somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুরমায় ভাসাভাসি আর হাসাহাসি

১০ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুরমা পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। এখনো নৌকা আসছে কেন? অপেক্ষা আর সইছে না। অনেক নৌকাই তো আসা-যাওয়া করছে, তবু আমাদের নৌকার দেখা নেই কেন? বললাম আমি। শামীম বলল, ঐতো একটা নৌকা আমাদের দিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। দেখি, এটা আমাদের নৌকা কি-না? হ্যাঁ, নৌকাটি আমাদের পাশে এসে ভিড়ল। নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, এটি খেয়া পারাপারের নৌকা। এরপর আরেকটি নৌকা আসতে দেখা গেল। সবাই ভাবলাম, এটি নিশ্চয় আমাদের নৌকা। নৌকাটি আসতে দেখে সবার চোখেমুখে হাঁসি ফুটে উঠল। রঙিন সাজে সাজানো সুন্দর একটা নৌকা তীরে এসে ভিড়ল। ভেতর থেকে রঙ্গিন সাজের বিচিত্র সব মানুষজন বেরিয়ে আসা শুরু করল। একসময় ভেতর থেকে বর এবং কনেও বেরিয়ে আসলেন। নৌকার সঙ্গীরা সবাই হইহুল্লোড় করল। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে নৌকাটি আবার চলে গেল। বর-কনে এবং যাত্রীরাও চলে গেল। আমরা আশাহত হলাম। এটিও আমাদের ভ্রমণের নৌকা নয়। ইসমাইলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, নৌকা ভাড়া করার জন্য। কোন এক অজানা কারণে সে আজ আমাদের সাথে আসেনি। আর সেজন্যে আমাদের জন্যে ভাড়া করা নৌকা চিনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফুলে ফেঁপে উঠা বিশাল সুরমা নদীর পানি একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ। এই ভরা নদীর ওপাড় থেকে একটি নৌকা আসতে দেখা যাচ্ছে। এবার আমরা আর আশাবাদী হলাম না। নৌকাটি একসময় কপাত কপাত করে আমাদের পাশে এসে থামলো। মাঝি নৌকা থেকেই বলল, আপনারা কি নৌকা ভ্রমণে যাবেন? জুনেদ বলল, হ্যাঁ, আমরা নৌকা ভ্রমণে যাবো। মাঝি বলল, তাহলে নৌকায় উঠুন। এই নৌকাটি আপনাদের ভ্রমণের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

আমরা নৌকায় উঠলাম। রওয়ানা দিলাম। এখন আমরা সুরমা নদীতে ভাসছি। মিনিট পাঁচেক চলার পর শামীম বলল, আমরা নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছি, কাজেই আমাদেরকে দোয়া দুরুদ পড়া উচিত, আর কোন কাজ শুরু করার আগে কোরআন তেলাওয়াত করাও উচিত। বিপদ-আপদের কথা তো বলা যায় না। ফরিদকে সবাই অনুরোধ করল, একটা সুরা পাঠ করার জন্য। ফরিদ সুরা পাঠ শুরু করল। সুরার পাঠের মাঝামাঝি যেতেই সে হাসতে শুরু করে দিল। সে কেঁপে কেঁপে সুরা পাঠ করছে, আর হাঁসছে। সবাই অবাক! কোনমতে সে সুরা পাঠ শেষ করল। রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি হেঁসেছো কেন? ফরিদ বলল, আমি সুরা পড়ছি আর তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে আছ, সেজন্যে আমার হাসি চলে এসেছে, আমি দু:খিত। আমি বললাম, সুরা পাঠের সময় হাসাহাসি ঠিক নয়। এদিকে রফিক কোকাকোলার বোতলটি নৌকায় বেঁধে পানিতে ছেড়ে দিল। জিজ্ঞেস করলাম, এরকমটি করলে কেন? সে বলল, পানিতে রাখলে কোকোকোলা ঠান্ডা থাকবে। আমরা ঠান্ডা পানীয় খেতে পারবো। এ নিয়ে যত হাসাহাসি করল সবাই। তবে রফিকের আইডিয়া মন্দ নয়। পানীয় খানিকটা ঠান্ডা থাকলেও থাকতে পারে।

আজ প্রচন্ড রোদ উঠেছে। আকাশটাও ঝকঝকে। তবে বাতাস বইছে। তাই গরম খুব একটা লাগছে না। আমরা নৌকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি। সুরমা পারের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। সবাই চারপাশে তাকিয়ে মনোমুগ্ধকর সব দৃশ্য দেখছি। অপূর্ব লাগছে। একেকজন বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবিও উঠাচ্ছে। ছবিগুলো ভারী সুন্দর হচ্ছে। একেবারে প্রেমে বাঁধাই করে রাখার মত।

ঝকঝকে আকাশ আর নদীর পানি যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে। নদীতে জেলেরা মাছ ধরছে। কিনারে এলাকার লোকজনও মাছ ধরছে। মাছ ধরার তালিকায় মেয়ে, ছেলে, বৃদ্ধা সবাই আছে। তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আমরা কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করছি, মাছ পাওয়া যাচ্ছে কিনা। কেউ বলছে, মাছ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কেউবা বলছে, মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আঁকাবাকা নদী বিস্তর এলাকা আমরা পেরিয়ে এসেছি। নদীর আশপাশে কোথাও সবুজ ধান ক্ষেত আবার কোথাও ধুঁ ধুঁ বালুচর দেখা যাচ্ছে। সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাখিরা বসে আড্ডা দিচ্ছে, অন্তত আমাদের কাছে সেরকমই মনে হচ্ছে। না হলে, কোন পাখি উড়াউড়ি করছে না কেন? জুনেদ একটা ঢিল ছুড়ে পাখিগুলোকে উড়াতে চেয়েছিল, আমরা সেটা হতে দিলাম না। সবাইকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেওয়া উচিত, নাকি?

নদী পাড়ের মানুষের সংগ্রামী জীবন-যাপন সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁরা কত কষ্টে জীবন-যাপন করছে, সেটা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। এরমাঝেও নদী পাড়ের মানুষেরা আনন্দ খোঁজে বেড়ায়। নিজেরা সুরে-বেসুরে মনের আনন্দে গান গায়। আমাদের কানে সেরকমই গান ভেসে আসছে। খারাপ লাগছে না।

আমরা সুরমা নদীর দু'পাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় লামাকাজী নামক স্থানে পৌঁছে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি দিলাম। সেখান থেকে কিছু ফলমুল কিনে আবার নৌকায় উঠলাম। আমরা যথারীতি বাড়ি ফেরার উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করলাম।

নৌকায় উঠেই লামাকাজী থেকে আনা পেয়ারা খাচ্ছিলাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলা অন্য নৌকার লোকেরা তাকিয়ে আমাদের খাওয়া দেখছিল। শামীম তাঁদেরকে বলল, পেয়ারা খাবেন? রফিক তার হাতে থাকা পেয়ারাটি ছুড়ে মারল পাশের নৌকার লোকজনের উদ্দ্যেশে। পেয়ারাটি নৌকায় পড়ল না, পড়ল গিয়ে পানিতে। কিন্তু জুনেদ ঠিকই পাশের নৌকার লোকজনের হাতে তিন-চারটি পেয়ারা পৌঁছে দিতে সক্ষম হলো। পাশের নৌকার লোকেরা আমাদেরকে ধন্যবাদ জানালেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশের সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন এক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করেছে। ডুবন্ত সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশকে লাল আভায় রক্তিমাভ করে তুলেছে। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশ যেন বিচিত্র সব রংয়ের খেলায় মেতে উঠেছে। দৃশ্যটা খুবই মনোমুগ্ধকর। শেষ বিকেলের এই অপরূপ দৃশ্য ধারণের সুযোগ কেউ হারাতে চাইল না। এই রঙিন ঝকঝকে আকাশের বেশ ক'টা ছবি সবাই উঠালো। আমি বললাম, এবার ছবি উঠানো বন্ধ কর, দেখো-কী সুন্দর ঝকঝকে রঙিন আকাশ, এসো আমরা এটাকে উদযাপন করি। সবাই নৌকায় বসে পড়লাম। মনে হচ্ছে, সবাই যেন কী ভাবছে। নাহ্ । এরকম নিরিবিলি বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। ফরিদ বলল, দেখো-নৌকার কী ছন্দ, এসো করি সবাই মিলে আনন্দ। আবারো আমাদের হইহুল্লোড় শুরু হলো। সুরমা পাড়ের শিশু-কিশোরেরা আমাদের এসব দেখে হাসাহাসি করছে। জুনেদও তাঁদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে, হি...হি...হি..........।

নৌকায় যাতায়াত খুবই আনন্দের, কিন্তু প্রতিনিয়ত যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁদের জন্যে ব্যাপারটি নিরানন্দের, তবুও তাঁরা আনন্দের উপলক্ষ পেলে সেটি উদযাপন করে, বললাম আমি। ঠিক এসময়ে নদীতে বয়ে চলা যাত্রীবাহী নৌকার লোকজনের খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। আমরা তাকিয়ে দেখি, একজন যুবতী মহিলা হাসছে। মহিলাটি খুবই সুন্দরী। চোখ ফেরানোর মত নয়। তাই আমরা তাকিয়ে আছি। মহিলাটি আরো বেশী হাসছে। আমরা বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম। নৌকাটি ক্রমেই আমাদের থেকে দূরে চলে গেল। একসময় নৌকাটি আমাদের চোখ থেকে হারিয়ে গেল। কিন্তু আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম, মহিলাটি এভাবে হাসলেন কেন?

সুরমায় ভাসাভাসি আর হাসাহাসিতে কিভাবে যে আমাদের সময় পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। এতক্ষণে সূর্যটা অস্ত গিয়েছে। কিছুটা অন্ধকারও নেমে এসেছে। আমরা তীরে এসে ভিড়লাম। ঠিক তখনই রফিকের মনে পড়ল, কোকাকোলাটি নৌকায় বাঁধা অবস্থায়ই রয়ে গেছে। আমরা সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবেই আছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল, সেটি পানিতে ডুবানো থাকেনি। নৌকার আগায় ঝুলিয়ে ছিল। রফিক হয়তো ঠিকমতো বেঁধে পানিতে ডুবাতে পারেনি। ঐ যুবতী মহিলা হয়তো এই অদ্ভূত কান্ডটি দেখেছিলেন। আর সেজন্যেই হয়তো তিনি হাসাহাসি করছিলেন। আপাতত এইটুকু বুঝে সন্তুষ্ট থাকি।



২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×