যেসব লোক অলৌকিকতার নামে মানুষের দুর্বলতা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কারকে ভাঙ্গিয়ে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করে চলছে তাদের মধ্যে পীর হল অন্যতম। বাংলাদেশে ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে পীর ব্যাবসা খুব জমজমাট। এখানে পীররা শুধু ধর্মীয় জায়গায় আবদ্ধ নয়, ধর্ম ছেড়ে তারা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিকেও করছে কুসংস্কার আচ্ছাদিত। প্রবীর ঘোষ পরিচালিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠন এবারে অভিযান চালায় এই রকম একজন পীরের বিরুদ্ধে।
কুসংস্কার দূরীকরণ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এই সংগঠন সকল প্রকার অলৌকিকতার বিরুদ্ধে। যারা কুসংস্কারকে সাফ করার নাম করলে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত নয় বলে সোচ্চার হয় তাদের বিরুদ্ধে। যারা জনগনের চেতনাকে বেশীদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে ভয় পায় তাদের বিরুদ্ধে। যারা জাতের নামে বজ্জাতি করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে। যারা ধর্মের নামে মানুষের মানবিকতার চূড়ান্ত বিকাশ গতিকে রুদ্ধ রাখতে চায় তাদের বিরুদ্ধে। একটি তলোয়ারের ধর্ম যেমন তীক্ষ্ণতা, আগুনের ধর্ম যেমন দহন। তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্বের বিকাশ। মানুষের চিন্তায়, মানুষের চেতনায় বপন করা উচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বীজ। যারা কুসংস্কার দূরীকরনের কথা উঠলেই বলে আগে চাই শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাই কুসংস্কার দূর করবে, তাদের স্মরণ করে দেয়া প্রয়োজন শিক্ষা বিস্তারের অর্থ শুধু বইয়ের পড়া মুখস্ত করা নয়। কুসংস্কার দূর করাও শিক্ষা প্রসারের অঙ্গ। অশিক্ষা বিতাড়নের চেয়ে বড় শিক্ষা আর কি হতে পারে? জনশিক্ষা ও যথার্থ বিজ্ঞান চেতনা আজও এ দেশে দুর্লভ। এই সংগঠন সেই দুর্লভ কাজই করতে চায়, ঘটাতে চায় চিন্তার বিপ্লব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
গত ১৮ জুলাই এই সংগঠনের সদস্য এন.সি.নীল যোগাযোগ করে মুহাম্মদপুরের এক পীরের সাথে। পীর সব ধরণের সমস্যার অলৌকিক সমাধান প্রদান করেন। সন্তান না হওয়া, জিন-পরীর আছর, জাদু টোনা বান, বাবসায় লোকসান, চাকুরী ও পরীক্ষায় সফল না হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর অমিল, পরকীয়া প্রেম, মনের মানুষকে বাধ্য করা, হারানো মানুষ খুজে বের করা, সন্তানের অবাধ্যতা, স্বপ্নদোষ, হস্তমৈথুন সহ হাজারো সমস্যার কোরআনের মাধ্যমে সমাধান দেন তিনি। তার ভিজিটিং কার্ড
( চিত্র ০১- Click This Link)
এন.সি.নীল যোগাযোগ করেন সংগঠনের আর এক সদস্য তাহসিব হাসানের বিষয় নিয়ে। তাহসিব হাসানের ভাই হারিয়ে গেছে, তাকে খোঁজার জন্য পীর সাহেব কে ধরা হয়। তাহসিবের বাবা তার ছোট ভাইকে সিগারেট খাবার জন্য ও নামাজ না পরার জন্য মার দিলে সে অভিমানে বাসা ত্যাগ করে। পরবর্তীতে বাসার সাথে সে কোন যোগাযোগ করে না। (বিঃ দ্রঃ তাহসিবের কোন ভাই নেই, তার বাবা মারা গেছে ৯৮ সালে। ) পীর সাহেব এই সমস্যা সমাধানের জন্য আগামী শুক্রবার আসতে বলেন।
শুক্রবার ২০ জুলাই বিকালে সংগঠনের প্রায় ২৫ জন সদস্য পীরের এলাকায় যায়। এন.সি.নীল, দেবজ্যোতি রুদ্র ও তাহসিব হাসান পীরের আস্তানায় যায় এবং বাকি সদস্যরা বাইরে অপেক্ষা করে, যাতে কোন সমস্যা হলে লোকবলের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তারা যায় পীরের শক্তি উপলব্ধি করতে। এই সেই ভণ্ড পীর
(চিত্র ০২- Click This Link)
পীর জানায় সে তাহসিবের ছোট ভাইকে খুঁজে আনতে পারবে, চুক্তি হয় ৫০০০ টাকা। আগে কাজ পরে টাকা। তবে প্রাথমিক হাদিয়া হিসেবে পীর কে দিতে হয় ৩১৩ টাকা। তিনি রাত্রে বসে দেখবেন তাহসিবের ভাই কোথায় আছেন। তিনি জীনের মাধ্যমে বা স্বপ্নের মাধ্যমে দেখবেন।
পরদিন পীর সাহেব ফোনের মাধ্যমে জানান যে তিনি তাহসিবের ভাইকে জীনের মাধ্যমে দেখতে পেয়েছেন। তাহসিব ও পীরের সাথে কথোপকথন গুলো শুনতে ক্লিক করুন http://www.mediafire.com/?5x9sqeifgjvuqh2
তাহসিবকে পীর মেশকা ও জাফরানের কালি, পদ্মা নদীর পানি ও ভাইয়ের ব্যবহার করা কাপড় সঙ্গে নিয়ে তার কাছে আসতে বলে। তাহসিব পীরকে ভাইয়ের ব্যবহার করা কাপড় বাদে অন্যান্য জিনিশগুলো সংগ্রহ করতে বলেন এবং এজন্য সেই পীর তার কাছ থেকে আরও ৭০০ টাকা দাবি করে। তাহসিব জানায় সে পরবর্তী শুক্রবার আসবে এবং সবকিছু দিবে।
পরবর্তী শুক্রবার ২৭ জুলাই সংগঠন থেকে প্রায় ৫০ জন সদস্য যায় পীরের ভণ্ডামি উন্মোচন করতে। একুশে ইটিভি ও এটিএন বাংলার মত ২ টি টেলিভিশনের যাবার কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও অপারেশনের সময় সকাল ১০ টায় হবার কারনে তারা যেতে পারে নি। এছাড়া সংগঠনের পীরের ভণ্ডামি উন্মোচনের ব্যাপারে প্রচার সম্পাদক এর পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় বিভিন্ন পত্রিকাতে। পরবর্তীতে তাদের সাড়া পাওয়া গেলেও ঘটনার সময় তাদের পাওয়া যায় নি।
প্রথম বার যে ৩ জন পীরের কাছে গেছিল এবারও সেই ৩ জন পীরের আস্তানায় যায়। বাকি সবাই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে পীরকে আক্রমণের জন্য। পীর প্রথমে কিছু তাবিজ বানায়। এই তাবিজ গুলো কোরআনের আয়াত সম্বলিত। ৪ টি তাবিজ পীর সাহেব তাহসিবের হাতে দেয় এবং বলে প্রথম তাবিজটি মাটিতে পুততে হবে, ২য় তাবিজটি পানিতে ফেলতে হবে, ৩য় তাবিজটি আগুনে পোড়াতে হবে, ৪র্থ তাবিজটি পাখি বা গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে আকাশে উড়াতে হবে। এছাড়া তিনি কাগজে সুতলি বেধে কিছু কুরআনের আয়াত দেন যা উল্টো করে ঘুরাতে হবে এবং প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১০০ বার আরবিতে পরতে হবে। কুরআনের আয়াত সম্বলিত আরও কিছু কাগজ দেন তিনি যা ভাইয়ের পড়ার টেবিলের সামনে ঝুলাতে বলেছেন।
এই ভাবে বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর সংগঠনের সদস্য এন.সি.নীল হঠাত করে পীরকে জিজ্ঞাস করেন এই ভণ্ডামি ব্যাবসা কত দিন ধরে করছেন? এই টি বলার সাথে সাথে পীর মোবাইল হাতে নিলে এন.সি.নীল মোবাইল সীজ করেন। পীরের সাথে একজন মুরিদ ছিল যে ঘটনা শুরু হবার সাথে সাথে দৌড়ে পালায় এবং মানুষ খবর দিতে যায়। এর মধ্যে সংগঠনের বাকি সদস্যগণ এসে পরে এবং অই খানের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়।
(চিত্র ০৩ Click This Link)
(চিত্র ০৪- Click This Link)
(চিত্র ০৫- Click This Link)
(চিত্র ০৬- Click This Link)
একটা পর্যায় পীর সংগঠনের একজন সদস্যকে টাকার মাধ্যমে ব্যাপারটা সমাধান করার কথা বলে হতাশ হয়। এই দিকে স্থানীয় লোকজন এসে সংগঠনের ছেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে। এক পর্যায় সংগঠন থেকে একজন প্রশাসনকে সব কিছু জানায় এবং আসতে অনুরোধ করে।
এদিকে তাহসিব তার মোবাইল এর অডিও ডকুমেন্টের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে প্রমাণ করে যে সে একজন ভণ্ড ও প্রতারক। এই বার স্থানীয় জনগন সংগঠনের কাজকে সমর্থন দিতে শুরু করলে পীর এবং তার সমর্থকরা মারাত্মক সমস্যায় পড়ে। অবশেষে পীর লিখিত দিতে বাধ্য হয়।
( চিত্র ০৭- Click This Link)
(চিত্র ০৮- Click This Link)
পীর যা লিখে দেন তা সংক্ষেপে নিম্নে দেয়া হল
(চিত্র ০৯- Click This Link)।
(চিত্র ১০- Click This Link)
“আমি আন নাজাত তদবির সেন্টারের পরিচালক এ এস হাবিবুর রহমান স্বীকার করছি যে আমার কাজগুলো ছিল প্রতারণামূলক। আমি ভবিষ্যতে এই ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকব এবং আমার জানা মতে কেউ যদি করে থাকে তাহলে তাদের সনাক্ত করতে আপনাদের সহযোগিতা করব। পীরের সাক্ষর, স্থানীয় ২ জন মানুষের সাক্ষর এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে সাক্ষর করেন তাহসিব হাসান।
(চিত্র ১১- Click This Link)
সংগঠনের নাম লিখিতপত্রে ছিল না। এই লিখিত মুচলেকার একটা কপি থানায় জমা দিতে হয়েছে। সংগঠন সরকারী ভাবে রেজিস্ট্রেশান এখনও হয় নি তাই থানা দিয়া কোন সমস্যা করতে পারে ভেবেই নাম ব্যাবহারে বিরত থাকা হয়। অবশেষে পীর আবারও সবার কাছে ক্ষমা চায় এবং প্রথম বার প্রদত্ত ৩০০ টাকা ফেরত দেয়। পীর সবার সামনে অঙ্গীকার করে তিনি এই ধরণের ব্যাবসা আর কোন দিন করবেন না।
আসলে এই পীর ছিল একবারেই নব্য পীর। তার বয়স খুব কম। পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেন ঢাকায় এসে বাচ্চাদের কুরান হাদিস পড়িয়ে খুব বেশী আয় হত না, তাই তিনি বাধ্য হয়ে এই ভণ্ডামি পেশাতে পদার্পণ করেন। তার বিবেক এখন সাড়া দিয়াছে বলে তিনি বলছেন। তিনি এখন একটি কাজ চান যে কোন ধরণের কাজ। পীর বলেছেন ছেলেরা তাকে গনপিটনি দিতে পারত অথবা পুলিশে ধরে দিতে পারত। পুলিশে ধরলে কিছু টাকা খেয়ে আবার তাকে ছেড়ে দেয়া হত, আবার তিনি ব্যাবসা চালাতেন। কিন্তু এখন তার উপলব্ধি হয়েছে। তিনি এখন কাজ চান।
শেষ করছি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনের একজন সদস্যার কথা দিয়ে, তিনি বলেছেন “আমাদের সংগঠন কাজ করতে চায়, কিন্তু এজন্য প্রয়োজন দিকনির্দেশনা ও ফান্ড। এই সংগঠনটির বেশীর ভাগ সদস্য বয়সে তরুন। তাদের যদি সাহায্য ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া যায় তাহলে এই সংগঠনটি হতে পারে বাংলাদেশ থেকে কুসংস্কার দূরীকরণের অন্যতম বড় হাতিয়ার। সংগঠনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন -+৮৮০১১৯৭২৩২৯৩০, +৮৮০১৬১১৮২৪৭৪২।
সংগঠনের ফেসবুক পেজ- http://www.facebook.com/a.k.m.bangladesh.g
ইমেল পাঠাতে পারেন- [email protected]
আসুন বাংলাদেশ থেকে কুসংস্কার দূরীকরণ করতে সবাই একযোগে কাজ করি।