somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিষচক্র ২ মাসুদ রানা

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৪২
মনোযোগ দিয়ে শুনছে রানা, গড়গড় করে নিজের কথা বলে
যাচ্ছে মিলি। রানার চোখ ডিভান হোটেলের ছাদে। অ্যানেক্স
বিল্ডিং আর হোটেলের জানালাগুলোর কাঁচ সূর্যের আলোয় সোনালী
দেখাচ্ছে। ওখানে ছাল্ডে সুইমিং পুলে উঁচু বোর্ড থেকে ডাইভ
দিচ্ছে অনেকে। বাচ্চারা খেলায় ব্যস্ত। ট্র্যামপোলিনে লাফাচ্ছে।
বিদ্যুৎ-চমকের মতো চিন্তাটা খেলে গেল রানার মাথায়। ডাইভিং
বোর্ড! ট্র্যামপোলিন! কাজ হতে পারে! হয়তো কাজ হবে! ঝুঁকিপূর্ণ
হলেও এখন সম্ভব বলেই মনে হচ্ছে!
‘রানা?’ ডাকল মিলি। ‘কোথায় হারালে?’
ঘুরে তাকাল রানা, মিলির চোখে চোখ রাখল। ‘আজ রাতে
আমি কাজে বের হবো।’
হাত ধরাধরি করে লিভিং রুমে ফিরে এলো রানা আর মিলি।
মিলি যেন কী বলতে চায়, মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
লাঞ্চ আনিয়ে সুইটেই খাওয়া সারল ওরা। বয়কে দিয়ে পেপার
আনাল রানা। প্রত্যেকটা পেপারে এসেছে চিকা মোস্তাকের
মৃত্যুসংবাদ, তবে একটাতে আছে অটোপসি রিপোর্ট। তাতে বলা
হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কোকেনে আসক্ত ছিল সে। ওর সন্দেহই
সঠিক জেনে মনটা আরও বিষণœ হয়ে গেল রানার।
দুপুরের পর শুলো রানা। কিছুক্ষণ পর ওর মাথার পাশে এসে
বসল মিলি, চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করল। টুকটাক কথা হলো
ওল্ডে মাঝে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
বিকেলে কপালে নরম ঠোঁটের স্পর্শে চোখ মেলল রানা।
তখনও মিলি ওর মাথার পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
‘ব্যাপারটা কী হলো, মিলি?’
‘আমি আমার ভূমিকা পালন করছি মাত্র,’ মুচকি হেসে বলল
মিলি।
‘সেটা তো করবে লোকের সামনে।’
‘তুমি না বললে, ঘরে-বাইরে সব সময় নিজের ভূমিকা পালন
করতে হবে, তবেই সার্থক অভিনেত্রী হতে পারব!’
চোখে চোখে কথা হলো দুজনের। হাসল রানা, আর কিছু
বলল না। আগুনে পুড়তে চায় যে মেয়ে, তাকে বুঝিয়ে কী লাভ?
সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য হোটেল থেকে বের হলো রানা। এক
দোকান থেকে দড়ি আর অন্য দোকান থেকে হুক কিনে ফিরল।
সুইটে ঢুকেই শুনল নাচের বাজনা বাজছে। নীল জামা পরা
মিলি পরীর মতো নাচছে বাজনার সঙ্গে। রানাকে দেখে ওর মুখটা
আরক্ত হলো। নাচতে নাচতেই রানার সামনে এসে দুহাতে জড়িয়ে
ধরল ওকে। ভূমিকা পালন করছে। ভেজা ভেজা ঠোঁট দুটো
সামান্য ফাঁক হলো। পায়ের পাতার সামনের অংশে ভর দিয়ে
আলতো করে রানার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল মিলি। অল্প অল্প কাঁপছে
ওর দেহ।
রক্তে কীসের এক অজানা শিহরন অনুভব করল রানা। ওর
নিষ্ঠুর ঠোঁট চেপে বসল মিলির কোমল অধরে। নীরব সমঝোতায়
অন্ধকার বেডরুমের দিকে চলল ওরা একটু একটু করে।
‘পরে পস্তাবে না তো, মিলি?’ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু
কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।
‘কেন? আমি তো তোমার কথামত অভিনয় করছি,’ দুষ্টামি
হাসি মিলির ঠোঁটে। ‘প্রেমিকার আচরণ করতে হবে না?’
‘না করলেও চলে কিন্তু।’ খাটের উপর বসল রানা।
‘তা ছাড়া ভাবছি, আমাকে যেভাবে পরীক্ষা করে দেখেছ ড্রাগ
নিচ্ছি কি না, তোমাকেও আমার সেই একই ভাবে পরীক্ষা করে
জেনে নেয়া ল্ডকার তুমিও নিচ্ছ কি না।’ একটা পেন্সিল টর্চ রানার
দিকে তাক করে, শান্ত গলায় বলল মিলি, ‘ভয় পেয়ো না, আমি






৪৩
তোমার কোনও ক্ষতি করব না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজটা করতে
হচ্ছে। তোমার পোশাক খুলে ফেলো।’
‘কীহ্!’
‘একবারই মাত্র ব্যাখ্যা করব আমি, রানা,’ বলল মিলি।
‘তারপর যদি তুমি কথা না শোনো তা হলে জোর করে তোমার
কাপড় খুলতে হবে আমাকে! নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমার কথা
অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে পারি না আমি? এবার পোশাক খুলে
ফেলো। আমি দেখতে চাই তোমার শরীরে সিরিঞ্জের নতুন কোনও
দাগ আছে কি না। ভেবো না আনন্দ পাবার জন্য কাজটা করছি
আমি, করতে হচ্ছে এটা আমার দায়িত্ব বলে।’
‘ইয়োক!’ বলল রানা।
‘করতেই হবে, রানা, দেরি কোরো না। আমি তা হলে বাধ্য হবো কাজটা নিজ হাতে করতে।’
‘ঠিক আছে, লজ্জা-শরম বলে কিছু যদি না থাকে, তা হলে
নিজ হাতেই করো। আমি পারব না।’
রানার কাপড় আর প্যাডিং খুলে ফেলল মিলি দক্ষ হাতে।
‘গুড!’ এক পা পিছিয়ে টর্চের আলো রানার দেহে ফেলল
মিলি। আপাদমস্তক পরীক্ষার ভান করছে।
ভ্রƒ কুঁচকে রেখেছে রানা। ‘সারাজীবন এজন্যে তোমাকে ঘৃণা
করব আমি, মিলি,’ হিসহিস করে বলল ও। ‘সারাজীবন! যজ্ঝিনেক বছর বাঁচি তো অনেক বছর ধরে তোমাকে আমি...’
‘চুপ!’ ধমক দিল মিলি।
দু’চোখ ভরা ঘৃণা নিয়ে মিলিকে দেখল রানা। ‘নোংরা মনের
মেয়েমানুষ তুমি, মিলি গঞ্জালেস! তুমি ছেলেল্ডে উলঙ্গ দেখে
বিকৃত আনন্দ পাও।’
জবাব না দিয়ে ব্যস্ত হাতে এবার নিজের ব−াউজের বোতাম
খুলল মিলি, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব−াউজটা খুলে ফেলল। ধীর
পায়ে এগিয়ে এলো রানার দিকে।
‘ইয়োক!’ রানা আপত্তি জানাল।
কিন্তু কথা শুনল না মেয়েটা। দু’হাত পিঠের পিছনে নিয়ে
ব্রেসিয়ারের হুক খুলল ও, তারপর ওটা খুলে মাটিতে ফেলেই
ঝাঁপিয়ে পড়ল রানার বুকে।
গ্রীষ্মের প্রখর খরতাপ শেষে এক সময় নামল বর্ষার ঝিরিঝিরি
বৃষ্টি, কেঁপে কেঁপে উঠল মিলি, তারপর রানার বুকে মুখ গুঁজে
ঘুমিয়ে পড়ল বেখবর। ওর ঠোঁট ছুঁয়ে থাকল অদ্ভুত মিষ্টি, সরল
একটা পরিতৃপ্তির হাসি। পাশে শুয়ে দ্বিধায় ভুগছে রানা। বুঝতে
পারছে না কাজটা ঠিক হলো কি না। মিলিকে ফিরিয়ে ত্থেয়াই কি
ওর উচিত ছিল?
মিলির ঘুম যাতে না ভাঙে তাই সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠল
ও, গোসল সেরে তৈরি হতে শুরু করল। রাতের খাবারটা সুইটে
আনিয়ে ডেকে তুলবে মিলিকে, খাওয়া সেরেই বেরিয়ে পড়তে হবে
কাজে।






সাত

আধখানা ঘোলাটে চাঁল্ডে আলোয় ডিভান হোটেলের ছাদে নানা
আকৃতির ছায়া সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধেক তৈরি একটা ঘরের ছায়াটাই






৪৪
সবচেয়ে বড়। এছাড়াও রয়েছে ওয়াটার টাওয়ার, এলিভেটর
মেশিনারি হাউসিং আর বাচ্চাল্ডে খেলবার নানান সরঞ্জামের ছায়া।
আরেকটা ছায়া অন্যান্যগুলোর মতোই নিথর হয়ে আছে। দীর্ঘ
সুঠাম দেহটা যেন পাথরে তৈরি। আধঘণ্টা হলো ঠায় স্ফাড়িয়ে আছে
সে, একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে ডিবার্গ অ্যান্ড কোম্পানির আলোকিত
সোনালী জানালাগুলো।
এখন মাত্র তিনটে জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। ওগুলো
বোধহয় ডিবার্গের প্রাইভেট সুইটের জানালা, আন্দাজ করল
লক্ষকারী। এরইমধ্যে সে দেখেছে একজন সশস্ত্র গার্ড বন্ধ
অফিসের সামনে দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর ঘুরে যাচ্ছে। কাজে কোনও
ত্র“টি নেই তার, তবে নির্দিষ্ট একটা ল্ডজা সে খুলছে না। ওটার
ওপাশেই সম্ভবত আছে ডিবার্গ ম্যাকেঞ্জি নামের অসুস্থ এক বুড়ো
মাকড়সা, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুনে চলেছে তার নোংরা জাল।
আজ রাতে তার জাল বোনায় বাধা আসবে।
শেষ পর্যন্ত ছায়া থেকে চাঁল্ডে আবছা আলোয় বেরিয়ে এলো
রানা। চিতার মতো নিঃশব্দে হালকা পায়ে হাঁটছে ও, কালো
ট্রাউজার্স, কালো সোয়েট শার্ট আর কালো জুতো-মোজা পরেছে।
ছাল্ডে কিনারায় এসে স্ফাড়াল ও, অ্যানেক্স বিল্ডিঙের দিকে
চেয়ে আছে। আরেকবার ভ্রƒ কুঁচকে আর্কিটেক্টের কথা ভাবল।
মাঝখানের দূরত্বটা পার হওয়া অসম্ভব নয়। কাছ থেকে দেখে
এখন মনে হচ্ছে বারো ফুটের বেশি হবে না। পেন্টহাউস তৈরির
কাজে বল্টহৃত একটা তক্তা মাঝখানে রেখে পার হওয়া যেত, কিন্তু
বাধ সেধেছে উচ্চতা। অ্যানেক্সটা অন্তত দশফুট উঁচু। সমস্যা
সেখানেই।
দুই বিল্ডিঙের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে নীচে তাকাল রানা।
দশতলা নীচে নিরেট কংক্রিটের মেঝে। যদি পড়ে যায় তা হলে
নিশ্চিত মৃত্যু।
কাজ শুরু করল ও। রাবার মোড়া হুক সহ দড়ি ছুঁড়ল
অ্যানেক্সের কোপিঙের দিকে। প্রথম চেষ্টায় অসফল হলো। পরপর
আরও কয়েকবার চেষ্টা করল ও। কোপিংটা পিছলা আর ঢালু, হুক
আটকাচ্ছে না, হড়কে যাচ্ছে। একটু পরেই ও বুঝে গেল এভাবে
হবে না। বাধ্য হয়ে একটা তক্তা বেছে নিয়ে ফিরে এলো কিনারায়।
নামিয়ে রাখল তক্তা। দুটো বাড়ির ছাদ সমান হলে নাচতে নাচতে
ওটার উপর দিয়ে পার হয়ে যেতে পারত ও। গভীর শ্বাস পড়ল
ওর। এই পেশায় ঝুঁকির কোনও শেষ নেই। এবার অর্ধসমাপ্ত
পেন্টহাউসের ওপাশ থেকে সিমেন্টের ব্যাগ আনল ও একেকবারে
দুটো করে। প্রতিটার ওজন একশো পাউন্ড। হাত টনটন করে উঠল
ওর। রাতটা শীতল, কিন্তু কায়িক পরিশ্রমে ঘামতে শুরু করল ও।
তক্তার প্রান্তে সিমেন্টের ব্যাগগুলো নামাল ও, তারপর তক্তাটা
ঠেলে দিল বাইরের দিকে। আরও সিমেন্টের ব্যাগ এনে রাখল।
পাঁচ মিনিট পর ওর পছন্দ মতো ওজন রাখা হলো তক্তার উপর।
মোট ছয়টা ব্যাগ। তৈরি হয়ে গেল ওর ডাইভিং বোর্ড। তবে
নীচের বদলে উপরে ডাইভ দেবে ও। আরেকবার নীচে তাকিয়ে
মনে মনে নিজেকে সাবধান করল, যদি পড়ো তো মরলে!
কাজ সেরে আবার ছায়ায় ফিরে গেল ও, অপেক্ষার ফাঁকে
মনোযোগ দিল অফিসটার দিকে। ওকে কেউ দেখে ফেলে থাকলে
তৎপরতা শুরু হয়ে যাবে। অস্ত্র পরীক্ষা করল রানা। বেল্টে গোঁজা
আছে ওয়ালথার। বাহুর খাপে স্টিলেটো তৈরি। সঙ্গে করে
সায়ানাইড গ্যাস বোমাটাও নিয়ে এসেছে। ডিবার্গের মুখ খোলাতে
এসবের মধ্যে স্টিলেটো কাজে লাগানোর ইচ্ছে আছে ওর। অবশ্য সঙ্গে ট্রুথ সিরামও রেখেছে ও। কিন্তু লোকটার হার্টের যা অবস্থা
তাতে ট্রুথ সিরাম দিলে মারাও যেতে পারে। সিগনেট আংটির






৪৫
ড্রাগটা কাজে লাগিয়ে হয়তো লোকটাকে গুহা থেকে বের করা
সম্ভব।
সবকিছু ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে ওর। মন থেকে সমস্ত
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তক্তার কাছে চলে এলো রানা। দীর্ঘদিনের
অভিজ্ঞতা থেকে জানে, একবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দ্বিধায় ভুগলে
বিপল্ডে সম্ভাবনা বাড়ে। তার চেয়ে সবরকম সতর্কতা শেষে
সম্পূর্ণ মনোযোগ একত্রিত করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া ভালো।
তক্তার বাইরের শেষ প্রান্তে এসে স্ফাড়াল রানা। বুঝতে পারছে
ও যদি পড়ে যায় তা হলে মেঝে থেকে কোদাল দিয়ে ওকে চেঁছে
তুলবে পুলিশের লোক। পিঠের কাছটা শিরশির করে উঠল ওর।
বার কয়েক হালকা লাফ দিল ও তক্তার উপর। ¯িপ্রঙের মতো
লাফাল তক্তাটা ওর নীচে। মনে হলো ওটা যেন জীবন্ত। উপর
দিকে তাকাল রানা। দশফুট উঁচুতে পৌঁছুতে হবে ওকে। পার হতে
হবে প্রায় ছয় ফুট। একবারই সুযোগ পাবে ও। সফল হলে ভালো,
নইলে গুড বাই এভরিবডি!
এখন!
লাফিয়ে উঠে তক্তার উপর নামল রানা, পা দুটো শক্ত করে
রেখেছে। নিজের পুরো দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শূন্যে শরীরটাকে
ভাসিয়ে দিল ও। দু’হাত মাথার উপর তুলে রেখেছে। চাঁল্ডে
ফ্যাকাসে আলোয় কালো একটা তীরের মতো ছিটকে উঠল ও।
ভুল হয়ে গেল! ওর বাড়ানো দু’হাতের আঙুল ছাল্ডে টাইলের
তৈরি কোপিং স্পর্শ করল। সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে টাইল
আঁকড়ে ধরতে চাইল রানা, পারল না। পিছলে যাচ্ছে আঙুলগুলো!
অন্তত একটা হাতও কোপিঙের ওপাশে নিতে পারলে উঠে যাওয়া
সম্ভব ছিল। শূন্যে ঝুলছে রানা, ক্রমেই পিছলে যাচ্ছে ওর আঙুল।
কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে এক তুর্কি রাজমিস্ত্রী কাজে
অবহেলা করেছিল, ফাটা একটা টাইল লাগায় সে, চারপাশের
ফাঁকগুলোতে সিমেন্টের আস্তরও দেয়নি। শুধু সে-কারণেই বেঁচে
গেল রানা। ওর ডান হাতের আঙুলগুলো ফাটা টাইলের ফাঁকে
আটকে গেল। রানার স্টিলের মতো শক্ত আঙুলগুলো ধরবার
জায়গা পেয়ে গেছে। ঝুলে থাকল রানা। জীবন-মৃতুশু মাঝে
তফাৎ এনে দিচ্ছে শুধু ওর চারটা আঙুল। নীচে অপেক্ষা করছে
শক্ত সিমেন্টের মেঝে।
বামহাতটা কোপিঙের উপর দিয়ে ওপাশে নিয়ে গেল রানা,
বাম হাতের জোরে শরীরটাকে কোপিঙের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ছাদে তুলে ফেলল। সামান্য সরে দুই বিল্ডিঙের মাঝখানের ফাঁকটা দিয়ে
তাকাল ও, পড়ে যাওয়ার চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে পরবর্তী কাজে
মন দিল। একটা চিমনির আড়ালে সরে এসে অপেক্ষা করল।
অ্যালার্ম বেজে উঠবে ওকে কেউ দেখে থাকলে। পাঁচ মিনিট
পেরিয়ে গেল, অ্যালার্ম বাজল না। আবার ছাল্ডে কিনারায় চলে
এলো রানা, ডিভান হোটেলের নিচু ছাদ্মা দেখল। উপর থেকে
লাফ দিয়ে পুরু তক্তায় পড়ে মাঝখানের দূরত্ব পেরিয়ে ওই ছাদে পৌঁছে যাওয়া কঠিন হবে না। ওর ফিরবার পথ উন্মুক্ত।
আরেকবার অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখল রানা। সন্তুষ্ট হয়ে
চলে এলো এলিভেটরের মেশিনারি ঘরের সামনে। যা ভেবেছিল,
ল্ডজাটায় তালা ঝুলছে। সস্তা তালা। সেলুলয়েডের টুকরো দিয়ে
ওটা খুলতে তিরিশ সেকেন্ড লাগল ওর। ঘোরানো লোহার সিঁড়ি
বেয়ে নেমে আরেকটা ল্ডজার কাছে চলে এলো রানা। এটা
খোলা। একটা ল্যান্ডিঙে আছে এখন ও। পাঁচ ধাপ সিঁড়ির পরই
ওপাশে একটা ফ্রস্টেড কাঁচের ল্ডজা দেখতে পেল। বিনকিউলার
দিয়ে আগে যখন দেখেছে তখন লক্ষ করেছে এরপর আছে সংক্ষিপ্ত
একটা করিডর। করিডরটা চলে গেছে ডিবার্গ লিমিটেডের






৪৬
অফিসগুলোয়। ওই অফিসগুলোর পর আছে ডিবার্গের প্রাইভেট
সুইট। ওখানে পৌঁছুতে হলে গার্ডের একটা বল্টস্থা করতে হবে
ওকে।
করিডর এবং অফিসের কোথাও আছে এখন সশস্ত্র লোকটা।
বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ল্যান্ডিং পার হলো রানা, সতর্ক হয়ে
আছে যেন ওর ছায়া ফ্রস্টেড গ−াসে না পড়ে। ল্ডজার ফাঁকটা দিয়ে
মিউজিকের আওয়াজ শুনতে পেল ও। আন্দাজ করল, একাকী বিরক্ত
হয়ে মিউজিক শুনছে গার্ড। নিশ্চয়ই সঙ্গে করে একটা ট্র্যানজিস্টর
রেডিও নিয়ে এসেছে। ভালো, মনে মনে বলল রানা। ওই মিউজিক
অনুসরণ করে লোকটার কাছে পৌঁছে যেতে পারবে ও।
কাঁচের ল্ডজাটা সামান্য ফাঁক করল রানা। ফাঁকে চোখ রেখে
দেখল করিডরের মাঝখানে একটা টেবিলের পিছনে বসে আছে
গার্ড। লোকটার পিঠ ওর দিকে ফেরানো। টিনের তৈরি একটা
টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে সে, সেই সঙ্গে
বাজনা শুনছে।
যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে রানা
জানে, কেউ যদি কোনও প্রাণী বা মানুষকে আড়াল থেকে
অনেকক্ষণ লক্ষ করে তা হলে সেটা সেই প্রাণী বা মানুষটা টের
পেয়ে যায়। সময় নষ্ট করল না রানা, নিশ্চিত পদক্ষেপে এগোল।
ও আর এক ফুট দূরে থাকতে ইন্দ্রিয় সতর্ক করল লোকটাকে, ঘাড়
ফেরাল সে। গার্ডের ঘাড়ে সজোরে এক কারাতে চপ বসাল রানা।
ঘাড় ভেঙে খুন করবার জন্য মারেনি, লোকটা অজ্ঞান হয়ে ঢলে
পড়ে যেতে শুরু করতেই ধরে ফেলল।
দ্রুত হাতে কাজ করছে রানা। পকেট থেকে এক রোল টেপ
বের হলো ওর। গার্ডের কব্জি আর গোড়ালি বাঁধল ও টেপ দিয়ে।
মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে তার উপর টেপ লাগিয়ে দিল। এবার গার্ডের
রিভলভারটা হোলস্টার থেকে তুলে নিল ও, গুলিগুলো বের করে
পকেটে রেখে রিভলভারটা রেখে দিল আগের জায়গায়। লোকটাকে
ডেস্কের পা রাখবার জায়গায় ভরে ডিবার্গের প্রাইভেট সুইটে যাওয়ার
সিঁড়ির দিকে এগোল ও। ল্ডজাটা চামড়া মোড়া। নবে মোচড় দিয়ে
ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ঢুকল রানা। খাটো একটা হলওয়ে এটা।
মেঝেতে পুরু কার্পেট। বেডরুমও কার্পেটে মোড়া। দেখা যাচ্ছে
এখান থেকে। ভিতরে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। পিছনে
ল্ডজাটা লক করে দিল রানা। এখন ওরা দু’জনই শুধু আছে এই
সুইটে। ইয়া মোটকা ডিবার্গ বিছানায় শুয়ে কী যেন পড়ছে।
নিজের উপস্থিতি জানান দিল না রানা। ছায়ায় স্ফাড়িয়ে ঘরটা
ভালো করে দেখল ও। বাতাসে হালকা সৌরভ ভাসছে, সেই সঙ্গে
ওষুধের গন্ধ। বিছানার পাশের ছোট টেবিলে পনেরো-বিশ রকমের
ওষুধ দেখতে পেল ও। বেশ কয়েকটা বোতল, একটা গ−াস, চামচ
আর একবাক্স বড়ি। রানার মনে পড়ল, ডিবার্গের হার্টের অবস্থা
ভালো নয়। ওটার অবস্থা আজ আরও খারাপ হতে পারে। তবে
সামান্যতম করুণা বোধ করছে না রানা।
ম্যাজেন্টা রঙের ঢোলা পাজামা পরেছে ডিবার্গ। খালি গা।
চারটে থুতনি গোনার পর গুনতিতে ক্ষান্ত দিল রানা। চর্বিতে
ভরপুর একটা দেহ। গোটা শরীরটা ঘিরে রেখেছে চর্বির স্তর। এক
মাথা রুপালী চুল ছোট করে ছাঁটা। থলথলে চেহারাতে চাতুরির
ছাপ। নাকটা যেন ঠিক টিয়া পাখির বাঁকানো ঠোঁট। তার নীচেই
একজোড়া লালচে ঠোঁট। বানরের লালচে নিত¤েল্ফ কথা মনে হয়ে
গেল ওটা দেখে রানার। মুখটা আকৃতি হারিয়েছে স্ফাতের অভাবে।
বেডসাইড টেবিলে কাঁচের গ−াসে স্ফাতগুলো দেখতে পেল ও,
পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়েছে।
‘গুড ইভনিং!’ বেডরুমে পা রাখল রানা, চলে এলো বিছানার






৪৭
পাশে। ‘আমাল্ডে প্রথম মিটিং বলে গোপনেই দেখা করলাম।’
বিস্ময়ে ডিবার্গের হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। বালিশের
তলায় ডানহাত ভরতে গেল সে। ভাসা ভাসা চোখে সতর্কতা নিয়ে
রানাকে দেখছে লোকটা। ‘কে...কে আপনি? কী চান?’
জবাব দিল না রানা। ‘হাতটা বালিশের কাছ থেকে সরান।’
ভ্রƒ কুঁচকে গেল ডিবার্গের। ‘গার্ড আপনাকে বাধা দেয়নি?’
‘না।’
‘দেখেছেন ওকে?’
‘দেখেছি।’
অবাক হলো ডিবার্গ। ‘কী চান? আমি অসুস্থ মানুষ।’
‘আমি মাওলানা আব্দুল হামিল্ডে লোক,’ নির্বিকার চিত্তে মিথেল্টলল রানা। ‘সে জানতে চেয়েছে আপনাল্ডে পরবর্তী মিটিং কবে
এবং কোথায় হবে।’
ডিবার্গের চোখে সন্দেহের ছায়া খেলে গেল। ‘মিথ্যে কথা!
মিস্টার হামিদ জানেন।’
রানার হাতে স্টিলেটো বেরিয়ে এলো। ওটার তীক্ষè ডগা দিয়ে
ডিবার্গের গলায় সামান্য খোঁচা দিল ও। এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে
এলো সঙ্গে সঙ্গে। ‘কোথায়?’
‘না!’ ডিবার্গের গলা কেঁপে গেল। বালিশের কাছ থেকে হাত
সরিয়ে ফেলেছে সে।
রানা বলল, ‘আপনি কিন্তু সময় নষ্ট করছেন। মিটিং কবে এবং
কোথায় হবে?’
‘এখনও ঠিক হয়নি। মিস্টার হামিদকে জানানো হবে সেটা
তিনি জানেন।’
রানার মনে হলো সত্যি কথাই বলছে মোটকু। স্টিলেটো সরাল
না ও। ‘এবারের কোকেন আর হেরোইনের চালানটা কোথা দিয়ে
যাবে সেটা বলুন।’
‘কে আপনি? কার হয়ে কাজ করছেন?’
স্টিলেটোর খোঁচায় আরেক ফোঁটা রক্ত বের হলো ডিবার্গের
গলার ফুটো দিয়ে।
‘স্ফাড়ান! কতো টাকা চাই আপনার?’
‘তোমার নোংরা পয়সা আমার চাই না, ডিবার্গ। যা জানতে
চাইছি জবাব দাও তার। আমার কাছে ট্রুথ সিরাম আছে। জিনিসটা
তোমার হার্টের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে।’ স্টিলেটো সরিয়ে
নিল ও, শার্টের পকেট থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ আর ছোট্ট
স্বচ্ছ বোতলটা বের করে দেখাল। ‘পাঁচ মিনিট সময় নেবে কাজ
করতে।’
অনেক কসরৎ করে বিছানায় উঠে বসল ডিবার্গ। মুখটা
টকটকে লাল দেখাচ্ছে। রেগে গিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ
বিছানার চাল্ড খামচে ধরল। শুয়ে পড়ল কাত হয়ে। বিদঘুটে
মুখটা হাঁ হলো। ‘ওহ্! আ! ওহ্গ্গ্গ্! হার্ট অ্যাটাক! মেডিসিন!
আমার মেডিসিন! সবুজ বোতল!’
সবুজ বোতলটা তুলে নিল রানা। ডিজিটালিস। ওটা বাড়িয়ে
দিতেই কাঁপা হাতে নিতে চাইল ডিবার্গ, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই। এবার
আমি...ঠিক হয়ে যাব।’
বোতলটা তার হাতে দিল না রানা। ‘আগে কোকেন আর
হেরোইনের চালান কোথা দিয়ে যাবে বলো, তার আগে ওষুধ পাবে
না। মিথ্যে বোলো না। বললে আমি টের পাব। এই অবস্থায় ট্রুথ
সিরাম তোমাকে খুন করবে।’
বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিল ডিবার্গ, দেখে মনে হলো ডাঙায়
তোলা তিমি মাছ। প্রতিবার শ্বাস নিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। মুখটা
আরও কুঁচকে গেছে তীব্র ব্যথায়। বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন






৪৮
পিংপং বল, মাটিতে পড়ে লাফিয়ে উঠবে। ‘টা-টাইম নেই! আমি
মরে যাচ্ছি!’
‘তা হলে তাড়াতাড়ি বলো, ওষুধটা দিয়ে èে।’
প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় চাল্ড খামচাতে শুরু করল ডিবার্গ।
‘উর্ফা!’ ককিয়ে উঠল সে। ‘উর্ফা! এডেসা পাস! তিন দিন পর।
এবার ওষুধটা...ওটা...আমি মারা যাচ্ছি!’
বোতলটা বাড়িয়ে ধরল রানা। ওটা নিতে হাত বাড়াল ডিবার্গ,
তারপরেই হাতটা নেতিয়ে পড়ল। পরক্ষণে দু’হাতে গলা চেপে
ধরল সে। ঝটকা খেল গোটা শরীর। ঢেউ উঠল পেটে। কাতর
একটা আওয়াজ বের হলো গলা দিয়ে। মাথাটা কাত হলো। মুখের
ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা স্বচ্ছ বুদ্বুদ, ঠোঁটে এসে স্থির
হলো, তারপর ফাটল ওটা। রানার দিকে তাকাল লোকটা, দৃষ্টিতে
কোনও অভিব্যক্তি নেই।
এক মুহূর্ত পর রানা বুঝতে পারল ডিবার্গ ম্যাকেঞ্জি মারা
গেছে। সিগনেট আঙটিটা একবার দেখল রানা। ওটা কাজে
লাগিয়ে ডিবার্গকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আর হলো না। এখন কিছু
করার নেই আর।
পরবর্তী পনেরো মিনিট ব্যয় করল ও সুইটে জরুরি কিছু আছে
কি না খুঁজতে। নেই। থাকবে আশাও করেনি ও, রুটিন চেক
করতে হয় তাই করল। এরা অত্যন্ত চতুর একটা দল। প্রমাণ
হাতের কাছে রাখে না কখনও। এখানেও তাল্ডে গোপন
কর্মকাণ্ডের কোনও প্রমাণ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
বাল্ডইল বাথরুমটা। ওখানে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয়
না। কিন্তু খোঁজা ওর কর্তব্য। উর্ফা, মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে
রানার। তিনদিন পর এডেসা পাস দিয়ে যাবে মাওলানা আব্দুল
হামিল্ডে কোকেন আর হেরোইনের চালানটা। মৃত্যুপথযাত্রী ডিবার্গ
বোধহয় সত্যি কথাই বলেছে। শেষ সময়ে মিথ্যে তৈরির কথা
চিন্তায় আসবার কথা নয়। মাথা খাটাবার উপায় থাকে না।
ডিবার্গের কথা সত্যি হলে এখন ও জানে ওকে কোথায় যেতে
হবে।
টয়লেটে ঢুকেই গন্ধটা পেল রানা। এবার চিনতে দেরি হলো
না। এসটোন। নেইলপলিশ রিমুভার। লা সিনেমা বি−উতে লেডি
স্টানার অফিস আর বাথরুমে ঠিক এই গন্ধই পেয়েছিল ও। হাতির
মতো লাশটার দিকে তাকাল ও, বিছানায় পড়ে আছে ওটা।
লোকটা হার্টের কন্ডিশন ভালো না হলেও হয়তো মেয়েল্ডে নিয়ে
ফুর্তি করত।
কিন্তু তার সম্ভাবনা কম। এসটোনের গন্ধ ওকে ভাবাচ্ছে। কিছু
একটা বিশেষ মানে আছে এর। ওর মন বলছে গন্ধটা ওকে যেন
কিছু স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কী?
মেডিসিন ক্যাবিনেট খুলল রানা। জানে কী দেখতে পাবে।
ছোট একটা বোতল। ফাস্টঅ্যাক্ট। শিকাগোতে তৈরি। লা
সিনেমাতেও এরকমই একটা পেয়েছিল ও বাথরুমে।
বোতলটা পকেটে পুরল ও, বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।
এখানে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। চারপাশে আরেকবার
দেখে নিয়ে সুইট থেকে বেরোনোর ল্ডজার দিকে পা বাড়াল রানা।
ল্ডজাটা খুলতেই সোনালী চুলওয়ালা মেরিলিন হিউলেটকে
দেখতে পেল ও। ডিবার্গের প্রাইভেট সেক্রেটারি। মেয়েটার হাতে
এখন ছোট্ট একটা অটোমেটিক পিস্তল। ঠিক রানার পেটে তাক
করল সে। তার পিছনে স্ফাড়িয়ে আছে ইউনিফর্ম পরা গার্ড। তার
হাতে শোভা পাচ্ছে রিভলভার।
চিন্তা করো, রানা! নিজেকে তাগাদা দিল রানা। একই সঙ্গে
বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে। মেয়েটাকে নিরস্ত্র করে কিছু প্রশ্ন






৪৯
করতে পারলে হতো, কিন্তু গার্ড সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে।
লোকটার পকেটে হয়তো বাড়তি গুলি ছিল। নিজেকে হাঁদারাম
মনে হলো রানার। সার্চ করে দেখা ল্ডকার ছিল লোকটাকে।
লাথি দিয়ে মেয়েটার হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে সরিয়ে দিল
রানা, একই সঙ্গে সামনে বেড়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে, নিজের
সামনে ধরে থাকল তাকে। গার্ড আর ওর মাঝে মেয়েটা এখন
একটা বাধা। দু’পা পিছাল গার্ড। গুলি করবার সুযোগ খুঁজছে।
হিসহিস আওয়াজ বের হচ্ছে সেক্রেটারির নাক দিয়ে, নীরবে
লড়ছে মেয়েটা। রানার মুখে খামচি মারতে চেষ্টা করল। এক
ঝটকায় মেয়েটাকে তুলে নিল রানা, পরক্ষণেই ছুঁড়ে মারল গার্ডের
গায়ে। মেয়েটার দেহের ধাক্কা খেয়ে একটা টেবিলে হোঁচট খেল
গার্ড। ওটা পার হয়ে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ল। তার উপর
পড়েছে মেয়েটা। তার পিংক আন্ডারওয়্যার আর সুগঠিত ফর্সা ঊরু
দেখতে পেল রানা।
পাকা চোরের মতো ঝেড়ে দৌড় দিল রানা। গার্ড আর মেয়েটা
সামলে নিয়ে উঠে বসবার আগেই করিডর পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে
উঠে ছাদে বেরিয়ে এলো ও। রানা মনে মনে নিশ্চিত, গার্ড গুলি
করবে না ওকে। মেয়েটাই করতে দেবে না। চিকা মোস্তাক যা-ই
বলুক, মেয়েটা এই ড্রাগ কার্টেলের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে
জড়িত। সে চাইবে না পুলিশি ঝামেলা হোক।
দৌড় শুরু করল রানা, নির্দিষ্ট জায়গায় টাইল কোপিং ডিঙিয়ে
ঝাঁপ দিল শূন্যে। দুই বাড়ির ফাঁকের মাঝখানে এসে নিজেকে ও
ঘুরিয়ে নিল নিখুঁত ফায়ারম্যান’স ফল-এর জন্য। পিঠ দিয়ে ও
তক্তায় পড়বে, দু’হাতে ধরে থাকবে হাঁটুÑপেশি আর হাড়ের তৈরি
একটা নিরেট বল। পড়েই ডিগবাজি খেয়ে উঠে স্ফাড়াবে, পৌঁছে
যাবে হোটেলের ছাদে।
যদি না কেউ তক্তাটা সরিয়ে থাকে!
সরায়নি কেউ। যেমন ছিল তেমনই আছে তক্তা। তক্তার ঠিক
মাঝখানে পড়ল রানা, ডিগবাজি খেয়ে সিধে হলো, তারপর দৌড়ে
পৌঁছে গেল হোটেলের ছাদে। দৌড় থামাল না, সোজা ছুটল
সিঁড়ির দিকে।
গার্ড আর মেয়েটা যখন অ্যানেক্স অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে পৌঁছুল
ততোক্ষণে হোটেলের ছাদে নীরব-নিথর ছায়াগুলো আর ডিভানের
ছাদ থেকে বেড়ে থাকা তক্তাটা ছাড়া দেখবার আর কিছু নেই।






আট

আত্মগোপন করে থাকা রানার ত্থেয়া গোপন তথ্য কানেই তুলল
না পুলিশ। কর্মকর্তারা হয় প্রচুর ঘুষ খেয়েছে, নয়তো তারা
ব−্যাকমেইলিঙের শিকার। পে-ফোন থেকে ফোন করেছিল রানা,
ওকে জানিয়ে দিল, অনির্ভরযোগ্য কোনও সোর্সের কথায় সীমান্ত
এলাকায় বড় ধরনের কোনও রেইড করা তাল্ডে পক্ষে সম্ভব নয়।
তাল্ডে কাছে এমন কোনও খবর নেই যে ড্রাগের চালান যাবে
এডেসা পাস দিয়ে।
বাধ্য হয়েই একা এডেসা পাসে যাবে ঠিক করল রানা। মিলি
জোর দিয়ে বলল, একা রানা ব্যর্থ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ড্রাগের
চালান নষ্ট করতে আরেকটা প্রচেষ্টা করতে পারবে ও উপযুক্ত






৫০
ইকুইপমেন্ট থাকলে। কথাটায় যুক্তি আছে বুঝে আর আপত্তি
করেনি রানা, মিলিকেও সঙ্গে নিয়েছে।
শেষ রাতের খানিক আগে ইয়েসিলকয় এয়ারপোর্ট থেকে
চার্টার করা কার্গো বিমানে রওনা হলো ওরা। পাইলট ওল্ডে
পরিচিত, আগেও রানা এজেন্সির কাজ করেছে, ফলে কোনও প্রশ্ন
করে ওল্ডে বিব্রত করেনি।
পাইলটের কাছ থেকে কেনা সেকেন্ডেহ্যান্ড একটা ছোট জিপও
তুলে নিয়েছে ওরা পে−নে। প্যারাশুট করে নামানো হবে ওটা
নির্দিষ্ট জায়গায়।
এখন চুপ করে বসে ঝিমাচ্ছে রানা। মিলি ওর কাঁধে মাথা
রেখে ঘুমাচ্ছে। বুশ জ্যাকেট, ট্রেঞ্চকোট আর ¯−্যাক্স পরে থাকায়
ওকে দেখতে বাচ্চা মেয়েল্ডে মতো লাগছে। ঘুমের মধেদ্দ রানার
একটা হাত ধরে আছে ও।
একটানা গুঞ্জন তুলে ছুটে চলেছে ওল্ডে বিমান।
হাতে বেশি সময় নেই ওল্ডে। ভোরের আগেই জাম্প করতে
হবে। সূর্য উঠবার আগেই লুকিয়ে পড়তে হবে নিরাপদ কোনও আশ্রয়
খুঁজে নিয়ে। যজ্ঝিবশ্য সূর্য ওঠে। আবহাওয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে
ঘন মেঘে আচ্ছন্ন থাকবে আকাশ। ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা আছে।
ওয়েদার রিপোর্টটা শুনে রানা এখন নিশ্চিত, আবহাওয়াবিল্ডা যখন
বলেছে বৃষ্টি হবে তা হলে সারাদিন কড়া রোদ না থেকেই যায় না।
একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তার রাজ্যে ডুবে গেল ও।
ইস্তাম্বুলের পুবে পুব-দক্ষিণে ছয়শো মাইল গেলে পৃথিবীর
রুক্ষতম জায়গাগুলোর একটা পড়ে। পাহাড়, মরু, জঙ্গল আর
গভীর সব খাদ পরস্পরকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে ওখানে। দুর্গম
একটা এলাকা। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেতিস নদীর খামখেয়ালীপনায়
সৃষ্টি হয়েছে ত্রিকোণ অঞ্চলটা। দেখলে মনে হয় দানবের দল
জমিতে চাষ দিয়েছিল, কিন্তু ফসল বুনতে ভুলে গেছে।
এই বুনো প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী বলতে কিছু
উপজাতীয় কুর্দি। প্রকৃতির মতোই রুক্ষ তারা, প্রকৃতির চেয়েও
নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর।
ঘড়ি দেখল রানা। সময় হয়ে এলো। মিলিকে ঘুম থেকে
জাগাল ও। কো-পাইলট গেল প্রস্তুতির বল্টস্থা করতে।
ভোরের সামানঞ্জাগে পে−ন থেকে প্যারাশুট জাম্প করল ওরা
দু’জন। তখনও আকাশ থেকে সামানঞ্জালো ছড়াচ্ছে চাঁদ্মা।
হালকা বাতাস আছে। সেটা কোনও সমস্যার কারণ হলো না।
হাত-পা না ভেঙেই মিলিকে নিয়ে সমতল একটা জায়গায় নামতে
পারল রানা। ছোটখাটো জিপটা সাপ−াইসহ আগেই নামিয়ে ত্থেয়া
হয়েছে চারটে প্যারাশুট বেঁধে। ওল্ডে মাথার উপর একবার চক্কর
মেরে ফিরে গেল কার্গো পে−ন। সভ্যতার সঙ্গে ওল্ডে শেষ
সম্পর্কটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আবহাওয়া বিভাগ সম্পর্কে রানার ধারণা পাল্টাতে হলো। মেঘ
ভেদ করে সূর্যটা মাঝে মাঝে মুখ বের করছে বটে, কিন্তু বৃষ্টিতে
ঝাপসা দেখাচ্ছে ওটাকে। ওরা একটা পাহাড়ী গুহার ভিতর আশ্রয়
নিয়েছে। গুহা থেকে সামান্য দূরেই একটা গভীর খাদ, ওটা চলে
গেছে এডেসা পাসের দিকে। ওল্ডে উত্তর আর পুবে আকাশ ছোঁয়া
পর্বত চূড়া। অস্পষ্ট দেখায় ওগুলো। বছরের কোনও সময়ই
ওগুলোর মাথার বরফ গলে না।
কাছেই আরেকটা গুহার ভিতর জিপটা লুকিয়ে রেখেছে ওরা।
জায়গাটা পাহাড়ী ছাগলের উপযোগী, এখানে আসবার সময়
জিপ চালাতে চালাতে ভেবেছে রানা। জিপের সামনের চাকায়
পিছলে গিয়ে একটা পাথর খাল্ডে ভিতর হাজার হাজার ফুট নীচে
পড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে সতর্ক হয়েছে ও। জিপ এখানে তেমন






৫১
একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
খাল্ডে পাশ দিয়ে আসবার সময় মিলি এতো ভয় পেয়েছে যে
একটা কথাও বলেনি। বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ করে থেকেছে।
মাঝে মাঝে ভরসা পাওয়ার জনশুানাকে স্পর্শ করেছে।
গুহাটা খুঁজে পাবার পর থেমেছে ওরা। ঠিক করেছে কাজে
নামবার আগে এখানেই বিশ্রাম নেবে। কম্বল পেতে শুয়েছে ওরা।
বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টি হচ্ছে। তাকালে মনে হয় গুহার বাইরে ধূসর
একটা দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। শীত-শীত করছে সবারই, কিন্তু আগুন
জ্বালানো যাবে না গুহার ভিতর। শুকনো কাঠ থাকলেও জ্বালানো
যেত না, ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে আসত। বাতাসটা বাইরে থেকে
আসছে। গুহার সামনে উপর দিকে চওড়া কার্নিশ মতো আছে।
ওটার তলায় আগুন জ্বালানো যায়, কিন্তু ঝুঁকিটা রানা নিতে চায়নি।
মিলি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠল রানা। গুহামুখের কাছে
রাখা রাইফেলটা আরেকবার পরখ করে দেখল। এটা কাজে
লাগতে পারে মিলির। মিলিই এই অ্যাসাইনমেন্টে ওর ব্যাকআপ।
রানা যè্যর্থি হয় তা হলে দূর থেকে অনুসরণ করবে সে ড্রাগের
চালানটাকে। কুর্দিল্ডে সহ ড্রাগের চালানটা ধ্বংস করে দেবে
টিএনটি-২৫ বল্টহার করে।
রাইফেলের চেম্বারে একটা গুলি ঢুকিয়ে রাখল রানা। এদিকে
নেকড়ে আর বুনো হয়ে যাওয়া বিরাটাকৃতির অ্যানাতোলিয়ান
শিপডগের অভাব নেই। তাল্ডে আক্রমণ হলেও রাইফেলটা কাজে
দেবে। জিনিসটা একটা স্যাভেজ ৯৯। হাই ভোলোসিটি বল বুলেট
বল্টহার করা হয়। সঙ্গে ওয়াদারবাই স্কোপ আছে। হাত ভালো
হলে তিনশো গজ দূর থেকেও নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব।
ওটা নিয়ে গুহার বাইরে এসে খাল্ডে কিনারায় স্ফাড়াল রানা।
মিলি চলে এলো ওর পাশে।
‘চলো, একটু ঘুরে দেখা যাক,’ বলল রানা। ভেড়ার চামড়ার
তৈরি জ্যাকেটের কলার টেনে দিল ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
‘আশপাশটা দেখে রাখো।’
‘চলো।’
কিছুক্ষণ চারপাশ দেখে যে-গুহায় জিপটা লুকানো আছে
সেটায় চলে এলো ওরা। কী কী এনেছে আরেকবার পরীক্ষা করে
দেখল দু’জন। ক্যাম্প করবার মতো সবকিছুই আছে। রানার
সুটকেসে ঠাঁই পেয়েছে ছয়টা টিএনটি-২৫। তার থেকে তিনটে
মিলিকে দিল ও। ‘রাখো। বাধ্য হলেই শুধু বল্টহার করবে।’
ড্রাগের চালানটা নষ্ট করলেই চলবে না, সেই সঙ্গে
সিন্ডিকেটকেও পঙ্গু করে দিতে হবে। সেজন্য ল্ডকার তথ্য। রানা
আন্দাজ করতে পারছে তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে। বুল হাডসন
মাঠ পর্যায়ে কাজ দেখাশোনা করে। সব খবরই তার নখদর্পণে
থাকতে হয়। নিশ্চয়ই তার কাছে সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যল্ডে
নাম থাকবে। ওই নামগুলো পেলে সিন্ডিকেটকে বিকল করে
ত্থেয়া সম্ভব। অন্তত কয়েক বছর কোমর সোজা করে আর
স্ফাড়াতে পারবে না তারা। সেটা পুলিশের সাহায্য না পেলে। আর
পুলিশের সাহায্য যদি পাওয়া যায় তা হলে এই ড্রাগ সিন্ডিকেটকে
সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ত্থেয়া সম্ভব।
রানা এবং মিলি, দু’জনই জানে, ওপিয়াম বল্টসা কখনোই বন্ধ
করা যাবে না। এতে এতো বেশি লাভ যে একদল লোক সবসময়
আগ্রহী হবে পপি চাষে। তুরস্কের ছোট ছোট খামারগুলোর
উৎপাদিত পপি সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে যাবে প্রসেসিং ফ্যাক্টরিতে।
ওখানে তৈরি হবে হেরোইন, এক সময় ঢুকে যাবে সারা দুনিয়ার
অসহায় অ্যাডিক্টল্ডে রক্তে, অনেক তরুণ-তরুণীর মৃত্যু ডেকে
আনবে। যারা মরবে না তারাও বেঁচে থাকবে জীবন্মৃতের মতো।






৫২
এসব কথা ভাবতে গিয়ে মিলির কথা মনে হলো রানার।
অজান্তেই চেহারার কঠোর রেখাগুলো কোমল হলো ওর। ভালো
হবার জনঞ্জনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে মিলি। ওর সাহসকে
প্রশংসা না করে উপায় নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে ও লাখে
একজন। ভাগ্য খুব ভালো না হলে হেরোইন বা কোকেনের মতো
ড্রাগ ছাড়তে পারে না কেউ।
ডিবার্গের কথা ভাবল রানা। লোকটা নিশ্চয়ই মৃত্যুশয্যায় সত্যি কথাই বলেছিল। মরবার সময় মিথেল্টানানোর চিন্তা মাথায়
আসবার কথা নয়। সেক্ষেত্রে বুল হাডসন কুর্দিল্ডে নিয়ে
আসবেই। আর লোকটা যদি সত্যি এডেসা পাস দিয়ে আসে তা
হলে রানার চোখ এড়িয়ে যেতে পারবে না। ও যে খাল্ডে ধারে
আছে তার দু’মাইল দূরেই এডেসা পাস।
দু’হাত ভরে রসদ নিয়ে গুহায় ফিরে এলো ওরা। আরেকবার
ভালো মতো দেখল, ওল্ডে নীচের খাদ এখনও সম্পূর্ণ নির্জন। খাল্ডে
দূরপ্রান্তে একদল বুনো কুকুর দেখতে পেল ওরা। ফিল্ডগ−াস চোখে
লাগাতেই দৃশন্ধা কাছে চলে এলো। বড় বড় লোমওয়ালা বুনো কুকুর,
আইরিশ উলফ হাউন্ডের চেয়েও আকারে বড়। শিকার করা একটা
ছাগলের মাংস খাচ্ছে ওগুলো নিজেল্ডে ভিতর কাড়াকাড়ি করে।
গুহায় ঢুকে চুলো জ্বালল মিলি। রানা বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই
জানো তোমাকে এখানেই আপাতত থাকতে হবে?’
জবাব দিল না মিলি। ব্যস্ত হয়ে রাঁধছে ও একটা ছোট্ট
গ্যাসোলিন চুলোয়। একধারে রাখা কোলম্যান লণ্ঠনটা হিসহিস
আওয়াজ করে সাদা আলো ছড়াচ্ছে। মিলির চেহারা ফ্যাকাসে
দেখাচ্ছে, চোখের নীচে হালকা কালি। সারাক্ষণ খারাপ কিছু
আশঙ্কা করছে মেয়েটা, বুঝতে পারল রানা।
কড়াইয়ের উপর ঢাকনা দিয়ে এবার মিলি বলল, ‘জানি এছাড়া
আর কোনও উপায় নেই। তুমি তো কারাভাঁর সঙ্গে যাবে। ছয়ঘণ্টা
পর পিছন থেকে রওনা হবো আমি। পিছনেই থাকব তোমার ফ্লেয়ার
জ্বলে উঠতে না দেখলে। নইলে তুমিই ফিরে এসে দেখা করবে।
কিন্তু তুমি যদি ফ্লেয়ার না জ্বালো বা না ফেরো...তা হলে সামনে যাব
আমি, চেষ্টা করব টিএনটি-২৫ দিয়ে চালানটা উড়িয়ে দিতে।’
‘ঠিক।’
একটু পরেই টিনের পে−টে ওকে খাবার বেড়ে দিল মিলি,
নিজেও নিল। ‘আমাকে যদি ইস্তাম্বুল ফিরতে হয় তা হলে আগে
হোক পরে হোক, কার্টেলের লোক আমাকে খুন করবেই।’
মিলির কাঁধে হাত রাখল রানা। ‘সব যদি পরিকল্পনা মতো চলে
তা হলে কার্টেল বলে কিছু থাকবে না। কোনও বিপত্থ হবে না
তোমার। নিজেল্ডে বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে থাকবে ওরা সবাই।’ একটু
থেমে বলল, ‘জীপটা তুমি পরে খাল্ডে ভেতর নামিয়ে রাখবে।
তারপর সময় এলে শুধু দূর থেকে অনুসরণ করবে কারাভাঁটাকে।
ছ’ঘণ্টা পিছনে থাকবে। এবার খেয়ে নাও। তোমার সাহায্য ল্ডকার হবে আমার। আগে কখনও আমি কুর্দিল্ডে ছদ্মবেশ
নিইনি।’
‘সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে পারি আমরা,’ বলল মিলি। ‘কুর্দিরা
এলে তখন ওল্ডে দেখে ছদ্মবেশ নেয়া যাবে।’
কথাটা নেড়েচেড়ে দেখল রানা মনের ভিতর। ভালো কথাই
বলেছে মিলি। ছদ্মবেশটা নিখুঁত করতে হলে সত্যিকারের কুর্দিল্ডে
দেখেই খুঁটিনাটি সব ঠিক করে নেওয়া উচিত।
পরদিন সূর্যোদয়ের পরপরই খাদে হাজির হলো কুর্দিরা।
দিনটা পরিষ্কার ঝকঝকে। জোরাল সজীব বাতাস পাক খাচ্ছে
টিলা-জঙ্গল-খাল্ডে ভিতর। একটা নালায় শুয়ে আছে রানা,
দু’পাশে দুটো মস্ত বোল্ডারের কারণে আড়াল পাচ্ছে। ঠিক মাঝখান






৫৩
দিয়ে মাথা সামানল্টাড়িয়ে ফিল্ডগ−াস দিয়ে কুর্দিল্ডে দেখছে ও।
সংখ্যায় তারা অনেক। অন্তত তিরিশজন তো হবেই। ছোট
ছোট কালো তাঁবু ফেলেছে তারা খাল্ডে ভিতর, উপর থেকে দেখে
মনে হয় ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে। ঘোড়া আর প্রচুর উট আছে
তাল্ডে কাছে, আরও আছে বিরাট একপাল ছাগল। ছাগল নেওয়া
হয়েছে দলের আগে আগে পাঠাতে। সিরিয়ান সীমান্তে মাইনফিল্ড
থাকলে আগেই সেটা টের পাওয়া যাবে। ছাগল যদি বিস্ফোরণে
মারা যায় তা হলে কারাভাঁ অন্য পথে এগোবে। উটগুলোর পিঠে
উঁচু করে একগাদা বস্তা বোঝাই।
আরেকটা নালায় শুয়ে দেখছে মিলি। একটু পর ওর পাশে
এসে বসল মেয়েটা। ‘ফিল্ডগ−াসটা একটু দেবে? আমি কখনও বুনো
কুর্দি দেখিনি।’
‘ভয় পেয়ো না,’ দূরবিনটা দিয়ে বলল রানা। ‘তবে জেনে রাখা
ভালো, ওরা দেখতে যেমন স্বভাবেও তা-ই।’
মিলিকে কেঁপে উঠতে দেখল রানা। ‘যা শুনেছিলাম তার কিছুই
দেখছি মিথ্যে নয়!’ বলল মিলি। ‘সভ্যতার আলো বঞ্চিত একদল
হতভাগ্য লোক।’
দিনটা আস্তে আস্তে পার হচ্ছে। কুর্দি দস্যুল্ডে ক্যাম্প দেখে
সময়টা পার করছে রানা। বিশ্রাম নিতে গুহায় ফিরে গেছে মিলি।
বাতাস যখন কুর্দিল্ডে দিক থেকে বইছে তখন ছাগলের ম্যা-
ম্যা, ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর ভারবাহী উটল্ডে আপত্তির চিৎকার
শুনতে পাচ্ছে ও। অপেক্ষার সময়টা গল্পগুজব করে কাটাচ্ছে কুর্দি
দসুশুা, পোকারের মতো একটা তাসের খেলা খেলছে অনেকে।
একটা ছাগল জবাই করতে দেখল রানা। ছাগলটাকে প্রায় কাঁচাই
খেয়ে ফেলা হলো। চিবুনোর আগে মাংসগুলো আগুনের উপর ধরা
হয়েছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
বাস্ক বুল হাডসন ঠিক লোকই বেছেছে, বুঝতে পারছে রানা।
কুর্দি দসুশুা ধর্মপালনে চরমপন্থী হলেও তুর্কি আর সিরিয়ানল্ডে
জাতশত্র“। এল্ডে চেয়ে ভালো চোরাচালানী আর হয় না। মরবার
আগে পর্যন্ত লড়বে এরা, ধরা পড়লে শত অত্যাচারেও মুখ বন্ধ
রাখবে। চিকা মোস্তাক এই কথাই বলেছিল হাইডআউটে। চিন্তাটা
মাথা থেকে দ্রুত দূর করে দিল রানা। ও মোস্তাকের কথা ভাবতে
চায় না। মানুষটা এক সময় একটা সম্পদ ছিল, পরে ওর ভুলেই
মারা গেছে রানা এজেন্সির তরুণ ছেলেগুলো। ড্রাগ নিয়ে নিশ্চয়ই
কারও সঙ্গে গল্প জুড়ত মোস্তাক। আর তার বেশি কথা বলবার
স্বভাবটাই বিপদ ডেকে এনেছিল। অথর্ব-প্রায় মোস্তাককে
নিজেল্ডে স্বার্থে বল্টহার করেছে ড্রাগ কার্টেল।
আরেক ঘণ্টা লোকগুলোকে দেখে ক্রল করে গুহায় ঢুকল
রানা। এবার প্রস্তুতি নিতে হবে। ওর সুটকেস থেকে বের হলো
পুরোনো ইস্তাম্বুল থেকে কেনা পোশাক। পাগড়ী পরতে সায় দিল
না ওর মন, বদলে একটা শাল গায়ে দিল ও, শাল দিয়ে ঢেকে নিল
মাথা। ওটা মুড়িয়ে নিলেই ওর চেহারা দেখতে পাবে না কেউ।
আজ রাতে শীত পড়বে, তখন শালটা কাজে আসবে ওর।
অধিকাংশ কুর্দির মতোই রানাও দীর্ঘদেহী। কুর্দি দস্যুল্ডে
মতোই লাগল ওকে দেখতে। কুর্দি ভাষা জানা নেই ওর, কাজেই
ধরা পড়বার জোরালো সম্ভাবনাটা থেকেই যাচ্ছে। কেউ কোনও
প্রশ্ন করলে বা আলাপ জুড়লেই ফেঁসে যাবে ও।
ফেল্ট বুট আর দীর্ঘ প্যাডওয়ালা জ্যাকেট পরে নিল রানা।
জ্যাকেটটা যেমন পুরোনো তেমনি নোংরা। ওটার গা থেকে দুর্গন্ধ
আসছে। সত্যিকার এক কুর্দির কাছ থেকে কিনেছে ও জিনিসটা।
মিলি নাক টিপে ধরে বলল, ‘সতিল্টলছি, গন্ধে মনে হচ্ছে
পাগল হয়ে যাব। তুমি যাচ্ছ বলে এখন আর ততোটা খারাপ






৫৪
লাগছে না।’
‘ছাগলের গন্ধ,’ হাসল রানা। ‘সেই সঙ্গে আছে উটের মুত, কাঁচা
মাংস, রক্ত আর গোবরের মিশ্রণ। কুর্দিরা সবাই জ্যাকেটে এভাবে
হাত মোছে।’ কাজটা করে দেখাল ও। ‘সত্যিকারের কুর্দির
পোশাক।’
‘এবার দাড়িটা পরাব?’ নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মিলি।
‘পরাও।’ মুখ বিকৃত করল রানা। ‘জানি অসম্ভব চুলকাবে। কিন্তু
করার কিছু নেই। স্পিরিট গাম নাও। আর ওই ছোরাটা দাও।’
খাপের মধেল্টাঁকা ফলার ধারাল ছোরাটা গুঁজে নিল ও।
দু’হাতের কব্জিতে পেঁচিয়ে বাঁধল নোংরা সাদা কাপড়। যুদ্ধে সব
সময় নিজের ব্যান্ডেজ নিজেই বহন করে কুর্দিরা।
দাড়ি আটকানোর পর একদৃষ্টে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল
মিলি, তারপর একটা আয়না ধরল ওর চেহারার সামনে।
‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল রানা। ‘মনে হচ্ছে ওল্ডে সঙ্গে
মিশে যেতে কোনও অসুবিধে হবে না। ভয়ঙ্কর লাগছে আমাকে
দেখতে!’
সূর্যাস্তের আগেই এসে হাজির হলো বুল হাডসন। নালায়
শুয়ে নজর রাখছে রানা, বুঝতে পারল কী করে লোকটা এই
অঞ্চলে এতো স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে। দুটো হাফট্রাক আর
একটা ল্যান্ড রোভার নিয়ে এসেছে লোকটা। হাফট্রাকগুলোয় উঁচু
করে স্তূপ দিয়ে রাখা হয়েছে অসংখল্টস্তা। পশ্চিম থেকে এলো
তারা, খাদ যেখানে এডেসা পাসের সঙ্গে মিশেছে সেখানে
থামল।
কুর্দিল্ডে দলনেতা, দীর্ঘ চুলওয়ালা হিংস্র চেহারার এক লোক
তার কালো তাঁবু থেকে বের হয়ে ল্যান্ড রোভারের পিছনের রংচঙে
ট্রেইলারের ল্ডজায় গিয়ে থামল। খুলে গেল ট্রেইলারের ল্ডজা।
সূর্যের শেষ লালচে আলোয় বুল হাডসনকে দেখতে পেয়ে
কঠোরতার ছাপ ফুটল রানার দৃষ্টিতে।
মিলি বিড়বিড় করল, ‘রানা, এ-ই বুল হাডসন। ড্রাগ পাচারের
দায়িত্বে আছে।’
‘জানি।’
বুল হাডসনের হোঁৎকা চেহারাটা প্রায় বুলডগের মতোই।
শরীরটা মোটা ধাঁচের। কাঁধ দুটো ঢালু, পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধাল্ডে
মতো। চেহারায় অজস্র কাটাকুটির দাগ। নাকটা ঘুসি খেয়ে থেবড়ে
গেছে। হাই লেস বুট, রাইডিং ব্রিচেস আর চামড়ার উইন্ডব্রেকার
পরে আছে সে। কোমরের কাছে ওয়েব হোলস্টারে ঝুলছে ভারী
একটা পিস্তল। রানার বিনকিউলারটা এতো শক্তিশালী যে বাঁটের
লেখাও পড়তে পারল ও। কোল্ট .৪৫, ১৯১১ মডেলÑক্লাসিক
একটা অস্ত্র। ওয়ালথারটা স্পর্শ করল রানা। জায়গামত গুলি
লাগাতে পারলে ওর ওয়ালথারটাও অবশ্য কম ভয়ঙ্কর না।
কুর্দিল্ডে নেতার হাতে চারকোনা একটা বড়সড় কাগজের
প্যাকেট দিল বুল হাডসন। নিশ্চয়ই টাকা, ভাবল রানা। এবার
একের পর এক নির্দেশ দিতে শুরু করল বুল হাডসন। কুর্দিরা
হাফট্রাক আর ল্যান্ডরোভারের পিছনে লাইন বেঁধে স্ফাড়াল।
প্রত্যেকেই তারা গাড়িগুলোর পিছন থেকে বড় বড় বস্তা তুলে
পাশেরজনের হাতে তুলে দিচ্ছে ঘর্মাক্ত কলেবরে। উটের পিঠ
থেকে খালি বস্তা আর অন্যানশুসদ নামিয়ে সেখানে তোলা হচ্ছে
ড্রাগের বস্তা। উটগুলোর আপত্তি কানেই তোলা হচ্ছে না। কাজে
কোনও খুঁত নেই। বোঝাই যাচ্ছে একাজে দলটা অভ্যস্ত। বিরাট
একটা চালান নির্বিঘেœ চলে যাবে তুরস্ক থেকে সিরিয়ার ভিতর।
ওখানে চালানের দায়িত্ব নেবে মাওলানা আব্দুল হামিদ।
পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে সূর্যটা এখন লালচে আভা বিলানো






৫৫
একটা ক্ষয়িষ্ণু গোলক। শীঘ্রি আঁধার নামবে। দক্ষিণে আর দশ
মাইল দূরে সিরিয়ার সীমান্ত।
গুহায় ফিরে এলো রানা, মিলির কাছ থেকে বিদায় নিল।
বলবার মতো তেমন কিছু নেই। রানা যা করতে যাচ্ছে তাতে
ঝুঁকির মাত্রা কতো বেশি এটা মিলি জানে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো দাড়িওয়ালা দুর্গন্ধযুক্ত রানাকে জড়িয়ে ধরবে মিলি,
কিন্তু মন শক্ত করে নিজেকে সামলে নিল সে। চোখ ছলছল
করছে ওর।
‘রাইফেলটা রেখে যাচ্ছি আমি,’ বলল রানা। ‘কোনও বিপদ হলে কাজে লাগবে তোমার। এছাড়া তোমার কাছে টিএনটি-২৫
রইল। প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় বল্টহার করবে।’
রাইফেলটা হাতে তুলে নিল মিলি ‘সাবধান থাকব আমি।’
‘গুড। আরেকবার বলছি, যদি দূর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ
পাও তা হলে কাভার নেবে। ফ্লেয়ার না দেখলে ছ’ঘণ্টার আগে
এগোবে না ভুলেও। যদি দেখো আমি ফিরছি না, যা ভাল বোঝো
করবে। ঠিক আছে?’ মিলির হাতদুটো ধরল রানা, নিচু গলায়
বলল, ‘কোনও ঝুঁকি নিয়ো না, পি−জ!’
আস্তে করে মাথা দোলাল মিলি।
গুহা থেকে বেরিয়ে এলো রানা, পাহাড়ী ছাগলের মতো
নিঃশব্দে এবং গোপনে খাল্ডে পাড় বেয়ে নামতে শুরু করল।
বিরাট উঁচু সব পাথরের ছায়ায় আড়াল নিয়ে নামছে ও। ওর লক্ষ্য কয়েকটা বোল্ডার। ওগুলোর কয়েকটা কুর্দিল্ডে ক্যাম্পের একশো
গজের ভিতরও আছে। দ্রুত নামছে সন্ধ্যার আঁধার। পাহাড়ী
অঞ্চলে যেন উপর থেকে কেউ কালো একটা চাল্ড নামিয়ে
আনছে। ধৈর্য ধরে স্থির হয়ে অপেক্ষা করল রানা। কুর্দিরা রওনা
হলে পিছনে পাহারা থাকবে। খাদ্মার গলা এডেসা গিরিপথে
ঢুকবার সময় সরু হয়েছে, সেটাই হবে ওর কুর্দিল্ডে দলে মিশে
যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
সূর্যাস্তের শেষ আলো অবশেষে ধূসর হলো। তারও সাত ঘণ্টা
পর তাঁবু উঠিয়ে খাপ্পরে তারার ¤−ান আলোয় এগোতে শুরু করল
কুর্দিল্ডে দলটা। ছায়ার মতো অনুসরণ করল রানা। বামদিকে
একশো গজ পিছনে আছে ও। বিরাটাকৃতি পাথরগুলোর আড়াল
নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝেই পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলাচ্ছে
ওর, তবে পড়ল না একবারও, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখল।
যা আশা করেছিল তার আগেই সুযোগটা এসে গেল ওর।
পিছনের প্রহরীল্ডে একজন দলছুট হয়ে রানার কয়েক ফুট দূরে
ঘোড়া থেকে নামল। পোশাক নিয়ে টানাটানি লাগিয়ে দিল সে।
প্রস্রাব করবে। একটা পাথরের গায়ে কাজ সারতে শুরু করল
লোকটা। ঠিক ওই পাথরের আড়ালেই আছে রানা। কুর্দির ঘোড়া
অপরিচিত লোকের গায়ের গন্ধ পেয়েছে। নাক দিয়ে আওয়াজ
করে সরে যেতে চাইল জন্তুটা।
কুর্দি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল যাতে ভিতু ঘোড়াটার হাত
থেকে সে মুক্তি পায়। ‘চুপ, শয়তানের বাচ্চা! চুপ! চুপ না করলে
শেয়াল দিয়ে খাওয়াব তোকে।’
পিছানো থেমে গেল জন্তুটার, তবে ওটার কান খাড়া হয়ে
আছে। নাক দিয়ে আওয়াজ করে অস্বস্তি প্রকাশ করছে। আবার
গাল বকল কুর্দি। ‘তুই অসুস্থ উটের বাচ্চা। স্বয়ং শয়তানও তোকে
নেবে না। ঈশ্বরের দাড়ির শপথ...হাইও!’
ঘাড়ে কারাতে কোপ খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল লোকটা।
যাতে ওটা পালাতে না পারে সেজন্য চট করে ঘোড়াটার রাশ ধরে
ফেলল রানা। এরপর কুর্দির ব্যান্ডেজ দিয়েই তাকে আচ্ছামতো
বাঁধল ও। এবার অচেতন দেহটা পাথরের পিছনে নিয়ে রাখল।






৫৬
কাজটা করতে গিয়ে ঝুঁকতে হলো ওকে। লোকটার কপালে একটা
বাঁকা চাঁজ্ঝাঁকা দেখতে পেল। কারণটা বুঝতে পারল না রানা।
নির্দিষ্ট উপদলের চিহ্ন? একটা মুহূর্ত দ্বিধায় ভুগল রানা, কারণটা
জানে না। কুর্দিরা কপালে চিহ্ন এঁকেছে তা হলে। চাঁদ্মা আবারও
দেখল রানা, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে কুর্দির ঘোড়ায় উঠে বসল,
কাফেলাটাকে পিছন থেকে অনুসরণ শুরু করল ও।
পরবর্তী এক ঘণ্টা কোনও বিঘœ ছাড়াই কেটে গেল। একধার
দিয়ে চলল রানা, ছাগলের পাল আর অভিযোগরত উটগুলোকে দূর
থেকে পার হতে দিল। চাঁত্থঠেনি আজ রাতে, মেঘে ছেয়ে আছে
আকাশ।
দক্ষ আরোহীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে ঘোড়াটা,
এখন নির্দেশ দিলে বিনা দ্বিধায় পালন করছে। পাঁচ মাইল পার
হয়ে এসেছে ওরা, আন্দাজ করল রানা। সীমান্ত আর পাঁচ
মাইল দূরে। ওর মনের ভিতর পরিকল্পনা তৈরি হতে শুরু
করেছে। বাস্ক বুল হাডসনকে চাই ওর। লোকটার কাছ থেকে
সিন্ডিকেট বিষয়ক তথঞ্জাদায় করতে হবে। তারপর ধ্বংস
করতে হবে ড্রাগের চালান। সব যদি ঠিক মতো চলে তা হলে
ড্রাগের চালান নষ্ট করতে টিএনটি-২৫ তিনটেই যথেষ্ট হবে।
বিস্ফোরণ ঘটলে দিগি¦দিক জ্ঞানশূনেশু মতো পালাতে থাকবে
কুর্দিরা, সেই সুযোগে সরে পড়বে ও। কুর্দিরা নেই নিশ্চিত হয়ে
ফ্লেয়ার জ্বালবে। জিপ নিয়ে এসে ওকে তুলে নিতে পারবে
তখন মিলি।
হঠাৎ ছয়জন ঘোড়সওয়ারীকে মূল দল থেকে সরে পিছনের
দিকে আসতে দেখল রানা। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ওর।
এদিকে আসছে কেন লোকগুলো? কারণ কী? পিছনে কী আছে যে
আসছে? মিলি আছে পিছনে জিপ নিয়ে, কিন্তু ও তো আছে অনেক
পিছনে, নিরাপদে।
কারাভাঁর কাছে সরে এলো রানা ওর ঘোড়া নিয়ে। খেয়াল
করল এবার অন্য তিনজন কুর্দি আসছে ওর দিকে। পেশি আড়ষ্ট
হয়ে গেল রানার। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ খাটিয়ে মনটা শান্ত
রাখল ও। এরকমটা ঘটতেই পারত। এখন ঘটছে এটাই বাস্তব
সত্য। বোবার অভিনয় করবার প্রস্তুতি নিল রানা। মনে মনে
আশা করছে যাকে পিছনে ফেলে এসেছে তার কোনও ভাই বা
আত্মীয় নেই এল্ডে মধ্যে। এমন কেউ হয়তো নেই যে ধরে
ফেলতে পারবে ও নকল লোক।
অশ্বারোহীরা বারো ফুট দূরে থামল। তাল্ডে একজন হাতের
ইশারায় ডাকল রানাকে। ‘বুরায়া গেলিনিজ!’ তুর্কি ভাষায়: এদিকে
এসো।
কৌশলটা অনেক পুরোনো। ফাঁদে পড়ল না রানা। খুব কম
কুর্দিই তুর্কি ভাষা বোঝে বা বলে।
বোকার মতো অশ্বারোহীল্ডে দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল
রানা। মুখের কাছে হাত নিয়ে বোবাল্ডে মতো আওয়াজ করল।
ভিতরে ভিতরে নড়ে গেছে রানা। উদ্ধার পাওয়ার পথ খুঁজে চলেছে
ওর মস্তিষ্ক। ওর সঙ্গে তুর্কি ভাষায় কথা বলা হলো কেন?
ঘোড়াসওয়াররা ঘিরে ফেলল রানাকে। তাল্ডে আচরণে
মনে হলো না তারা সতর্ক বা শত্র“ভাবাপন্ন। তাল্ডে একজন
একটা প্যানকেক ধরিয়ে দিল ওর হাতে। কুর্দি ভাষায় কী যেন
বলল।
ইস্পাতের মতো শক্ত আঙুল দিয়ে রানার ঘোড়ার রাশ
খামচে ধরল আরেকজন। ঘোড়াটাকে সে কারাভাঁর দিকে নিয়ে
যেতে চাইছে। এখনও কারও আচরণে মনে হচ্ছে না কিছু
সন্দেহ করেছে। কারাভাঁ থেমেছে, লক্ষ করল রানা। ছোট ছোট






৫৭
জটলায় ভাগ হয়ে আলাপ করছে কুর্দিরা। একটু পরই গোল
একটা বৃত্ত তৈরি করে স্ফাড়াল। ছায়ার মধেদ্দদিকে একই রকম
আরেকটা বৃত্ত দেখতে পেল রানা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কি একটা
প্রহরা-বৃত্ত রচনা করছে এরা?
অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করল রানা। নিজেকে শাসন করল,
এখনই চিন্তার কিছু নেই। কিছু করে বসতে যেয়ো না। এখন
যত্থি পালাতে চেষ্টা করে তা হলে ড্রাগের চালান নষ্ট করার
পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। বুল হাডসনকেও হাতের নাগালে
পাওয়ার আশা ছাড়তে হবে সেক্ষেত্রে। পালাতে পারলে সেটাই
এক অবিশ্বাসল্ট্যাপার হবে। এদিকে এগিয়ে যাবে কারাভাঁ,
সোহেলরাও যè্যর্থি হয় তা হলে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু
করবে স্বল্পমূল্য ড্রাগ। মনটাকে শক্ত করল রানা। এটা হয়তো
কুর্দিল্ডে কোনও ধরনের অনুষ্ঠান, বা আর কিছু। হয়তো
ইন্সপেকশন। হয়তো নতুন নির্দেশ ত্থেয়া হবে। এল্ডে সঙ্গে
আপাতত তাল মিলিয়ে চলাই ভালো। টিএনটি-২৫ বল্টহার
করতে পারে ও, কিন্তু তা হলে পঞ্চাশ ফুট রেডিয়াসের ভিতর
কেউ বাঁচবে না। মরতে হবে ওকেও। প্রয়োজনে তা-ই করবে
ও। কিন্তু এখনই ওরকম বেপরোয়া কিছু করে বসবার সময়
আসেনি।
কুর্দিরা ঘোড়া থেকে নেমে দশজন করে তিনটা বৃত্ত রচনা
করেছে। রানার সঙ্গীল্ডে একজন কুর্দি ভাষায় কী যেন বলে বৃত্ত
দেখাল রানাকে। ওকেও বৃত্তে গিয়ে স্ফাড়াতে বলা হচ্ছে। ঘোড়া
থেকে নেমে অপেক্ষারত লোকগুলোর পাশে বৃত্তে স্ফাড়াল রানা।
কেউ ওর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল না। বৃত্তে স্ফাড়িয়ে ভ্রƒ কুঁচকে
গেল রানার। ব্যাপারটা কী ঘটছে এখানে?
বুল হাডসনকে বৃত্তের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল রানা।
ছোট একটা টর্চ দিয়ে প্রত্যেকের চেহারা দেখছে হাডসন। পাগড়ী
বা মাথার শাল সরিয়ে দিয়ে আলো ফেলছে। সন্তুষ্ট হয়ে চলে
আসছে পাশেরজনের সামনে।
এবার বুঝতে পারল রানা। অতি সহজ এবং সাধারণ একটা
কৌশল। অতি সহজ একটা ফাঁদ। আর ফাঁদ্মায় পড়ে গেছে ও!
অচেতন কুর্দির কপালের পাশে যে চাঁদ্মা আঁকা ছিল সেটাই
ছিল এবারের চালানে তার উপদলের পরিচিতি।
রানার কপালে কোনও বাঁকা চাঁজ্ঝাঁকা নেই!









নয়

পাঁচ মিনিট সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর বন্দি করা হলো রানাকে।
সব তা হলে শেষ হয়ে গেল, ভাবছে রানা। এসপিওনাজে
কখনও না কখনও মারাত্মক ভুল করে বসে এজেন্ট। এমন ভুল,
যেটা নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনে। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও, ও-
ও ঠিক তেমনই একটা ভুল করে বসেছে। বিসিআই
হেডকোয়ার্টারে অনেকেই হয়তো কিছুদিন মনে রাখবে ওর নাম,
তারপর সবাই আস্তে আস্তে ভুলে যাবে ওকে। যে যার কাজ নিয়ে






৫৮
ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। ওর অস্তিত্ব স্মরণেও থাকবে না কারও।
না, হয়তো থাকবে। সোহানা মনে রাখবে ওকে। মনে রাখবে
ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবরা। কিন্তু আর কখনও ওল্ডে সঙ্গে আড্ডা মারবে
না রানা।
হাল ছেড়ে দিয়ো না, মনের ভিতর গম্ভীর একটা কণ্ঠ¯ল্ফ শুনতে
পেল ও। রাগ হচ্ছে ওর নিজের উপর। এতো সহজ একটা
কৌশলের কাছে বোকা বনতে হয়েছে, এটা মানতে সায় দিচ্ছে না
মন। বুল হাডসন শিশুসুলভ একটা কৌশল করেছে, যাত্রা শুরুর
আগে প্রতিটা উপজাতির সবকজন কুর্দির কপালে এঁকে দিয়েছে
একটা করে বাঁকা চাঁদ। এক ঘণ্টা পর কারাভাঁ থামিয়ে দেখতে
চেয়েছে সবার কপালে ওই চিহ্ন আছে কি না। নতুন কেউ জুটে
থাকলে ধরা পড়তেই হবে তাকে। এ থেকে রানার উদ্ধার পাওয়ার
কোনও সুযোগই ছিল না। সরে পড়তে চেয়েছিল রানা, ছায়ায়
মিশে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ঘোড়সওয়াররা ওকে ঘিরে ফেলল।
পাঁচজন কুর্দি যখন ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন ওর আর করবার
কী থাকে। এরপর ছেঁচড়ে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো বাস্ক বুল
হাডসনের সাজানো-গোছানো ট্রেইলার ট্রাকে। ওখানে সার্চ করা
হলো। ওয়ালথারটা নিয়ে নিয়েছে বুল হাডসন। স্টিলেটো,
বাঁকানো ফলার ছোরা, গ্যাসবোমা, ফ্লেয়ার আর বেল্টে বাঁধা চারটে
ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড কেড়ে রাখা হয়েছে। অণ্ডকোষের পাশে
ছোট্ট থলে থেকে ঝুলন্ত টিএনটি-২৫ তিনটে পায়নি তারা। কিন্তু
এখন এই অবস্থায় টিএনটি-২৫ থাকলেও ওর কোনও কাজে
আসবে না। পিটিয়ে ওকে আধমরা করেছে কুর্দিরা। এখন রানা
স্ফাড়িয়ে আছে বুল হাডসনের সামনে। দশ-বারোটা জায়গার ক্ষত
থেকে রক্ত ঝরছে ওর। মাথার চুলগুলো এলেমেলো। পিছনে
পিঠের কাছে শক্ত করে বাঁধা হাত দুটো টনটন করছে ব্যথায়।
ছোট ফিল্ড ডেস্কের পিছনে বসে খুব মন দিয়ে রানাকে দেখল
বুল হাডসন। কথা বলবার আগে একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে ওটা
দিয়ে তাল ঠুকল ডেস্কে। তার পিছনে বসে আছে দু’জন লালমুখো
আমেরিকান। তাল্ডে চোখে খেলা করছে কৌতূহল। রানা তাল্ডে
জন্য কোনও সমস্যা নয়। অন্তত এখন তো নয়ই।
বুল হাডসনের শুয়োরের মতো কুতকুতে চোখের চারপাশে
অজস্র কাটাকুটির দাগ। নিচু গলায় কথা বলে উঠল, ভাব দেখে
মনে হলো রানার, চাকরির ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
‘নাম?’
‘জোসেফ হলব্রিজ।’
মৃদু হাসল বুল হাডসন। ‘মিথেল্টলছ, মাসুল্ডানা। কিন্তু
তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি তো বিসিআইয়ের লোক?’
‘বিসিআই?’ অবাক হয়ে তাকাল রানা। ‘আপনি কী বলছেন
বুঝতে পারছি না।’
দু’জন আমেরিকানের একজন আরেকজনের কানে কানে কী
যেন ফিসফিস করল, তারপর বাস্ক লোকটার দিকে তাকাল।
‘বিসিআই? আমাল্ডে আমেরিকান মাফিয়ার অনেক ক্ষতি করেছে
ওল্ডে এজেন্ট মাসুল্ডানা।’
‘হ্যাঁ, এ-ই সেই মাসুল্ডানা,’ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল বুল
হাডসন।
চুপ করে থাকল রানা। হয়তো একটা সুযোগ এখনও পেতে
পারে ও। কিন্তু আপাতত কিছু করে বসতে যাওয়া ঠিক হবে না।
এখনও সময় আসেনি।
সরু চোখ করে অগ্নিদৃষ্টিতে রানাকে দেখছে আমেরিকান
মাফিয়ার দুই সদস্য। তাল্ডে একজন বলল, ‘আপনার কাজ শেষ
হলে একে আমরা চাই। একে আমাল্ডে হাতে তুলে দেয়া সম্ভব?






৫৯
আমাল্ডে ডনরা খুব খুশি হবেন বস্টনে একে হাতের মুঠোয়
পেলে।’
ভ্রƒ কুঁচকে উঠল বুল হাডসনের। ‘সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে
না,’ বলল সে। ‘আমাল্ডে সিন্ডিকেটের কয়েকজন মাথাও এর সঙ্গে
কথা বলতে চায়। আপনারা পরে সুযোগ পাবেন, যদি তখনও এ
বেঁচে থাকে। তার আগে মনে রাখবেন, এই চালানটা সম্পূর্ণ
আমার অধীনে যাচ্ছে। আপনারা আমার অতিথি, কাজেই সেভাবে
চলবেন। এবারের চালান ঠিক মতো যাওয়ার পরই আমাল্ডে সঙ্গে
চুক্তিতে আসছেন আপনারা।’
‘নিশ্চয়ই। আপনি তো জানেন আমরা আফগানিস্তান থেকে
অপারেট করব।’
রানার দিকে তাকাল বুল হাডসন। ‘শুনলাম ইস্তাম্বুলে তুমি
আলোড়ন সৃষ্টি করেছ, মাসুল্ডানা?’
‘বলতে পারো,’ শার্টের কাঁধে ঠোঁটের রক্ত মুছল রানা। ‘ইঁদুর
দেখলে আমার সহ্য হয় না। মেরে ফেলি।’
কঠোর হয়ে উঠল হাডসনের চেহারা। ‘একা এসেছ নিশ্চয়ই?’
‘অবশ্যই। আমি সব সময় একা কাজ করি।’
‘এটা সম্ভবত আরেকটা মিথ্যা, নইলে তোমার কাছে ফ্লেয়ার
থাকত না। ঠিক আছে, সত্যি কী মিথ্যা সেটা আমি ঠিকই জানব।
ছয়জনের সশস্ত্র একটা দলকে আমি পিছনে পাঠিয়েছি খুঁজে
দেখতে।’
মিলির কথা চকিতে খেলে গেল রানার মাথায়। মিলি ওর
নির্দেশ পালন করলেই হয়। তা হলে এখন ও অনেক পিছনে
আছে। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সম্ভাবনা ওকে খুঁজে পাবে না কুর্দিরা।
আর যদি পায়ও, মিলির কাছে রাইফেল আর টিএনটি-২৫ আছে।
কুর্দিল্ডে ঠেকাতে পারবে ও প্রয়োজনে।
রানার চিন্তার জাল ছিন্ন হলো বুল হাডসনের কথায়।
ইতালিয়ান আমেরিকান মাফিয়াসোল্ডে সঙ্গে চোস্ত কর্সিকান ভাষায়
কথা বলে উঠল সে। রানা যেমন কপালে চাঁদ না এঁকে ভুল
করেছিল এটাও তেমনি একটা ছোট্ট ভুল। কিন্তু সময়ে ছোট ভুলই
মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। হাডসনের বোকামিটা এতো সাধারণ
যে প্রথমে রানা সন্দেহ করেছিল ওকে ভুল তথ্য দিচ্ছে লোকটা।
নির্বিকার চেহারায় দু’পক্ষের কথোপকথন শুনতে শুরু করল ও।
রানাকে পাত্তা না দিয়ে মানচিত্রে কী যেন একটা দেখাচ্ছে
হাডসন দুই সঙ্গীকে। তারপর তাকে বলতে শুনল রানা।
‘এই যে এখানে কার্দু নদী। টাইগ্রিসের একটা শাখা। এই ঘাট
আমরা আগে কখনও বল্টহার করিনি। মাইন থাকতে পারে, কিন্তু
সীমান্ত রক্ষী নেই। দু’দেশেরই সীমান্ত রক্ষীল্ডে প্রচুর টাকা দিয়ে
কিনে নেয়া হয়েছে। আশপাশের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে থাকবে না
তারা। এখানে তুরস্ক আর সিরিয়ার সীমান্ত। যদি মাইন থাকে তা
হলে এক মাইল পশ্চিমে আরেকটা ঘাট আছে, ওখান দিয়ে পার
হবো আমরা।’ মানচিত্রে তর্জনী দিয়ে খোঁচা মারল হাডসন।
‘মাইন থাকে প্রায়ই?’ উদ্বিগ্ন দেখাল এক আমেরিকানকে।
কাঁধ ঝাঁকাল বুল হাডসন। ‘মাঝে মধ্যে থাকে। সবসময় নয়।
কখনও কখনও মাইনফিল্ডে গিয়ে পড়ি আমরা। সেকারণেই ছাগল
বল্টহার করা হয়।’ ম্যাপটা ভাঁজ করে রানার দিকে তাকাল বাস্ক।
ইংরেজিতে বলল, ‘ইস্তাম্বুলে তোমাকে খোঁজা হচ্ছে, রানা। কিন্তু
নির্দেশটা পালন করব কি না, তোমাকে পৌঁছে èে কি না তা
এখনও ঠিক করিনি। এখানে আমিই সর্বেসর্বা। অনেক সময়
কথাটা ইস্তাম্বুলের ওরা ভুলে যায়। আর আমি এমন একজন মানুষ
যে খেলতে ভালোবাসি। সামান্য মজা লোটার সুযোগ পেলেও ছাড়ি
না। আমার ধারণা তুমি আমাকে মজা দেবে। খুলে বলব?’






৬০
নির্বিকার চেহারা করে রাখল রানা, আরেকবার শার্টে ঠোঁটের
কোণের রক্ত মুছল। কী ঘটতে চলেছে তার একটা ধারণা আছে
ওর। আপাতত নিজেকে বাঁচানোর কোনও উপায় নেই। বলল,
‘বলে ফেলো।’
‘বলছি,’ ডেস্কে রাখা পোর্টেবল কম্পিউটারটা দেখাল হাডসন।
‘তার আগে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে নিই। তুমি ভাবতেও পারবে না
রানা, সিন্ডিকেট বিষয়ে যতো ইনফর্মেশন চাও সব আছে আমার
কম্পিউটারে। এটা শুধু টার্কিশ সিক্রেট পুলিশের হাতে তুলে দাও,
গোটা অপারেশন বাতিল করে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হবে
আমাল্ডে নেতা-কর্মী সবাইকে। সাপ−াই রুট বন্ধ হয়ে যাবে।
সোজা কথায় কার্টেল অচল হয়ে পড়বে। অথচ, রানা,
কম্পিউটারটার এতো কাছে আছো, ইনফর্মেশনগুলো এতো কাছে,
কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই তোমার।’
পুরু ঠোঁট ফাঁক হলো, তামাক খাওয়া খয়েরী স্ফাতগুলো বের
করে হাসল হাডসন।
রানা জিজ্ঞেস করল, ‘টর্কিশ সিক্রেট পুলিশ জানলেই যদি তোমাল্ডে অপারেশন বন্ধ করতে হয় তা হলে তারা কিছু করছে না
কেন?’
‘কারণ তাল্ডে কয়েকটা মাথা আমরা ভালো পয়সা দিয়ে কিনে
নিয়েছি। সব তথ্যই আছে আমার কম্পিউটারে, রানা। কিন্তু
আফসোস, তোমার কোনও কাজে আসবে না তা।
‘এবার আসি অন্য কথায়। আমাকে যতোটা খারাপ লোক মনে
হয় আসলে আমি ততোটা খারাপ লোক নই। আমি তোমাকে
একটা সুযোগ èে। ইচ্ছে করলে কুর্দিল্ডে হাতে তোমাকে তুলে
দিতে পারতাম। ভীষণ কষ্ট পেয়ে মরতে হতো তোমাকে। তা
আমি করছি না। সুযোগ দিচ্ছি। জুয়া খেলছি এটাও ধরে নিতে
পারো। একটা উটের সঙ্গে বাঁধব তোমাকে। বলতে পারো
তোমাকে আমি মাইন ডিটেক্টরের কাজ দিচ্ছি।’
‘আর আমি যদি সীমান্ত নিরাপদে পার হই?’ জানতে চাইল
রানা।
হেসে উঠল বুল হাডসন। ‘তা হলে তোমাকে ধরে আমি
ইস্তাম্বুলে ফেরত পাঠাব।’ মোটা একটা সিগার গুঁজল সে ঠোঁটের
ফাঁকে। ‘ওরা তোমাকে পাওয়ার জনল্ট্যগ্র হয়ে আছে। তোমার
ধরা পড়ার খবরটা দিতেই খুশি হয়ে উঠল সবাই। কাল সকালে
তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পে−ন পাঠাবে ওরা। নিজের ভালো
চাও তো আশা করো আগেই মারা যাবে। এক ভদ্রলোক তাঁর
সার্জিকাল ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। মানুষের ওপর
নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে খুব ভালোবাসেন তিনি।’ সিগারটা
ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল হাডসন। ‘আর তাঁর কাজ শেষ হলে এখানকার
এই দুই আমেরিকান ভদ্রলোক তোমাকে চান। চারপাশে প্রচুর
চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তোমার। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম
তা হলে প্রার্থনা করতাম যাতে আমার উট মাইনের ওপর পা
ফেলে।’
ট্রেইলারের পিছনের দেয়ালে বেশ কয়েকটা সবুজ কনসোল
আছে। ওগুলোর একটা গুঞ্জন তুলতে শুরু করল। ধাতব আওয়াজ
ছাড়ল একটা স্পিকার।
সিগার ঝেড়ে ছাই ফেলল হাডসন। ‘ইস্তাম্বুলের কল। নিশ্চয়ই
কী ঘটছে জানতে চায়।’ রানার দিকে তাকাল সে। ‘দুঃখের কথা,
কিন্তু সামান্য মিথেল্টলতে হবে আমাকে। ইস্তাম্বুলের ওরা চাইবে
না আমরা ছোটখাটো জুয়াও খেলি।’
কর্কশ গলায় নির্দেশ দিল হাডসন। দু’জন গার্ড রানাকে
ছেঁচড়ে নিয়ে বাইরে একটা রুগ্ন উটের পিঠে আচ্ছামতো বাঁধল।






৬১
আগেই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে ওর। পা দুটো এক করে
বাঁধা হলো কঙ্কালসার উটের পেটের তলায়। কব্জি আর
গোড়ালিগুলো চামড়ার ফিতে দিয়ে বেঁধেছে তারা বিন্দুমাত্র দয়া না
দেখিয়ে। চামড়া-মাংসে স্ফাত বসাল ফিতে।
কুর্দিরা রওনা হলো আবার। উটটাকে নিয়ে ছেড়ে ত্থেয়া হলো
ছাগলগুলোর মাঝে। ওখানে আপাতত পাহারায় থাকল একজন।
সাবধানে হাতের চামড়ার বাঁধন পরখ করে দেখল রানা।
গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়েও কোনও লাভ হলো না, আধ ইঞ্চিও
ঢিল হলো না ফিতে। বাঁধবার আগে ফিতেগুলো পানিতে
ভিজিয়েছে কুর্দিরা। এখন ফিতে শুকিয়ে আসছে, সেই সঙ্গে আরও
শক্ত হচ্ছে বাঁধন। তীক্ষèধার তারের মতো মাংসে কেটে বসছে
ফিতে।
ওর উটটা বিরক্তি বোধ করছে। ছাগলের উপস্থিতি পছন্দ হচ্ছে
না ওটার। রানাকেও তার পছন্দ নয়। বারবার ঘাড় ফেরাচ্ছে ওটা,
বড় বড় হলুদ, চৌকো স্ফাত বের করে রানার পায়ে কামড় ত্থেয়ার
চেষ্টা করছে।
কার্দুর ঘাটের দিকে এগিয়ে চলেছে কাফেলা। এখনও চারপাশ
অন্ধকার, কিন্তু পর্বতশ্রেণীর উপর পুবাকাশে সরু একচিলতে
রুপোলি দাগ ফুটতে শুরু করেছে। রানার আধ মাইল পিছনে
কারাভাঁর সঙ্গে আসছে বুল হাডসন। নিরাপদ দূরত্ব থেকে তারা
দেখতে চাইছে ঘাটে মাইন আছে কি না।
কী করা যায় ভাবছে রানা ব্যতিব্যস্ত হয়ে। উট যদি মাইনের
উপর পা দেয় তা হলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ও। যদি মাইন না থাকে
তা হলেও বাস্ক বুল হাডসন ওকে ব›িজ্ঝবস্থায় ইস্তাম্বুল ফেরত
পাঠাবে। ওখানে অপেক্ষা করছে ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয তার ছুরি-কাঁচি
নিয়ে। বসফরাসের তীরে স্যানাটারিয়ামে চিকিৎসার নামে খুন করা
হবে ওকে। জার্মান নাজি ডাক্তাররা অসহায় বন্দি রোগীল্ডে উপর
কী জুলুম করত তা ভাবতে গেলেও শরীর শিউরে ওঠে।
কিন্তু তবুও, মাইনের বিস্ফোরণে মৃত্যু না হলে হাতে সময়
পাবে ও। সুযোগের জনঞ্জপেক্ষা করতে পারবে। চোখ-কান
খোলা রাখলে নিজেকে মুক্তও হয়তো করা অসম্ভব হবে না।
পানির গন্ধ পেয়ে দৌড়াতে শুরু করল ওর উট।
ছাগলগুলোকে তাড়া করে সরিয়ে দিয়ে ছুটছে। ওটার পিঠের উপর
বলের মতো লাফাচ্ছে রানা, পড়ছে না কেবল আঁটো করে বেঁধে
রাখা হয়েছে বলে। কুর্দি প্রহরীরা এগিয়ে আসছে, গাল বকে তাড়া
দিচ্ছে ছাগলগুলোকে। রানা লক্ষ করল, যারা ওর পাহারায় নেই
তারাও বেশ কয়েকজন আমেরিকার তৈরি সাবমেশিনগান বহন
করছে। তাল্ডে প্রতি ছয়জনের কাছে আছে ওরকম একটা করে
অত্যাধুনিক অস্ত্র। বোধহয় আমেরিকান মাফিয়ার ত্থেয়া উপহার।
ঘাট আর বেশি দূরে নেই, এমন সময় রানার উট মাইনের
উপর পা ফেলল!
মাইনটা হাই এক্সপে−াসিভ মাইন হলে টুকরো টুকরো হয়ে যেত
রানা। কিন্তু ফেটেছে এটা অ্যান্টি পার্সোনেল মাইন। ডেইযি
কাটার বা বল বাউন্সারও বলা হয় জিনিসটাকে। এমন ভাবে
ওগুলো তৈরি করা হয় যে, কেউ পা দিয়ে বসলে ক্যানিস্টার ভরা
শ্র্যাপনেল উপর দিকে বিস্ফোরিত হয়, দুই ঊরু আর পেট
ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়।
উটটা ছুটছিল বলে মাইন যখন ফাটল তখন জানোয়ারটার
পেট ঠিক ক্যানিস্টারের উপর থাকল। প্রচণ্ডগতি তীক্ষèধার
শ্র্যাপনেল উটের পেট চিরে দিল। ওটার যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে পড়ল
বিস্ফোরণে। রানার গোড়ালিতে বাঁধা ফিতেও ছিঁড়ে গেল সেই
সঙ্গে। উড়ে গিয়ে আতঙ্কিত ছাগলের পালের মাঝখানে পড়ল






৬২
রানা। করুণ একটা শেষ চিৎকার ছেড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল ওর
উট।
ছাগলগুলোর পিঠের উপর পড়েছে বলে তেমন একটা ব্যথা
পেল না রানা। পড়বার পরমুহূর্তেই আরেকটা মাইন ফাটতে শুনল
ও। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল মৃত ছাগলের দেহ। আতঙ্কিত
হয়ে ধাক্কাধাক্কি করছে ছাগলগুলো। সম্বিত ফিরতে রানা দেখল বড়
একটা রামছাগলের পিঠের উপর আসীন হয়েছে ও, ওটার শিঙের
সঙ্গে বেধে গেছে ওর কব্জিতে বাঁধা চামড়ার ফিতে। কাত হয়ে
পড়ে গেল রানা, টের পেল ফিতেয় আটকে প্রায় ঝুলছে ও। ভয়ে
আতঙ্কে ছুটতে চাইছে রামছাগল। ঘনঘন মাথা ঝাঁকাচ্ছে। নামাতে
চাইছে মাথায় চেপে বসা আপত্তিকর ওজনটা।
শক্তিশালী একটা জানোয়ার এই বিশেষ রামছাগলটা। রানা
অনেক চেষ্টা করেও যা করতে পারেনি সেটাই করল ওটার ধারাল
শিং, কব্জির ফিতে ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেল। হাত মুক্ত হতে দেখল
রানা, উন্মত্ত রামছাগলের উপর থেকে গড়িয়ে দূরে সরে যেতে চেষ্টা
করল। দু’হাতে মাথা ঢেকে রাখল। ওকে মাড়িয়ে ছুটে চলে গেল
দশ-পনেরোটা ছাগল।
সাবমেশিনগানের আওয়াজে ও বুঝতে পারল ছাগলের পালের
উপর গুলি চালাচ্ছে কুর্দি প্রহরীরা। উঠে স্ফাড়াল রানা, স্ফাড়াতে
পেরে ক্ষণিকের জন্য বিস্ময় বোধ করল, কোনও হাড় ভাঙেনি তা
হলে!
ছাগলের পালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রায় দু’ভাঁজ হয়ে ছুটে
চলল ও। একবার ঝুঁকি নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল এক কুর্দি প্রহরী
ভীত ছাগলের পালের ভিতর তার ঘোড়া নিয়ে ঢুকে পড়েছে।
আরেকজন কুর্দি প্রহরী ব্রাশ ফায়ার করল রানাকে লক্ষ্য করে।
ঝাঁপ দিল রানা, চিত হয়েই পরক্ষণে বড় একটা ছাগল হাতের
নাগালে পেয়ে ওটার গলা পেঁচিয়ে ধরল দু’হাতে। দু’পা দিয়ে
ওটার পেটও আঁকড়ে ধরেছে। অন্যান্য সঙ্গীকে ছুটতে দেখে
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ভারী ওজন ছেঁচড়ে নিয়ে ছুটল ছাগলটা।
আরেকবার ব্রাশ ফায়ার করল কুর্দি প্রহরীরা। দিক পাল্টাল
ছাগলের পাল, সরাসরি ছুটল তাল্ডে মাঝখানে হাজির হওয়া কুর্দি
প্রহরীর দিকে।
স্টিরাপ আর ফেল্ট বুট দেখতে পেল রানা পাশে। কুর্দি প্রহরী
পাশ কাটাচ্ছে ওকে। স্পষ্ট বুঝতে পারল ও, এটাই ওর একমাত্র
সুযোগ। প্রহরীর পা ধরে গায়ের জোরে টান দিল রানা। বিস্মিত
চিৎকার ছেড়ে জিন থেকে খসে পড়ল লোকটা। দেরি না করে
তারই কোমরের খাপ থেকে বাঁকানো ফলার ছোরাটা এক টানে বের
করে নিল রানা, ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিল কুর্দির বুকের বামপাশে।
গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো লোকটার মুখ থেকে, দাড়ি ভিজে
গেল। ছাগলের পালের মাঝখানে পড়ল মৃত লোকটা। মাটিতে
পড়া সাবমেশিনগানটা এক ঝটকায় তুলে নিল রানা। একই সঙ্গে
হাত বাড়িয়ে ঘোড়ার রাশটাও ধরে ফেলেছে ও, চট করে উঠে
বসল ঘোড়ার পিঠে। এখন যত্থি মারা যায় তা হলে লড়ে মরবে।
অন্যান্য কুর্দিরা বোধহয় ভেবেছিল প্রথম সুযোগেই সিরিয়ার
সীমান্তের দিকে পালাতে চেষ্টা করবে রানা। চমক কাটিয়ে উঠবার
সময় পেল না তারা, তার আগেই ঘোড়ার রাশে ঝটকা দিয়ে
তাল্ডে দিকে ছুটল রানা। শক্ত করে ধরেছে ও টমিগানটা। ট্রিগারে
আঙুল চেপে বসল। লাল লাল ফুলকি বের হলো অস্ত্রটার মুখ
থেকে। কর্কশ শব্দ হলো ক্রমাগত বিস্ফোরণের। এদিক ওদিক
ছুটছে দ্রুতগতির বুলেট।
প্রথম দফা আক্রমণেই ধড়াস করে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ল
দুই কুর্দি। অন্য দু’জন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাতে চেষ্টা






৬৩
করল। ফিরে চলেছে তারা অপেক্ষমাণ বুল হাডসনের ট্রেইলার লক্ষ
করে। খুব দ্রুত চলে গেল দু’জন রেঞ্জের বাইরে। কিন্তু একজন
কুর্দি গার্ড এখনও আছে। বেশ কাছে সে। তীক্ষè একটা চিৎকার
ছেড়ে রানার দিকে ঘোড়া নিয়ে তেড়ে এলো লোকটা, টমিগান
তুলতে শুরু করেছে, গুলি করবে। ছুটছে রানার ঘোড়াটাও। যেন
পুরোনো আমলের দুই নাইট সম্মানের লড়াইয়ে নেমেছে,
একজনের মৃত্যু না হলে শেষ হবে না দ্বন্দ্বযুদ্ধ। লোকটা টমিগান
পুরোপুরি কাঁধে তুলবার আগেই দুটো ঘোড়ার মুখোমুখি সংঘর্ষ
হলো। ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেল রানার ঘোড়াটা।
ছিটকে পড়ল রানাও, কিন্তু সাবমেশিনগান ছাড়েনি ও।
বিজয়ীর চিৎকার ছাড়ল কুর্দি প্রহরী। রানার দিকে টমিগানের
নল তাক করেই ট্রিগার টেনে দিল। তার আগেই শরীর গড়িয়ে
দিয়েছে রানা। গুলি গাঁথল ও যেখানে ছিল, সেখানে। সামলে
নিয়েই পাল্টা গুলি করল রানা, কুর্দি লোকটা পেটে একঝাঁক গুলি
খেয়ে প্রায় দু’টুকরো হয়ে গেল।
ধুলো, রক্ত, গানস্মোক আর পোড়া করডাইটের গন্ধের মধ্যে উঠে স্ফাড়াল রানা। ভোর হতে আর দেরি নেই। বুল হাডসনের
কাছে এখানে কী হয়েছে রিপোর্ট করবে পলাতক দুই কুর্দি। সে
নিশ্চয়ই ড্রাগের চালানের পথ পাল্টাবে। এদিকে আরও মাইন
থাকতে পারে। ঝুঁকি নেবে না বুল হাডসন।
আহত গোড়ালি পরীক্ষা করে দেখল রানা। ঝরঝর করে রক্ত
পড়ছে ক্ষত থেকে। কব্জি থেকে নোংরা সাদা কাপড় খুলল ও, দ্রুত
হাতে দুই গোড়ালি ব্যান্ডেজ করে নিল। কাজটা সেরেই
টমিগানগুলো একে একে তুলে নিল ও, মৃত কুর্দিল্ডে কাছ থেকে
সংগ্রহ করে নিল সমস্ত গুলি।
ওর ঘোড়াটা উঠে স্ফাড়িয়েছে। ওটার কিছু হয়েছে বলে মনে
হলো না। ছোট ছোট ঘাসে মুখ দিয়েছে জন্তুটা। কার্দুর শাখা নদী
পার হয়ে গেছে ছাগলের পাল। চারপাশে আবার নীরবতা
নেমেছে।
চারটে ভারী টমিগান আর প্রচুর গুলি বহন করে খানিক কসরত
শেষে ঘোড়ার পিঠে উঠতে পারল রানা, রওনা হয়ে গেল পশ্চিমে।
এক মাইল পশ্চিমে আছে আরেকটা ঘাট। বুল হাডসন সম্ভবত ওই
ঘাট দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করবে। আর ঠিক ওখানেই হাডসনের
জনঞ্জপেক্ষা করবে রানা।












দশ

রানা যখন পশ্চিমের ঘাটে পৌঁছল তখন বরফে মোড়া পাহাড়ের
কাঁধের উপর দিয়ে মুখ তুলেছে সোনালী গোলকের মতো সূর্যটা।
কার্দু এখানে চওড়া হয়ে বয়ে গেছে, তবে পানির গভীরতা হাঁটু
সমান। ঝকঝকে পরিষ্কার পানি বড় বড় মসৃণ পাথরখণ্ড পাশ






৬৪
কাটিয়ে ছুটে চলেছে। ঘাটের কাছেই ছোট একটা দ্বীপ মতো
আছে। জায়গাটাকে প্রাকৃতিক একটা দুর্গ বললেই চলে। উইলো
আর ট্যামারিস্ক গাছের মাঝখানে পড়ে আছে পাথরের বড় বড় খণ্ড,
সহজেই আড়াল নেওয়া যাবে। ঘোড়াটাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে পানিতে
নামতে বাধ্য করল রানা, পৌঁছে গেল দ্বীপটাতে। টমিগানগুলো
পাশে নামিয়ে একটা বড় পাথরের পিছনে অবস্থান নিল। উটের
গোঙানি শুনতে পাচ্ছে। কাছে চলে আসছে কারাভাঁ। উত্তরে হালকা
ধুলো উড়তে দেখল। আজ ভোরেই সীমান্ত পার হতে চাইছে বুল
হাডসন। কাজটায় কোনও ঝুঁকি নেই, সীমান্ত রক্ষীল্ডে ঘুষ দিয়ে
আগেই সরিয়ে ত্থেয়া হয়েছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না রানাকে, পাঁচ মিনিট পরই
উটের দল দেখতে পেল ও। একটা সরু খাল্ডে ভিতর দিয়ে ঘাটের
দিকে আসছে কাফেলা, দু’পাশে উঁচু-উঁচু পাথুরে টিলা। বাঁক ঘুরল
তারা, দৃষ্টিপথে চলে এলো। টমিগান হাতে নীরবে অপেক্ষায় থাকল
রানা। চারটে টমিগান আছে ওর কাছে, আরও আছে আটটা বাড়তি
ক্লিপ। টিএনটি-২৫ আছে তিনটে। রানা প্রস্তুত।
কারাভাঁর পিছনে আসছে বুল হাডসনের ল্যান্ডরোভার, ট্রেইলার
আর হাফট্রাক দুটো। বুল হাডসনকে দেখতে পেল রানা, একটা
রোন ঘোড়ার পিঠে বসে এগোচ্ছে লোকটা, ওখান থেকেই কুর্দিল্ডে
নেতাকে নির্দেশ দিচ্ছে। বুল হাডসন যত্থির মুক্ত হওয়ার সংবাদ পেয়ে চিন্তিত হয়ে থাকে তা হলে তার কোনও আভাস দেখা গেল
না লোকটার আচরণে। সম্ভবত মনে করেছে রানা মারা গেছে,
অথবা ভেবেছে কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছে ও।
রানার চোখ সরু হলো। আর কয়েক মিনিটের মধেল্টুল
হাডসন বুঝতে পারবে তার ধারণা ভুল। পাথরের উপর টমিগানের
নল রেখে অগ্রসরমান দলটার দিকে অস্ত্রটা তাক করল ও
সাবধানে।
ছয়জন কুর্দি পৌঁছে গেল ঘাটে, ঘোড়া থামাল ওগুলোকে পানি
খেতে ত্থেয়ার জন্য। একজন কুর্দি ঘোড়া থেকে নেমে সবার
পানির বোতলগুলো ভরতে শুরু করল। তার উপরই প্রথমে
লক্ষ্যস্থির করল রানা, ট্রিগারে আঙুলের চাপ বাড়ল ওর।
ঘোড়াগুলোকে এড়াতে চাইছে ও, একই সঙ্গে চেষ্টা করছে উপস্থিত
কুর্দিল্ডেও গুলি করতে।
প্রথম দফা গুলিবর্ষণে চারজন কুর্দিকে ফেলে দিতে পারল ও।
একটা ঘোড়া আহত হয়ে তীক্ষè আর্তচিৎকার ছেড়ে পড়ে গেল
পানিতে। বার কয়েক পা ছুঁড়ে স্থির হয়ে গেল। বাকি দুই কুর্দি
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। আরেক
পশলা গুলি বের হলো রানার টমিগান থেকে। জিন থেকে খসে
পড়ল কুর্দি দু’জন। ধুলোর মধ্যে পড়েই থাকল তাল্ডে নিথর দেহ।
মানুষ মারছে বলে মনে হচ্ছে না রানার। মনের ভিতর স্পষ্ট জানে,
এরা পশুরও অধম, অসহায় দুর্বলচিত্ত অসংখ্য তরুণ-তরুণীর
অকাল মৃতুশু দায়ে দায়ী। গুলি বন্ধ করে তৈরি টমিগান হাতে
অপেক্ষা করছে ও ক্ষতিকর আরও কিছু পশু হত্যার জন্য।
কারাভাঁতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। উটগুলো দিগি¦দিক
জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। বুল হাডসনকে দেখতে পেল
রানা, লোকটা ঘোড়া থামিয়েছে। দ্বীপটার দিকে একবার তাকিয়ে
ঘোড়ার পেটে খোঁচা মেরে ফিরে চলল সে কারাভাঁর পিছনে
স্ফাড়ানো হাফট্রাক আর ল্যান্ড রোভারের কাছে। ঘোড়া থেকে নেমে
ট্রেইলারের ভিতর ঢুকে গেল লোকটা। এক মুহূর্ত পরই বের হয়ে
এলো আবার। এখন তার হাতে বিনকিউলার। তার সঙ্গে দুই
আমেরিকানও আছে। তিনজনই যেখান দিয়ে এসেছে সেই খাল্ডে
বাঁকের দিকে ছুটছে, দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যাবে।






৬৫
ঘোড়া দাবড়ে তাল্ডে পিছনে পৌঁছে গেল কুর্দিল্ডে দীর্ঘদেহী
নেতা, তার হাতে লম্বা নলের একটা রাইফেল। বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হলো সবাই। মনের ভিতর একটা অস্বস্তি জেগে উঠল রানার। কুর্দি
নেতার হাতের রাইফেলটাই এখানে ওর দেখা প্রথম স্কোপ লাগানো
রাইফেল। দূর থেকে দেখেও মনে হয়েছে ওটা অত্যন্ত আধুনিক
জিনিস। ঠিক ওরকম একটা রাইফেলই ও মিলির জিম্মায় রেখে
এসেছে।
মিলির কী হলো? যে ছয়জন কুর্দি পিছনদিকে ফিরে গিয়েছিল
তারা কি ওর হদিস পেয়ে গেছে?
সরু খাল্ডে এক ধারে উঁচু পাথুরে দেয়ালের উপর কাঁচের
গায়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হতে দেখল রানা। আপাতত মিলির
চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল ও। আন্দাজ করল, বুল
হাডসন আছে ওখানে, টেলিস্কোপ দিয়ে ওকে দেখতে চেষ্টা
করছে। একটু সময় হয়তো লাগবে, কিন্তু লোকটা ঠিকই বুঝে
যাবে ও ঠিক কোথায় আছে। বুঝে যাবে প্রতিপক্ষ মাত্র একজন।
মাসুল্ডানা একাকী আক্রমণ করেছে।
বিইইইইং করে আওয়াজ হলো পাথরে বুলেট পিছলে
যাওয়ার। চমকে গেল রানা। ওর মাথা যেখানে আছে তার ছয়
ইঞ্চি দূরে পাথরে ঠোকর মেরে বেরিয়ে গেছে বুলেট। একটু
পিছিয়ে এলো ও অজান্তেই। বুঝতে পারছে বাড়তি সুবিধা
হারিয়েছে। সামান্য সময়েই বুল হাডসন মোটামুটি জেনে গেছে
ওর অবস্থান।
আরেকটা গুলি ঢুকল পাথরের ফাঁক দিয়ে। বারবার
তিনদিকের পাথরে বাড়ি খেতে শুরু করল ওটা। ডানদিকে শরীর
গড়িয়ে দিয়ে একটা ট্যামারিস্ক গাছের কাণ্ডের আড়ালে সরে
এলো রানা। পাথুরে আড়ালের ফাঁক দিয়ে একের পর এক
বুলেট আসছে, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে শক্তি ফুরিয়ে
মাটিতে খসে পড়বার আগে। পাথর খণ্ডের মতোই স্থির হয়ে
পড়ে থাকল রানা। ওকে এখনও খুঁজে পায়নি বাস্ক বুল হাডসন।
লোকটা জানে ও কোথায় থাকতে পারে, তবে নিশ্চিত নয় সে।
তার কপাল অতিমাত্রায় সহায়তা না করলে আপাতত রানার
আহত হওয়ার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই।
থেমে গেল রাইফেলের গুলি বর্ষণ। ক্ষণিকের জন্য মনে
হলো দু’পক্ষের কারও কিছু করবার নেই। কিন্তু সেটা মাত্র
একটা মুহূর্তের জন্য। কয়েকটা ঝোপ সামান্য সরিয়ে নদীর
ওপারে তাকাল রানা। ওর ডান আর বামদিক দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে
দ্রুত ছুটে আসছে কুর্দি দসুশুা, গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।
এতো জোরে স্পার দাবাচ্ছে যে ঘোড়াগুলোর পেট থেকে রক্ত
ঝরে লাল হয়ে গেছে তাল্ডে স্পার। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যেই রানার টমিগানের রেঞ্জের বাইরে চলে গেল তারা। এবার
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে কার্দু নদীতে নামল। ওসব জায়গায় কার্দু
নদী বেশ গভীর। কুর্দিল্ডে ঘোড়াগুলো সাঁতার কাটছে। গলাটা
শুকনো ঠেকল রানার। দু’দিক থেকে আক্রমণ করতে চাইছে
কুর্দি দসুশুা!
বুল হাডসন ওকে খুন করে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
তা হলে! পালাচ্ছে না লোকটা, অন্য কোথাও দিয়ে চালানটা পার
করবার কথাও ভাবছে না। লোকটা নিশ্চয়ই জানে মাসুল্ডানা
দ্বীপটাতে লুকিয়ে আছে। ওর কাছে আছে চারটে টমিগান আর
যথেষ্টরও বেশি গুলি। তারপরও পিছিয়ে যাচ্ছে না সে। পিছাবার
কথাও নয়, প্রতিপক্ষ যতো শক্ত লোকই হোক, সংখ্যায় সে মাত্র
একজন। তিক্ত হাসল রানা, পাশে পড়ে থাকা একটা শুকনো
ডাল তুলে নিল। দৈর্ঘেদ্দটা অন্তত দশফুট হবে। ঝোপের






৬৬
ভিতর দিয়ে ডালটাকে সাবধানে ঠেলে দিল রানা, দীর্ঘ ঘাসের
একটা গুচ্ছের কাছে লাঠিটা পৌঁছুতেই ওটা নাড়তে শুরু করল।
এদিক ওদিক মাথা হেলাচ্ছে হলদেটে ঘাসগুলো।
একটা বুলেট ঘাসের গুচ্ছ ভেদ করে বড় একটা পাথরে লেগে
সশব্দে চ্যাপ্টা হয়ে গেল। বুল হাডসনের পরিকল্পনা বুঝতে দেরি
হলো না রানার। লোকটা ওকে এখানেই আটকে রাখতে চাইছে।
সেই ফাঁকে দু’পাশ আর পিছন থেকে ওকে ঘেরাও করে শিকার
করতে আসবে কুর্দিরা। চমৎকার একটা যুদ্ধ-কৌশল। এতোটাই
নিখুঁত যে, বেঁচে যাওয়া প্রায় অসম্ভব!
রানা যখন প্রথম কুর্দি দস্যুকে হত্যা করে তখন তার বাঁকানো
ফলার ছোরাটা নিয়ে নিয়েছে, এখন ওটা দিয়ে নরম মাটি আর
বালি খুঁড়তে শুরু করল ও। বুঝতে পারছে অগভীর একটা
ফক্সহোল খুঁড়বার সময় হয়তো পাওয়া যাবে কপাল ভালো
থাকলে। দ্রুত হাত চলছে ওর, সমস্ত মনোযোগ একত্রিত করে
খুঁড়ে চলেছে। অত্যন্ত সতর্ক, কনুইয়ে ভর দিয়ে সামান্য উঁচুও
হচ্ছে না ও।
ফক্সহোল খুঁড়বার ফাঁকে খাল্ডে ভিতর থেকে আবারও উটের
দলের গোঙানি আর ডাক শুনতে পেল ও। আগের চেয়ে দ্রুত
চলতে শুরু করল ওর হাত। বুল হাডসনও যত্থির মতো করে
ভেবে থাকে তা হলে ওই উটগুলো উন্মত্তের মতো ছুটে আসবে
নদীর অগভীর অংশটার দিকে। ও যাতে কিছু করতে না পারে
সেজনশুাইফেলের গুলিতে ওকে আটকে রাখা হবে এখানেই।
দ্বীপ পার হওয়ার সময় পিষে দিয়ে যাবে ওকে ছুটন্ত ভারী
জন্তুগুলো।
দূর থেকে মশার গুঞ্জন যেন শুনতে পেল রানা। মাটি খোঁড়ায়
বিরতি না দিয়েই আকাশে চোখ বুলাল ও, বেশ খানিক পর দেখতে
পেল খুদে বিমানটা। চিনতে পারল। এলসি ফোর পে−ন। দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধের সময় আর্টিলারি খুঁজে বের করবার কাজে বল্টহৃত
হতো। ওটার গায়ে সিরিয়ান মার্কিং এতোটা দূর থেকেও স্পষ্ট
চেনা যাচ্ছে।
মোটামুটি কাজ চলবার মতো মাটি আর বালি খুঁড়তে পেরেছে
ও। অগভীর ফক্সহোলটায় ঢুকে পড়ল রানা, পে−নটাকে চক্কর
কাটতে দেখছে। হঠাৎ কর্কশ আওয়াজ করে গর্জে উঠল কয়েকটা
সাবমেশিনগান। তারই ফাঁকে শোনা গেল বুনো চিৎকার। কুর্দি
দসুশুা পে−নটা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে।
একটা-দুটো গুলি বোধহয় লেগেছে বিমানে, কারণ দ্রুত বাঁক
নিয়ে উপর দিকে উঠতে আরম্ভ করল ওটা, ক্রমেই সরে যাচ্ছে।
পশ্চিম দিকে রওনা হলো। কোনও সন্দেহ নেই সবচেয়ে কাছের
সীমান্ত রক্ষীল্ডে সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করেছে পাইলট।
তাতে রানা কোনও বাড়তি সুবিধে পাবে তা নয়। সবচেয়ে কাছের
প্যাট্রল হয়তো কয়েক ঘণ্টার পথ দূরে আছে।
সিরিয়ান সীমান্তের দিক থেকে এলো কুর্দি দস্যুল্ডে প্রথম
আক্রমণ। সোজা দ্বীপটা লক্ষ্য করে ছুটে আসছে তারা। গুলি
ছুঁড়তে শুরু করল রানা। থামল হাতে টমিগানের নলের ছ্যাঁকা
খেয়ে। পুরো ক্লিপটা শেষ হয়ে গেছে। তবে কাজ হয়েছে,
ঝটিকা আক্রমণে ক্ষান্ত দিয়ে গুলির আওতার বাইরে চলে গেল
কুর্দিরা। এক ঝটকায় আরেকটা টমিগান তুলে নিল রানা,
ডানদিক থেকে আসা কুর্দি দস্যুল্ডে দিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু
করল। ঘাটের দিক থেকেও আসছে কুর্দিরা, তীক্ষè রণহুঙ্কার
ছেড়ে ঘোড়াগুলোকে দ্রুত ছুটতে উৎসাহিত করছে। তাল্ডে
মধ্যে গুলি করছে কয়েকজন। একটা গুলিও রানার ধারেকাছে
এলো না। কারণটা দেখতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেল রানার।






৬৭
বেশিরভাগ কুর্দি দস্যু দীর্ঘ বর্শা বহন করছে। মৃতুশু আগে
কতোটা কষ্ট হবে ভাবনাটা মাথা থেকে জোর করে দূর করতে
হলো ওকে। আরেক পশলা গুলি করল ও লোকগুলোকে লক্ষ্য করে। কয়েকজন ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল পানিতে। দুটো
ঘোড়াও পড়ল। কিন্তু তবু আসছে কুর্দিরা।
বামদিকের আক্রমণ ঠেকাতে ওদিকে মনোযোগ দিতে হলো
এবার রানাকে। ব্রাশ ফায়ারের ফাঁকে মনে মনে ভাগ্যকে
ধনল্টাদ দিল, কুর্দিল্ডে হাতের তাক মোটেই ভালো নয় বলে।
ঠিক তখনই ওর কাঁধে আঁচড় কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট।
ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠল জায়গাটা। আরেকটা বুলেট হাঁটুর কাছে
প্যান্ট ছিঁড়ে দিয়ে গেল। ওর চারপাশের পাথরে অজস্র গুলি
এসে লাগছে, তীক্ষè শব্দে দিক বদলে ছুটে যাচ্ছে নানাদিকে।
এক নাগাড়ে গুলি করছে রানা। একটার পর একটা টমিগান
তুলে নিচ্ছে হাতে যন্ত্রের মতো। মাঝে মধেদ্দর গুলিতে আহত
কিংবা নিহত হচ্ছে দু’একজন কুর্দি, কিন্তু তাল্ডে এগিয়ে আসায়
কোনও বিরতি নেই। তারপর বিনা নোটিশেই ফিরতি পথ ধরল
দস্যুদল। বুঝতে পেরেছে সরাসরি আক্রমণের ঝুঁকি নেওয়ার
আর কোনও প্রয়োজন নেই।
ওদিকে কুর্দিল্ডে তাড়া খেয়ে ঘাটের দিকে দ্রুত ছুটে আসছে
উন্মত্ত উটের দল। বুল হাডসনকে এক পলকের জন্য দেখতে পেল
রানা। নিজে এখন একটা হাফ ট্রাক চালাচ্ছে লোকটা। তার পিছনে
আসছে হাফ ট্রাক আর ট্রেইলার সহ ল্যান্ড রোভার। দুই
আমেরিকানের একজন ল্যান্ড রোভারটা চালাচ্ছে। তার পাশে বসে
আছে অন্যজন। রানার মনে হলো সিনেমা দেখছে, আর দৃশ্যগুলো
পেরিয়ে যাচ্ছে খুব বেশি দ্রুত। উটের দল ছুটে চলেছে তাড়া
খেয়ে। মুখের কাছে কিছু দেখলেই বড় বড় স্ফাত দিয়ে কামড়ে
দিচ্ছে ওগুলো।
ওগুলো দ্বীপের উপর দিয়ে ছুটে যাবে। পিষে মারবে রানাকে।
পড়ে থাকবে থেঁতলানো একটা মাংসপিণ্ড। চিনবার উপায় থাকবে
না কারও।
চট করে রানার হাত চলে গেল ব্যাগি কুর্দিশ পায়জামার
ভিতর, তিনটে টিএনটি-২৫ই বের করে আনল ও। এক মাথার নব
ঘুরিয়েই গায়ের জোরে একে একে ছুঁড়ে দিল রানা ওগুলো
অগ্রসরমান দলটার দিকে। কাজটা করেই অগভীর গর্তে মুখ লুকাল
ও। বুঝতে পারছে যতোটা দূরে ছুঁড়তে চেয়েছিল কাগজী লেবু
আকৃতির বোমাগুলো ততোটা দূরে ছুঁড়তে পারেনি বেকায়দা
অবস্থানের কারণে। মনে মনে ও বলল, রানা, এভাবেই হয়তো
শেষ হওয়া ছিল তোমার ভাগ্যে। একটা বিস্ফোরণ তুমি পার করে
এসেছ। এবারেরগুলো সম্ভবত তোমাকে খুন করবে।
ওর দেহের নীচে থরথর করে কেঁপে উঠল জমিন। কানে তালা
ধরানো গুরুগম্ভীর একটা প্রলম্বিত ভরাট প্রচণ্ড গর্জন শুনতে পেল
ও। মুখ তুলল রানা, দেখতে পেল ওর ফুট পঞ্চাশেক দূরে একটা
পাঁচ টন ওজনের পাথরের বোল্ডার আকাশে লাফ দিয়ে উঠেছে।
রানার মনে হলো বেশ খানিকক্ষণ শূন্যে যেন স্থির হয়ে ভেসে
থাকল ওটা, তারপর থ্যাপ শব্দ করে পড়ল ওর মাথা থেকে চার
ফুট দূরে। আরেকবার কেঁপে উঠল ওর চারপাশ, তারপর এলো
শকওয়েভ। গরম বাতাসের হলকা নিয়ে এলো যেন স্বয়ং
মৃত্যুদূত। কানে কিছু শুনতে পেল না রানা, হঠাৎ করেই যেন বধির
হয়ে গেছে। খপ করে ওকে আঁকড়ে ধরল যেন দানবীয় একটা
হাত, তারপর মুঠোয় পুরে ওকে ছুঁড়ে দিল আগুনে পোড়া গরম
কয়েকটা পাথরের উপর। ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখল রানা।
তারপর টের পেল, আরেকবার ওর নাগাল পেয়ে গেছে অদৃশ্য






৬৮
শক্তিটা। ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান হারাল ও। নইলে দেখতে পেত,
বাতাসে ওড়া তুলোর মতো তিরিশ ফুট উড়ে গিয়ে কার্দু নদীতে
গিয়ে পড়েছে ও।
নাকে-মুখে পানি ঢুকে যেতে সচেতন হলো রানা, কাশতে
কাশতে উঠে স্ফাড়াতে চেষ্টা করল। ওর মনে হলো হাঁটুগুলো
রাবারের তৈরি। হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল ও অগভীর পানিতে।
কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। প্রথমে বুঝতে পারল না ও কোথায়।
উহ্, গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! ঢক ঢক করে কয়েক
ঢোক পানি খেল ও। চোখে-মুখে পানির ছিটা দিল। আরেকবার
চেষ্টা করল উঠে স্ফাড়াতে। ব্যর্থ হলো আবার। হামাগুড়ি দিয়ে
তীরের দিকে এগোল ও। সামনের দৃশন্ধা দেখে মনে হলো খোদ নরকে উপস্থিত হয়েছে।
নড়ছে না কিছুই। একটা প্রাণীও বেঁচে নেই। দূরে উটের ডাক
শুনতে পেল। যে’কটা বেঁচে গেছে সেগুলো বোধহয় ফিরে গেছে
খাল্ডে ভিতর নিরাপজ্ঝাশ্রয়ে। এখানে ওখানে পড়ে আছে উট,
ঘোড়া আর মানুষের দেহের পোড়া টুকরো টাকরা। দুটো মাথা আর
সাতটা হাত দেখল রানা। তারপর চোখে পড়ল কয়েকটা ঊরু।
দুটো হাফট্রাকই উল্টে পড়েছে। জ্বলছে এখনও ওগুলো।
জ্বলন্ত ল্যান্ড রোভারটা মাটিতে নাক গুঁজে স্ফাড়িয়ে পড়েছে। শুধু
ট্রেইলারটা, আশ্চর্যজনক হলেও একদম অক্ষত! শামশের আলীর
কথাগুলো মনে পড়ল রানার। খুব ছোট হলেও আণবিক বোমার
সঙ্গে বিস্ফোরণের মিল পাওয়া গেছে টিএনটি-২৫এর। চারপাশের
সবকিছু হয়তো ধ্বংস করে দিল, অথচ একটা জায়গার হয়তো
একেবারে কিছুই হলো না।
এবার উঠে স্ফাড়াতে পারল রানা, টলতে টলতে ট্রেইলারের
দিকে এগোল। মনে পড়েছে ওর অস্ত্রগুলো ওখানে আছে। চোখে
ঝাপসা দেখছে ও এখনও। ট্রেইলারের কাছে নড়াচড়াটা প্রথমে ওর
মনে হলো চোখের ভুল, তারপর বুঝতে পারল ও ছাড়াও আরও
কেউ বেঁচে আছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ওদিকে তাকাল রানা। এবার স্পষ্ট
দেখতে পেল। বুল হাডসন! লোকটা হোঁচট খেয়ে ট্রেইলার
থেকে নামল। দুটো বড় বড় ব্যাগ তার হাতে, অপ্রকৃতিস্থের
মতো এদিক ওদিক তাকাল, কিন্তু কিছু দেখল বলে মনে হয়
না। পা টেনে টেনে হাঁটতে শুরু করল। দু’পাশে উঁচু টিলাওয়ালা
খাদ্মার দিকে চলেছে সে। বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
উঠল আবার। টলতে টলতে এগোল। বারবার পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু
উঠছেও আবার। দু’হাতের ব্যাগ দুটো এতো কিছুর মধেদ্দ
হাতছাড়া করছে না।
টাকা, আবছা ভাবে চিন্তাটা এলো রানার মাথায়। নিশ্চয়ই
টাকা আছে ওই ব্যাগগুলোয়। মৃতুশু মুখ থেকে ফিরেও টাকার
চিন্তা দূর হয়নি পিশাচটার মাথা থেকে।
চিৎকার করে লোকটাকে ডাকবার চেষ্টা করল রানা। গলা
আবার শুকিয়ে যাওয়াতে ঠিক মতো আওয়াজ বের হলো না।
মাতালের মতো এলোমেলো পদক্ষেপে পিছু নিল রানা। তবে
বুল হাডসনের তুলনায় দ্রুত এগোচ্ছে ও। দূরত্বটা ক্রমেই
কমছে। বুল হাডসন পৌঁছে গেছে টিলা-ঘেরা খাল্ডে মুখে।
ওখানেই ধুপ করে পড়ে গেল লোকটা। তখনও ব্যাগ দুটো হাত
থেকে ছাড়েনি।
বুল হাডসনের কাছে আরও পাঁচ মিনিট পর পৌঁছুল রানা, পা
দিয়ে লোকটাকে চিত করল ও। দেহটা গড়ানোর সময় গুঙিয়ে
উঠল হাডসন। তার চেহারার অর্ধেকটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যেই ফেটে গেছে বড় বড় ফোস্কাগুলো। ঠোঁট দুটো নেই






৬৯
এখন আর, লাল মাড়ি আর হলদে স্ফাত দেখা যাচ্ছে। গলে গেছে
একটা চোখ। ওটার শিরাটা গালের উপর ঝুলছে লোকটার। পুরো
দেহ ছেঁচে গেছে বিশ্রী ভাবে, সারাদেহে রক্ত চটচট করছে, কিন্তু
এখনও বেঁচে আছে হাডসন। অবশিষ্ট আধবোজা চোখটা মেলে
রানাকে দেখল সে, বাতাসের জন্য হাঁস-ফাঁস করছে। ব্যাগটা
দেখাতে চেষ্টা করল। অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘আমি...আমার
নির্দেশে নয়...ওরা...’ দীর্ঘ বিরতি দিল। অপেক্ষা করছে রানা। কী
বলতে চায় লোকটা?
একটা ব্যাগ রানার দিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করল হাডসন।
‘নাও তুমি! তুমি নাও। কবর দিয়ো...দায়ী না...আমি
না...কুর্দিরা...উন্মাদ...ওরা...আমি বলিনি...আমি...’
ক্ষণিকের জনশুানার মনে হলো দেহে শক্তি ফিরে আসছে
ওর। ব্যাগটা তুলে নিতে গেল ও, বুল হাডসনের হাত থেকে ওটা
খসে আসবার সময় ব্যাগের মুখটা খুলে গেল। কী যেন একটা
গড়িয়ে পড়ল, স্থির হলো রানার পায়ের কাছে।
জিনিসটা মিলির কাটা মুণ্ডু!
বুকের ভিতর অব্যক্ত একটা কষ্ট অনুভব করল রানা। স্ফাতে
স্ফাত পিষল বীভৎস দৃশন্ধা দেখে। শিউরে উঠল একবার। ওর
চোখ যেন আটকে গেছে কাটা মাথাটার উপর।
চুড়ো করে বাঁধা রক্তমাখা চুলের উপর এখনও ছোট লাল
বেরেট পরে আছে মিলি। ওটাতে আটকানো রানার উপহার ত্থেয়া
রুপোর পিনটা চকচক করছে। চোখ দুটো বন্ধ মিলির। কিন্তু মুখটা
হাঁ হয়ে আছে। মরবার আগে খুব কষ্ট পেয়েছিল মিলি?
বিড়বিড় করে কী যেন বলতে চেষ্টা করছে বাস্ক শয়তানটা।
বালিতে খামচি মারছে তার ক্ষতবিক্ষত একটা হাত। ফিসফিস
করল, ‘ওরা...আমি...না! দোষ...আমার...নেই! ওরা...বলিনি
ওল্ডে...ওরা...কুর্দিরা...উন্মাদ! ওরা...মেয়েটা...তিনজন কুর্দিকে
খুন করেছিল সে। বাকিরা...মেয়েটাকে রেপ করেছে ওরা...আমার
কাছে...নিয়ে এসেছে...মাথাটা। আমার কাছে...কম্পিউটার...মাফ
করে দাও... সব পাবে...আমি...সব খবর...মাফ...মাফ করে...’
মিলির কাটা মাথার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল রানা, আস্তে
করে হাঁটু গেড়ে বসল বুল হাডসনের পাশে। হাডসন তখনও কথা
বলতে চেষ্টা করছে। দু’হাতে লোকটার গলা টিপে ধরল রানা। কী
করছে যেন ও সচেতন নয় ঠিক। আস্তে আস্তে আঙুলের চাপ
বাড়াচ্ছে রানা। আঙুলে খিঁচ ধরল। আরও জোর খাটাতে চেষ্টা
করল ও। বুল হাডসন এখনও শ্বাস নিচ্ছে। দুর্বলতার কারণে
নিজেকে গাল দিল রানা।
অস্বচ্ছ চিন্তা ওকে বলে দিচ্ছে হয় মিলি ওর নির্দেশ মানেনি,
টিএনটি-২৫ বল্টহার করেনি, অথবা হয়তো অসতর্ক অবস্থায় ফাঁদে পড়ে যায় ও। মিলিকে রেপ করেছে কুর্দিরা, তারপর মাথাটা কেটে
নিয়ে এসেছে বুল হাডসনকে দেখানোর জন্য।
আরও জোরে হাডসনের গলা টিপতে চেষ্টা করল ও। সাড়া
দিচ্ছে না অবশপ্রায় আঙুলগুলো।
বিস্ফোরণের কারণে টিলার মাথার পাথরগুলো আলগা হয়ে
গেছে। চোখের কোণে উপরে পাথরের নড়াচড়া দেখতে পেল
রানা। বুঝে ফেলল কী ঘটতে যাচ্ছে। অনল্ট্যাগটা বুল হাডসনের
হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল ও, নিয়েই ফাঁকা জায়গা লক্ষ্য করে
দৌড়াতে চেষ্টা করল। টলতে টলতে এগোতে পারল শুধু। আবার
চোখে ঝাপসা দেখছে ও, মাথাটা যেন চরকির মতো ঘুরছে। বুকের
ভিতর হাহাকার করছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে ওর দোষে মরল
মিলি। এগিয়ে চলেছে রানা মাতালের মতো। বিশ
ফুট...বাইশ...পঁচিশ ফুট...






৭০
ওর পিছনে ধসে পড়ল একদিকের টিলা। থ্যাচ করে একটা
আওয়াজ শুনে চলার উপরই ফিরে তাকাল ও, এখনও গা
শিউরানো কর্কশ আওয়াজ তুলে পড়ছে পাথর।
নিরাপদ জায়গায় চলে এসেছে বুঝে বসে পড়ল বিহ্বল রানা।
পাথর পড়া শেষ হলে উঠে স্ফাড়াল আবার। টলায়মান পায়ে ফিরে
এলো খাল্ডে কাছে। পাথরের স্তূপের নীচে কবর হয়ে গেছে মিলির
মাথাটার। ওই একই স্তূপের নীচ থেকে বুল হাডসনের দু’পা
বেরিয়ে থাকতে দেখল ও। পা ধরে টেনে শরীরটা বের করে আনল
রানা। দেহটার সঙ্গে মাথা নেই এখন আর। বিরাট একটা বোল্ডার
সম্ভবত পিষে ফেলেছে মাথাটাকে! পিছিয়ে এলো বিবশ রানা,
ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘুরে স্ফাড়িয়ে ধীর অনিশ্চিত পায়ে ফিরে চলল
অক্ষত ট্রেইলারের দিকে।
নিজের সমস্ত অস্ত্র পেল ও দেয়ালের গায়ে কাত হয়ে পড়ে
থাকা ডেস্কের কোনায়। ওগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে ব্যাগটা খুলল।
ছোট একটা অ্যাপেল ল্যাপটপ কম্পিউটার আছে ভিতরে। এই
জিনিস আগেও বল্টহার করেছে রানা। নির্দিষ্ট ¯−টে চাপ দিয়ে ছোট্ট
হার্ডডিস্কটা বের করে প্যান্টের পকেটে পুরল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে
চিন্তাগুলো পরিষ্কার করতে চেষ্টা করল। সীমান্ত রক্ষীরা যজ্ঝিাসে
তা হলে তাল্ডে কী বলবে ও? বিশ্বাসযোগ্য কিছু বলতে না পারলে
ওকে ধরে জেলে পুরে দেবে ওরা। সিরিয়া কিংবা তুরস্ক, যে-
দেশের জেলেই ঢোকাক, পচে মরতে হবে ওখানে। কিন্তু সমস্যা
হচ্ছে মাথাটা কাজ করছে না ওর। মাঝে মাঝেই ঝাপসা হয়ে
আসছে দৃষ্টি।
ট্রেইলার থেকে নামল ও। দূরে আবার পে−নের গুঞ্জন শুনতে
পেল। কারা আসছে? বর্ডার প্যাট্রল? কী করবে ও? অসহায় বোধ
করল রানা।
নদীর মাঝখানের দ্বীপটাতে বেঁচে আছে একজন কুর্দি দস্যু।
পাথরের উপর দিয়ে মাথা তুলল আহত লোকটা। ট্রেইলারের কাছে
একজন লোক দেখে নিচু স্বরে গাল বকল সে। ওই বাস্ক
হারামজাদা তা হলে বেঁচে আছে? চারদিক যেন দোজখের আগুনে
পুড়েছে। অথচ ওই লোকটা...
পাশে পড়ে থাকা লম্বা নলের প্রাচীন রাইফেলটা অনেক কষ্টে
তুলে নিল সে, লোকটার পিঠে সাবধানে লক্ষ্যস্থির করল। অন্যানঞ্জনেকের মতো অটোমেটিক অস্ত্রে তার বিশ্বাস নেই। স্রষ্টার কাছে
প্রার্থনা করল সে, তার লক্ষ্য যাতে ঠিক থাকে। এবার ট্রিগার টেনে
দিল। বেকায়দায় ধরা রাইফেলের ঝাঁকিতে মনে হলো, কাঁধের হাড়
ছুটে গেল রানার। ব্যথার বোধ যেন তার নেই। তৃপ্তির সঙ্গে দেখল
ঝাঁকি খেল একাকী মূর্তিটা, পরমুহূর্তে ঢলে পড়ল কুর্দি দস্যু মৃতুশু
কোলে।








এগারো

সোনালী রথে চেপে সাদা মেঘের ভিতর দিয়ে যেন নামছে রানা।
রেশমী কোমল একটা অনুভূতি। তারপর মনে হলো অন্ধকার
আঠাল একটা কুয়ার ভিতর থেকে উঠে আসছে ও। শ্বাস আটকে






৭১
আসতে চায়। ফুসফুসে যেন কেউ পাথর ভরে দিয়েছে। পেট চেপে
ধরেছে কেউ সাঁড়াশি দিয়ে। হঠাৎ বুঝতে পারল, যে-ঢাল বেয়ে
উঠছে ও সেটা খুব পিছলা। দু’পা এগোলে এক পা নেমে যাচ্ছে
পিছলে। এক সময় ঢালের উপর উঠল রানা, চোখের সামনে
ঝাপসা ভাবে দেখতে পেল সবুজ কাঁচের একটা দেয়াল। চারপাশে
সবকিছু যেন ঘুরছে, কিন্তু কাঁচের দেয়ালটা আছে।
ওই দেয়ালটার ওপাশে মানুষের আকৃতি নড়ছে চড়ছে।
তাল্ডে ডাকতে চেষ্টা করল রানা, গলা দিয়ে দুর্বল গোঙানি বেরিয়ে
এলো। অসহায় বোধ করল রানা। কেউ জানে না ও এখানে আছে,
বেঁচে আছে এখনও। দৃষ্টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে ওর। এখন
একজনকে পরিচিত মনে হচ্ছে। ডিনার জ্যাকেট পরা এক যুবক।
চকচকে কালো চুল ব্যাকব্রাশ করা। কুচকুচে কালো চোখ। উপরের
ঠোঁটের কাছে মোম মাখানো পেন্সিল গোঁফ। এগিয়ে আসছে
লোকটা। ভাবতে চেষ্টা করল রানা, একে আগে কোথায় যেন
দেখেছে ও?
ওই লোকটা, ডিনার জ্যাকেট পরা লোকটা সম্ভবত শেভ
করবে। শেভ? নাÑতা তো নয়! তা হলে পকেট থেকে ক্ষুর বের
করেছে কেন সে? ওকে শেভ করিয়ে দেবে? না হলে এদিকে
আসছে কেন? সতর্ক হওয়ার কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে
না রানা। সবুজ কাঁচের দেয়ালের এপাশে নিরাপদ জায়গায় আছে
ও। ক্ষুরওয়ালা লোকটা এপর্যন্ত কিছুতেই পৌঁছাতে পারবে না।
আরেকজন লোক দেখতে পেল রানা। লম্বা, চিকন একটা
লোক, দেখলে মাকড়সার কথা মনে পড়ে যায়। চেহারাটা শকুনের
মতো। তার পরনে সাদা একটা স্মক। কৌতূহলী হয়ে চেয়ে থাকল
রানা। লোক দু’জন এখন কথা বলছে। কী ব্যাপারে যেন তর্ক
করছে তারা। কেন তা জানে না রানা, কিন্তু ওর মন বলছে ওর
ব্যাপারেই কথা বলছে লোক দু’জন।
মাকড়সা আকৃতির শকুনমুখোই তর্কে জিতল। কনুই ধরে
ক্ষুরওয়ালা যুবককে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। একটা ল্ডজার কাছে
চলে গেল। ল্ডজা দিয়ে বেরিয়ে গেল যুবক। কারণ না জানলেও
মনের ভিতর অদ্ভুত একটা স্বস্তি অনুভব করল রানা। শকুনমুখো
বোধহয় ওর বন্ধু।
সবুজ কাঁচের ওপাশে এসে আবার স্ফাড়াল সাদা স্মক পরা
প্রৌঢ়। লোকটার হাতে কী যেন আছে। ছোট একটা কাপ। বিষ না
কি ওটাতে?
লোকটা কী যেন ঢালল কাপে। এদিকে আসতে শুরু করেছে
সে। ভয় পেল না রানা। হাসি পেল ওর। সবুজ কাঁচের দেয়াল
ওকে রক্ষা করবে।
সরে গেল কাঁচের দেয়াল। হঠাৎ করে সচেতন হয়ে উঠতে
শুরু করল রানা। ওকে ধরে আধবসা করাল সাদা স্মক, কাপের
তরলটা ঠোঁটে ধরেছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিলতে বাধ্য হলো রানা।
লোকটা ওর উপর ঝুঁকে বলল, ‘বেশ বেশ, শেষ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরল
তা হলে। গুড আফটারনুন।’
ইংরেজিতে কথা বলছে লোকটা, সুরে জার্মান টান স্পষ্ট।
রানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, অস্বাভাবিক সরু ঠোঁট দুটো
ফাঁক হলো, নিঃশব্দে হাসছে সে।
বসতে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু আস্তে করে ঠেলে ওকে
হাসপাতলের সাদা চাল্ড বিছানো খাটে শুইয়ে দিল লোকটা।
রানার কাঁধে বন্ধুর মতো চাপড় দিল। রানা বুঝতে পারছে কোথায়
যেন গলজ্ঝাছে। লোকটা ওর বন্ধু না। সতর্ক হওয়ার
প্রয়োজনীয়তা বোধ করল রানা। বুঝতে পারছে এটা হাসপাতালের
কোনও ঘর। আর এই লোকটা ডাক্তার। ওই পে−নটা, যেটার শব্দ






৭২
শুনেছিল ও জ্ঞান হারাবার আগে, ওটা তো সিরিয়া কিংবা তুরস্কের
পে−ন? হয় ওটা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে, না হলে কোনও দেশের
সীমান্ত রক্ষীরা। দুর্গম ওই এলাকা থেকে নিয়ে এসে ওকে এখানে
এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু ওই ক্ষুরওয়ালা
যুবক...ঠিক মিলছে না। না কি স্বপ্নে দেখেছে ও লোকটাকে?
ডাক্তারী সাদা স্মক পরা লোকটা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে
আছে। ঠোঁটে কোণে তার লেগে আছে অদ্ভুত একটুকরো বাঁকা
হাসি। নিজের চোখা থুতনিতে তর্জনী বোলাল সে। রানা ভাবল,
সত্যি লোকটা দেখতে শকুনের মতো। অশুভ, বুদ্ধিমান কোনও
শকুন। বুকে কাঁপুনি শুরু হলো রানার। এখন বুঝতে পেরেছে
কোথায় আছে ও। ওই পে−নটা...ওটা সিরিয়া বা তুরস্কের
কর্তৃপক্ষের পে−ন ছিল না। ওটা ছিল কার্টেলের! ধরে আনা হয়েছে
ওকে!
ডাক্তার সম্ভবত রানার চিন্তাস্রোত বুঝতে পেরেছে, হাসল
লোকটা, বেরিয়ে পড়ল নিখুঁত, ঝকঝকে সাদা নকল স্ফাতগুলো।
‘কোথায় আছেন বুঝতে পেরেছেন তা হলে, মিস্টার রানা?
জানতাম বুঝতে পারবেন। দ্রুতই বুঝেছেন। অন্য কেউ শরীরের
এই অবস্থায় আরও অনেকক্ষণ বিবশ হয়ে থাকত। আপনি
আমার ব্যক্তিগত দুর্গে অতিথি হয়েছেন। ক্লিনিকটা পাশেই।
আপনি আছেন আমার বিশেষ রোগীল্ডে জন্য সংরক্ষিত
রুমগুলোর একটায়।’
চোখ বুজল রানা। ভাবতে হবে ওকে। একটা ঝিমানি অনুভব
করছে ও। সচেতন ভাবে বুঝতে পারছে শিথিল হয়ে আসছে ওর
দেহ। ওকে যেটা গেলানো হলো সেটার কারণেই কি এরকম
আচ্ছন্ন লাগছে? মনের চোখে তীক্ষèধার সার্জিকাল ইন্সট্রুমেন্ট
দেখতে পেল ও। রাগ হলো ওর। এতো কিছুর পর, এতো কষ্টের
পর এখন ফ্রাঞ্জ হার্টযের অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হবে? বাঁচতে
পারবে বলে মনে হলো না ওর। তবে হাল ছেড়ে ত্থেয়া যাবে না।
রানা বলল, ‘আমার নাম রানা নয়। ওই নামের কাউকে আমি চিনি
না। আপনি কে? আমি কোথায় আছি?’
ওর উপর ঝুঁকল লোকটা। ‘তা হলে আপনি কে?’
‘আমি থমসন। এতো ঘুম পাচ্ছে কেন আমার?’
‘আচ্ছা!’ হাসল ফ্রাঞ্জ হার্টয। পকেট থেকে একটা সিগারেট
বের করে সাধল। নিল না রানা। থুতনিতে আবার আঙুল বোলাল
ডাক্তার। ‘আরও ঘুম পাবে। আরও এক ঘণ্টা বাঁচবেন আপনি,
মিস্টার থমসন ওরফে রানা। মরফিনের ম্যাসিভ ডোজ দিয়েছি
আপনাকে আমি। শেষ সময়টা বিশ্রাম নিন, মিস্টার রানা।’
‘আমি মিস্টার রানা নই। কিন্তু আপনি কে সেটা বুঝেছি।
আপনি ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয। আমি বসফরাসে আপনার
স্যানাটোরিয়ামে আছি, তা-ই না? টর্চার কখন শুরু করবেন,
ডাক্তার?’
‘ধরেছেন ঠিক।’ হাসিটা চওড়া হলো ফ্রাঞ্জ হার্টযের। ‘আগে
আরও গভীরে যান আপনি। এমন একটা সময় আসবে যখন
আর নড়তে পারবেন না। তখনও জ্ঞান থাকবে আপনার। আর
ঠিক তখনই হাতের কারুকাজ দেখাব আমি আপনার দেহের
ওপর। সেজন্য যত্থি জরুরি মিটিং ছেড়ে আসতে হবে আমাকে,
তবু সময়টা উপভোগ না করে পারব না আমি। সতিল্টলছি,
মিস্টার রানা, আপনার মতো এতো সুপার্ব ফিজিকাল কন্ডিশনে
কাউকে আগে দেখিনি আমি। আপনি কীভাবে মরেন সেটা দেখা
আমি কিছুতেই মিস করতে পারি না। আমাল্ডে বিরাট ক্ষতি
করে দিয়েছেন আপনি, সেটার খানিকটা অন্তত পূরণ হবে
আপনাকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখলে।’ রানার চুলে আল্ড করে






৭৩
হাত চালাল ফ্রাঞ্জ হার্টয। ‘মিস্টার রানা, রনি রুথলেসকে আমি
আপনার গলা কাটতে দিইনি। একটা ধনল্টাদ দেবেন না
আমাকে? আপনার প্রাপ্য সম্মানটাই দিচ্ছি, রঙিন নেশা করে
মরবেন আপনি।’
সত্যিই, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। সচেতন হয়ে উঠতে চাইল রানা।
আরামদায়ক অনুভূতি ল্ডকার নেই ওর। জেগে থাকতে হবে
ওকে। মিথেল্টলবার কোনও কারণ নেই ফ্রাঞ্জ হার্টযের, লোকটা
সতিদ্দকে ম্যাসিভ ডোজের মরফিন দিয়েছে। কথা বলে নিজেকে
জাগিয়ে রাখতে হবে! ‘আচ্ছা,’ বলল রানা, ‘তা হলে আমি স্বপ্ন
দেখিনি? ডিনার জ্যাকেট পরা লোকটা সত্যিই এঘরে ছিল?’
‘ছিল,’ থুতনিতে টোকা দিল ফ্রাঞ্জ হার্টয।
ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইছে দু’চোখ। ‘আমি এখানে এলাম কী
করে?’
জবাব ত্থেয়ার আগে একটা সিগারেট ধরাল মাকড়সা,
তারপর বলল, ‘ওখানে যায় আমাল্ডে পে−ন। ধ্বংসযজ্ঞ দেখে।
একজনও বাঁচেনি ওখানে আপনি ছাড়া। নতুন ধরনের কোনও
বোমা বল্টহার করেন আপনি, মিস্টার রানা, ঠিক কি না?’
‘আমি মিস্টার রানা নই। আমি থমসন।’
‘ওখানে আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। আপনার
মাথার একপাশ ছিলে দিয়ে গেছে একটা বুলেট, এছাড়া তেমন
কিছু হয়নি। ওটার কারণেই আপনি জ্ঞান হারান।’
মাথায় হাত দিয়ে ব্যান্ডেজের স্পর্শ পেল রানা। এবার টের
পেল, ওর দুই গোড়ালিতেও ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। মারবার আগে
ওকে যতোটা সম্ভব সুস্থ করে তুলছে এরা! ওর শরীরে আরও ছয়-
সাত জায়গায় গজ কিংবা প−াস্টার লাগানো হয়েছে।
খলখল করে হাসল ফ্রাঞ্জ হার্টয। ‘যাচ্ছেতাই অবস্থা ছিল
আপনার, মিস্টার রানা। আমাল্ডে পে−নে বুদ্ধিমান এক লোক ছিল,
সে আপনাকে নিয়ে আসে। এশিয়াটিক সাইডে নামে আমাল্ডে
পে−ন। ওখান থেকে ক্লিনিকের অ্যাম্বুলেন্সে করে আপনাকে এখানে
আনা হয়। হেভি সিডেশন ত্থেয়া হয় আপনাকে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা
বেঘোরে ঘুমিয়েছেন আপনি।’
ছত্রিশ ঘণ্টা! ঘরের একমাত্র জানালাটার দিকে তাকাল রানা।
বসফরাসে সন্ধ্যার ছায়া ঘনাতে শুরু করেছে। ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম
পাচ্ছে। আরাম! আহ্! কী শান্তি! মরফিন, রানার ভিতরে যেন
বিস্ফোরিত হলো ড্রাগের নামটা। না, ওকে জেগে থাকতে হবে।
আচ্ছা, ওই জানালার নীচে কী আছে?
একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল ও। অন্ধকার ঘনাচ্ছে ওর চোখের
সামনে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চিন্তাগুলো যেন ভোঁতা হয়ে
গেছে। মিলির মিষ্টি চেহারা দেখতে পেল ও চোখের সামনে।
হাসছে মিলি। ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠোঁটে লেগে
আছে এক টুকরো সরল হাসি। প্রচণ্ড রাগ হলো ওর। কার উপর ও
জানে না।
‘আমি যাচ্ছি, মিস্টার রানা,’ বলল ফ্রাঞ্জ হার্টয। ‘জরুরি মিটিং
আছে আমাল্ডে। আবার আসব আমি, চিন্তা করবেন না। ঠিক
সময়ে দেখবেন আমি হাজির। আপাতত বিদায়।’
ল্ডজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল মাকড়সার মতো লোকটা।
শান্তি! প্রশান্ত একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। মৃত্যু যেন কোমল একটা
বিছানা, ওকে ঘুমিয়ে পড়তে আহ্বান করছে। আহ্, কী আরাম!
মনের ভিতর কে যেন বলছে: মরে যাও, রানা। কেন নয়? এতো
আন›জ্ঝার কোথায় পাবে তুমি? মৃত্যু ভয়ঙ্কর নয়, মৃতুঞ্জারামের। বড় শান্তির। তোমার কাজ শেষ হয়েছে। আর কোনও
কাজ নেই, রানা। ঘুমিয়ে পড়ো। আরাম! নিজেকে ছেড়ে দাও।






৭৪
ভেসে যাও রঙিন স্রোতে।
‘না, রানা, বাঁচতে হবে তোমাকে!’ বুকের ভিতর থেকে গম্ভীর
একটা কণ্ঠ¯ল্ফ আদেশ দিল ওকে। এ আদেশ লঙ্ঘন করে না ও
কখনও। এই মানুষটার চেয়ে আপন আর কেউ নেই ওর। পিতার
মর্যাদা দিয়েছে ও অপার স্নেহময় ওই বৃদ্ধকে। পেয়েছে পিতার
অকৃত্রিম আল্ড। কী যেন নাম?
নামটা কিছুতেই মনে করতে পারল না রানা। শুধু দেখতে
পাচ্ছে উজ্জ্বল, তীক্ষè দুই চোখের উপর ঘন, কাঁচাপাকা ভুরু। চোখ
দুটো চেয়ে রয়েছে ওর দিকে নরম দৃষ্টিতে। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘তুমি
ছাড়া আমারও যে কেউ নেই, রানা!’
নিজের উপর জোর খাটিয়ে সচেতন হতে চাইল রানা। ওর
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। ঘামছে সেটা টের পাচ্ছে ও।
ভালো। ওর অনুভূতি এখনও কাজ করছে। কিছুতেই মরব না
আমি! মনে মনে চিৎকার করল রানা। আমাকে বাঁচতে হবে। সমস্ত
মানসিক জোর একত্রিত করে সচেতন হতে চেষ্টা করল ও। ওর
সুঠাম শরীর এতোদিন মালিকের সমস্ত নির্দেশ মেনে এসেছে, কিন্তু
এখন আর মানতে চাইছে না, গড়িমসি করছে। বালিশ থেকে মাথা
তুলল রানা। সচেতন হতে চেষ্টা করল ও, বাঁচার তীব্র ইচ্ছে ওকে
খানিকটা শক্তি যেন ফিরিয়ে দিচ্ছে।
বিছানা থেকে যে করে হোক নামতে হবে ওকে। স্ফাড়াতে
হবে। বাথরুমে যেতে হবে। বমি করতে হবে। পাকস্থলি থেকে
মরফিন বের করে দিতে হবে। জেগে থাকো, রানা! ঘুমিয়ে পোড়ো
না!
মনটা বলছে, লুবনা, মিলি, সুলতা, রেবেকাÑওরা ঘুমিয়ে
পড়েছে। ওকে ফেলে চলে গেছে। ও যায়নি। এখন গেলে ক্ষতি
কী? কী হবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে? এল্ডে হাত থেকে মুক্তি
মিলবে না। ডাক্তার ফ্রাঞ্জ হার্টয কি ওকে এখনও দেখছে কোথাও
থেকে? বমি করতে পারলে আবার ওকে মরফিন দেবে? তা হলে
এতো চেষ্টা করে কী হবে? মৃত্যু হবেই, ঠেকানো যাবে না, তা হলে
এখনই মরতে দোষ কী?
আমি বাঁচতে চাই! শরীরটা গড়িয়ে দিল রানা। মেঝেটা যেন
অতিদ্রুত উঠে এলো উপরে। মনে হচ্ছে যেন তুলোর মধ্যে পড়েছে
ও। নরম! আস্তে আস্তে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে শরীরটা তুলল
রানা, পাশে একটা চেয়ারের অস্পষ্ট অবয়ব দেখে এক হাতে ওটা
ধরে উঠে স্ফাড়াতে চেষ্টা করল।
ওই জানালা! থাই অ্যালুমিনিয়াম! ওপারে আছে বসফরাস।
কিন্তু জানালার নীচে কী আছে? কী আছে তাতে কার কী! ওর কিছু
না। কার্নিস? ব্যালকনি? পাথর? সিমেন্টের মেঝে? কী যায় আসে
তাতে? যত্থিই জানালা পর্যন্ত ও যেতে পারে...ঝাঁপ দেবে ও কেউ
ওকে ধরে ফেলবার আগে। হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু প্রথমে যেতে
হবে বাথরুমে। বমি করতে হবে।
কী ছোট বাথরুমটা! টিমটিমে ডীম লাইট জ্বলছে। কিন্তু এতো
দূরে কেন ওটা? উঠতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা। শরীর
ছেঁচড়ে এগোল। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করল আবার।
পারছে না। বড় বেশি কঠিন। না, এই তো হামাগুড়ি দিতে পারছে!
যাহ্, হাঁটু পিছলে গেল। গলার ভিতর আঙুল পুরে দিল রানা। কই,
বমি তো হচ্ছে না! আবার আঙুল পুরে দিয়ে চেষ্টা করল। বিচ্ছিরি
স্বাদ টের পেল রানা গলার ভিতর। এতে কাজ হবে না। বমি হচ্ছে
না! চারপাশ থেকে অন্ধকার যেন ঘিরে ধরছে ওকে। বনবন করে
ঘুরছে মাথা। কালো একটা গভীর গর্তে যেন পাক খেয়ে খেয়ে
নেমে যাচ্ছে ও। চারদিক থেকে কালো দেয়াল চেপে আসছে ওর
দিকে। পিষে মারবে।






৭৫
আবার এগোল রানা। মনে হলো যেন অনন্ত কাল, কিন্তু
বাথরুমের ল্ডজা পেরিয়ে ঢুকল ও ভিতরে। বেসিনটা হাতের
নাগালে পেয়ে ওটা ধরে উঠে স্ফাড়াতে চেষ্টা করল। তিনবারের
চেষ্টায় বেশ খানিকটা উঠতে পারল ও। হাঁটুগুলো যেন রাবারের
তৈরি, এক্ষুণি বেঁকে যাবে। মেডিসিন ক্যাবিনেট হাতড়াল ও।
এমন কিছু কি আছে যেটা ওকে বমি করতে সাহায্য করবে?
বাথসল্ট! এক বোতল বাথসল্ট আছে! আর আছে জং ধরা
একটা বে−ড।
রানা! তাড়াতাড়ি! ছোট্ট বাথরুমটার দেয়ালগুলো ওর চারপাশে
দুলে দুলে পাক খাচ্ছে। আলো কমে আসছে ক্রমেই। সময় বড়
কম!
চিৎকার করতে চাইল রানা, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো
না। কাঁপা হাতে বেসিনের রাবারের তৈরি স্টপ-ককটা আটকাল
ও, বাথসল্ট ঢেলে কল খুলে দিল। মিশ্রণটা আঁজলায় তুলে
গিলতে শুরু করল এবার। ঘন সুগন্ধী তরল নেমে যাচ্ছে ওর
গলা দিয়ে। আবার আঁজলা ভরে গিলতে শুরু করল রানা।
স্বাদ্মা জঘন্য। বেসিনে মুখ নামিয়ে চুমুক দিল ও, তৃষ্ণার্ত
যেভাবে পানির উপর হামলে পড়ে সেভাবে গিলছে ও। বিচ্ছিরি
স্বাদ! কিন্তু কাজ হচ্ছে! অসুস্থ বোধ করছে ও। অনেক দূর থেকে
প্রিয় বৃদ্ধের গরুগম্ভীর গলা আবার শুনতে পেল: বাঁচতে হবে
তোমাকে, রানা।
হড়হড় করে বমি করতে শুরু করল রানা। বমি থামতেই
কল থেকে আবার আঁজলা ভরে পানি মুখে দিল, বাথসল্টের
বোতলটা উপুড় করে ধরল মুখের উপর। বমি করল আবার।
কষ্ট হচ্ছে খুব। মোচড় মারছে পেটর ভিতরটা। বুকে তীব্র
ব্যথা। বমি থামতে আবার মুখে পানি নিল ও, বাথসল্ট ঢেলে
গিলে ফেলল তরলটা। আবার বমি। খুব দুর্বল লাগছে। পা
দুটো আর শরীরের ভর রাখতে পারল না, বেসিনের ধাক্কা খেয়ে
আরেকটু হলেই কমোডের উপর মাথা দিয়ে পড়ছিল ও, একটুর
জন্য পাশে পড়ল। ব্যথা নেই কোনও। চুপ করে শুয়ে থাকল
রানা। সংখ্যা গুনছে এক দুই করে। ধীরে ধীরে পঁচাশি পর্যন্ত
গুনল, তারপর স্ফাড়াবার চেষ্টা করল।
স্ফাড়াতে পারল ও, মাতালের মতো এদিক-ওদিক টলছে। ওহ্!
পেটের পেশিতে খিঁচ ধরেছে। অসহল্ট্যথা! প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁজো
হয়ে গেল রানা। আরও বেশি করে খিঁচ ধরছে!
সোজা হতে চেষ্টা করল ও, চিৎকার করতে চাইল, পশুর মতো
দুর্বোধ্য গোঙানি বের হলো শুধু।
জানালা! ওই জানালার কাছে যেতে হবে ওকে। যা করবার
দ্রুত করতে হবে। কেউ এসে পড়বার আগেই। হয়তো নজর
রাখছে কেউ। মজা দেখছে। সে কিছু বুঝে উঠবার আগেই
জানালার ওপাশে চলে যেতে হবে। তারপর যা হয় হোক। কিন্তু
জানালার দিকে গেলে ওকে ঠেকানো হতে পারে। লড়বার সাধ্য নেই ওর এখন। কৌশল করতে হবে।
টলতে টলতে ঘরে ঢুকল রানা, শরীরটাকে ইচ্ছে করেই
জানালার দিকে পড়তে দিল। পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। শক্তি সঞ্চয়
করতে চাইছে। উঠল আবার। বিছানার দিকে এক পা বাড়িয়ে
আবার পড়ে গেল। জানালাটা কাছে চলে এসেছে। এবার!
ঝট করে উঠে স্ফাড়িয়েই এক টানে জানালার ¯−াইডিং কাঁচ
সরিয়ে দিয়ে নীচে তাকাল রানা। তিরিশ-চলি−শ ফুট নীচে সাগরের
কালো পানি দেখতে পেল ও। দুর্গটা সাগর থেকে কতোটা দূরে?
লাফ দিলে তীরে আছড়ে পড়বে ও? কোনও কার্নিস নেই জানালার
তলায়। সাগরের পানি ওখানে কতটা গভীর?






৭৬
পিছনে ল্ডজা খুলবার আওয়াজ পেল রানা। এখন আর
ভাবনার সময় নেই। জানালা টপকে লাফিয়ে পড়ল রানা। দুর্গের
দেয়াল উপরে উঠে যেতে দেখল ও আবছা ভাবে। শরীরটা পাক
খাচ্ছে ওর। ডিগবাজি খেল বারকয়েক, তারপর ধড়াস করে পড়ল
পানিতে। জোর একটা ঝাঁকি অনুভব করল ও সারা শরীরে। বড়
করে শ্বাস নিল রানা। একগাদা নোনা জল ঢুকে গেল ওর
ফুসফুসে। খচ্ করে ব্যথা লাগল বুকে। পরমুহূর্তেই চারপাশ থেকে
ধেয়ে এলো গাঢ় অন্ধকার। জ্ঞান হারাল মাসুল্ডানা।













বারো

কে যেন ওর জিভটা গোড়া থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।
ঝাঁকি খেল রানার দেহ। বমি করতে শুরু করল ও। কেউ ওর
পিঠের উপর চেপে বসে আছে, দানবীয় শক্তিতে ওর ফুসফুসে
বারবার চাপ দিচ্ছে। ফুসফুস ফাটিয়ে ওকে মেরে ফেলবার চেষ্টা
করছে না কি লোকটা? বারবার প্রচণ্ড চাপ ত্থেয়া হচ্ছে। লোনা
জল বমি করতে শুরু করল রানা। বমির ফাঁকে চোখ মেলল।
অন্ধকার নেমেছে চারপাশে। আকাশে মিটমিট করছে নক্ষত্রগুলো।
দূরে শহরের টিমটিমে আলো দেখতে পেল। শুনতে পেল কে যেন
চিৎকার করে বলছে, ‘তাজিক, তাজিক, অসুস্থ বাচ্চার মতো বমি
করছে এফেন্দি! শ্বাস নিচ্ছে এফেন্দি! চাপ দাও আরও! চালিয়ে
যাও!’
ওর পিঠের উপর বসে থাকা লোকটা হেঁড়ে গলায় বলল,
‘নিজের জিভ বন্ধ করে এফে›িল্ড জিভ ধরে টান লাগাও, বাপজান!
ঠিক মতো টান দাও। এফে›িèাঁচলে আমরা বহুত বকশিশ
পাবো।’
শরীর মুচড়ে পিঠের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা
লোকটাকে নামিয়ে দিল রানা। বিস্মিত হলো ও প্রায় পুরোপুরি সুস্থ
হয়ে উঠেছে দেখে। শক্তি ফিরে এসেছে দেহে। বুঝতে পারছে
বসফরাসের নোনা পানি অনেক গিলেছিল ও, তারপর এরা ওকে
বমি করানোয় শরীর থেকে অবশিষ্ট মরফিন বেরিয়ে গেছে।
এতোটাই সজীব লাগছে যে ওর মনে হলো মাত্র ঘুম থেকে
উঠেছে। দেখতে পেল, কাঠের পাটাতনে একগাদা সদ্যমৃত মাছের
উপর পড়ে আছে ও। দু’জন লোক ওকে বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে।
তাল্ডে একজন বুড়ো, অন্যজন পালোয়ানের মতো এক যুবক।
যুবকই ওর পিঠে চড়েছিল। মাছের উপর রাখা একটা টর্চ জ্বলছে,
সেই আলোতে রানা বুঝতে পারল ও আছে একটা দাগলিয়ান বা
মাছধরা নৌকার বাড়তি পাটাতনে। এখান থেকেই জাল ছুঁড়ে দেয়
তুর্কি জেলেরা। খেয়াল করল, তীর থেকে শ’খানেক গজ দূরে
আছে নৌকাটা।






৭৭
বুড়ো কুঁজো জেলের গাল ভরা খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি।
তাপ্পিমারা একটা প্যান্ট পরে আছে সে, গায়ে ভারী একটা
সোয়েটার। হাসতেই তার ভাঙা ভাঙা আধখাওয়া, পোকাধরা
স্ফাতগুলো দেখা গেল। ‘তুমি বেঁচে আছো, এফেন্দি! আল−াহ্ মহান!
জাল ফেলতেই পেয়েছি তোমাকে, বুঝতে পারছ? মাছ তুলছিলাম,
এমন সময় তুমি উঠে এলে। সবচেয়ে বড় মাছ, এফেন্দি! আমরা
ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছ।’
যুবক হাসল। ‘আমি তাজিক, ফার্স্ট এইড জানি। বাপজানকে
বললাম তোমার জিভ টেনে ধরতে, আর আমি দিলাম ফুসফুসে
চাপ। বাপজান যেমন বলল, আমরা ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ,
এফেন্দি! আল−াহ্ সত্যিই মহান।’
‘আমিও ভেবেছিলাম আমি মারা যাব।’ উঠে স্ফাড়াল রানা।
একশো গজ দূরের তীরের দিকে তাকাল ও। বসফরাসের তীরে
মাথা উঁচু করে স্ফাড়ানো দুর্গটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এদিকটা অন্ধকার, শুধু তিনতলার একটা জানালায় উজ্জ্বল আলো
জ্বলছে। ওখানেই নিশ্চয়ই মিটিং করছে ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয তার
সাঙ্গপাঙ্গল্ডে নিয়ে। দুর্গের চারদিকে চারটে টাওয়ার। কোনও
সন্দেহ নেই ওটাই ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টযের দুর্গ। ওকে নিশ্চয়ই তন্ন
তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে এখন! তবে বেশিক্ষণ খুঁজতে যাবে না।
ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয ধরেই নেবে এতোক্ষণে মারা গেছে ও,
বসফরাসের স্রোত ওর লাশটাকে পৌঁছে দিয়েছে মারমারা
সাগরে।
তীরে স্ফাড়ানো গম্ভীরদর্শন দুর্গটা আঙুল তুলে দেখাল
রানা। ওটার পাশে খেত। খেতের ওপারে একটা ব্যস্ত রাস্তা
দেখতে পাচ্ছে ও, গাড়ির আলো আসছে যাচ্ছে। ‘দুর্গটা কি
হাসপাতাল?’
বুড়ো জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, হাসপাতাল। গরীবল্ডে চিকিৎসা বিনা
পয়সায় করে ওখানে। ওটা চালায় খুব ভালো এক এফেন্দি।
গরীবল্ডে খুব দেখে।’
সচেতন হলো রানা। দুই জেলে ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে
তাকাচ্ছে। বোধহয় তারা ভাবছে ও পালিয়ে আসা কোনও পাগল
রোগী, স্যানাটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সাইকো, অ্যাডিক্ট
বা অ্যালকোহলিক ধরনের কিছু ও। আর দেরি করা ঠিক হবে না,
বুঝতে পারছে রানা। মিটিঙের কথা কী যেন বলছিল ডক্টর ফ্রাঞ্জ
হার্টয? ওখানে মাওলানা আব্দুল হামিত্থ নিশ্চয়ই থাকবে। তাকে
বন্দি করবার একটা সুযোগ হয়তো পাবে ও। জেলেল্ডে বলল ও,
‘ফিরে এসে অনেক বকশিশ èে তোমাল্ডে আমি। এখন আমাকে
যেতে হচ্ছে।’
কথাটা বলেই ডাইভ দিল রানা বসফরাসে। দুর্গের দিকে
সাঁতরাতে শুরু করে পিছনে শুনতে পেল জেলেল্ডে কথা। ‘পাগল
এফেন্দি! যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই যাচ্ছে আবার। এর
কাছ থেকে বকশিশ আশা করা যায় না।’
‘ঠিক,’ সায় দিল অন্যজন। ‘ওই এফে›িল্ড ধারণা ও দুনিয়া
কিনে ফেলতে পারবে। আল−াহ্ বেচারার মাথায় বাড়ি মেরেছিলেন
বোধহয়।’
ঘাড় ফেরাল রানা, দেখল জেলেরা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে
তাল্ডে জাল নিয়ে। মৃদু হেসে সাঁতারে মন দিল ও। তীরের
কাছে পৌঁছে গতি কমাল, তারপর পানিতে স্থির হয়ে স্ফাড়াল,
মাথাটা প্রায় ডুবিয়ে রেখেছে। দুর্গে ঢুকবার পথ খুঁজছে ওর
অভিজ্ঞ দু’চোখ।
অবশেষে ওটা দেখতে পেল ও। স্টিলের জালের তৈরি
একটা ওয়াটার গেট, ওপাশে চিকন একটা খাল, সোজা চলে






৭৮
গেছে দুর্গের তলায়। একটা প্যাডলক আটকানো আছে গেটে।
খালটা এখন আর বল্টহার করা হয় বলে মনে হলো না ওর।
অনেক আগে হয়তো দুর্গের বড়লোক মালিক এপথে বোটে করে
ইস্তাম্বুল যেত।
গেট টপকে ওপাশে চলে গেল রানা। খালটা অগভীর,
তলার কাদায় পা ঠেকে গেল ওর। বুক সমান পানির ভিতর
দিয়ে হেঁটে এগোল ও। দুর্গের বেযমেন্টের কাছে পৌঁছুতেই
মানুষের গলার আওয়াজ পেল ও। বুট জুতোর খটখট আওয়াজ
হচ্ছে পাথরের মেঝেতে। কান পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে দিল
রানা, স্থির হয়ে স্ফাড়াল। শ্বাস আটকে ফেলেছে। মূর্তির মতো
অপেক্ষা করছে।
ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টযের প্রহরীল্ডে দু’জন, পরনে সাদা প্যান্ট আর
সাদা জ্যাকেট। দু’জনই সুঠামদেহী। তাল্ডে একজনের হাতে
একটা টর্চ, অবহেলার সঙ্গে ওটার আলো ফেলছে সে খালের
দু’ধারের বাগানে।
‘পাগলের কাণ্ড,’ বলল তাল্ডে একজন। ‘গাধাটা যèিসফরাসে পড়ে থাকে তা হলে স্রোতের টানে এতোক্ষণে অনেক
দূরে সরে গেছে তার লাশ। আমি তো বলব, সী অভ মারমারায়
হতভাগার লাশটা পাওয়া যাবে খুঁজলে। ডক্টর বাধ্য না করলে এখন
আমরা কোয়ার্টারে বসে আরাম করে রাকি গিলতে পারতাম।’
নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ করল অপরজন। ‘রাকি
তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এফে›িত্থ পালাতে পারবে না।
শীতল পানিতে মাছের খাবার হতে শুরু করেছে সে এতোক্ষণে।’
‘ঠাণ্ডা লেগে গেছে আমার,’ বলল প্রথমজন। ‘রাকি ল্ডকার।
চলো, যাওয়া যাক।’
‘এক মিনিট।’ রানা যেখানে লুকিয়ে আছে সেখানে খালের
কালো পানির উপর টর্চের আলো ফেলল প্রহরী। আস্তে করে ডুব
দিল রানা। এরকম ঘটতে পারে আশা করেছিল, কাজেই দমের
অভাব হলো না। প্রায় চার মিনিট শ্বাস আটকে পানির তলায়
থাকতে পারবে ও। চোখ খোলা রেখেছে রানা, পানির উপর
আলোর আবছা প্রতিফলন দেখতে পেল। তারপর নিভে গেল
আলোটা। আবার পানির উপর মাথা জাগানোর আগে আরও দুই
মিনিট অপেক্ষা করল রানা। আরেকজন প্রহরীকে দেখতে পেল, এ
সশস্ত্র, দু’পাশে তাকাতে তাকাতে দুর্গের আরেক প্রান্তে চলে গেল
লোকটা।
কালো আর্চওয়ের তলা দিয়ে সাঁতরে এগোল রানা। সামনেই
ল্যান্ডিং প−্যাটফর্ম থাকবার কথা। খালটা বেঁকে দুর্গের তলায় চলে
গেছে।
ল্যান্ডিং প−্যাটফর্ম পর্যন্ত আসছে একজন গার্ড, তারপর ঘুরে
স্ফাড়িয়ে সিঁড়ি পার হয়ে চলে যাচ্ছে দুর্গের সামনে। লোকটা সিঁড়ি
পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপর পানি ছেড়ে উঠে
ঘাসে পা মুছল। প্যান্ট চিপে নিল। এবার দৌড়ে উঠতে শুরু করল
ও সিঁড়ি বেয়ে। গার্ড ফিরে আসবার আগেই দোতলার ল্যান্ডিঙে
পৌঁছে গেল ও। মনে মনে আশা করল, প্রায়ান্ধকারে ওর গা থেকে
পড়া পানির ছোপ চোখে পড়বে না লোকটার। ল্যান্ডিং ঘুরল রানা।
এখন লোকটা ওকে আর দেখতে পাবে না। তিনতলায় উঠতে শুরু
করল রানা।
তিনতলার চারটে অন্ধকার ঘর পার হলো ও। পাঁচ ন¤ল্ফ
ঘরটাতে আলো জ্বলছে। ভারী ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে ঘরের
ফ্রেঞ্চ জানালায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভিতরটা স্পষ্ট দেখতে পেল
রানা। ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয ছাড়াও ঘরে আরও পাঁচজন লোক
রয়েছে। ডক্টর বসেছে টেবিলের এক মাথায়, অন্য মাথায়






৭৯
দাড়িওয়ালা মাওলানা আব্দুল হামিদ। মাঝে টেবিলের দু’দিকে
বসা লোকগুলো অপরিচিত। তবে তাল্ডে চেহারাই বলে দিচ্ছে
অপরাধ জগতের মানুষ। এরাই সম্ভবত সিন্ডিকেটের মাঝারী
গোছের নেতা।
ডক্টরের সামনে টেবিলে ওর ওয়ালথার, স্টিলেটো, বুল
হাডসনের হার্ডডিস্ক আর সায়ানাইড গ্যাস বোমাটা দেখতে পেল
রানা। মার্বেল আকৃতির বোমাটা সাবধানে নাড়ছে ডক্টর।
আব্দুল হামিèলে উঠল, ‘তা হলে কথা তো হয়েই গেল।
যেহেতু আমার হাতে পৌঁছোনোর আগেই ড্রাগের চালান নষ্ট হয়ে
গেছে সেইহেতু সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন আপনারা। তিনমাস পর
আরেকটা চালান আমাকে দেবেন।’
‘নিশ্চয়ই,’ বোমাটা হাত বদল করল হার্টয। ‘আপনি এ-
ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। কথার বরখেলাপ হয় না আমাল্ডে।’
ল্ডজার কাছে চলে এসে নবে হালকা মোচড় মারল রানা।
তালা বন্ধ করা নেই। সামান্য ফাঁক করল ও ল্ডজাটা। ওর
সবচেয়ে কাছে আছে ফ্রাঞ্জ হার্টয। আর তার হাতে আছে
সায়ানাইড গ্যাস বোমাটা। ওটা রানার ল্ডকার। একবার গ্যাস
বোমা আর ওয়ালথারটা হাতে পেলে এল্ডে বন্দি করতে পারবে
ও। বেঁধে রেখে পুলিশে খবর ত্থেয়া যাবে। হার্ডডিস্কটা কাজে
আসবে তখন।
তৈরি হয়ে নিল রানা, তারপর নিক্ষিপ্ত তীরের মতো ছিটকে
ঢুকল ঘরে। এক লাফে পৌঁছে গেল ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টযের পাশে।
ওকে দেখে হুড়মুড় করে চেয়ার ঠেলে উঠে স্ফাড়াল লোকটা। হাতে
এখনও মার্বেল আকৃতির গ্যাস বোমা। ওই হাতের কব্জিটা গায়ের
জোরে খপ করে ধরল রানা, থাবা মারল বোমাটা নিয়ে নেওয়ার
জন্য। কিন্তু কব্জি বেশি শক্ত করে ধরা হয়ে গেছে ওর। মড়মড়
করে উঠল হার্টযের শুকনো হাড়। ব্যথা পেয়ে হাত থেকে বোমাটা
ছেড়ে দিল ডক্টর। কার্পেটবিহীন মেঝেতে পড়ে ঠুস করে ফাটল
কাঁচের গোলক। সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস আটকে ফেলল রানা।
এদিকে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছে সিন্ডিকেটের চার ষণ্ডা।
দু’পা এগোনোর আগেই ধড়াস করে পড়ে গেল তারা। মেঝেতে
গড়াচ্ছে প্রচণ্ড কষ্টে। রানার গায়ে ঢলে পড়ল ডক্টর ফ্রাঞ্জ হার্টয,
তারপর ঠেলা খেয়ে পড়ে গেল। এখনও চেয়ারে বসে আছে আব্দুল
হামিদ, দু’হাতে দাড়ি আর গলা চেপে ধরে কী যেন বলতে চেষ্টা
করল। কথাটা বুঝতে পারল না রানা।
অল্প অল্প কাঁপছে তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত লোকগুলো, ক্রমেই
চলে যাচ্ছে মৃত্যু-সেতুর ওপারে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা
যাবে সবাই। টেবিল থেকে ওয়ালথার, স্টিলেটো আর হার্ডডিস্কটা
নিয়ে নিল রানা, একটা লাশ বাছাই করল, তারপর ওটাকে ছেঁচড়ে
নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে অন্ধকার করিডরে। পিছনে ল্ডজা
বন্ধ করে দিল।
সিঁড়ির কাছে শুধু একটা ডিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোয় মৃত
লোকটার পোশাক খুলতে শুরু করল ও, পাঁচ মিনিটের মাথায় পরে
নিল নিজে। একটু আঁটো হলো, তবু এই দিয়েই আপাতত কাজ
চালাতে হবে। জুতোটা কিছুতেই হলো না। সাদা শার্ট, নিট টাই
আর কালো প্যান্ট পরা একজন মানুষ ও, যার জুতো নেই। এ
নিয়ে মাথা ঘামাল না রানা, জুতো ওর ল্ডকার নেই। হেঁটে
ইস্তাম্বুলে ফিরবার কোনও ইচ্ছে নেই ওর। লাশের কাছ থেকে
টার্কিশ পাউন্ডের মোটা একটা বান্ডিল পেয়েছে ও, ওটা বল্টহার
করে ট্যাক্সি বা রেন্টাল কার পাওয়া যাবে। এখন ও কোথায় আছে
সে-সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা আছে ওর। বসফরাসে, ইস্তাম্বুল থেকে দশ
মাইল উত্তর-পুবে। স্যানাটোরিয়ামের সামনে ব্যস্ত রাস্তায় অনেক






৮০
গাড়িঘোড়া দেখেছে, মনে পড়ল ওর। ওখানে স্ফাড়ালে হয়তো
লিফট পাওয়া যাবে। এখন প্রথম কাজ এখান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল রানা, ষ্ণেতলায় এসে
থামল। গার্ড লোকটা এক পাক ঘুরে চলে যেতেই নিঃশব্দে চলে
এলো ও খালের পাড়ে। নেমে পড়ল পানিতে। এক হাত উঁচু
করে রেখেছে যেন হার্ডডিস্ক না ভেজে। স্টিলের গেট টপকে
সাঁতরাতে শুরু করল ও দুর্গের সীমানা প্রাচীর লক্ষ্য করে। ওটা
পেরিয়ে তীরে উঠল। খেত মাড়িয়ে পৌঁছে গেল রাস্তার ধারে।
ক্লিনিকের গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে এসে একটা
স্পোর্টস কার দেখল ও। ক্লিনিকের দিক থেকে দুর্গ পাশ কাটিয়ে
আসছে স্পোর্টস কার। ক্রমেই গতি বাড়ছে গাড়িটার। গর্জাচ্ছে
ওটার শক্তিশালী ইঞ্জিন।
লিফট চাওয়ার জনল্টুড়ো আঙুল দেখাল রানা। রাতের
আঁধারে হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ওকে জ্বলজ্বলে একটা হলদে কাকতাড়–য়ার মতো দেখাল।
রাস্তার উপর উঠে এসে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে রানা। গাড়িটা
গতি কমাচ্ছে না। গনগনে আগুনের মতো জ্বলছে হেডলাইট,
আকৃতিটা আরও বড় আর উজ্জ্বল হচ্ছে দ্রুত। খুব কাছে এসে
গেছে গাড়িটা, থামছে না। হয় ড্রাইভার মাতাল, নইলে ইচ্ছে করে
ওকে খুন করতে চাইছে!
একেবারে শেষ মুহূর্তে পাশের খাদে লাফ দিয়ে পড়ে
আত্মরক্ষা করল রানা। তার আগেই খেয়াল করেছে ড্রাইভার
স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে কুস্তি লড়ছিল। গা রী-রী করা তীক্ষè
আওয়াজ করে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে অর্ধেক রাস্তায় আর অর্ধেক
কাঁচামাটিতে ব্রেক কষে থামল গাড়িটা। তখনও স্টিয়ারিং হুইল
সামলাতে ব্যস্ত ড্রাইভার। তারপর নামল সে। হাইহিলের টিকটিক
আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে। খাদ ছেড়ে উঠে এলো রানা।
গাড়ির টেইললাইটের আলোয় দেখতে পেল ড্রাইভার একজন
মহিলা। এক হাতে তার হুইস্কির বোতল। টলছে মাতালের মতো।
রানার সামনে এসে স্ফাড়াল, তাল রাখতে ওর কাঁধে এক হাত রেখে
জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু হয়নি তো তোমার? আমি দু-দুঃখিত।
তোমাকে দেখতেই পাইনি।’
‘এ অবস্থায় গাড়ি চালানো আপনার ঠিক হয়নি,’ বলল রানা।
‘ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
‘আমি তো বলেছি আমি দুঃখিত,’ ঠোঁট ফোলাল মেয়েটা।
‘তোমার ক্ষতি হোক চাইনি। আসলে দেখতেই পাইনি তোমাকে।
একটা ড্রিঙ্ক নাও, মাফ করে দাও আমাকে, কেমন? কোথায় যাবে
তুমি, বলো। পৌঁছে èে আমি।’
‘ইস্তাম্বুল। জরুরি কাজ আছে ওখানে আমার।’
মাথা নাড়ল লালকেশী। ‘সরি, হানি, আমি ইস্তাম্বুল যাচ্ছি না,
বাড়ি ফিরছি। প−াজ বিচে আমার বাসা। ব−্যাক সি’র তীরে। সু›ল্ড
একটা ভিলা। যাবে আমার সঙ্গে?’ রানার গায়ের সঙ্গে সেঁটে এলো
যুবতী। তার দেহের মিষ্টি সৌরভ রানার নাকে এসে লাগল।
রানা জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু তুমি তো ইস্তাম্বুলের দিকে
যাচ্ছিলে। জানতে না?’
‘ইস্তম্বুলের দিকে যাচ্ছিলাম?’ রানার দিকে সবুজ চোখ মেলে
চাইল মেয়েটা। ‘ইস্তাম্বুলের দিকে?’ খিলখিল করে হেসে উঠল সে,
ঠোঁট ওল্টাল। ‘ছিঃ, আমি ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে চলেছি।
লিডোতে ড্রিঙ্ক করছিলাম। দুঃখ ভোলার চেষ্টা। ভুল দিকে বাঁক
নিয়েছি তা হলে!’
প−াজ বিচে যেতে পারলেও মন্দ হয় না, ভাবছে রানা। এই
অবস্থায় ইস্তাম্বুলে ঢুকলে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে যেতে পারে ও।






৮১
তারচেয়ে প−াজ বিচে গিয়ে ধাতস্থ হয়ে ফিরতে পারে ও।
হাইডআউটে ফোন করে রাশেদিকে সব জানিয়ে দিলেই চলবে।
‘আমি রানা, মাসুল্ডানা,’ হাত বাড়িয়ে দিল ও।
‘ওহহো, আমার নামই তো বলা হয়নি,’ হাসল যুবতী। ‘আমি
রায়ানা রনসন।’ আরেক চুমুক গলায় ঢালল সে বোতল থেকে।
এক হাতে রানাকে জড়িয়ে ধরল। ‘বাবা-মা বেড়াতে গেছে বলে
ভিলা একদম খালি। আশা করি তোমার খারাপ লাগবে না?’
‘ভিলায় ফোন আছে তো?’
‘নিশ্চয়ই! দুটো আছে। আমাল্ডে গরীব মনে করেছ? ইচ্ছে
করলে তুমি দুটোই বল্টহার করতে পারবে।’
‘আমিই ড্রাইভ করছি,’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। মেয়েটাকে
পৌঁছে দিয়ে এই গাড়ি নিয়েই ইস্তাম্বুলে ফিরতে পারবে ও।
গাড়িটার ব্যাপারে পুলিশকে জানিয়ে দিলেই চলবে, তারা ওটা পরে
ফেরত দিতে পারবে।
ড্রাইভিং সিটে বসেই অ্যালকোহলের গন্ধ পেল রানা। আরও
কীসের পরিচিত একটা গন্ধ যেন আছে গাড়ির ভিতর। পিছনের
সিটে হাত দিয়ে দেখল ও, জায়গাটা এখনও ভেজা। হাতটা নাকের
কাছে আনতেই মল্ডে গন্ধ পেল। পিছনের সিটে মদ ফেলা
হয়েছে। ওখানে পেটমোটা একটা ব্যাগও পড়ে আছে। এক
চিলতে রহস্যময় হাসি ক্ষণিকের জন্য দেখা দিল রানার ঠোঁটে।
বিনা আপত্তিতে রানার পাশে এসে বসল রায়ানা রনসন। গাড়ি
ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হলো রানা। পনেরো মিনিট নীরবে কাটল,
তারপর ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ভরল রায়ানা রনসন। শিকাগোর তৈরি
ফাস্টঅ্যাক্ট নেইলপলিশ রিমুভারের এসটোনের গন্ধটা আরও বেশি
করে পেল রানা। সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল রানা, প্রায়
জায়গায় স্ফাড় করিয়ে ফেলল গাড়ি। হঠাৎ গতি কমে যাওয়ায়
মেয়েটার মাথা ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে বাড়ি খেল। মুহূর্তের জন্য তাকে
বিবশ মনে হলো। ভ্যানিটি ব্যাগটা হ্যাঁচকা টানে নিয়ে নিল রানা,
ওটা হাতড়ে একটা চকচকে ধারাল পিউমা ক্ষুর বের করে আনল।
ওটা দূরে সরিয়ে আরেক হাতে রায়ানা রনসনের চুলের গোড়া ধরে
টান দিল ও। খসে এলো লালচে চুল। নীচে কালো চুল পুরুষল্ডে
মতো করে ছাঁটা।
‘হ্যালো, রনি রুথলেস,’ কঠোর শোনাল রানার কণ্ঠ। ‘কিছু
বলার আছে তোমার?’
‘না।’ যুবতীর চোখ দুটো যেন জ্বলছে।
‘মোস্তাককে তুমি খুন করেছ।’ অভিযোগ করছে না রানা, মনে
করিয়ে দিচ্ছে।
‘ও একটা হাঁদা ছিল।’
‘খুব ভালো মানুষ ছিল ও।’
‘কচু! তিনমাস আগে তোমাল্ডে অফিস থেকে পনেরো দিনের
ছুটি নেয় ও। তখন ওকে আটকে রেখে দশদিনে আমরা ওকে
অ্যাডিক্ট করে তুলি। প্রচুর তথ্য দিত নেশা করলে। তার মাধ্যমে
অনেক খবর পেয়ে যেতাম আমরা। ওর দেয়া তথ্য পেয়েই সহজে
খুন করতে পেরেছিলাম তোমাল্ডে এজেন্টল্ডে। পুরোপুরি ড্রাগ
নির্ভর একটা লোক ছিল মোস্তাক। শুধু শেষ দিকে কিছু তথ্য গোপন করতে পেরেছে সে। তোমাকে গুরু মানত, কিন্তু মুখ
ফসকে বলে ফেলেছিল তুমি কবে কীভাবে আসছ। আসলেই
একটা হাঁদা ছিল ও। ড্রাগ ওকে চাকর বানিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু
এসব কথা কীসের জন্য, মাসুল্ডানা? তুমি তো আমাকে খুন
করবে।’
‘পুলিশের হাতে তুলে èে তোমাকে। অবশ্যই সমস্ত প্রমাণ
সহ। যজ্ঝিপরাধী সাব্যস্ত হও তা হলে ফাঁসি হবে তোমার। এই
সুযোগটা তোমাকে èে আমি, যত্থি কোনও সুযোগই তোমার
প্রাপ্য হয় না।।’






৮২
আনমনে মাথা ঝাঁকাল রায়ানা রনসন। গাড়ির ভিতরের
বাতিটা জ্বেলে দিল রানা। লক্ষ করল মেয়েটার সবুজ চোখে আশার
আলো দেখা দিয়েছে। এখনই মারা পড়বে না বুঝে সাহস ফিরে
আসছে তার। সতর্ক হয়ে উঠল রানা আরও।
‘তুমি কথা দিচ্ছ আমাকে খুন করবে না?’
‘কথা দিচ্ছি আমি খুন করব না।’ মেয়েটা সাহস ফিরে পাচ্ছে
কেন? ওর আস্তিনের ভাঁজে আরও কোনও কৌশল নেই তো?
‘এবার বলো কীভাবে ছদ্মবেশ নিতে।’
‘সোনালী উইগ পরলেই আমি হয়ে যেতাম মেরিলিন হিউলেট।
লাল উইগটা রায়ানা রনসন হতে বল্টহার করতাম। চোখে
লাগাতাম সবুজ কন্ট্যাক্ট লেন্স। আর প্যান্ট-ডিনার জ্যাকেট পরে
বুকে স্ট্র্যাপ আটকে নিলেই রনি রুথলেস। খুব সহজেই মেয়ে
হিসেবে শিকারের কাছে চলে যেতে পারতাম, তারপর কাজ
সারতাম পুরুষ হিসেবে।’
‘মোস্তাককেও নিশ্চয়ই সহজেই মারতে পেরেছ?’
অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসল রায়ানা রনসন। ‘খুব সহজে।
ড্রাগের জন্য পাগল ছিল ও। ড্রাগ èে এই অপেক্ষায় আমাকে
বিশ্বাস করে বসে ছিল সে মারা যাবার আগে। স্টানার অফিসে
ফোন করে বলে দেয় তুমি ওখানে যাবে। ড্রাগ চাইছিল আমার
কাছে। ড্রাগ খুব ল্ডকার ছিল মোস্তাকের।’
‘পোস্ট মর্টেম করে সিরিঞ্জের অনেক দাগ পাওয়া গেছে ওর
দেহে,’ আপনমনেই বলল রানা। ‘তুমি নিজের হাতে ওকে খুন
করেছিলে?’
‘অবশ্যই! ড্রাগ ওর এতো ল্ডকার হয়ে পড়েছিল যে কাঁপছিল
ও থরথর করে। খুন করে ওকে চিরতরে মুক্তি দিয়েছি আমি।’
রানার মনে পড়ল চিকা মোস্তাকের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের
সময়টা। তখন মোস্তাকের হাত কাঁপতে দেখে ও মনে করেছিল
নার্ভাসনেসের কারণে অমন হচ্ছে। ‘তুমি যখন লেডি স্টানাকে খুন
করছ তখন তোমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ও, তোমাকে
জানিয়ে দেয় ওর গাড়ি কোথায় আছে। স্টানাকে খুন করে পোশাক
বদলাও তুমি, তারপর মোস্তাককে গিয়ে হত্যা করো। ও নিশ্চয়ই
তোমাকে মেরিলিন হিউলেট নামে চিনত? মোস্তাককে খুন করে
আবার ফিরে আসো আমার বল্টস্থা করতে। ব্যর্থ হয়ে আজকে
গাড়িচাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিলে।’
‘ব্যর্থ হতাম না,’ শান্ত গলায় বলল রায়ানা রনসন। ‘ডক্টর
হার্টয আপত্তি না করলে দুর্গেই তোমার গলা দু’ফাঁক করে দিতাম।’
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল হঠাৎ সে। মুখ দিয়ে তীক্ষè একটা
আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো তার। ‘উহ্!’
‘কী?’ জিজ্ঞেস করল রানা। সতর্কতায় কোনও ঢিল দিল না।
‘পায়ে খিঁচ ধরেছে!’ পায়ের পাতার কাছে হাত নিয়ে গেছে
রায়ানা রনসন, একটা হাইহিল খুলে ফেলল। ওটা মোচড় দিতেই
জুতোর সোলের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এলো তীক্ষèধার একটা
স্টিলেটো। হিলটা হাতলের কাজ করছে। রানার উপর উন্মাদিনীর
মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
হাতটা ধরে ফেলবার পরও পাঁজরে খোঁচা খেল রানা। ক্ষুরটা
ফেলে দু’হাতে মেয়েটার হাত ধরতে চেষ্টা করল ও এবার। দানবীর
মতো শরীর মোচড়াচ্ছে রায়ানা রনসন, বারবার হাতটা ছোবল
মারছে তার। এই সময় তার সিটের আপডাউন নবে চাপ পড়ল।
সিটটা শোয়ার উপযোগী হয়ে গেল। তখনও স্টিলেটো রায়ানার
হাতে, ওটা সোজা করে ধরবার চেষ্টা করছে সে। হিলটা পিছলে
যাওয়ায় ফলাটা তারই দিকে তাক হয়ে গেল। ঠাণ্ডা মাথায় রায়ানার
হাতটা গায়ের জোরে তার বুকের দিকে ঠেলে দিল রানা। ঘ্যাঁচ
করে বুকে গাঁথল স্টিলেটো। মেয়েটা শিউরে উঠল, টের পেল
রানা। চিৎকার করতে হাঁ করল রায়ানা। সু›ল্ড মুখটা বিকৃত হয়ে






৮৩
গেছে। কয়েকটা ঝাঁকি খেয়ে স্থির হয়ে গেল তার দেহ।
পাশের সিটে সরে এলো রানা, দেখল রায়ানা রনসনের
বামবুকে, হৃৎপিণ্ডের ভিতর গেঁথে আছে স্টিলেটোর পুরোটা ফলা।
হিলটা একটা অদ্ভুত মেডেলের মতো অল্প অল্প দুলছে।
গাড়ি থেকে নামল রানা, রায়ানার লাশটা খাল্ডে ভিতর ফেলে
দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ইস্তাম্বুলের পথে রওনা হয়ে গেল। ঠিক করেছে
গাড়িটা কোনও নির্জন রাস্তায় রেখে দেবে। পুলিশ মালিকের নাম-
ঠিকানা খুঁজে বের করুক।
এখনও অনেক কাজ বাকি ওর। মেজর জেনারেল রাহাত
খানকে রিপোর্ট করতে হবে, হার্ডডিস্কটার কপি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের
হাতে পৌঁছোবার বল্টস্থা করতে হবে, নিরাপদে গোপনে বেরিয়ে
যেতে হবে তুরস্ক থেকে, তারপর আবার ফিরে আসতে হবে
সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। আগামী ক’টা দিন দম ফেলবার
ফুরসত পাবে না ও। তবে তুরস্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দুই
জেলের সঙ্গে দেখা করবে ও। তাল্ডে চেহারা ওর মনে আছে।
সাগরে কোথায় তাজিক আর তার বাপজান মাছ ধরে সেটাও জানা
আছে। খুশি করে দিতে হবে দু’জনকে।
আপাতত মর্গের নীচের গোপন আস্তানায় ফিরছে ও। ঘুম
ল্ডকার ওর। ল্ডকার মন থেকে মিলিকে মুছে ফেলা। কখনও
পারবে কি না জানে না ও, তবে চেষ্টা ওকে করতেই হবে।

***
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফাঁদ (The Middle Class Trap): স্বপ্ন না বাস্তবতা?

লিখেছেন মি. বিকেল, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৪৫



বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত কারা? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কিছু রিসার্চ এবং বিআইডিএস (BIDS) এর দেওয়া তথ্য মতে, যে পরিবারের ৪ জন সদস্য আছে এবং তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×