somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বাসের দহন

০৯ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিষিদ্ধ পল্লী সংলগ্ন একমাত্র চায়ের দোকানটির পেছন দিকে এরই মধ্যে দু বিল্ডিঙের ফাঁকা জায়গাটিতে ছড়িয়ে থাকা বিকেলের এক ফালি সূর্যালোক হারাতে বসেছে তার আপন মহিমা। নানা বয়সের সাজগোজ করা দেহ-জীবী মেয়েরা যারা নিত্যদিনকার মতোই যার যার সীমানায় দাঁড়িয়ে দেহ ক্ষুধা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে আসা পুরুষদের বগলদাবা করার নানা চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ব্যাপারটা দেখে ইদ্রিস আলি নিজেকে বেশ খানিকটা ভাগ্যবান মনে করছিল এই ভেবে যে, তাদের কেউ তাকে দেখতে পায়নি!

যদিও মেয়েদের অনেকের সঙ্গেই তার আরো বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল খদ্দের হিসাবে। যে কারণে কারও কারও সঙ্গে মুখ চেনা খাতিরও আছে সামান্য কিছুটা। রত্না নামে একজন তার কাছে টাকাও পাবে কিছু। কিন্তু দেনা শোধের সামর্থ্য না থাকায় আড়ালে থাকাটাই নিরাপদ মনে করেছে সে। দোকানের চিনির কৌটা থেকে কাপের চায়ে খানিকটা চিনি ঢেলে নিয়ে লোকজনের আড়ালে নুয়ে পড়ে যতটা দ্রুত পারা যায় বিপদে পড়ার আগে আরো খানিকটা দূরে সরে গিয়ে একটি বিদ্যুতের থামের আড়ালে দাঁড়ায় সে। পেছনে দোকানদার মাহাবুব খানিকটা উচ্চ কণ্ঠ হতে শোনা যায়, চিনি কি আমি চুরি কইরা আনি, নাকি চিনি মন্ত্রী আমার খালু লাগে? তুই তো আমার হালা-হমন্দিও কেউ না হউরের পো!

ইদ্রিস আলি কখনওই মাহাবুবের কটকটানিকে পাত্তা দেয় না। বেশি চেঁচামেচি করলে বলে, বউয়ের ভেড়া, আমার চ্যাটটার লগেই পারস গলাবাজি করতে। পারস না তো বউয়েরে পাহারা দিয়া রাখতে। বাইরের ত্যাল্লাচোরা আইয়া চাইট্যা যায় পরতেক দিন!

কিন্তু আজ তেমন কিছু বলতে উৎসাহ নেই তার। যাবতীয় আগ্রহ মিশে আছে দোতলার চার নাম্বার দরজার ওপর। সকাল থেকেই শোনা যাচ্ছে যে, সে ঘরের নতুন বাসিন্দা কোহিনূর আজ বের হবে ওসমান হাজির সঙ্গে। বিশেষ একটি দলের নেতা হাজি সাহেব মাঝে মাঝেই বিনা ঘোষণায় সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে এ গলিতে চলে আসেন। নতুন কোনও মেয়ে এলে তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে যান মটর সাইকেল ভটভটিয়ে। তার আগে অন্য কেউ সে মেয়েকে ছুঁতে পারবে না, এটাই এ পাড়ার নিয়ম। তাই হয়ত কোহিনূরের দরজায় কাউকে দেখা যায়নি এ পর্যন্ত। কেউ দেখতে পায়নি তার মুখ। শোনা যায়, এর আগে এত রূপসী মেয়ে আর আমদানি হয়নি এ পাড়ায়। যে কারণে নারী-পুরুষ সবারই একটা আলাদা রকমের কৌতূহল রয়েছে তার ব্যাপারে।

হাজি সাহেবকে দিয়ে তার বনি হবে। হয়ত তিনি তাকে তার বাড়িতেই নিয়ে যাবেন। নয়তো নিয়ে যাবেন কোনও ছোট খাট লঞ্চ ভাড়া করে মেঘনা নদীতে। ইদ্রিস আলি সে আশাতেই আছে, যদি একটিবার দেখা যায় কোহিনূরকে। দরজা খুলে বেরোবার সময় একটিবার যদি দেখা যায় তার মুখ।

কিছুক্ষণের ভেতরই চায়ের তেজ অথবা দিনের ভ্যাপসা গরম তার ভাবনাকে উসকে দেয় যেন। এলোমেলো ভাবনার দোলায় ভাসতে ভাসতে সে মনে করতে চেষ্টা করছিল, এই পুরান ঢাকার নোংরা, জরাজীর্ণ নানা অলিগলি, দোকান-পাট আর আবাসিক বাড়িগুলোর যেগুলো সে দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছে, এই এলাকার অধিবাসীদের ভেতর কতজন কান্দু পট্টির এমন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন নিষিদ্ধ পল্লীর অতিথি হন নাই বা সবচেয়ে চালু পল্লীটি ভেঙে দিয়ে তৈরি করা মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসুল্লিদের কতজনই বা ছিলেন সাবেক পতিতা পল্লীর নিয়মিত খদ্দের। তা ছাড়া স্থানীয় আদি বাসিন্দা কিংবা তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কে কে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া গরম গরম পরাটা আর ডিম ভাজি খান নাই। খান নাই শাহি হালিম, ফুসকা, চটপটি, ঘুগনি আর রমজান মাসের ‘বাপের বড় পোলায় খায়’ নামের অতি উপাদেয় বা হাজারো জীবাণু আক্রান্ত খাবারগুলোর কোনওটি। এমন তরো নানা উদ্ভট ভাবনা সমূহ পলায়নপর ভীত ইঁদুরের মতই যেন তার মস্তিষ্কের শেকড় থেকে ডাল-পালা অবধি ছোটাছুটি করছিল বিপুল বিক্রমে।

মস্তিষ্কের উদ্ভট ভাবনা সমূহকে সরিয়ে রেখে নির্ভার মনে চায়ের কাপ হাতে ইদ্রিস আলি তাকিয়ে থাকতে চেষ্টা করছিল পুরো গলিটির ওপর। বিভিন্ন বয়স আর পেশার লোকজন হালকা পদক্ষেপে এগোতে এগোতে দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দেখছিল। তাদের কেউ কেউ কোনও মেয়ের সঙ্গে হাসি-মশকরায়ও মেতে উঠে পুরোনো পরিচয়টাকেই যেন ঝালিয়ে নিতে তৎপর হয়। কেউ কেউ আবার ইচ্ছে করেই হয়ত কারও কারও স্তন মুঠিতে নিয়ে মোচড় দেয় কিংবা কারও গাল টানা বা পাছায় থাপ্পড় দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো ঘটালেও মেয়েদের কারও কাছ থেকে কোনও রকম বাধা আসে না। এমন কি কারও কণ্ঠে ফুটে ওঠে না প্রতিবাদের হু-হুঙ্কার। বিনা পয়সায় যেটুকু আনন্দকে আপাতত মুঠো বন্দি করা যায় সে চেষ্টাও হতে পারে। যে কারণে এক পক্ষ আগ্রাসী হলে অন্য পক্ষকে খানিকটা ছাড় দিতে দেখা যায়। দেখা যায় কারও গায়ের রঙের সঙ্গে নিদারুণ ভাবে বেমানান গাঢ় লিপস্টিক ঘষা দু ঠোঁটের ফাঁকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা দাঁতের ঝিলিকও। এমন দৃশ্য তো হর হামেশাই সে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তার বিশেষ আগ্রহ থাকে, নতুন কোনও মুখের আগমন হয় কি না, যে এ পাড়ার বাসিন্দা বা খদ্দের হিসাবে একেবারেই নতুন।

নিচে রাস্তায় বা গলিতে যারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে সাধারণত তাদের শারীরিক জৌলুস আর দর মোটামুটি পড়তির দিকে বলেই তারা নেমে আসে নিচের তলায়। আয় বেশি না থকলে উপর তলার খরচ মেটানো কঠিন। নিচে চলে এলে সস্তার হোক আর মাঝামাঝি হোক কম বেশি খদ্দের ধরা যায়। সর্দারনী বা বাড়িওয়ালী নিচের মানুষদের ততটা গুরুত্ব দেয় না, যতটা গুরুত্ব পায় দোতালার বাসিন্দারা। নিচের বাসিন্দাদের সঙ্গে মাংতির সম্পর্ক। যা ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ আর পানি খরচ মিলিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে দিতে হয় মাসের দশ তারিখের ভেতর। এই মাংতি চালিয়ে খুব একটা খারাপ কাটে না দিনকাল। কেবল অসুখ-বিসুখ হলেই টান পড়ে সঞ্চয়ে। অবশ্য দোতালার মেয়েদের সবারই বয়স কম।
চেহারা-সুরত, শরীরের রঙ-গঠন সবই খদ্দেরের জন্য লোভনীয় বলেই ইদ্রিসের মতো মানুষদের নাগালের বাইরে তারা, যেমন নাগালের বাইরে অবস্থানের দিক দিয়ে, তেমনি রেটের হিসাবেও। অবশ্য বেশ্যা পল্লীতে বসবাসরত মেয়েদের কর্মকাণ্ড এবং এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকজনকে মন থেকে সমর্থন করতে না পারলেও সাহস বা সামর্থ্যকে জয় করে অনেকবারই সে ঢুকতে পেরেছিল এ পাড়ার নিচতলার কয়েকটি ঘরে। কিন্তু প্রতিদিনই ঘুম ভাঙলে মনে মনে পণ করে যে, এ মুখো আর হবে না সে। কিন্তু কীসের টানে যেন সে চলে আসে এখানেই। কখনও বা মনে হয় ভুল করেই যেন এসে পড়ে এখানে।

যে বার সপ্তাহ খানেক জ্বরে ভুগে বেশ কাহিল হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল, সে কথা মনে পড়লে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয় সে। সারাদিন পড়ে থাকলেও কিন্তু সন্ধ্যার দিকে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল রোকসানার ঘরের সামনে, সিঁড়ির ধাপে। সে কীভাবে এসেছে সে কথা বলতে পারবে না শুনে, হা হা করে হেসে উঠেছিল মেয়েটি। হয়ত তার হাসি শুনেই আশপাশের নিষ্কর্মা লোকজন, প্রায় অচল বিগত যৌবনা দেহজীবী কয়েকজন এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য করে রোকসানা বলে উঠেছিল, মাঙ্গের ভাই, ক্যামনে এই মিহি আইলে, কইৎ পারে না নাহি!

দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশ ঘেঁষে অঘোষিত ট্রাক স্ট্যান্ডের দিক থেকে জনা পাঁচেক পুলিশ সদস্য আসতে দেখে ভীতু লোকজন ছুটাছুটি করতে থাকে। আর তাই হয়ত ভাবনার ঘোর কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় ইদ্রিস আলি। হাতে ধরা কাপের চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তলানি টুকু ফেলে দিয়ে মাহাবুবের দোকানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দুজন পুলিশ তাকে থামায়। একজন তাকে জেরা করে জানতে চায়, এখানে তুর কী কাম?

এমন ঘটনায় ইদ্রিস কিছুই মনে করে না। বলে, চা খাইলাম। অখন কাপ ফেরত দিবার যাইতাছি!

-কাজ কাম কিছু করিস, নাকি মাগির দালালি করিস?

পাশের জন আগ বাড়িয়ে বলে ওঠে, মাগি ব্যাচা-কিনির কাম করছ না তো?

যেন মহা রসিকতার কথা শুনে ফেলেছে এমন ভাবে হেসে উঠে বললো ইদ্রিস আলি, সারে কি আমার শইলের হাড্ডি দেইখ্যা বুঝেন না!

-ব্যাটা মজা করিস? দেবানে পাছায় দুডো লাগায়ে, শ্যালা!

ইদ্রিস আলি উচ্চবাচ্য না করে এক ছুটে মাহাবুবের দোকানের সামনে গিয়ে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে।

মাহাবুব ইদ্রিস আলির কাপ সমেত অন্যান্য কাপ ধুতে ধুতে চাপা স্বরে বলে, চোরের জাতের মায়রে বাপ! ফিরি মাল খাইবার আইছে। দ্যাশটা য্যান হালাগো বাপের জমিদারি, যহন যা মনে চায় তাই করবো!

মাহাবুব আরো চাপা স্বরে বলে, দ্যাখ হউরের পো, হালারা দোতালায় উঠতাছে!

ইদ্রিস আলি আড় চোখে তাকিয়ে দেখে, ওরা বিভিন্ন ঘরে ঢুকে গেলেও কোহিনুরের ঘরের সামনেও দাঁড়ায়নি। এ ভাবে প্রতিদিনই পাশের থানা থেকে কর্তব্যের নামে বিনা পয়সায় ফুর্তি করতে আসে ওরা। আর এটাও যেন এ পল্লীর অনেক ঘটনার ভেতর একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

কানের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে এদিক ওদিক তাকায় সে। কিছু একটা দেখে বা দেখে না। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালে মাহাবুব সঙ্গে সঙ্গেই বলে, উঠতাছস ক্যান?

-রাইতের খাওনের যোগাড়-যন্ত্র করি গিয়া।

-বয়, যাবি তো কমুনিডি সেন্টারের ঝুডা-কাঁডা খাইবার!

তারপর পায়ের নিচের চটের প্রান্ত তুলে একটি পাঁচশত টাকার নোট বের করে ইদ্রিসের হাতে দিয়ে বললো, বোরখা পিন্দা একজন ভাঙ্গারির দোকানের সামনে থাকবো। হাতে থাকবো দুইডা ফুলের ঝাড়ু। তুই গিয়া কইবি, ঝাড়ু দুইডা ক্যান? এই কথা কইয়া তুই হাডা দিবি। বাস ইস্টিশন যাবি। ঘোড়ার গাড়ি দিয়া গুলিস্তান। গুলিস্তান থাইক্যা রিশকায় কমলাপুর। তারপরে রাইতের ট্রেনে আখাউড়া। বেডির লগে তাগো বাইত্যে যাবি। মাঝ পথে ছাইড়া দিয়া ভাগিস না আবার!

বুচ্ছি! বলে, টাকাটা কোমরের ভাঁজে লুকানো খুঁতিতে রেখে দেয় সে। তারপরের গল্প মোটামুটি তার অজানা নয়। মেয়ে মানুষটির বাড়ি গিয়ে এক দুদিন কাটানোর পর ঝগড়া ঝাটি করে চলে আসবে। ফলে, মেয়েটির বাড়িতে কোনও প্রশ্ন উঠবে না সে এতদিন কোথায় ছিল। কিন্তু ঘটনা আর মানুষের ভাবনা-চিন্তা সব সময় এতটা সরল থাকে না। তখনই আবার মনে পড়ে রোকসানার কথা।

সেবার তার কথা রোকসানা বিশ্বাস করেছিল কি না সে জানে না। কিন্তু তখনই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল আকামত আলি ডাক্তারের কাছে। ওষুধ-পথ্য কিনে দিয়েছিল। সেই থেকে প্রতিদিন একবার তার খোঁজ নিতো সে। আর এভাবেই যেন জন্ম হলো একটি অদৃশ্য মায়ার বন্ধন। শেষটায় একদিন সিদ্ধান্ত নেয় সে পালাবে। কিন্তু কী ভাবে? ইদ্রিস পরিকল্পনা সাজায়। একদিন হরতালের সময় তারা বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু বিপত্তি বাধে রোকসানার বাপের বাড়ি গিয়ে। বরিশালের কোনও এক গ্রামে ভোরের দিকে তারা নেমেছিল। কিন্তু গ্রামের লোকজন কী ভাবে যেন আগেই জেনে গিয়েছিল যে, রোকসানা কান্দু পট্টির কোনও এক পতিতা পল্লীতে থাকে। শহরের কারও সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বা লেখাপড়া করে সেই গল্প বানানো। আসলে টাকার বিনিময়ে যার তার সঙ্গে বিছানায় যায়। কথাটা এমন ভাবেই ছড়িয়েছিল, ইদ্রিসকে সঙ্গে দেখেও কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না। এমন কি তার বাবা-মা কেউ না। হাজার মুখের ছি ছি শুনে ফেরার পথে মাঝ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হতভাগিনী। সেই কষ্ট থেকেই সে নানা রকম নেশা করতে আরম্ভ করেছিল। সে মনে মনে ভাবে যে, রোকসানার মতো আশা ভঙ্গের ঘটনা যেন এ মেয়েটির জীবনে না ঘটে। সে যেন সত্যি সত্যিই তার বাবা মায়ের সংসারে ঠাঁই পেয়ে যায়। ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটলে সে আর এই এলাকায় ফিরে আসবে না। তারপর কী মনে করে সে আকাশের দিকে তাকায়। সূর্যটা যেন বড্ড ক্লান্ত। তবু ঘুম চোখে জেগে রয়েছে দায়িত্বের কথা ভেবে।

সন্ধ্যা নামবে আর একটু পরেই। আর তখনই ইদ্রিস আলির মনের জানালায় ভেসে ওঠে রোকসানার মুখ। যেন কুমারের কালো মাটি দিয়ে গড়া কোনও এক স্বপ্ন প্রতিমা। শাঁখারী পট্টির কালি মূর্তির মতই যার দেহের গড়ন। সাজিয়ে দিয়ে দেবীর পাশে দাঁড় করিয়ে দিলে মনে হবে যমজ বোন। বেঁচে থাকলে সে একদিন না একদিন রোকসানার প্রেমে পড়তো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নিয়তি বা সময় তার অনুকূল ছিল না কোনও কালে।

একটি সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে টানতে টানতে সে হেঁটে চলে ভাঙ্গারির দোকানের উদ্দেশ্যে। যেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে বোরখা পড়া একজন নারী। যার হাতে থাকবে দুটো ফুলের ঝাড়ু। সে পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইবে, দুইডা ঝাড়ু ক্যান? তারপরই সে হাঁটা শুরু করবে ঘোড়ার গাড়ি ধরার উদ্দেশ্যে। বোরখা পরা নারীটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসবে নীরবে। নিষিদ্ধ পল্লী এলাকাটা পার হতে পারলেই কেউ তাদের চিনতে পারবে না আর। সমাজের চোখে পতিত নারীটি হয়ত পেয়ে যাবে মুক্ত হাওয়ার স্বাদ। কিন্তু তার নিজের কী হবে? নিজের কথা ভাবতে গেলেই তার ইচ্ছে হয় রোকসানার মতোই কোনও উঁচু বিল্ডিঙের ছাদ থেকে নয়তো লঞ্চের ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

নারীটি নীরবেই অনুসরণ করে তাকে। গুলিস্তান পৌঁছাবার আগেই সূর্য ডুবে যায়। তবু খানিকটা আলো ছড়িয়ে থাকে চার দিকে। সে আলোয় পথ চলায় কারও অসুবিধা হয় না। দরাদরি করে রিকশায় উঠে বসতেই নারীটি ঘনিষ্ঠ হয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ইদ্রিসের কোমর। সে বিস্মিত হয়ে নারীটির মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু নেকাবের আড়ালে মুখ দেখতে পায় না। খানিকটা বিব্রত হয়ে সে শক্ত হয়ে বসে থাকে আর নানা ধরনের অর্থহীন চিন্তায় ঘামতে থাকে। সেই অবসরে হঠাৎ করেই যেন বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো আকার পেতে আরম্ভ করে তার মনের সীমানায়। নানা রকম জিজ্ঞাসায় গুটিয়ে যেতে থাকে ভেতরে ভেতরে।

কে সে? কোথা থেকে কখন এসেছিল এই পুরান ঢাকায়। তার কি বাবা মা ছিল না? নাকি কান্দু পট্টির সেই নিষিদ্ধ বাড়িটির কোনও এক নিষিদ্ধ নারীর পাপের ফসল? তাহলে তার নাম ইদ্রিস আলি হলো কেমন করে? কে রেখেছিল তার নামটি? পিতা-মাতার পরিচয় থাকলে হয়ত তার এ অবস্থা হতো না আজ। হয়ত সত্যি সত্যিই এমন করে তার পাশে বসে থাকতো তার স্ত্রী। কিন্তু পিতৃ-পরিচয়-হীন বলে সে আজ এতোটাই পতিত যে, আরেকজন পতিতাও তার স্ত্রী হতে সম্মত হবে না হয়ত। এমন কি সে নিজেও তেমন কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে সাহস পাবে না।

কমলাপুর স্টেশনে এসে যথারীতি বিভ্রান্ত না হয়ে পারে না ইদ্রিস আলি। জীবনে এই প্রথমই সে ঢুকলও স্টেশনের এ অবধি। কিন্তু কোথা থেকে টিকেট কিনবে বা এ ব্যাপারে কাকে কাকে কী জিজ্ঞেস করবে তাই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ তার পাশ থেকে স্বচ্ছন্দ ভঙ্গীতে নারীটিকে এগিয়ে যেতে দেখে টিকেট কাউন্টারের দিকে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের নানা কথা উপেক্ষা করে খানিক পর দুটো টিকেট নিয়ে ফিরেও আসে। তারপর অকস্মাৎ মুখের নেকাব উলটে ধরে মাথায় তুলে দিয়ে হাসি মুখে বলে ওঠে, টিকেট তো নিয়া আইলাম!

ইদ্রিস আলির হৃদপিণ্ডটিকে যেন অদৃশ্য কোনও হাত অকস্মাৎ চেপে ধরে প্রবল রোষে। এ কি দেখছে সে? যাদের ভয়ে সে লুকিয়ে চলাফেরা করেছে এতদিন তাদেরই একজন এই রত্না। শেষবার তার ঘরেই গিয়েছিল সে। অনুনয় বিনয় করে পরে দেবে বলে কিছু টাকা কমও দিয়েছিল। মেয়েটি কি ভুলে গেছে সে কথা?

হঠাৎ ইদ্রিসের একটি হাত ধরে রত্না এগিয়ে যেতে থাকে প্লাটফর্মের দিকে। চলতে চলতে বলে, আমি আইতাছি জানাইয়া একমাস আগে বাড়িত চিডি পাডাইছি। লগে জামাই আইতাছে, এই কতাও লেখছি! বলেই ফিক করে হেসে ওঠে রত্না। তারপর বলে, তুই কইলাম আগ বাড়াইয়া কোনও কতা কবি না। যা কওনের আমিই কমু! কেউ তরে ঘর জামাই কইলেও শরম পাইস না কইলাম! তারপরই কেমন প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি মেলে দিয়ে ইদ্রিসের মুখের দিকে তাকায় সে। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে ঠোঁট বাঁকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফের বলে, আর কইলেই কি, দুইন্যাইৎ যে তর কেউ নাই হেইডা তো আর মিছা না!

কী বলবে ইদ্রিস আলি? সে বুঝতে পারে না, রত্না সত্যি কথা বলছে নাকি এমনিই মজা করছে। তবু তার মনে হয়, সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, সে যে নিজের কানে কথাগুলো শুনেছে সেটাই এখনকার মতো চরম সত্য। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে তার নিজের উপস্থিতির মতোই জ্বলজ্বলে সত্য। আর এ কথা মনে হতেই নানা রকম অবিশ্বাসের দহন বা সম্ভাব্য স্বপ্ন ভঙ্গের আতঙ্কে তার ইচ্ছে হয় চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু স্টেশনে যে ক’টা ট্রেন দেখা যাচ্ছে সবই থেমে আছে। অন্যদিকে রত্নার শক্ত মুঠিতে বন্দি হয়ে আছে তার একটি হাত। যা এ মুহূর্তে ছাড়িয়ে নিতেও মন চাইছে না তার। হয়ত বা সেই চেষ্টা করলেও রত্না তা হতে দেবে বলে নিশ্চিত হতে পারে না সে।

((((()))))
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×