আজ পর্যন্ত এমন পরিণতি হয়তো ঘটেনি কারও জীবনে। একইদিন দুই বোনের তালাক কার্যকর ঘোষণার দৃশ্যটি কেবল বেদনাদায়কই নয় নিয়তির চরম পরিহাস। ক্ষণিকের আবেগ ও ভুল সিদ্ধান্তের দহনে দুটি জীবনের করুণ পরিণতি। সালিশি পরিষদে সবাই চেয়ে চেয়ে দেখেছে দুই জীবনের দহন। বার্ধক্য নয়, কষ্টের ভারে ন্যূজ এক পিতার শোকার্ত অবয়ব!ক্ষণিকের আবেগপ্রসূত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় সারা জীবন দিয়ে।
মুক্তা ও হিরা (ছদ্মনাম) দুজনের মধ্যে বছর দুয়েকের ব্যবধান। একসাথে বেড়ে ওঠা। মুক্তা ও হিরাকে দেখে সমবয়সী ভেবে ভুল করেছেন এমন প্রতিবেশি অনেক। স্কুল পেরিয়ে মুক্তা যখন কলেজ করিডোরে তখন তার বাবা জাবেদ সাহেব মেয়েকে একটি মোবাইল ফোন দেন। মুক্তার কিশোরী মনে প্রভাব পড়ে অন্য একজনের। ছেলেটির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোবাইল ফোনেই। প্রেমের একবছর পেরুতেই পালিয়ে বিয়ে করে প্রেমিক তোফায়েলকে। বোন হিরা বড়বোনের সম্পর্কের কথা জানতেন।
এদিকে, হিরার সাথে কনক নামে এক ছেলের সম্পর্ক তৈরি হয়। এক বছরের মাথায় ছোট বোন হিরাও মুক্তার পথ ধরেন। বিয়ের পরবর্তী দাম্পত্য জীবন বেশ সুখেই কেটেছে দুই বোনের। মা-বাবার সাথে যোগাযোগ না রাখলেও দুই বোন নিজেদের যোগাযোগ ঠিকই অক্ষুণ্ন রেখেছিল।
সময় বয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাস্তবতার অসম সমীকরণের বোঝা বুঝতে পারেন দুই বোন। একদিন দু’বোন সিদ্ধান্ত নেন দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করার। দুই বোনই আদালতের মাধ্যমে তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে দেন। চট্টগ্রাম আদালতের বিদায়ী বিচারক ও সালিশি পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহাবুবুর রহমানের আদেশে প্রথম মুক্তার এবং পরে হিরার তালাক কার্যকর করা হয়।
প্রথম পর্ব: সালিশের আলোকিত অংশ- মুক্তার সাথে তার বাবা জাবেদ সাহেব ও ছোট বোন হিরা হাজির আছেন। প্রথমে ধারণা করা হয়- হিরা তার বোনকে সঙ্গ দেয়ার জন্য কিংবা সহযোগিতা করার জন্য এসেছেন। সালিশী পরিষদের পক্ষ থেকে মুক্তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, ‘আমার বোনেরও তালাক কার্যক্রম আছে। আজ ওর টারও তারিখ আছে।’ তাদের বাবা অত্যন্ত দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলেন, ‘স্যার, আমার মেয়েরা আমার অমতে নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করেছে। এখন তারা তাদের ভুলের মাশুল দিচ্ছে।’
দ্বিতীয় পর্ব: সালিশের আলোকিত অংশ- হিরা বলেন, ‘আমার সাথে ওর বনিবনা হচ্ছে না। তার সাথে মিল-বন্ধনের কোন সম্ভাবনা নেই। স্যার, আমার তালাক কার্যকর করা হোক।’ অনেকটাই নিস্তেজ ভংগিতে বসে আছেন জাবেদ সাহেব। কিছুক্ষণ আগে এক মেয়ের-‘বিবাহ বিচ্ছেদের’ ধকল হয়তো তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। তারপরও খুবই মৃদু স্বরে তিনি বলেন, ‘স্যার, কি আর করব? হয়তো এটাই আমার নিয়তিতে লেখা ছিল। কোন মেয়েই আমার কথা শুনেনি। তাদের মাও অসুস্থ। আমাকেই সবকিছু করতে হচ্ছে।’হিরা সালিশী পরিষদের আদেশের প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকেন।
বিচারক বললেন, ‘যাই হোক, ইতোমধ্যে দুইটি তালাক নোটিশেরই বিধিবদ্ধ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। অতএব, দি মুসলিম ফ্যামিলি অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৭(৩) ধারার অধীনে তালাক আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হল।’
মুক্তা, হিরা ও বাবার চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ করে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। এই তিনটি মানুষ যেন পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষের প্রতিরূপ। জাবেদ সাহেবের চেহারায় বয়ে চলা জীবনের ভার যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল- জীবনকে যেন টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। জীবনটাই তার পাহাড়সম বোঝা !
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৩৬