My Neighbor Totoro(1988)আইএমডিবি রেটিং ৮.২।১৯৮৮সালে মুক্তি পাওয়া একটি জাপানিজ মুভি।এখন যে ক্লিপটি দেখছেন এটাই সে মুভির একটি ক্লিপ।সেই সময়কার -বিখ্যাত ডিজনি একপেশে অ্যানিমেশন মুভি তৈরি করে যাচ্ছিলো।সব এক কাহিনী - ভিলেনের আগমন ,পপ গানের বাহার ,অতি আধুনিকতা দেখানোর চেষ্টা ইত্যাদি ...ইত্যাদি।অবাস্তব কাহিনী, হাতি ঘোড়া , রাক্ষস ইত্যাদি দিয়ে অ্যানিমেশন ছবি ভরিয়ে ফেলেছিল।এককথায়,অ্যানিমেশন মুভিই একঘেয়ে করে ফেলেছিল। প্রান্তিক মানুষ ও সমাজের কোনো ঘটনা নিয়ে যে অ্যানিমেশন মুভি তৈরি করা যায়- সেটিই মাই নেইবর তোতোরো দেখিয়ে দিয়েছে । মুভি সমঝদাররা এটা দেখে বলতে বাধ্য হল- দ্যা মাস্টারপিস।
আইএমডিবিতে আর দশটা ছবির যখন লিস্ট দেখায়-তখন একরকম থাকে কিন্তু এই ছবিটা যখন লিস্টে থাকে তখন-
আমাদের মতো সাধারণ ফিল্ম ক্রিটিকরা নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হয়।কারণ,অন্য সব ছবিতে এরকম ক্যাপশন থাকে না।
মেঘলা সকাল ।বই পত্র দেখতে ভাল লাগছিল না। ভাবলাম একটা মুভি দেখে নি ।দেখতে শুরু করলাম - মাই নেইবর তোতোরো। পিক্সারের ছবি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।তাই,ভাবলাম ভাল লাগবে না।গ্রাফিক্স ওয়ার্ক অতটা ভাল লাগবে না।কিন্তু , আমার সব ধারণা মিথ্যে করে ছবিটা ভাল লাগতে শুরু করলো।প্রথম থেকেই অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুরু হল।অত্যাধিক রিয়ালিজম ঘেঁষা মুভিটা দেখা শুরু করলাম।
মাত্র ৮৬ মিনিট। একরকম ঘোরের মধ্যে কাটলো।প্রায় বলতে গেলে কিছুই বলতে পারছিলাম না।অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।কান্তা আর সাসুস্কি মনে করিয়ে দিলো সে হারিয়ে যাওয়া উদ্দাম শৈশব ।প্রায় সম্মোহিত করে রাখল আমাকে। আপনাদেরকেও যে সম্মোহিত করে রাখবে তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।
জাপানিজ ভাষায় মুভিটির নাম, তেনারি নো তোতোরো। এই মুভি প্রথম জাপানিজ ভাষায় মুক্তি পেয়েছিলো। এরপর ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পায়। এই মুভির পরিচালনায় ছিলেন হায়াও মিয়াজাকি।তাঁর চিত্রনাট্যে পরিচালিত এবং স্টুডিও ঘিবলি কর্তৃক প্রযোজিত।মিয়াজাকির শৈশবের প্রতিধ্বনি ঘটেছে এই ছবিতে।মুভির শিশু কান্তা চরিত্রটি তাঁরই প্রতিচ্ছবি।
ছবির চরিত্র দের মধ্যে প্রধান চরিত্র সাসুস্কি ।
বয়স মাত্র ১১ । চলচিত্রটির প্রধান চিত্র। এই নামটি নেয়া হয়েছে জাপানের বর্ষলিপির পঞ্চম মাসকে কেন্দ্র করে।ছবিটির ঘটনা সম্ভবত এই পঞ্চম মাস অর্থাৎ মে মাসকে ঘটনা করে লিখা।
সাসুস্কির চার বৎসর বয়সী ছোট বোন - মে ।নাম দুটো প্রায় একি উচ্চারণে । এর থেকে বোঝা যায়- মূল কাহিনীতে একটাই চরিত্র ছিল। সেটা হল সাসুস্কি।
দুজনেই উদ্দাম শিশু কালের প্রতিচ্ছবি ।
আরেকটি অপরিহার্য চরিত্র - কান্তা। গ্রামের কিশোর কান্তা।
সাসুস্কির প্রতি অপরিসীম দুর্বলতা দেখা যায়। এক বৃষ্টির দিনে সে নিজের ছাতাটা সাসুস্কিকে দিয়ে দেয়। যখন সাসুস্কি নিতে চায় না । সে তখন ছাতাটা ফেলে দৌড় দেয়।আসলে চরিত্রটি মিয়াজাকিরই প্রতিচ্ছবি।কান্তা চরিত্রটির মতো মিয়াজুকিও শৈশবে খেলনা প্লেন চালাতে পছন্দ করত।যেমনটা ছবিতেও দেখা যায়।আর ,সাসুস্কি যে তাঁর শৈশবের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার(??) প্রতিচ্ছবি না -- এ সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যায় না।আসলে ছবিটি এক গভীর বেদনার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে শৈশবে হারিয়ে যাওয়া খেলার সাথীরা (??) কোথায় গেলো। বারবার এই কথা মনে হয়।।উপরে সে ঘটনার ছবিই দেওয়া হয়েছে।ওইটা ভিডিও না- এনিমেটেড পিকচার।
তাটসু কুসাকব্বে -মেয়েদের বাবা।গল্পে তিনি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর। পুরো , মুভিতেই তিনি হাস্যজ্বল একজন বাবা। যে কিনা তাঁর মেয়ে দুটিকে অসম্ভব ভালবাসে।
কাহিনীঃছবিটি ১৯৮৮ সালে নির্মিত।তবে ঘটনা ১৯৮৮ সালের না।যুদ্ধপূর্ববর্তী ১৯৫৮ সালের জাপানের টোকিওর একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে এর ঘটনাপ্রবাহ।এর থেকে মিয়াজাকির সে সময়কার শান্তির প্রতি তীব্র আকুলতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়।গ্রামীণ জীবন যে কতটা সুন্দর সেটাও তুলে ধরে এই ছবি।ইট কাঠের জাপান - এর চেয়ে শান্ত সৌম্য গ্রামীণ জীবনই ছিল আকাঙ্ক্ষিত।গ্রাম্য প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবি সে বারতাই পৌছিয়ে দেয়।
প্রফেসর আর তাঁর দুই মেয়ে তাদের অসুস্থ মাকে দেখার সুবিধার জন্য গ্রামের এক পুরনো বাড়িতে উঠে। তাদের মা দীর্ঘকালীন রোগে ভুগছিলেন(ছবিতে রোগ সম্পর্কে না বলা হলেও - পরবর্তীতে নির্মাতারা জানান রোগটি ছিল যক্ষ্মা- -- পরিচালকের শৈশবে এমনটা হয়েছিল)।একদিন ছোট মেয়ে মে বাগানে খেলা করার সময় খরগোশের মতো একটা ছোট প্রাণী দেখতে পায়।দেখে সেও প্রাণীটির পিছনে পিছনে ছোটা শুরু করে।অনেক ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে এক শতবর্ষী ক্যাম্পর গাছের সামনে এসে দাঁড়ায়।সেখানে সে দেখতে প্রায় তিন মিটার লম্বা তোতোরোকে - বনের আত্মা।মুভির ভাষায় "keeper of the forest"।সে তোতোরর গায়ের উপর ঘুমিয়ে পড়ে।এরপর, মে'র বোন আর বাবা যখন তাকে খোজা খুঁজি শুরু করে- তখন তারা আবিষ্কার করে - মে ঘাসের উপর শুয়ে আছে।মে ঘুম থেকে উঠে তোতোরোকে খুঁজে না পেলে- ওর বাবা বলে " হয়ত ,তুমি কোনো বনের আত্মাকে দেখেছো, সে যখন চাইবে কেবলমাত্র তখনি তুমি তাকে দেখতে পারবে।"
এরপর ,তোতোরো সাসুস্কিকে দেখা দেয় ।একদিন বৃষ্টি ভেজা রাত্রে মে আর সাসুস্কি তাদের বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলো।এমন সময় তোতোরো হাজির।তোতোরো শুধুমাত্র পাতা দিয়ে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে চাইছিল। সাসুস্কি তাকে তাঁর ছাতাটা তোতোরোকে দিয়ে দেয়।এরপর,তোতোরো তাদেরকে একটা ছোট্ট থলি দেয়- যাতে বীজ ভরা ছিল।এরপর সে তাঁর ক্যাটবাসে করে চলে যায়।
এরপর, মে বাড়িতে এসে সেই বীজ গুলো রোপণ করে। কিন্তু , গাছ আর উঠে না।এমন সময় আবারও তোতোরো হাজির।সারারাত -হয়ত স্বপ্নের মধ্যে গাছটি ক্রমেই বড়ো হতে থাকে।কিন্তু,সকাল হলে তাঁর আর কোনই অস্তিত্ব থাকে না।
একসময় , হসপিটাল থেকে একটা টেলিগ্রাম আসে।যেখানে লেখা থাকে,মে আর সাসুস্কির মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।এই খবরে , মে আর সাসুস্কি খুব ঘাবড়ে গেলো।সাসুস্কি সাথে সাথে তাঁর বাবাকে টেলিফোন করে।এরকম মানসিক টানাপোড়েনে থেকে সাসুস্কি ,মে কে ধমক দেয়।কারণ, মে ধারনা করেছিলো- তাদের মা মারা গিয়েছিলো।
সাসুস্কির ধমক শুনে মে একটা ভুট্টা নিয়ে হাসপাতালে তার মাকে দেখতে রওয়ানা হয়।সাসুস্কিকে ছাড়াই।তার বিশ্বাস ছিল ভুট্টা খেলে তার মা ভাল হয়ে যাবে।হাসপাতালের দূরত্ব ছিল প্রায় ৪-৫ মাইল। একজন চার বছরের মেয়ের পক্ষে এতদূরের পথ চেনা সম্ভব না ।তাই সে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যায়।এদিকে সাসুস্কি তার ভুল বুঝতে পারে ।মে কে খোঁজা খুঁজি শুরু করে ।কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায় না।সাসুস্কি দিশেহারা হয়ে পড়ে।সে পাগলের মতো তাকে খুঁজতে শুরু করে।কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।(ছবিটার টুইস্ট আপনাকে হতবাক করে দিবে।এতো সুন্দর একটা ঘটনা এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে--আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না।পারিবারিক অশান্তি ছোটদের মনে কি কঠিন হয়ে আঘাত করে -- তা আপনি এই মুভি দেখলেই বুঝতে পারবেন)
সাসুস্কি যখন অনেক খোঁজাখুঁজি করে মে কে খুঁজে পায় না। তখন শেষ ভরসা হিসেবে তোতোরোকে দেখা দেবার জন্য প্রার্থনা শুরু করে।এরপর,ক্যাম্পর গাছে সামনে তোতোরো আবার দেখা দেয়।তোতোরো সাসুস্কির জন্য তার ক্যাটবাসটা দিয়ে দেয়।ক্যাটবাস,সাসুস্কিকে এক অসাধারন এডভেঞ্চারের মাধ্যমে অনেক অনেক দূরের জঙ্গলে নিয়ে যায়।যেখানে , মে পথ হারিয়ে বসে আছে। সাসুস্কি , মে কে পেয়ে অনেক খুশি হয়।এরপর,ক্যাটবাস তাদের দুজনাকে তার মায়ের হাসপাতালে নিয়ে যায়।কিন্তু সেখানে যেয়ে মে আর সাসুস্কি দেখে যে তাদের মা ভালোই আছে ।তাদের মা , বাবার সাথে অনেক মজা করে গল্প করছে।সাসুস্কি আর মে'র মন ভরে যায়।তাদের দুজনের হাস্যজ্জ্বল চেহারা আবার ফিরে আসে।(সকল দুশ্চিন্তা , আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে-ছবিটির হ্যাপি ইন্ডিং দেখা যায়। মাঝে ভয় হয়েছিলো- সকল গ্রেট ছবির মতো হয়ত এটাও ট্রেজিডি দিয়ে শেষ হবে।কিন্তু তা হয় নি।)
ছবির শেষ অংশে দেখা যায়, তাদের মা আবার সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে।মে আর সাসুস্কি আগের মতো ,রাত্রে ঘুমানোর সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনে।তোতোরো দূর থেকে তাদের দিকে তৃপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।( আমিও তৃপ্ত দৃষ্টিতে আমার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকি ।মনে হয় ইসস যদি আমার জীবনে এমনটা হতো।ইট কাঠের ঠাসা বুনটের চার দেয়াল ভেঙ্গে , যদি এমন একটা শহর গড়ে তোলা যেত।আমি নিমগ্ন হয়ে স্বপ্ন দেখি ,যদিও জানি সেটা বাস্তব হবার নয়। )
এই ছবিটি সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে- এই ছবি জাপানের অ্যানিমেশন ছবিকে স্পটলাইটে এনেছে।অনেক ফিল ক্রিটিক এটাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা মুভিগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে।তোতোরো হয়েছে সর্বকালের সেরা অ্যানিমেশন চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম। এই ছবি ১৯৮৮সালের সেরা ছবি হিসেবে এনিমেজ এনিম গ্র্যান্ড প্রিক্স প্রাইজ এবং মানচিনি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায়।
"টয় স্টোরি ৩" মুভিতে তোতোরো আর মে কে সম্মান জানাতে একটি দৃশ্যে-
ডাউনলোড লিঙ্ক--তরতাজা টরেন্ট(৭০০এমবি)
অ্যানিমেশন জগতের এই বিস্ময় - ছবিটি আমাদের কাছে অনেক অনেক বার্তা পৌঁছে দেয়।সকল কালের ,সকল বয়সের জন্য এই অ্যানিমেশন ছবি তৈরি হয়েছে ।সকল কালকে অতিক্রম করে এই মুভি শতবর্ষ ধরে থাকুক- আমাদের হৃদয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৩ সকাল ৯:২৫