চলো সবাই, কুইক।’ একবার হুইস্ল দিয়েই এগোল ওরা যেদিক থেকে
দুর্গম দুর্গ ২৭
এসেছিল সেই দিকে।
মিশ্রী খানকে চারদিকে নজর রাখবার আদেশ দিয়ে আলতাফ আর রানা
রশি বেয়ে নেমে এল নিচে। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে যা দেখল তাতে গুলিয়ে এল
রানার গা-টা। নিজের অজান্তেই আপনা আপনি শিউরে উঠল একবার।
একটা মোটা শিকড় আর খানিকটা উঁচু হয়ে থাকা চোখা পাথরের মধ্যে
পড়েছে মাহবুবের ডান পা। সিঁড়ির মত তিনফুট চওড়া ধাপ থেকে পাঁচ ফুট
উঁচুতে। ডান পায়ের হাঁটুর নিচটা বেকায়দা রকম উঁচু হয়ে আছে। সেই ভাঙা
পায়ের ওপরই অজ্ঞান অবস্থায় ঝুলছে দেহটা। মাথার কাটা জায়গায় আবার
জোর আঘাত লেগে রক্ত ঝরছে।
বুকের ওপর কান রেখে শুনল রানা দুর্বলভাবে হার্ট বিট হচ্ছে।
আলগোছে পা-টা ছাড়িয়ে নামিয়ে আনল আলতাফ ঝুলন্ত দেহটা। পা-টা
টেনে সোজা করবার চেষ্টা করল রানা। অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ বেরোল
মাহবুবের মুখ থেকে। প্যান্টের পা গুটিয়ে ওপরে তুলে দিল রানা যতেড়বর
সঙ্গে। হাড়টা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে খানিকটা, মাংসের ভেতরের সাদা অংশ
আর রক্ত দেখে দুই গাল কুঁচকে গেল রানার। আলতাফের মুখ থেকে
বেরোল, ‘ইশ্শ্!’
একবার পায়ের ওপর হাত বুলিয়ে রানা বলল, ‘কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার,
আলতাফ।’ তারপর কি মনে করে ওপর দিকে হাত দিয়ে আপন মনেই বলে
উঠল, ‘হায়, খোদা! ওপরেও ভেঙেছে। হাঁটুর ওপরে। আলতাফ, ছেলেটার
অবস্থা খারাপ।’
‘এখানে তো কিছু করবার উপায় নেই, তাই না?’
‘না, ওকে এখন ওপরে নেয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে...’
‘আমি নিয়ে যাব। আমার পিঠে বেঁধে দাও তুমি ওকে।’
‘এই অবস্থায়? ভাঙা পা ঝুলছে শুধু চামড়া আর ছেঁড়াখোঁড়া পেশীর
ওপর। মরে যাবে ছেলেটা!’
‘ওকে ওপরে না তুললেও মরবে। তাই না?’
মাহবুবের দিকে চেয়ে রইল রানা কিছুক্ষণ। তারপর প্রতিধ্বনির মত
বলল, ‘ওপরে না তুললেও মরবে।’
ধীরে ধীরে উঠে গেল আলতাফ রশি বেয়ে। ভাঙা পা-টা ধরে থাকল
রানা কিছুদূর পর্যন্ত, তারপর ছেড়ে দিল আস্তে করে। মাথাটা ঝুলে আছে
একপাশে। বৃষ্টির পানির সাথে রক্ত মিশে টপটপ করে পড়ছে চিবুক বেয়ে।
দ্বারোকা পাঁচ মাইল দক্ষিণে। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে মাইল খানেক
এসে থামল ওরা। থামতে হলো মিশ্রী খানের পীড়াপীড়িতে।
‘এভাবে আর কিছুদূর গেলেই ছেলেটা মারা যাবে, ওস্তাদ। এক্ষুণি
আমাদের কিছু করা দরকার।’
.
২৮ মাসুদ রানা-৬
‘সামনেই একটা গুহা পাব, মিশ্রী,’ কাঁধের ওপর বোঝার ভারে অবনত
রানা বলল হাঁপাতে হাঁপাতে। ‘কিছু একটা করতেই হবে।’
গুহায় পৌঁছে শুইয়ে দেয়া হলো মাহবুবকে একটা চাদর পেতে ভেজা
মাটির ওপর। রানা দেখতে যাচ্ছিল ভাঙা জায়গাটা, সরিয়ে দিল ওকে মিশ্রী
খান।
‘আমার ওপর ছেড়ে দিন, ওস্তাদ। আলতাফ, ওষুধের বাক্সটা খোলো,
প−ীজ। আর বাইরে থেকে কিছু ডাল ভেঙে নিয়ে এসো সোজা দেখে।’
‘তুমি পারবে, মিশ্রী?’ রানার বুকের ওপর থেকে যেন একটা বোঝা
নেমে গেল। হঠাৎ কেন যেন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মনটা। কিছু একটা
বলতে ইচ্ছে করল। বলল, ‘কিন্তু ওর পা-টা কিভাবে...’
‘দেখুন, ওস্তাদ!’ অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলল মিশ্রী খান, ‘সারা জীবন শুধু
তিনটে জিনিস ঘেঁটেছি আমি। বারুদ, বারুদ আর বারুদ। বিশ্রী জিনিস এই
বারুদ। শত শত হাত-পা ভাঙা লোক দেখেছি আমি। নিজের দলের হলে
বেশির ভাগ নিজেই মেরামত করেছি। এসব আমার কাছে পানি।’
‘ঠিক আছে।’ মিশ্রীর কাঁধে চাপড় দিল রানা। ‘ওকে তোমার হাতেই
সোপর্দ করলাম।’
‘ছোকরার প্রম দরকার মরফিন।’ বাচাল মিশ্রী খান কথা বলবার
সুযোগ পেয়েছে। পেনসিল টর্চ জ্বেলে ওষুধের বাক্স থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস
বাছতে বাছতে মুখ চলল ওর ফুল স্পীডে। ‘হ্যাঁ, মরফিন না হলে চলবে না।
সালফা দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দেব পা-টা। তারপর দরকার আশ্রয়, শুকনো
কাপড়, খাবার।’
‘শুকনো কাপড়, খাবার? কোথায় পাব?’ রানার মনে পড়ল মাহবুবের
বাঁধার দোষেই খাবার, স্টোভ সব খোয়া গেছে।
‘কোথায় পাব জানি না, কিন্তু জোগাড় করতে হবে। নইলে ঠিক এই
ভেজা শরীরে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে ওর। আর পায়ে যদি একবার সেপসিস্
বা গ্যাংগ্রিন হয় তবে...’ থেমে গেল মিশ্রী খান। কয়েকটা বেত কেটে
এনেছে আলতাফ। সোজা ডাল পাওয়া যায়নি আশেপাশে। আলতাফ আর
মিশ্রী খান ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাহবুবের পা নিয়ে। রানা দেয়ালে হেলান দিয়ে
দেখছে।
কী জীবন! মানুষ কখন কি অবস্থায় থাকে কেউ বলতে পারে? এই
তিনদিন আগে মরিয়মের সাথে ফিটফাট এয়ার কণ্ডিশন্ড হোটেলে ডিনার
খাচ্ছিল ধোপদুরস্ত কাপড় পরে, ঢাকায় বসে। আর আজ? কাদার মধ্যে বসে
বসে ধুঁকছে- পেটের ভেতর চোঁ-চোঁ ছুঁচোর কেত্তন। ঢাকার পি. সি. আই.
অফিসের কথা মনে হলো- মেজর জেনারেল রাহাত খানের ঋজু চেহারাটা
মনে পড়ল। মনটা অনেক দূরে চলে গেল। বাইরে একটানা বৃষ্টির রিমঝিম।
ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা হলো, টেনে বাঁধা হলো পা-টা। বেত দিয়ে
দুর্গম দুর্গ ২৯
স্পি−ন্ট-এর কাজ সারা হলো। কাজ শেষ করে মাহবুবের পাশে শুয়ে পড়ে
ফস্ করে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে বগা সিগারেট ধরাল মিশ্রী খান।
‘আল−া! শরীরে আর দুব্বল পাচ্ছি না, ওস্তাদ। এই ছোকরাকে বাইরে
থেকে দেখতে যেমন লাগছে, আমার ভেতরটায় সেই রকম বোধ করছি।’
হঠাৎ কি কথা মনে পড়ায় উঠে বসল সে। সুর বদলে বলল, ‘এখানেই
রাতটা কাটাবেন নাকি, ওস্তাদ?’
‘হ্যাঁ, গুহাটাকে রাত্রিবাসের উপযুক্ত করে গুছিয়ে নিতে হবে।’
‘কিন্তু...’ ইতস্তত করল মিশ্রী খান।
‘কি ব্যাপার?’ কেন যেন রানার মনে হলো কোনও দুঃসংবাদ আছে।
‘দুঃসংবাদ আছে, ওস্তাদ। বলি বলি করেও বলা হয়নি এতক্ষণ।’
‘এখন ভণিতা না করে বলে ফেলো ঝট্পট্,’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল রানা।
‘যে লোকটাকে আপনারা চ্যাং দোলা করে সাগরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন,
মনে আছে? বাম ধারের দুটো পাথরের মধ্যে আটকে আছে ওর দেহটা।’
‘আচ্ছা! এই জন্যেই তোমার ওয়াটারপ্রƒফের তলাতেও সমস্ত কাপড়
ভেজা?’
‘চার-পাঁচবার চেষ্টা করলাম, ওস্তাদ, কোমরে রশি বেঁধে ধরে রেখেছিল
মাহবুব। কিন্তু প্রতিবারেই শালার ঢেউগুলো এক ধাক্কায় নিয়ে আসে তীরে।’
দশ সেকেণ্ড চুপচাপ চিন্তা করল রানা। তারপর বলল, ‘এখন দশটা
বাজে। কাল সকালেই ওরা জানতে পারবে যে আমরা ঢুকে পড়েছি ওদের
এলাকায়, মাঝের এই সময়টা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সকাল বেলাই
ওরা দেখতে পাবে লাশ। ওর হƒৎপিণ্ড বরাবর আলতাফের ছুরির দাগও
দেখতে পাবে। কাজেই আধঘণ্টার মধ্যে রওনা হব আমরা। হাফ অ্যান
আওয়ার রেস্ট।’
আবার ক্লান্তিকর পথ চলা। মাহবুবকে তুলে নিয়েছে আলতাফ আগাগোড়া
দুটো রেইনকোটে মুড়ে। রানা তুলে নিল কাঁধের ওপর প্রকাণ্ড একটা বোঝা।
‘আমি আলতাফের আগে আগে পথ দেখিয়ে চলি, তাহলে গর্তে পা
পড়বার ভয় থাকবে না,’ বলল মিশ্রী খান। হেঁইও বলে মালপত্র কাঁধের ওপর
তুলেই বুঝল কতখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীর। চট্ করে যোগ করল,
‘প্রম কিছুদূর। তারপর আমাদের দু’জনকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে ওর।’
আরও দুই মাইল দক্ষিণে সরে এল ওরা পাহাড়ী পথের খাড়াই-উতরাই
ভেঙে। তারপর বেশ কিছুদূর পুবে এগিয়ে আরেকটা গুহা পেল পাহাড়ের
অনেকটা ওপরে। পরিষ্কার মনে আছে রানার কমোডোরের আঁকা নক্সা।
বুঝল, আর মাইল দুয়েকের মধ্যেই লেফটেন্যান্ট আরীফের সাথে দেখা
করবার জায়গা। কিন্তু ঘড়িতে বাজছে সাড়ে চারটা। এখন সে জায়গায়
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে না কাউকে। তাছাড়া এখন অতদূর যাবার শক্তিও নেই
.
৩০ মাসুদ রানা-৬
আর।
পথের মধ্যে দুইবার থেমে আলতাফ পরীক্ষা করে দেখেছে এখনও নাড়ী
চলছে কিনা মাহবুবের। গুহায় পৌঁছেই তাঁবুর ক্যানভাস টাঙিয়ে প্রবেশ পথটা
ঢেকে ফেলা হলো। কোন মতে একটা বিছানা মত করে মাহবুবকে তার
ওপর শুইয়ে দিয়েই ওরা তিনজন ভেজা মাটিতে শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন
হয়ে পড়ল।
যার-পর-নাই ধকল গেছে সারাদিন-সারারাত।
ছয়
কেন ঘুমটা ভাঙল বুঝতে পারল না রানা। কিসের শব্দ? ঘুমের কালো পর্দা
ভেদ করে একটা শব্দ এসে পৌঁছেচে ওর অর্ধসচেতন মনের দুয়ারে।
রোমাঞ্চ আর বিপদ নিয়েই রানার জীবন। এই সঙ্কেতের উপযুক্ত গুরুত্ব দিল
সে। এক মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ সজাগ, সতর্ক সে এখন। এমনি সময়
আবার শুনতে পেল সে শব্দটা। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে উঁচু পর্দায়
একটা হুইস্লের শব্দ। দুই সেকেণ্ড বেজেই থেমে গেল। ছোট-বড় অনেক
পাহাড়ের গায়ে অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি উঠল।
রানার μি€াল সেভেন সিটিজেন অটোমেটিক ঘড়িতে বাজে সাড়ে
দশটা। ক্যানভাসের পর্দা সরিয়ে বাইরে চাইল সে। অন্ধকার হয়ে আছে
এখনও আকাশটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
জেইস আইকন বিনকিউলারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে গুহা
থেকে।
পঁয়ত্রিশ কি চলি−শজন হবে। পার্বত্য সৈনিক। তনড়ব তনড়ব করে খুঁজতে
খুঁজতে এগোচ্ছে ধীর পায়ে ওরা যে-পথে এসেছে সেই পথ ধরে। অনেক দূর
ছড়িয়ে। প্রত্যেকটা পাহাড়, টিলা খুঁজছে ওরা সাবধানে। আধ মাইলও হবে
না।
দূরবীনটা চোখ থেকে নামাল রানা। হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তেই চমকে
ফিরে দেখল আলতাফ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। বিনাবাক্য ব্যয়ে
দূরবীনটা ওর হাতে দিল রানা। ওটা চোখে তুলে গম্ভীর হয়ে গেল
আলতাফের মুখ। ফোকাস অ্যাডজাস্ট করে ভাল করে একবার দেখে নিয়ে
বিনকিউলারটা নামাল সে চোখ থেকে।
‘অবস্থা তো খুব খারাপ দেখা যাচ্ছে, রানা।’
‘ওদের পার্বত্য ট্রুপ। এদের ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই, খুঁজে বের
করবেই এরা আমাদের।’ মাথার পেছনটা চুলকাল রানা চিন্তিত মুখে। ‘কিন্তু
দুর্গম দুর্গ ৩১
এত তাড়াতাড়ি আমাদের উপস্থিতি জানতে পারল কি করে ওরা? কাল
রাতেই বোধহয় সেই সেন্ট্রির মৃতদেহটা পেয়েছে সেপাইগুলো। ফিরে এসে
যখন সাগর পারে মাহবুবের দেহটা দেখতে পায়নি, তখনই ওরা বুঝে
নিয়েছে আমরা একজন আহত লোককে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কাজেই খুব বেশি
দূরে যেতে পারিনি এখনও। আগে হোক, পরে হোক ধরা পড়ছি আমরা।’
‘বড়জোর এক ঘণ্টা। এই অবস্থায় মাহবুবকে ফেলে পালালে পালাতে
পারি আমরা, ওকে নিয়ে গা ঢাকা দেয়া অসম্ভব।’
‘কিন্তু পালাতেই হবে। এবং ওকে নিয়েই।’
‘বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বিসর্জন?’ হাসল আলতাফ।
‘তাই।’
‘কিন্তু তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ, বন্ধু। চলো, ক্যাপ্টেন মিশ্রী খানকে
চমকে দেয়া যাক সুখবরটা দিয়ে।’
ক্যানভাসের পর্দা তুলেই প্রম চোখ পড়ল রানার মাহবুবের চোখে। ওর
দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। বলল, ‘যাক, জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। এখন
কেমন বোধ করছ, মাহবুব?’
রানার দিকে চেয়ে মৃদু হাসবার চেষ্টা করল মাহবুব। রক্তশূন্য মুখে ঠোঁট
দুটো সাদা দেখাল। রানা ভাবল, আহা, কার বাচ্চা না জানি। একেবারে অল্প
বয়স বেচারার, অথচ কী দুর্ভোগই না ভুগছে।
‘খুব খারাপ না,’ বলল মাহবুব। কথা বলতে গিয়ে ব্যথায় কুঁচকে গেল
মুখটা। ব্যাণ্ডেজ করা পায়ের দিকে চাইল সে একবার, তারপর সোজাসুজি
রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, স্যার। বোকার মত এই
কাণ্ডটা বাধিয়ে বসলাম।’
‘এটা শুধু বোকামি নয়, গর্দভের মত কাজ হয়েছে। অমার্জনীয়
অপরাধ। এবং এজন্যে একমাত্র দায়ী হচ্ছি আমি। তুমি কি পরিমাণ দুর্বল
হয়ে পড়েছ, আমার বোঝা উচিত ছিল। দলের কে কেমন আছে খোঁজ নেয়ার
দায়িত্ব ছিল আমারই ওপর।’ মাহবুবের কাঁধে একটা হাত রাখল রানা।
‘আমাকে সেজন্যে মাফ করো, মাহবুব। সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি তোমার
অবস্থা।’
অস্বস্তি বোধ করল মাহবুব। কিন্তু মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এই ভেবে যে
কেউ এটা ওর দোষ মনে করছে না। খুশি হয়ে উঠল ওর মনটা ভেতর
ভেতর। লজ্জিত হাসি হাসল সে। তারপর বলে ফেলল সেই কথাটা, যেটা
অন্য সময় বা অন্য কারও কাছে কিছুতেই বলত না প্রাণ গেলেও।
‘ব্যাপারটা দুর্বলতার জন্যে ঘটেনি, স্যার। আসলে খুব ভয়
পেয়েছিলাম। অতিরিক্ত ভীতু আমি। প্রম দিন থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে আছি।
ভয়েই হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল আমার।’
সাইকো-অ্যানালিস্টের কাছে রোগী যেমন কিছুই গোপন রাখে না, সব
.
৩২ মাসুদ রানা-৬
কথা বলে ফেলে, তেমনি ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল মাহবুব। প্রমটায়
হতভম্ব হয়ে গেল রানা। তারপর মাহবুবের দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসি
হাসল।
‘বুঝতে পারছি, তুমি এই মাঠে নতুন পিলিয়ার। তুমি হয়তো ভাবছ
আমি হাসতে হাসতে গান গাইতে গাইতে চলেছি? ভাবছ আমি ভয় পাইনি?’
চোখ সরু করে পাপড়ির মধ্যে দিয়ে চাইল রানা মাহবুবের দিকে। ‘কেবল
ভয় নয়, প্রতিটা মুহূর্ত আমার আতঙ্কিত বিভীষিকার মধ্যে কেটেছে।
আলতাফেরও। মিশ্রীরও।’
‘আলতাফ!’ হাসল মাহবুব। হাসতে গিয়ে ভাঙা হাড় একটু নড়ে
উঠতেই গোঙানি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। সামলে নিয়ে বলল,
‘আলতাফ? আতঙ্কিত? আমি বিশ্বাস করি না।’
‘আলতাফ সত্যিই ভীত।’ প্রকাণ্ড সিন্ধীর গলাটা গমগম করে উঠল
গুহার মধ্যে। ‘আলতাফ ভীতু বলেই এতদিন পর্যন্ত বেঁচে আছে। যারা ভয়
পায় না, তারা মারা পড়ে অসাবধান থাকার জন্যে। এই যেমন ভয় না পেলে
এখন রাইফেল নিয়ে বেরোতাম না। আর বাইরের ওই বন্ধুরা ভয় পায়নি
বলে প্রাণ দেবে অকাতরে।’
‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল মিশ্রী খান। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে এই
সব আলাপ শুনছিল সে। এই কথায় চোখ বড় বড় করে চাইল। রাইফেলের
ওপর একটা টেলিস্কোপিক সাইট লাগিয়ে ফেলেছে আলতাফ ইতিমধ্যেই।
‘মাউন্টেন ট্রুপের পঁয়ত্রিশ-চলি−শজন এদিকে আসছে। আমাদের খুঁজে
বের করতে ওদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।’
‘চমৎকার!’ উঠে বসল মিশ্রী খান। ‘খুশির চোটে আমার নাচতে ইচ্ছে
করছে। কতদূর ওরা, ওস্তাদ?’
‘ঘণ্টা খানেক লাগবে পৌঁছতে,’ বলল রানা।
‘আগামী ষাট ঘণ্টার মধ্যে এই গুহার কাছাকাছি আসতে পারবে না
ওরা,’ বলল আলতাফ। ‘ওদের বিভ্রান্ত করে দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাব আমি।
আমি একটু ঘুরে আসতে পারি, মেজর?’
রানা বুঝল এছাড়া আপাতত আর কোনও উপায় নেই। এই অবস্থায়
মাহবুবকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে নির্ঘাৎ মারা যাবে ছেলেটা। মাথা
ঝাঁকাল সে।
‘সন্ধ্যার আগে তো ফেরা যাবে না। তোমরা কি এখানেই থাকবে?’
জিজ্ঞেস করল আলতাফ।
‘সবাই যদি নাও থাকি, কেউ না কেউ থাকবে।’
মিশ্রী খান চেপে ধরল আলতাফের হাত। বলল, ‘খোদাকা ওয়াস্তে,
নিজের দিকে লক্ষ রেখো, আলতাফ।’
‘আমার জন্যে চিন্তা করো না, মিশ্রী। ওই বেচারাদের জন্যে প্রার্থনা
দুর্গম দুর্গ ৩৩
করো খোদার কাছে। ওরা বড় ভুল পথে এসেছে আজ।’ চলে গেল
আলতাফ মৃদু হেসে।
‘স্যার!’ মাহবুবের দুর্বল কণ্ঠ শোনা গেল। এগিয়ে গেল রানা ওর
কাছে। ‘স্যার, যদি অপরাধ না নেন তবে একটা কথা বলি। আমি অকৃতজ্ঞ
নই, তাছাড়া হিরো হবারও চেষ্টা করছি না, কিন্তু...কিন্তু এটা ঠিক, আমি
আপনাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছি এখন, আপনাদের কাঁধের ওপর
চেপে বসেছি সিন্ধুবাদের সেই...’
‘তাই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, এই তো?’ বাধা দিল রানা। ‘ওসব
কথা ভুলে যাও, মাহবুব। তোমাকে শত্র“দের হাতে তুলে দিয়ে পালানো
আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্যে দুঃখিত।’
‘কিন্তু...কিন্তু স্যার...’
‘তুমি আমাদের অপমান করছ, মাহবুব,’ মিশ্রী খান বিশ্রী করে হাসল।
‘তাছাড়া আমি তো আমার পেশেন্ট ভাল না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাতছাড়া
করতে পারি না।’
মাহবুবকে অবাক হয়ে চাইতে দেখে রানা বলল, ‘ওহ-হো, ডাক্তার আর
রোগীর পরিচয়ই তো হয়নি এখনও। শোনো, মাহবুব, ইনি হচ্ছেন ডক্টর
মিশ্রী খান। আপাতত ওঁরই চিকিৎসাধীনে আছ তুমি। তোমার পায়ের
ব্যাণ্ডেজ আর স্পি−ন্ট ওঁরই বাঁধা।’
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মিশ্রীর দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল মাহবুব। হাত
তুলে থামবার ইঙ্গিত করল মিশ্রী খান।
‘আর কোনও কথা নয়। এখন রি-ড্রেস করতে হবে। মনটাকে শক্ত
করে নাও, ভাতিজা। তেমন কিছু লাগবে না। আগে এই ওষুধটা খেয়ে
নাও। পায়ের অবস্থাটা একবার চেক করে দেখা দরকার।’
পাঁচ মিনিটে জ্ঞান হারাল মাহবুব। ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রানার দিকে ফিরল
মিশ্রী খান।
‘ছেলেটা মারা যাচ্ছে, ওস্তাদ। কমপক্ষে একশো চার ডিগ্রী জ্বর ওর
গায়ে, পালস্ বিট একশো বিয়ালি−শ। এক্ষুণি হাসপাতালে দেয়ার ব্যবস্থা না
করতে পারলে আর বড়জোর আটচলি−শ ঘণ্টা টিকবে। ওর অবস্থা আমার
ক্ষমতার বাইরে। আমি সালফা দিয়ে বেঁধে দিলাম, কিন্তু সেপ্সিস্ ঠেকাতে
পারব না। এখন কি করা যায়, ওস্তাদ?’
‘আপাতত কিছুই করবার নেই।’
‘এই গুহা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি কখন?’
‘খুব সম্ভব আজই রাতে।’
‘ওকে নিয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক মরে যাবে।’
.
৩৪ মাসুদ রানা-৬
‘মারা গেলে ওকে ফেলে রেখে এগোতে পারব আমরা, কিন্তু তার আগে
নয়।’ রানার মুখটা কঠোর দেখাল। ‘মাহবুব আমাদের প−্যান জানে।
ভারতীয়রা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছে আমরা এখানে ঘাস কাটতে
আসিনি। কিন্তু ওরা জানে না কিভাবে আমরা কাজ উদ্ধার করতে যাচ্ছি।
কিন্তু মাহবুব জানে। ওকে যদি ভারতীয়দের হাতে ফেলে রেখে যাই, সব
কথা বলতে বাধ্য করবে ওকে ওরা। স্কোপোলামিন ট্রু সিরাম পড়লে যে
কেউ কথা বলতে বাধ্য।’
‘আধমরা ছেলেটার ওপর স্কোপোলামিন!’ অবিশ্বাসের ভাব মিশ্রীর
মুখে।
‘কেন নয়? তুমি বা আমি হলেও তাই করতাম। এতবড় একটা
নৌঘাঁটির নিরাপত্তার জন্যে এটুকু করাটা কিছুই নয়।’
‘বুঝলাম, ওস্তাদ। এরই জন্যে ওকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। নিজ
হাতে খুনও করতে পারছি না, আবার কোথাও ফেলে রেখেও পালাতে পারছি
না। অথচ বেচারা ভাবছে আমরা ওর কত বড় মঙ্গলাকাদক্ষী- কত ভালবাসি
ওকে আমরা! ওর বিপদে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা তুচ্ছ করেও ওকে
বাঁচাবার কি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ছিঃ! একটা মুমূর্ষু বাচ্চা ছেলের এই সরল
বিশ্বাসে নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছে, ওস্তাদ। ঘেনড়বা লাগছে নিজের ওপর।’
তীক্ষè দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল রানা মিশ্রী খানের মুখের দিকে। পরিষ্কার
দেখতে পেল সে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার কোমল মনটা। নিজের মনের সাথে
সে-ই কি কম যুদ্ধ করেছে গত রাত থেকে? কিন্তু কঠিন কর্তব্যের কাছে স্হে
মমতা ভালবাসার কোনও স্থান নেই। এ-কথাটা মিশ্রীও জানে। তাই তাকে
কিছুই বোঝাবার চেষ্টা করল না সে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল বাইরের
দিকে।
‘টাশ্, টাশ্, টাশ্!’ রাইফেলের গুলির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর আবার
তিনটে আওয়াজ। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর এলোপাথাড়ি শব্দ আরম্ভ
হলো। শত্র“পক্ষও এবার গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে।
ঘণ্টা খানেক পর এক-আধটা শব্দ পাওয়া গেল বহু দূর থেকে। রানা
বুঝল বিপদ কেটে যাচ্ছে μমে।
‘ওস্তাদ!’ ডাকল মিশ্রী খান আস্তে করে।
‘বলো,’ থেমে দাঁড়াল রানা সূচীভেদ্য অন্ধকারে। তিনহাত দূরেও কিছু
ঠাহর করা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে ওরা।
‘আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?’
‘সে বয়স আমার পার হয়ে গেছে। কেন, ভয় লাগছে নাকি?’
‘কিসের যেন শব্দ শুনলাম, ওস্তাদ!’ কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
মিশ্রী খান।
দুর্গম দুর্গ ৩৫
‘ওটা মনের ভুল।’
‘না, ওস্তাদ, অস্পষ্ট মত যেন শুনলাম মানুষের গলা। দু’জন কথা
বলছে।’
‘অসম্ভব। এখনও আধমাইল আছে সেই ডাকবাংলো। বাদলার রাতে
এই জঙ্গলের মধ্যে কে আসবে?’
এখানে ওখানে টুপ-টাপ পানি পড়ছে ঝরা পাতার ওপর। রানার বাম
হাতটা ধরে ফেলল মিশ্রী খান। রানা বুঝল ভয় পেয়েছে মিশ্রী খান।
‘সেজন্যেই তো ভাবছি, মানুষ না। জিন-টিন হতে পারে।’
চুপচাপ বেশ কিছুদূর এগোল ওরা। হঠাৎ মিশ্রী খান বলল, ‘ওস্তাদ,
ক্যাপ্টেন আলতাফ কি বেঁচে আছে এখনও?’
‘কেন? তুমি কি ভাবছ আলতাফের ভূতই পিছু নিয়েছে আমাদের?’
একটু হাসল রানা। মিশ্রী খানের কাঁধের ওপর হাত রাখল। ‘এত সহজে
মরবে না আলতাফ। ও হচ্ছে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ গেরিলা ফাইটার।’
‘তবু ওকে একা এভাবে যেতে দেয়া আপনার ঠিক হয়নি।’
‘ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা তোমার-আমার চাইতে ওর অনেক বেশি
আছে। তুমি হয়তো জানো না, আর্মিতে ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিল।’
‘কি বললেন?’ চমকে উঠল মিশ্রী খান। ‘আমি তো জানতাম
ক্যাপ্টেন...’
‘ডাবল ডিমোশন হয়েছিল ওর। বর্ডারে ওর বাড়ি। রান অফ কাচের
যুদ্ধের সময় ওর বাবা-মা, স্ত্রী এবং তিন ছেলেকে ভারতীয় সৈন্যরা ঘর
জ্বালিয়ে দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। খবরটা কানে যেতেই ছদ্মবেশে চলে
গিয়েছিল সে শত্র“ লাইনের পেছনে। ছয় মাস নিরুদ্দেশ থেকে এই
হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী প্রত্যেকটা লোককে খুঁজে বের করে নির্মম প্রতিশোধ
নিয়েছিল সে। যখন পাকিস্তানে ফিরে এল তখন চেহারা আর চেনা যায় নাহাড়
ক’খানা আছে শুধু শরীরে। অ্যারেস্ট করা হলো ওকে সেনাবাহিনী থেকে
পালানোর অপরাধে, বিচারে ডাবল্ ডিমোশন হলো। এমন সময় আমাদের
চীফ সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে ওকে নিয়ে এলেন পাকিস্তান কাউন্টার
ইন্টেলিজেন্সে। এখন বুঝতে পারছ, ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা ওর এত বেশি
কেন?’
মিশ্রী খান এতক্ষণ মনে মনে তলিয়ে দেখে বুঝল কেন রানা বিশেষ
সম্মানের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন আলতাফের সঙ্গে, কেন ওর মতামতের
এত দাম দেয়, কখনও কেন হুকুমের সুরে আদেশ দেয় না, অনুরোধ করে।
চুপচাপ বেশ কিছুদূর চলে গেল ওরা। হঠাৎ রানার আস্তীন ধরে টান দিল
মিশ্রী খান।
‘ওস্তাদ! আবার শুনলাম!’
হেসে ফেলল রানা। পরমুহূর্তেই সতর্ক হয়ে গেল ওর সজাগ মন।
.
৩৬ মাসুদ রানা-৬
বলল, ‘সত্যি শুনেছ তুমি? কোন্দিক থেকে এল শব্দটা?’
‘বামদিক থেকে!’ গলাটা কেঁপে উঠল মিশ্রী খানের। অদ্ভুত মানুষের
চরিত্র। সামনা-সামনি যুদ্ধক্ষেত্রে যে লোক বীরের মত যুদ্ধ করতে পারে,
রাত্রির অন্ধকারে সেই লোকই শিশুর মত ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত। শিশুকাল
থেকেই ভয়টা মজ্জার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় আমাদের কুসংস্কারাচ্ছনড়ব মায়েরা।
কিন্তু রানার মন এইসব গবেষণায় একবিন্দু সময়ও নষ্ট করল না। মাথায়
চলছে ওর দ্রুত চিন্তা। তিন সেকেণ্ডেই প−্যান ঠিক করে ফেলল সে। মিশ্রী
খানকে বুঝিয়ে বলতেই ভূতের ভয় কেটে গেল ওর। কিছুদূর এগিয়ে চট্
করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল রানা, আর কৌশলে দু’জনের পায়ের
শব্দ করতে করতে এগিয়ে গেল মিশ্রী খান সামনের দিকে।
আμমণটা এল পেছন থেকে। প্রায় হুড়মুড় করে ওর ঘাড়ের ওপর এসে
পড়ল লোকটা। ধাঁই করে রানার কনুইয়ের গুঁতো পড়ল ওর পেটের ওপর,
সোলার পে−ক্সাসে। নিঃশব্দে পড়ল লোকটা মাটিতে। পিস্তলের বাঁটটা প্রচণ্ড
জোরে ওর মাথায় মারতে গিয়েও সামলে নিল রানা। সোজা ধরে থাকল
সেটা লোকটার বুকের দিকে। কিন্তু নড়ল না লোকটা। এত সহজেই অজ্ঞান
হয়ে গেল? সাবধানে এক পা এগিয়ে ওর হাঁটুর ওপর মাঝারি রকম একটা
লাথি দিল রানা বুট দিয়ে। এটা একটা পুরানো কৌশল। জ্ঞান থাকলে নড়ে
উঠতেই হবে। কিন্তু একটুও নড়ল না ধরাশায়ী দেহটা। হাঁটু গেড়ে বসল
রানা পাশে। হুড লাগানো একটা পেনসিল টর্চ জ্বেলেই চমকে উঠল সে।
লেফটেন্যান্ট আরীফ! এরই সাথে দেখা করতে চলেছে ওরা।
সাত
সতেরো-আঠারো বছরের বাচ্চা ছেলে একটা। দাড়ি গোঁফ ওঠেনি এখনও।
মেয়েলী চেহারা। লম্বায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে। এত অল্প বয়সী ছেলের
ওপর কমোডোর এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়েছেন দেখে বিস্মিত না হয়ে
পারল না রানা। কালো একটা রেইনকোট পরনে, পায়ে গাম বুট। বাম
হাতের কব্জিতে বড় সাইজের বেমানান ঘড়ি। মাথার হুডটা চিবুকের নিচে
বেল্ট দিয়ে বাঁধা। একটা ক্যানভাসের ব্যাগ ঝুলছে কাঁধ থেকে। আঙুলের
নখগুলো বড় বড়।
জ্ঞানহীন দেহটা উপুড় করে বগলের তলা দিয়ে হাত দিয়ে ঢুকিয়ে টেনে
দাঁড় করাল রানা। তারপর নিয়ে এল রাস্তার ওপর। একটা সাঙ্কেতিক শিস
দিতেই ছুটে এল মিশ্রী খান।
মিনিট দু’য়েক পর নড়ে-চড়ে উঠল লেফটেন্যান্ট আরীফের দেহটা।
দুর্গম দুর্গ ৩৭
চোখের পাপড়ি কেঁপে উঠল প্রমে, তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সে। চোখের
ওপর টর্চের আলো পড়ায় চোখ ছোট করল ভুরু কুঁচকে।
‘ওস্তাদ, এ যে দুধের বাচ্চা! এই ছোকরার কাছেই যাচ্ছিলাম আমরা?’
‘কে তোমরা?’ মেয়েলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লেফটেন্যান্ট আরীফ।
‘তুমি যাদের খুঁজতে বেরিয়েছ আমরা সেই লোক, লেফটেন্যান্ট
আরীফ। কিন্তু আমাদেরই তোমার সঙ্গে দেখা করবার কথা- তুমি চলেছিলে
কোথায়?’
‘তোমাদের গ্র“পের কোড সিগন্যাল বলো আগে।’
‘ডেলায়লা।’
‘আপনি কি মেজর মাসুদ রানা?’ উঠে বসল আরীফ।
‘হ্যাঁ, তাই। আমার প্রশেড়বর জবাব দাও, আরীফ।’
‘গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছিলাম আপনারা পৌঁছে
গেছেন। অথচ সকাল থেকে অপেক্ষা করছি, কারও দেখা নেই। তাই
যাচ্ছিলাম আপনাদের বর্তমান অবস্থা জানবার জন্যে। আপনি বডি জোরে
মেরেছেন আমাকে।’
‘আমাদের খুঁজে পেতে কি করে?’
‘এখানকার প্রতিটা পাহাড়, প্রতিটা গুহা আমার নখদর্পণে।’ ডান পা-টা
ভাঁজ করে সোজা করল একবার। ‘হাঁটুটা ব্যথা করছে কেন?’
স্পড়ে গিয়েছিলে বেকায়দা মত,’ অম−ান বদনে মিথ্যে কথা বলল রানা।
‘গুলি কোরো না, নাজির। এরা আমাদের লোক,’ হঠাৎ বলে উঠল
আরীফ।
বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল রানা। দেখল পেছনে মিশমিশে কালো একটা
ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের আলো পড়তেই চক্চক্ করে উঠল ওর
হাতের রিভলভারটা।
‘এই লোক কে?’
‘ওর নাম নাজির বেগ, আমার সহকারী। কমোডোর জুলফিকার
পাঠিয়েছেন ওকে বছর খানেক আগে। ওর সামনে সব কথা বলতে পারেন।
যাক্,’ উঠে দাঁড়িয়ে বার কয়েক পা-ঝাড়া দিল আরীফ। ‘এখন কি প−্যান?
আর দু’জন কোথায়?’
‘প্রম দরকার এখন খাবার। কাল দুপুরের পর থেকে আমরা কেউ কিছু
খাইনি।’
‘খাবার আমার সঙ্গে আছে।’ ক্যানভাসের ব্যাগটা দেখাল আরীফ।
‘তারপর দরকার ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ আর শুকনো কাপড়।’
‘ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ কেন?’
‘আমাদের মধ্যে একজন সাদঘাতিক রকম জখম হয়েছে। খুব সম্ভব
বাঁচবে না।’
.
৩৮ মাসুদ রানা-৬
‘নাজির!’ হুকুম করল আরীফ। ‘গ্রামে ফিরে যেতে হবে তোমাকে।
যেখান থেকে পারো ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ আর শুকনো কাপড় জোগাড় করে
আনো।’
গুহাটা চিনিয়ে দিল রানা। কি ভেবে আরীফ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা
ঠিক পথ চিনে ফিরতে পারবেন তো?’
‘আশা তো করি। কেন?’
‘সন্দেহ যখন আছে তখন আমাকে যেতে হবে আপনাদের সঙ্গে।
ভাবছিলাম নাজিরের সঙ্গে একজন থাকলে জিনিসগুলো জোগাড় করতে
সুবিধে হত ওর।’
‘আমি যাচ্ছি ওর সঙ্গে,’ বলল মিশ্রী খান। ‘সেই সাথে খানিকটা
ব্যায়াম-ও হয়ে যাবে।’
নাজির বেগ আপত্তি করল। বলল একাই পারবে সে। কিন্তু মিশ্রী খান
ছাড়ল না। বলল, ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’
মিশ্রী খান আর নাজির বেগ রওনা হয়ে যেতেই রানারাও এগোল।
রানাদের আকস্মিক ভাবে পেয়ে গিয়ে মানসিক উদ্বেগের অবসান হয়েছে
আরীফের। খুশি মনে চলল সে বকর বকর করতে করতে। শত্র“ এলাকার
মধ্যে সর্বক্ষণ কতখানি অনিশ্চয়তা আর বিপদের ভেতর ভয়ে ভয়ে সাবধান
থাকতে হয়, সেই গল্প। একবার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল- নাজিরকে তো
নিয়েই গিয়েছিল। দু’জন সৈন্যকে খালি হাতে খুন করে প্রাণ নিয়ে ফিরেছে
নাজির বেগ। লুকিয়ে দুই-দুইবার ঢুকেছে সে দ্বারোকা দুর্গের মধ্যে। প্রতিটা
জিনিস ওর মুখস্থ। কোথায় কট্রোল রূম, কোথায় ব্যারাক, কোথায়
অফিসারস কোয়ার্টার, সেন্ট্রি পোস্ট, সবকিছু দেখে এসেছে। একবার তো
পুরো একটা রাত ছিল সে দুর্গের মধ্যে।
খুশি হয়ে উঠল রানার মন। খুবই কাজে আসবে তাহলে লোকটা।
‘তোমার সহকারীটা একটি রতড়ব দেখতে পাচ্ছি!’
‘আশ্চর্য রতড়ব। কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি এতখানি বিতৃষ্ণ লোককে
বোধহয় এখানে পাঠানো ঠিক হয়নি। ভারতীয় সৈন্যরা জুনাগড়ে নাকি ওর
পরিবারের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করেছিল, ওর চোখের সামনে হত্যা
করেছিল ওর স্ত্রীকে, ওকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে চাবুক মেরে সারাদেহ জর্জরিত
করেছিল। ফেলে রেখে দিয়েছিল শকুনে ছিঁড়ে খাবার অপেক্ষায়। আশ্চর্য
ভাবে বেঁচে গেছে ও। তারপর থেকে প্রতিশোধ নিয়ে চলেছে সুযোগ মত।
আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, কী ভয়ঙ্কর সে প্রতিশোধ। ভারতীয়
সৈন্য দেখলেই মাথায় খুন চেপে যায় ওর। অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় ও, নিঃশে
পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, পিঠের ওপর বসিয়ে দেয় ছুরি। টুঁ শব্দ করার আগেই
শেষ। অসংখ্য খুন করেছে ও। জীবনের কোনও আনন্দ ওর কাছে এর চেয়ে
বড় নয়।’
দুর্গম দুর্গ ৩৯
শিউরে উঠল একবার লেফটেন্যান্ট আরীফ নিজেই নাজির বেগের কথা
ভেবে।
‘আমাকে ও খুব মানে। আমার বাবা ছিলেন জুনাগড়ের মস্ত বড়
জমিদার। সব লুটে-পুটে নিয়েছে হিন্দুরা রায়টের সময়। আমি বাবার
একমাত্র সন্তান। ও নাকি আমাদেরই প্রজা ছিল। আমি অবশ্য দেখিনি ওকে
কোনদিন।’
‘তুমি কলেজ ছেড়েছ কবে?’
‘বি. এস. সি. পাস করে আর পড়িনি, এই চাকরিতে ঢুকে পড়েছি।
দেখতে কম মনে হলেও আসলে বয়স আছে আমার।’
খানিকক্ষণ নীরবে হাঁটল রানা। খাড়াই উতরাই ভেঙে অন্ধকার রাতে
চলতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে।
‘আমি কিছুই চিনতে পারছি না, আরীফ। কোন্দিকে চলেছি আমরা?
আর কতদূর?’
হেসে উঠল আরীফ।
‘আর মাত্র দু’শ গজ আছে। অন্য রাস্তায় নিয়ে এসেছি!’ আবার হাসল।
‘আপনাকে আপনারই আস্তানায় নিয়ে চলেছি আমি, অথচ আপনার চেহারাটা
একবারও দেখিনি। এখন পর্যন্ত আপনার গলার স্বর ছাড়া কিছুই চিনি না।
আশ্চর্য লাগছে ভাবতে। কয়েকটা কোড ওয়ার্ড মানুষের মধ্যে কি অদ্ভুত
বাঁধন সৃষ্টি করে দেয়! কিন্তু আমাকে চিনলেন কি করে আপনি?’
‘তোমার ছবি আর ডোশিয়ে দেখেছি আমি করাচিতে।’
‘ও।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘আপনার গলার স্বর শুনে আপনার
চেহারাটা মনে মনে কল্পনা করে রেখেছি আমি। গুহায় পৌঁছে মিলিয়ে দেখব
মেলে কিনা। আমার মনে হয় ঠিক মিলে যাবে।’
এই ছেলেমানুষী খেলায় মজা পেল রানাও। একঘেয়ে হাঁটার চেয়ে মনে
মনে এইসব খেলায় দোষের কিছু নেই।
‘মিলল কিনা আমি বুঝব কি করে? বলো শুনি, কেমন দেখতে আমি?’
‘বয়স পঞ্চানড়ব। গাল দুটো বসা, কপালে ভাঁজ, ভুরু জোড়া কাঁচাপাকা!
এক মুঠো দাড়ি আছে চিবুকে।’ আবার খানিক ভেবে বলল, ‘টুপির নিচে
মাথা ভর্তি চকচকে টাক আছে।’
নিজের চেহারার এই বর্ণনা শুনে খুশি হতে পারল না রানা। চুপ করে
রইল সে।
‘কি, মিলেছে না?’ জিজ্ঞেস করল আরীফ উৎসাহিত কণ্ঠে।
‘ঠিক মিলে গেছে!’ তৃতীয় এক ব্যক্তি কথা বলে উঠল। থমকে দাঁড়াল
ওরা দু’জনেই। হো-হো করে হেসে উঠল আলতাফ। কাঁধে রাইফেল
ঝুলানো।
‘আলতাফ! তুমি...তুমি ফিরলে কখন?’ বিস্মিত রানা জিজ্ঞেস করল।
.
৪০ মাসুদ রানা-৬
‘ব্যাটাদের পুব দিকে ভাগিয়ে দিয়ে আধঘণ্টা আগে ফিরে এসে পাহারা
দিচ্ছি। ইনি নিশ্চয়ই লেফটেন্যান্ট আরীফ? মিশ্রী কোথায়?’
‘ও গেছে ওর রোগীর জন্যে ওষুধপত্র আর শুকনো কাপড় জোগাড়
করতে।’
‘ফিরবে কি করে? ওর তো অসম্ভব ভূতের ভয়।’
‘সাথে লোক আছে।’
সাবধানে ক্যানভাস সরিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল তিনজন। আলো জ্বলছে
ভেতরে। গুহায় ঢুকে মোমবাতির আলোয় রানাকে আপাদমস্তক একবার
দেখেই ভয়ানক লজ্জা পেয়ে গেল আরীফ।
‘মাফ করবেন, মেজর রানা। কণ্ঠস্বর শুনে আমি ভাবতেও পারিনি যে
আপনি আমার চেয়ে মাত্র চার-পাঁচ বছরের বড়। দাড়িও নেই, টাকও নেই।
হেরে গেছি আমি।’
কোনও জবাব না দিয়ে প্রমেই মাহবুবের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা।
জেগেই আছে সে। খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। চোখ দুটো লাল। বলল, পায়ে
আর কোনও বোধ নেই, ব্যথাও নেই। রানা বুঝল লক্ষণটা খুবই খারাপ।
মিশ্রী খান এখন তাড়াতাড়ি ফিরে এলে বাঁচা যায়। মাহবুবের গায়ে প্রবল
জ্বর, কপালে হাত রাখা যাচ্ছে না। প্রমাদ গুণল রানা। ওকে এখান থেকে
সরানোই একটা মস্তবড় সমস্যা হয়ে যাবে।
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কিছুই খেলো না মাহবুব। পাশ ফিরে ভাঙা
ভাঙা অস্বস্তিকর ঘুমে আচ্ছনড়ব হয়ে পড়ল। মিশ্রী এবং মাহবুবের ভাগ আলাদা
করে রেখে নিল খেয়ে রানা আর আলতাফ। খাবার শেষে ফ্লাস্কে করে আনা
চা-টুকু মনে হলো যেন অমৃত। তৃপ্তির সঙ্গে কাপ শেষ করে উঠে দাঁড়াল
রানা। রাত দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট। মাহবুবের রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার তুলে
নিয়ে বলল, ‘ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে চেষ্টা করে দেখি স্যামসনকে পাওয়া
যায় কিনা। আমার সাথে যে-কোনও একজন আসতে পারো। উঁচুতে উঠলে
রিসেপশন ভাল পাওয়া যাবে।’
আলতাফ আর আরীফ দু’জনেই উঠে দাঁড়াল।
‘একজন যেতে পারো, অপর জন থাকবে মাহবুবের কাছে।’
‘ঘুমিয়ে পড়েছে মাহবুব। এই অল্পক্ষণের মধ্যে কিছুই হবে না ওর।’
‘সেকথা ভাবছি না। কিন্তু কোন রকম ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আমি চাই
না ও ভারতীয় সৈন্যদের হাতে ধরা পড়থক। যে করেই হোক ওকে দিয়ে
কথা বলাবে ওরা। সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে।’
‘তুমি মিছেই ভাবছ, মেজর রানা,’ বলল আলতাফ। ‘আশেপাশে এক
মাইলের মধ্যে ওদের একটি প্রাণীরও চিহ্ন নেই।’
একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেল রানা। আস্তে করে ঝাঁকি দিতেই
চোখ মেলে চাইল মাহবুব।
দুর্গম দুর্গ ৪১
‘আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। দশ মিনিটেই ফিরে আসব। কোনও
অসুবিধে হবে না তো তোমার?’
‘কি অসুবিধে? কিছু না। একটা রাইফেল রেখে যান আমার পাশে, আর
বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যান।’ ট্র্যান্সমিটারের দিকে চেয়ে হাসল মাহবুব।
‘ফিরে এসে ঢোকার সময় ডাক দিয়ে ঢুকবেন।’
আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা তিনজন। তিনজন একসাথে না
থাকলে পাহাড়টায় ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ত। পরিষ্কার পাওয়া গেল করাচি।
খবর শুনে চমকে উঠল সবাই। যুদ্ধের অবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে।
দ্বারোকা ঘাঁটি শেষ করতে না পারলে সমূহ বিপদ। সর্বশেষ সংবাদ, রওনা
হয়ে গেছে পাকিস্তানী নৌবাহিনী।
ফিরে এসে আস্তে ডাকল রানা মাহবুবের নাম ধরে গুহামুখে। সাড়া নেই
কোনও। আবার ডাকল। এবারও সাড়া নেই। ট্র্যান্সমিটারটা আলতাফের
হাতে দিয়ে পিস্তল বের করল রানা।
বাম হাতে টর্চ। ঝট্ করে পর্দা সরিয়েই সেফটিক্যাচ্ আর টর্চের বোতাম
একসাথে টিপল রানা।
চারদিকে ঘুরে এল আলোটা একবার। এবার ধীরে ধীরে প্রতিটা কোণা
পরীক্ষা করল রানা। মেঝেটা পরীক্ষা করল।
এলোমেলো বিছানা পড়ে আছে। মাহবুব নেই।
আট
‘তার মানে, ও তখন জেগেই ছিল,’ আলতাফ বলল উত্তেজিত চাপাস্বরে।
‘হ্যাঁ, জেগে ছিল। এবং আমার প্রত্যেকটি কথা শুনেছে ও। কেন
ওর প্রতি আমাদের এত আগ্রহ, এত যতড়ব, বুঝতে পেরেছে ও পরিষ্কার। ও
যে আমাদের কাজে কতবড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা ওর আর অজানা নেই।
ওর মনের মধ্যে কি তুফান যে বয়ে গেছে, কি প্রচণ্ড অভিমান উথলে উঠেছে
ওর বুকের মধ্যে, ভাবতেও আমার...আলতাফ!’ ঘড়ির দিকে চাইল একবার
রানা। স্পনেরো মিনিটে বেশি দূর যেতে পারবে না ও, এই গুহার পঞ্চাশ
গজের মধ্যেই আছে। চলো, তিনজন তিন দিকে যাব। খুঁজে বের করতেই
হবে ওকে।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুটো বড় বড় পাথরের মাঝখানে পাওয়া গেল
মাহবুবকে। অজ্ঞান। এমন ভাবে লুকিয়েছিল যে পাথরের গায়ে রক্তের দাগ
না দেখতে পেলে কিছুতেই বের করা যেত না।
অবলীলায় তুলে নিল আলতাফ ওকে, ফিরে এল গুহায়। খানিকটা
....
৪২ মাসুদ রানা-৬
ব্র্যাণ্ডি খাওয়াবার চেষ্টা করল রানা ওকে- বেশির ভাগই পড়ে গেল কষা বেয়ে
বাইরে। আলগা হয়ে যাওয়া বেতগুলো বেঁধে দিল রানা শক্ত করে। নাকে
একটা গন্ধ আসতেই চম্কে উঠল সে। মিশ্রী খান না আসা পর্যন্ত কিছুই
বোঝা যাচ্ছে না ঠিক মত, কিন্তু রানা মনে মনে উপলব্ধি করল, মিশ্রী খানও
কিছু করতে পারবে না এখন আর। কেউই কিছু করতে পারবে না। সময়
পার হয়ে গেছে।
দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করছে রানা। তন্দ্রায় জড়িয়ে
আসতে চাইছে দুই চোখ। অনেকক্ষণ পর চোখ তুলতেই দেখল এতক্ষণ
একদৃষ্টে চেয়ে ছিল আরীফ ওর দিকে, ও চাইতেই চোখ সরিয়ে নিল।
‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘না, ভাবছিলাম, দ্বারোকা পৌঁছবেন কি করে?’
‘তোমার কোনও প−্যান আছে?’
‘আশেপাশের প্রত্যেকটা গ্রামে আজ রাত থেকে সার্চ আরম্ভ হয়ে যাবে।
আমার মনে হয় ভোর হওয়ার আগেই যদি আমরা রেল লাইনটা μস করে
পশ্চিমে চলে যেতে পারি তাহলে আমাদের খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে
কঠিন হবে। শত শত গুহা পথ আছে পশ্চিমের পাহাড়গুলোর গায়ে,
আমাদের ধরা খুবই কঠিন হবে। একবার দ্বারোকা পৌঁছতে পারলে আর চিন্ত
া নেই। ওখানে দু’দুটো গোপন আস্তানা আছে আমাদের।’
‘আমরাও সেই প−্যানই ঠিক করে এসেছিলাম। ভয় ছিল গুহার গোলক
ধাঁধায় না পড়ে যাই। তুমি সঙ্গে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। ভোর চারটের
সময় আমরা এখান থেকে রওনা হব।’
‘কি চিন্তা করছেন?’ অনেকক্ষণ রানাকে চুপচাপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস
করল আরীফ।
‘ভাবছি টিএনটি আর ডিটোনেটারের বাক্স দুটো কোথাও লুকিয়ে
ফেলতে পারলে হত। কখন কি অবস্থায় আমাদের এই গুহা ছাড়তে হয়
কিছুই বলা যায় না। একে মাহবুব, তার ওপর বাক্সগুলো, সব মিলে মস্ত
বোঝা হয়ে যাবে জরুরী অবস্থায়।’
খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবল আরীফ, তারপর বলল, ‘চিন্তা
নেই। আমি এগুলো এমন একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখব যেখান থেকে খুঁজে
বের করা কারও পক্ষে সম্ভবপর হবে না কিছুতেই। দুটো বাক্স তো একা
নিতে পারব না, আপনাদের একজনকে আসতে হবে আমার সঙ্গে।
আধঘণ্টার ব্যাপার।’
‘আমি যাচ্ছি,’ উঠে দাঁড়াল আলতাফ। বড় বাক্সটা অনায়াসে তুলে নিল
কাঁধের ওপর। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল আরীফের পেছন পেছন।
মিশ্রী খান আর নাজির বেগ ফিরে এল আধঘণ্টার মধ্যেই। প্রায় সাথে
সাথেই ফিরল আলতাফ আর আরীফ। কথার খৈ ফুটল মিশ্রী খানের মুখে।
দুর্গম দুর্গ ৪৩
নাজির বেগের আশ্চর্য কৌশলে ওষুধপত্র, খাবার আর কাপড়-চোপড়
জোগাড়ের কাহিনী। শেষে বলল, ‘খোদ কর্নেলের কোয়ার্টার থেকে রুটি
নিয়ে এসেছে সে।’
‘কর্নেলের বাড়ি থেকে? অসম্ভব!’ বলল রানা।
‘নাজির বেগের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, ওস্তাদ। কিছুই অসম্ভব নয়।
আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গেছে, দুই হাঁটু ঠকাঠক বাড়ি খাচ্ছে তখন
আমার, চিন্তা করছি একটু আওয়াজ পেলেই ঝেড়ে দৌড় দেব- কিন্তু
কোন্দিকে যাব স্থির করে উঠতে পারছি না...এমন সময় ঝুড়ি ভর্তি করে
এইসব নিয়ে বেরিয়ে এল ভাতিজা নিরাপদে। এই লোকের সঙ্গে আর
কোথাও পাঠালে আমি হার্টফেল করব, ওস্তাদ!’
‘কিন্তু গার্ড, সেন্ট্রি, কেউ দেখল না?’
‘সব ব্যাটারা বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে আমাদের খুঁজতে। কর্নেলের
সদর দরজায় দুটো টোকা দিয়েই ছুটে গিয়ে ঢুকেছে সে পেছনের রানড়বাঘরে।
পথে গ্রামের কয়েকজন লোককে ডেকে তুলে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জেনেছে
মিলিটারি সার্চের ব্যাপার। সব কিছুই ওর চেনা।’
আরীফ আর নাজির বেগ নিচু গলায় কি যেন আলাপ করছে। বেশির
ভাগ কথা বলছে নাজির বেগ।
‘কি ব্যাপার, আরীফ?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যাপার তেমন সুবিধের নয়, মেজর। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের এই
জায়গা ছেড়ে সরে যেতে হবে। নাজির তো এই মুহূর্তে রওনা হতে চায়।
আশেপাশে সমস্ত গ্রাম আজ রাতের মধ্যে সার্চ করে ওরা ভোরে আবার
আসবে পাহাড়ে। এখনই সরে না গেলে অসুবিধা হবে।’
‘কিন্তু মাহবুব?’
‘ওস্তাদ!’ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মিশ্রী খান। ‘মাহবুবের এই দশা
হলো কি করে?’
স্পালিয়ে গিয়েছিল ও গুহা থেকে। আমাদের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চায়
না ও আর। লুকিয়ে ছিল দুটো মস্ত পাথরের ফাঁকের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায়।
আলতাফ খুঁজে বের করেছে।’
জিভ দিয়ে চুক্ চুক শব্দ করল মিশ্রী খান। তারপর বলল, ‘আগামী
দু’দিনের মধ্যে ওকে এখান থেকে এক পা-ও সরানো যাবে না। আজ রাতে
তো অসম্ভব।’
ব্যাণ্ডেজ খুলতে আরম্ভ করল মিশ্রী খান। পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের
করল রানা। দুর্গের ম্যাপ। বলল, ‘এদিকে আসুন, মি. নাজির বেগ। দুর্গটা
সম্পর্কে আপনার সাথে কিছু আলাপ করতে চাই। শুনলাম দুই-দুইবার
আপনি ঢুকে দেখে এসেছেন দুর্গের ভেতরটা। আমি নিজেও অনেক কিছু
জানি, কিন্তু আপনার জ্ঞানও আমার খুব কাজে লাগবে। সব কিছু বলে যান,
........
৪৪ মাসুদ রানা-৬
কোথায় কি আছে কিচ্ছু বাদ দেবেন না। পাওয়ার রূম, গার্ড রুটিন, অ্যালার্ম
সিসটেম, সব। যত সামান্য ব্যাপারই হোক বাদ দেবেন না, যেমন ধরুন
দরজাগুলো ভেতর দিকে খোলে না বাইরের দিকে, কোন্খানে ছায়াটা বেশি
ঘন, কোথায় আলো, কোথায় অন্ধকার, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ব্যাপার জানতে
চাই আমি।’
‘কিন্তু ভেতরে ঢুকছেন কি করে আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল আরীফ।
‘এখনও সেটা জানি না। দুর্গটা না দেখলে আগে থেকে কিছুই বলা
যাচ্ছে না।’ রানা অনুভব করল চট্ করে ওর দিকে একবার চেয়েই অন্য
দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল আলতাফ। দুর্গে ঢোকার প−্যান ওরা নৌকাতেই ঠিক
করে রেখেছে। কিন্তু যত কম লোকে প−্যানটা জানতে পারে ততই মঙ্গল।
এরই ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।
ঘণ্টা খানেক হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল ওরা চার্টের ওপর। প্রতিটা নতুন
তথ্য নোট করে নিল রানা। অদ্ভুত তীক্ষè নাজির বেগের চোখ। মাত্র
দুইবারের স্বল্পস্থায়ী অবস্থানেই সবকিছু দেখে এসেছে সে। চার্ট দেখেই ছবির
মত সবকিছু ফুটে উঠল ওর মনের পর্দায়- গড় গড় করে বলে গেল যা যা
দেখেছে সব। মিশ্রী খান আর আলতাফ ব্রোহী মাহবুবের পা-টা ওষুধ দিয়ে
ব্যাণ্ডেজ করে দিল আবার। কাজ শেষ করেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান
মাহবুবের পাশে।
‘পিঠটা একটু সোজা করে নিই, ওস্তাদ, তারপর একটু কথা আছে।’
আলতাফ নিঃশব্দে রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আধ মিনিটের
মধ্যেই ফিরে এল সে।
‘সবাই চুপ! কি যেন নড়াচড়া করছে বাইরে।’
কথাটা শেষ হবার আগেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল
নাজির বেগ। এমনি সময় হঠাৎ কথা বলে উঠল মাহবুব।
প্রলাপ বকছে। μমেই গলার স্বর উঠছে ওপরে।
মিশ্রী খান উঠে বসে মাহবুবের একটা হাত ধরল, আরেক হাত কপালে
আর চুলের মধ্যে বুলাতে বুলাতে নিচু গলায় আবোল তাবোল কথা বলতে
আরম্ভ করল। একঘেয়ে ভাবে কথা বলে যাচ্ছে মিশ্রী খান। প্রমে কিছুই
ফল হলো না- কিন্তু অল্পক্ষণেই হিপনোসিসের মত কাজ দিল মাথায় হাত
বুলানো আর অনর্গল একঘেয়ে সুরে কথা বলা। থেমে গেল প্রলাপ ধীরে
ধীরে। হঠাৎ চোখ খুলে চাইল সম্পূর্ণ সজাগ মাহবুব।
‘কি ব্যাপার, ক্যাপ্টেন খান? আমার মাথায়...’
‘শ্ শ্ শ্!’ চুপ করতে ইশারা করল মিশ্রী খান।
বুঝতে পারল মাহবুব। গুহার চারদিকে চেয়ে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে
গেল ওর কাছে। আবার চোখ বন্ধ করল সে।
‘কিছু না,’ পর্দা সরিয়েই বলল নাজির বেগ। ‘কয়েকটা পাহাড়ী ছাগল।’
দুর্গম দুর্গ ৪৫
‘ছাগল তো মনে হলো না আমার কাছে,’ বলল আলতাফ। ‘আমি
আরেকবার দেখে আসি।’
মিশ্রী খানের ইশারায় রানাও বেরিয়ে এল গুহার বাইরে।
‘একটু শুঁকে দেখেন, ওস্তাদ!’
রক্তমাখা একরাশ ব্যাণ্ডেজ তুলে ধরল মিশ্রী খান রানার নাকের সামনে।
একটু শুঁকেই নাক কুঁচকে পেছনে সরে গেল রানা।
‘কি হয়েছে, মিশ্রী?’
‘গ্যাংগ্রিন!’ বলল মিশ্রী খান হতাশ কণ্ঠে। ‘গ্যাস গ্যাংগ্রিন। দাবানলের
মত ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলেটাকে বাঁচানো গেল না, ওস্তাদ।’
একটু পরেই ফিরে এল আলতাফ। ছাগলও দেখতে পায়নি সে এবার।
নয়
ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ল ওরা ভারতীয় সৈন্যদের হাতে। ভোর তখন
সাড়ে চারটা। কোনও সুযোগ পেল না ওরা বাধা দেবার। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত
অবস্থায় আÍসমর্পণ করতে হলো ওদেরকে অতর্কিতে অনুপ্রবেশকারী
সৈন্যদের কাছে।
রানাই প্রম জাগল। রানার অচেতন মনের একটা অংশ সব সময়
প্রস্তুত থাকে বিপদের জন্যে। এক মুহূর্তে পূর্ণ সজাগ রানা উঠে বসল গুহার
মধ্যে কি একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে। ডান হাতটা চলে গেল “িপ্রং লোডেড
শোলডার হোলস্টারের কাছে। কিন্তু দপ্ করে জ্বলে উঠল একটা টর্চের তীব্র
আলো। মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল রানা। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে।
টর্চের পেছন থেকে একটা তীক্ষè কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘কেউ নড়বে না। নড়লেই মারা পড়বে!’
এক, দুই করে আরও তিনটে টর্চ জ্বলে উঠল। সমস্ত গুহাটা আলোকিত
হয়ে গেল উজ্জ্বল আলোয়। রানা চেয়ে দেখল কেবল টর্চ নয়; অটোমেটিক
কারবাইনের চক্চকে নলও দেখা যাচ্ছে টর্চগুলোর পাশে।
‘মাথার ওপর হাত তোলো সবাই!’ আবার এল তীক্ষè আদেশ। ধীরে
ধীরে মাথার ওপর হাত তুলল রানা। চেয়ে দেখল মাহবুব ছাড়া সবাই উঠে
বসেছে এতক্ষণে। ওর দেখাদেখি সবাই হাত তুলল মাথার ওপর।
‘দেখেছ, শান্তা, একবিন্দু ভাব পরিবর্তন নেই ওদের মুখে, চোখের
পাতাও কাঁপল না একবার। ভয়ঙ্কর লোক এরা, শান্তা। পাকিস্তান তার সেরা
লোকদেরই পাঠিয়েছে।’
তিক্ততায় ভরে গেল রানার মন। হেরে গেছে সে। এবার কপালে কি
ঘটতে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে আঁৎকে উঠে দূর করে দিল সে চিন্তাটা মন
.......
৪৬ মাসুদ রানা-৬
থেকে। ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ কি? প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ, প্রতিটা চিন্তা
এখন ব্যয় করা উচিত বর্তমানের পেছনে। ধরা পড়েছে বলে যে ধরা পড়েই
থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। বিপদমুক্তির কোনও না কোনও পথ
নিশ্চয়ই আছে। ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলে হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে
চায়, ভবিষ্যৎ কল্পনা সব সময় সুখকর নয়।
নাজির বেগের কি হলো? ভোর রাতের পাহারায় ও-ই ছিল। ওকি
পায়ের শব্দ শুনে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও, নাকি ধরা পড়েছে? জিজ্ঞেস
করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রানা। যদি সে ধরা পড়ে না থাকে
তাহলে এখনও সুযোগ আছে। একজন সেন্ট্রি দক্ষ হাতে হোলস্টার থেকে
তুলে নিল রানার পিস্তলটা।
‘আমাদের খুঁজে পেলে কি করে?’ জিজ্ঞেস করল রানা শান্ত কণ্ঠে।
‘কর্নেল রাম নারায়ণের কোয়ার্টার থেকে খাবার চুরি করে অত্যন্ত
বীরত্বের পরিচয় দিয়েছ বলে ভাবছ তোমরা। আসলে কাজটা গর্দভের কাজ
হয়েছে। দুটো ব−াড হাউণ্ড এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের- নিজেদের আর
বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি।’
‘কিন্তু এত বৃষ্টির মধ্যে...’ মিশ্রী খান কিছু বলতে যাচ্ছিল।
‘শাট আপ!’ ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে পাশ ফিরল অফিসার।
স্পর্দাটা ছিঁড়ে নামিয়ে দাও। আমার দুই ধারে দুইজন করে রাইফেল নিয়ে
প্রস্তুত থাকো।’ আবার ফিরল সে রানাদের দিকে। ‘তোমরা চারজন বেরিয়ে
এসো বাইরে। বিশ্বাস করো, তোমাদের কুকুরের মত গুলি করে মারবার
ছুতো খুঁজছে আমার লোকেরা। কারও কোনও মতলব থাকলে চেষ্টা করে
দেখতে পারো- ফল ভাল হবে না।’
মাথার ওপর হাত তুলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল চারজন। এক পা
এগোতেই আবার আদেশ এল চাবুকের মত। থমকে থেমে গেল সবাই।
‘দাঁড়াও!’ টর্চের আলো ফেলল সে এবার মাহবুবের ওপর। আলতাফের
উদ্দেশে বলল, ‘একপাশে সরে দাঁড়াও। কে লোকটা?’
‘ওকে ভয় পাবার কিছুই নেই,’ বলল রানা। ‘আমাদেরই লোক, কিন্তু
ভয়ঙ্কর ভাবে জখম হয়েছে। ও এখন মৃত্যু শয্যায়।’
‘আচ্ছা, দেখছি। পেছনে সরে যাও সবাই। একেবারে ওই দেয়াল পর্যন্ত
।’ মাহবুবকে ডিঙিয়ে সরে গেল ওরা দেয়ালের দিকে। চট্ করে বসে পড়ে
মাটির ওপর কারবাইনটা রেখে পিস্তল বের করল অফিসার। ধীরে ধীরে
এগোল মাহবুবের দিকে। রানা চেয়ে দেখল, চারটে রাইফেল প্রস্তুত আছে
ওদের জন্যে। অফিসারের সাথে সাথে ওরাও এগিয়ে আসছে সামনে। রানা
বুঝল, চমৎকার ট্রেনিং পেয়েছে এরা, রীতিমত দক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে এদের
প্রতিটা কার্যকলাপে।
এক ঝটকায় মাহবুবের গায়ের চাদরটা উঠিয়ে ফেলল অফিসার। ঘুমের
দুর্গম দুর্গ ৪৭
মধ্যেও ককিয়ে উঠল মাহবুব আহত পায়ে হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে। দ্রুত একবার
চোখ বুলাল অফিসার মাহবুবের কুঁচকানো মুখ আর ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পায়ের
ওপর। গ্যাংগ্রিনের দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছতেই খানিকটা পিছিয়ে গেল সে।
তারপর যতেড়বর সঙ্গে ঢেকে দিল আবার মাহবুবের অসুস্থ দেহ।
‘সত্যি কথাই বলেছ। আমরা বর্বর নই। মুমূর্ষু লোকের সাথে আমাদের
কোন ঝগড়া নেই। ও এখানেই থাক, বাকি সবাই বেরিয়ে এসো গুহা
থেকে।’
উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল অফিসার স্থির নিষ্কম্প হাতে টর্চ
আর পিস্তল ধরে। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে কারবাইন তুলে নিল সে মাটি
থেকে।
ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল সবাই বাইরে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। এখনও অন্ধকার চারদিকে- কিন্তু পুবের আকাশটায়
ফর্সা হয়ে আসবার আভাস। উজ্জ্বল একটা ভোরের তারা টিপটিপ করে
জ্বলছে। পবিত্র, শান্ত একটা ভাব।
চারদিকে চাইল রানা নিরুৎসুক দৃষ্টি মেলে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা
করছে সে। নাজির বেগের কোন চিহ্নই নেই। লাফিয়ে উঠল রানার বুকের
ভেতরটা আশার আলো দেখতে পেয়ে। দ্রুত চলতে আরম্ভ করল চিন্তা।
নাজিরের হাতে অটোমেটিক রাইফেল আছে একটা, এরা মোট আটজন।
এক্সট্রা ম্যাগাজিন কি নিয়েছিল সে সাথে? যদি লুকিয়ে গুলি ছুঁড়তে পারে
তাহলে এই আটজনকে শেষ করে দিতে পারবে নাজির স্পেয়ার ম্যাগাজিন
না থাকলেও।
‘তুমি হয়তো ভাবছ তোমাদের প্রহরীটা কোথায় গেল, তাই না?’ বিদ্রƒপ
ভরা কণ্ঠে প্রশড়ব করল অফিসার। জামার হাতায় চিহ্ন দেখে এতক্ষণে বুঝল
রানা ওর র‌্যাঙ্ক হচ্ছে লেফটেন্যান্ট। ‘অত ভাবনার কিছু নেই। বেশি দূর নয়,
কাছেই ঘুমিয়ে আছে। গভীর ঘুমে আচ্ছনড়ব সে এখন।’
‘তোমরা খুন করেছ ওকে?’ দুই হাত মুঠো করে নিজেকে সামলাবার
চেষ্টা করল রানা। হাতের তালু ব্যথা হয়ে গেল আঙুলের চাপে।
‘মরে গেছে না বেঁচে আছে সঠিক করে বলতে পারব না। অতি সহজে
আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে লোকটা। ওই পাথরের আড়ালে আমাদের
একজন বসে মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ করেছে- ও গেছে শব্দের উৎস
অনুসন্ধান করতে। দ্বিতীয়জনের রাইফেলের কুঁদো পড়েছে এসে মাথার
ওপর। ব্যস, ফ্ল্যাট।’
ধীরে ধীরে মুঠি দুটো ঢিল করল রানা। তাহলে নাজির বেগের আশাও
শেষ।
‘যাক্। কোথায় চলেছি আমরা এখন?’
‘রাজগড়ে। কিন্তু একটা কথার আগে উত্তর দাও। এক্সপে−াসিভগুলো
.........
.....৪৮ মাসুদ রানা-৬
কোথায়?’
সোজা টর্চটা ধরল লেফটেন্যান্ট রানার মুখের ওপর।
‘এক্সপে−াসিভ!’ বিস্মিত হবার ভান করল রানা। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস
করল, ‘কিসের এক্সপে−াসিভ?’ কথাটা শেষ করবার আগেই দড়াম করে সাত
ব্যাটারির টর্চটা এসে লাগল ওর মুখে প্রচণ্ড বেগে। পড়ে গেল রানা মাটিতে।
টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়াল সে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। জিভে
নোনতা লাগল রক্তের স্বাদ।
‘কোথায় টিএনটি-র বাক্স?’
‘গাঁজা খেয়েছ নাকি হে, ছোকরা! কি আবোল তাবোল...’
‘শাট্ আপ্!’
আবার চালাল সে টর্চ। মুখটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু
চোয়ালের হাড়ের ওপর এসে পড়ল সেটা ঠকাশ্ করে। ঠিক জুলফির নিচে।
আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ - টলমল করে দুলছে দুনিয়াটা। দরদর করে
রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে। মূর্ছার শেষ প্রান্ত থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনল সে
অমানুষিক মানসিক বল প্রয়োগ করে। আবার পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত
মনে হলো ওর কাছে।
‘বন্দীদের প্রতি এই কি ভারতীয় ব্যবহার নাকি?’ বলল সে নিস্তেজ
কণ্ঠে।
‘বন্দী যদি সৈনিক হত তাহলে সে অন্য ব্যবহার পেত। কিন্তু নরঘাতক
স্পাইয়ের জন্যে...’ উত্তেজনায় কাঁপছে লেফটেন্যান্টের কণ্ঠস্বর।
‘আমরা স্পাই না,’ হাতের পোঁছায় ঠোঁটের রক্ত মুছে বলল রানা।
‘আমরা সৈনিক, যুদ্ধ করতে এসেছি শত্র“দেশের সঙ্গে।’
‘তাহলে তোমাদের ইউনিফরম কোথায়? তোমরা নিশাচর স্পাই!
রাতের অন্ধকারে মানুষের পিঠে ছুরি বসিয়ে দাও। তোমরা কসাই। সুযোগ
পেলেই গলায় ছুরি চালাও।’ হঠাৎ থেমে গেল লেফটেন্যান্ট কিছু একটা
জিনিসের ওপর চোখ পড়তেই। রানা ঘুরে দেখল নাজির বেগকে নিয়ে আসা
হচ্ছে এদিকে। পেছন থেকে বেয়োনেটের খোঁচায় কাতরাতে কাতরাতে
আসছে সে। কাছে আসতেই দেখা গেল বাম গালটায় এক থোকা রক্ত জমে
আছে। মাথার কোনও একটা গুরুতর জখম থেকে রক্ত পড়েছে প্রচুর
পরিমাণে।
‘সবাই বসে পড়ো মাটিতে,’ আদেশ দিল লেফটেন্যান্ট। নিজের
লোকদের দিকে ফিরে বলল, ‘হাতগুলো বেঁধে ফেলো।’
‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলা হবে এখন, তাই না?’ শান্ত ভাবে
জিজ্ঞেস করল রানা। তাই যদি হয় তাহলে যুদ্ধ করে মরবে, স্থির করল সে।
হাতবাঁধা অবস্থায় মরার চেয়ে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ দেয়া অনেক ভাল। কিন্তু যদি
এই মুহূর্তে ওদেরকে হত্যা করবার ইচ্ছে লেফটেন্যান্টের না থাকে, তাহলে
দুর্গম দুর্গ ৪৯
সুযোগের অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
‘আমি দুঃখিত। সেটা করতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু আমাদের
কর্নেল রাম নারায়ণজী আগে তোমাদের সাথে দু’চারটে কথা বলতে চান।
তোমাদের পক্ষে অবশ্য ওঁর সাথে দেখা হওয়ার চাইতে এক্ষুণি গুলি খেয়ে
মরে যাওয়া শতগুণে ভাল হত।’ লেফটেন্যান্ট হাসল একটু। ‘তারপর
তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে দ্বারোকার অফিসার ইন কম্যাণ্ড বিগ্রেডিয়ার
চৌধুরীর কাছে। আজ সূর্যাস্তের আগেই সব খতম হয়ে যাবে। স্পাইদের
ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়িই কাজ সেরে থাকি আমরা।’
‘কিন্তু, স্যার! ক্যাপ্টেন!’ দুই হাত তুলে যেন নালিশ জানাচ্ছে এইভাবে
এক পা এগিয়ে এল আলতাফ। তারপর থমকে দাঁড়াল দুটো রাইফেলের
মাথা বুকের ওপর ঠেকতেই।
‘ক্যাপ্টেন না, আমি লেফটেন্যান্ট।’ শুদ্ধ করে দিল অফিসার। ‘আমি
লেফটেন্যান্ট অলোক রায়। কি বলছ তুমি, মোটা গর্দভ?’
‘আপনি স্পাইয়ের কথা বলছেন। আমি স্পাই না, হুজুর!’ তড়বড় করে
বলতে গিয়ে বেধে যাচ্ছে মুখের কথা। ‘কিরে কেটে বলছি, হুজুর, আমি
স্পাই না। আমি ওদের লোক না!’ দুই চোখ বিস্ফারিত। কথার শেষে
নিঃশব্দে ঠোঁট দুটো নড়ছে। ‘আমি কচ্ছের জেলে একজন। গরীব জেলে।
এরা জোর করে ধরে এনেছে আমাকে কচ্ছ ভাষা হিন্দিতে অনুবাদ করবার
জন্যে। গায়ের জোরে ধরে এনেছে। কিরে কেটে বলছি, হুজুর!’
‘ওরে শালা হারামজাদা!’ ঘুসি পাকিয়ে এগোচ্ছিল মিশ্রী খান, কিন্তু ‘উহ্’
বলেই বাঁকা হয়ে গেল ওর দেহটা পেছন দিকে। ভয়ঙ্কর জোরে শিরদাঁড়ার
ওপর এসে পড়েছে একটা রাইফেলের বাঁট। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে
মাটিতে। মাটিতে পড়েও চিৎকার করে চলল মিশ্রী খান। ‘নিমকহারাম,
দুইমুখো সাপ। ওরে শুয়োরের বাচ্চা, তোকে দেখে নেব আমি...’ ঠাস করে
একটা শব্দ হলো। একটা বুটের লাথি এসে পড়ল মিশ্রীর মাথায়। ঢলে পড়ল
সে জ্ঞান হারিয়ে।
পাথরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল রানা। মিশ্রীর দিকে ফিরে চাইল না
একবারও। হাত দুটো মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল
সে আলতাফের দিকে। আলতাফের মাথায় কি প−্যান এসেছে জানে না সে,
অনুমানও করতে পারল না; কিন্তু এটুকু বুঝল, ওর এই বানানো গল্পটাকেই
সত্য বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে হবে।
‘অর্থাৎ?’ প্রশড়ব করল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়, তারপর নিজেই উত্তর
দিল। ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া। যাই হোক মটু সিং, তোমার কপাল মন্দ।
জুয়ার আডিায় যাদের ধরা হবে- সব জুয়াড়ী; দর্শক বললে মাপ নেই।
তোমার ভাগ্য এই খুনীগুলোর সাথে লেখা হয়ে গেছে।’
‘না, না, না, হুজুর!’ ভয়ে উত্তেজনায় গলার স্বর উঁচু পর্দায় উঠে গেছে
........
৫০ মাসুদ রানা-৬
আলতাফের। ‘আমি সত্যি কথা বলছি, হুজুর। আমি ওদের দলের লোক
না। ভগবানের দোহাই দিয়ে বলছি...’ গলাটা ভেঙে গেল আলতাফের।
একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার কোনও দোষ নেই, হুজুর, আমাকে কেন
ওদের সাথে মারবেন? আমি আসতে চাইনি ওদের সাথে। আমি লড়াইয়ের
লোক না, হুজুর, আমি একজন গরীব জেলে।’
‘সে-তো দেখতেই পাচ্ছি,’ বলল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়। ‘আর্মিতে
থাকলে এত চর্বি জমত না ওই বেধড়ক শরীরে। প্রতি আউন্স চর্বি তোমার
কাছে মহামূল্যবান। তোমাকে সাথে আনা ওদের ঠিক হয়নি।’
‘আমি সব কথা বলতে পারি, হুজুর। ওদের অনেক কথা জানি আমি।
সব কথা শুনলে হয়তো আমাকে...’
‘তবে রে, শয়তান?’ বলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা আলতাফের
ওপর, দু’জন সেন্ট্রি ধরে ফেলল ওর দুই হাত, মুচড়ে টেনে রাখল পেছন
থেকে। ঝাড়া দিয়ে ছুটবার ব্যর্থ চেষ্টা করল রানা, তারপর বলল, ‘যদি মুখ
দিয়ে একটা কথাও বের করিস, কসম খোদার, তোকে...’
‘থামো!’ ধমকে উঠল তরুণ লেফটেন্যান্ট। তীক্ষè কণ্ঠে বলল, ‘হয়েছে।
আর একটি কথা উচ্চারণ করলে ওইখানে ওর পাশে শুয়ে থাকতে হবে।’
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বুড়ো আঙুল দিয়ে মিশ্রী খানের জ্ঞানহীন দেহটা দেখাল
অলোক রায়। তারপর আলতাফের দিকে ফিরে বলল, ‘কোনও কথা দিতে
পারছি না, কিন্তু তোমার কিছু বলার থাকলে শুনতে পারি।’
‘সেটা আপনার দয়া। আমার কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন, হুজুর।’
আলতাফের কণ্ঠে আশা এবং ঈকান্তিকতার আভাস ফুটে উঠল। সাহসও
ফিরে এল কিছুটা। নাটকীয় ভাবে রানা আর মিশ্রীর দিকে আঙুল দেখিয়ে
বলল আলতাফ, ‘এরা সাধারণ সৈনিক না, হুজুর- উঁচু উঁচু র‌্যাঙ্কের অফিসার।
পাকিস্তান নেভির অফিসার সব।’
‘যেটা আমরা জানি না সে-রকম কিছু তথ্য বলো, গর্দভ। এরা বহুদিন
থেকেই পেছনে লেগেছে আমাদের। যদি তোমার এইটুকুই বলার থাকে...’
‘দাঁড়ান!’ হাত তুলে বাধা দিল আলতাফ। ‘নানান জায়গা থেকে বেছে
বেছে এদের একসাথে করা হয়েছে। গত রোববার বিকেল বেলা এসে
পৌঁছেচে ওরা কেটি বন্দরে। সেইদিনই সন্ধ্যার সময় রওনা হয়েছে একটা
নৌকায় চড়ে।’
মাথা নাড়ল অলোক রায়। ‘এই পর্যন্ত আমরাও জানি। বলে যাও।’
‘আপনারাও জানেন? কি করে...’ বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাইল আলতাফ
লেফটেন্যান্টের মুখের দিকে।
‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। বলে যাও।’
‘হঠাৎ ওদের এঞ্জিন খারাপ হয়ে যাওয়ায় পাল তুলে দিয়ে চলছিল ওরা,
এমন সময় একটা পাহারাদার লঞ্চ আমার মাছ ধরার নৌকার পাশ দিয়ে
দুর্গম দুর্গ ৫১
গিয়ে ওদের নৌকার সাথে লাগল। সেটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে ওরা।’
‘এত বড় লঞ্চটাকে ডুবাল কি করে?’ ওটাকে যে ডুবানো হয়েছে তাতে
অলোক রায়ের সন্দেহ নেই। কি করে ডুবানো হলো তাই জানতে চাইছে।
অর্থাৎ ঠিকই সন্দেহ করেছিল রানা, খানসামা করিম আগেই খবর দিয়ে
দিয়েছে এদেরকে। এরা প্রস্তুত হয়েই ছিল রানাদের জন্যে।
‘ওরা আমার মত নিরীহ জেলের ভান করেছিল। লঞ্চটা নৌকার গায়ে
গিয়ে লাগতেই গোলাগুলি ছুটতে আরম্ভ করল দুই পক্ষ থেকে। হঠাৎ
দেখলাম দুইটা বাক্স উড়ে গিয়ে পড়ল লঞ্চের এঞ্জিন ঘরের মধ্যে। ব্যস,
ভিড়িম! সব খতম!’ দুই হাত ছুঁড়ে অভিনয় করে দেখাল আলতাফ।
‘তাই ভাবছিলাম...যাক, তারপর?’
‘কি ভাবছিলেন, হুজুর?’ জিজ্ঞেস করেই লেফটেন্যান্টের কুঁচকানো ভুরু
দেখে ভয় পেয়ে গেল আলতাফ। গড় গড় করে বলে চলল, ‘ওদের মধ্যে
কচ্ছ ভাষা জানত যে লোকটা সে এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, তাই আমাকে
জোর করে নৌকায় উঠিয়ে নিয়েছে। আমার তিন ছেলেকে হুকুম দিয়েছে
সোজা গ্রামে ফিরে যেতে, গিয়ে চুপচাপ থাকতে। যদি একটি কথাও প্রকাশ
পায় তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে বলে শাসিয়েছে। কানতে কানতে
চলে গেছে আমার বাচ্চা তিনটে। খানিক বাদেই ঝড় উঠল, আহারে...আমার
ছেলে তিনটে নিরাপদে পৌঁছতে পারল কিনা...’
‘তোমার ছেলের গল্প কে শুনতে চেয়েছে, মোটা গর্দভ?’ ধমকে উঠল
অলোক রায়।
হক্চকিয়ে গিয়ে আবার আরম্ভ করল আলতাফ, ‘এই ঝড়ের মধ্যে
একটা দ্বীপে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর বললে বিশ্বাস
করবেন না, হঠাৎ কোত্থেকে যেন একদল সৈন্য এসে উপস্থিত হলো সেই
নির্জন দ্বীপে...আর তাই দেখেই আবার ছেড়ে দেয়া হলো নৌকা।’
‘ঠিক উল্টো। তোমার এই কথাটা আমি বিশ্বাস করছি।’ মাথা নাড়ল
লেফটেন্যান্ট, যেন এই কথাগুলো নিজের কোনও গোপন জ্ঞানের সাথে
মিলিয়ে দেখে মিল পাচ্ছে সে।
‘তারপর তুফানের মধ্যেই নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙায় উঠেছি।’
‘নৌকাটার কি হলো?’
‘এমনিতেই ডুবে যাচ্ছিল জল খেয়ে, ঘাটে পৌঁছবার পরই ডুবে গেছে।’
‘তারপর?’
‘তারপর পাড়ের গায়ের শিকড় বেয়ে উঠে এসেছি আমরা ওপরে।
ওপরে একজন গার্ড ছিল- ওই লোকটা ছুরি চালিয়ে খুন করেছে তাকে।’
রানার দিকে আঙুল দেখিয়ে নির্লজ্জের মত বলল আলতাফ। ‘সারা রাত
হাঁটিয়ে মেরেছে আমাকে ব্যাটারা। ওই জখম হওয়া লোকটাকে আমার কাঁধে
চাপিয়ে আমাকে দিয়ে মোট বইয়েছে। গতকাল ভোর রাতে পৌঁছেছি আমরা
........ পরের অংশে দেখুন
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×