somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমদ কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকদের অবাধ এবং নিরুপদ্রুত বাজারে ঝড় হয়ে আবির্ভূত হন।

৩০ শে জুলাই, ২০১২ রাত ৮:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মনে হয়েছে হুমায়ুন ছিলেন প্রচুর রসবোধের অধিকারি এক মানুষ। উইট হিউমারকে উপজীব্য ধরে তিনি নাটক চলচ্চিত্র গল্প উপন্যাসে পাঠককে মজা দিয়েছেন। তার অধিকাংশ চরিত্রই মূলত: অপ্রকৃতিস্থ। খানিকটা অস্বাভাবিক পাগলাটে ধরনের। এদের আচাড় আচরন কথাবার্তা চলন বলন স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন। হয়তো তিনি দেখাতে চেয়েছেন সমাজে বসবাসকারী মানুষগুলো সকলেই কোন না কোন দিক দিয়ে অস্বাভাবিক অপ্রকৃতিস্থ। আমরা মানুষের এই অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারিনা। হুমায়ুন এই বিষয়গুলোকে পিনপয়েন্ট করে সামনে তুলে ধরেছেন। চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে। কারন দর্শকরা বানরের অদ্ভুত আচার আচড়ন দেখে মজা পায়। এই দর্শকদের মধ্যে বাচ্চাদের সংখ্যা থাকে বেশী। তারাই মজা পায় বেশী। আসলে আমরা অবচেতন মনে সব সময় ভিন্নতা খুঁজি। সেই ভিন্নতা অস্বাভাবিকতার মাঝেও পাওয়া যায়। হুমায়ুন নিপুনভাবে মানুষের অস্বাভাবিকতা পাগলামির সাথে উইট এবং হিউমারের সংমিশ্রন ঘটাতে পেরেছিলেন, অস্বাভাবিকতা পাগলামিকে শৈল্পিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন আর এভাবেই তৈরী হয়েছে হিমু মিসির আলী বাকের ভাইয়ের মত চরিত্র। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এসব চরিত্রে বেশী মজা পেয়েছে, অনেকের কাছে এসব চরিত্র আদর্শ হয়ে উঠেছে। হুমায়ুন আহমদের আর একটা সাফল্য- তিনি নিজে, তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এবং অগনিত ভক্তকূলকে নিয়ে নিজস্ব একটা ভুবন বা পরিমন্ডল গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

হুমায়ুনের বড় কৃতিত্ব এখানেও নয়, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র লেখক যিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকদের জন্য এদেশের বাজার সংকুচিত করে ফেলেছিলেন। বিভাগপূর্ব বাংলায় কলকাতা ছিল ব্যবসা বাণিজ্য অর্থনীতি সাহিত্য সং®কৃতির একমাত্র পীঠস্থান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা শুধু বাংলা নয় ছিল সমগ্র বৃটিশ ভারতের রাজধানী। এর আগে মাত্র ছয় বছর ঢাকা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের রাজধানী। এ সময় শিক্ষাদীক্ষা ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে ঢাকা কিছুটা সমৃদ্ধ হতে পারলেও সাহিত্য সং®কৃতি রয়ে গেছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়ার পর সব কিছু আবার আবার কোলকাতাকেন্দ্রিক কায়েমী স্বার্থবাদীদের করতলগত হয়। এই চক্রটি এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করতেও দ্বিধা করে নাই। সাহিত্য সং®কৃতির অঙ্গনের কলকাতাকেন্দ্রিক এই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি সব সময়ই ঢাকাকে দেখে এসেছে তাদের পণ্য বা বইয়ের বাজার হিসাবে। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গান্ধী নেহেরু প্যাটেল জ্যোতি বসুরা বাংলা ভাগ করে এক অংশকে ভারতের সাথে মিলিয়ে দেয়ার পরও ঢাকা রয়ে গেছিল কলকাতার কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের অবাধ চারণভূমি। এতদসত্বেও একটি নতুন স্বাধীন দেশের অংশ হিসাবে পূর্ব বঙ্গেও নিজস্ব সাহিত্যকর্ম শুরু হয়। কলকাতার মানিক বন্দোপাধ্যায় বনফুল মহাশ্বেতা দেবী শংকরদের মত লেখকদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশেও ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হাসান হাফিজুর রহমান সিকান্দার আবু জাফর সৈয়দ আলী আহসান ফররুখশিয়র বন্দে আলী মিয়া ড: আশরাফ সিদ্দিকী প্রমূখের মত লেখক কবি সাহিত্যিকদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ছিল কলকাতার বই পুস্তক পত্রপত্রিকার জন্য অবারিত বাজার। কলকাতায় প্রকাশিত সে দেশের লেখকদের বই পুস্তক পাঠকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল এদেশে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তো হয়ে ওঠে খুল্লামখুল্লা। এ দেশের এক শ্রেণীর লেখক কবি সাহিত্যিকদের জন্য কলকাতা হয়ে ওঠে তীর্থভূমি। ওপারের দাদাদের চরণামৃত পান না করতে পারলে এদের অনেকের জীবন ধন্য হতো না। কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকরাও এই সুযোগে এ দেশে তাদের হারানো বাজার পুন:প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এক সময় দেখা যায় কলকাতার তৃতীয় শ্রেণীর লেখকের বইও নকল হয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

হুমায়ুন আহমদ কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকদের এই অবাধ এবং নিরুপদ্রুত বাজারে ঝড় হয়ে আবির্ভূত হন। লন্ডভন্ড হয়ে যায় কায়েমী স্বার্থের সাজানো বাগান। সাধারন পাঠকরা ভারতীয় লেখকদের থেকে বাংলাদেশের লেখকদের দিকে ফেরেন। বাজারে ভারতীয় লেখকদের বই বিক্রির হার হু হু করে নেমে যায়। আতংকিত হয়ে ওঠেন লুটেরা কায়েমী স্বার্থবাদীরা। এদেরকে ‘ভাতে মারায়’ হুমায়ুন হয়ে ওঠেন এই গোষ্ঠীটির চক্ষুশূল। এরাই ছিলেন হুমায়ুনের সবচেয়ে বড় সমালোচক। এরাই হুমায়ুনের উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’। এদের পা-চাটা একটি বাহিনী আছে বাংলাদেশে। এরা কলকাতায় গিয়ে দাদা বলতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। দাদাদের জন্য ইলিশ মাছ বৌদিদের জন্য টাঙ্গাইলের শাড়ী নিয়ে যান, আমন্ত্রন করে ডেকে এনে রাখেন খাওয়ান গাড়ীতে করে এখানে ওখানে নিয়ে যান আবার ফেরার পথে কোচরে কিছু নগদ দক্ষিণাও গুজে দেন। এরা মনে করেন ওপারের দাদাদের সেবাযতœ না করলে তাদের জয়গানে মুখরিত হতে না পারলে নিয়মিত তাদের চরণামৃত পান না করলে বড় লেখক কবি সাহিত্যিক হওয়া যাবে না, বুদ্ধিজীবি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া যাবেনা, আনন্দবাজার গোষ্ঠীর নেক নজরে আসতে না পারলে জাতে ওঠা যাবে না। এই তল্পিবাহক সারমেয় চরিত্রের লোকগুলোর কাছেও হুমায়ুন ছিলেন একজন ‘অপলেখক’।

কলকাতার সাহিত্য সং®কৃতির অঙ্গনে হুমায়ুন কতটা অপাংক্তেয় ছিলেন তার প্রমান পাওয়া যায় তার মৃত্যুতে দায়সারা গোছের প্রতিক্রিয়া জানানোয়। আনন্দবাজারসহ বড় বড় পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের ক্রেজ এই জনপ্রিয় লেখকের মৃত্যুসংবাদ ছেপেছে মাত্র কয়েক লাইনে। কোন কোন পত্রিকা তো দুই দিন কোন সংবাদই প্রকাশ করে নাই। অথচ কলকাতার কোন তৃতীয় শ্রেণীর লেখকের মৃত্যুতে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাগুলোয় শোকের বান ডাকে। এমন হতভাগা জাতি আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকীতে এমন উদ্দাম উচ্ছাসে মেতে উঠি খোদ কলকাতার লোকেরা পর্যন্ত হা হয়ে তাকিয়ে থাকে! এমন একটা ভাব দেখাই যেন রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলাদেশেরই ঠাকুর! হুমায়ুনের মৃত্যুতে অবশ্য কলকাতার কয়েকজন লেখক মৌখিক প্রতিক্রিয়ায় শোক জানিয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তা নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ কথা সত্য হুমায়ুনের মৃত্যুতে অনেকে মনে মনে খুশীও হয়েছেন।

সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়ে গেল-, বাংলাদেশের নিজস্ব সাহিত্যাঙ্গনের দরজায় পাহাড়াদার আর কেউ থাকলো না। শংকা এই- কলকাতাওয়ালারা না বাজারটা আবার দখল করে নেয়, আবার না ঢাকায় তাদের রামরাজত্ব শুরু হয়ে যায়! একমাত্র হুমায়ুনই পেরেছিলেন ওদেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে, আর কেউ কি হুমায়ুন হয়ে উঠে আসতে পারবেন!

হুমায়ুন আহমদ আর দ্বিতীয়টি জন্ম নেবেনা তবে হুমায়ুনের কাজ অর্জন সাফল্যগুলোকে যদি ধরে রাখা যায়, তার মত করে পাঠক তৈরী করা যায় তাহলেই কেবল সাহিত্যাঙ্গনে কলকাতার আগ্রাসন রুখে দেয়া সম্ভব হবে। সং®কৃতির অঙ্গন তো গেছে। নাটক থিয়েটার সঙ্গীত চিত্রকলায় বাংলাদেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলে আর কিছু নাই। এসব ক্ষেত্রে বিজাতীয় বা পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবধারা ষোল আনা ঢুকিয়ে দেয়া গেছে, পারা যায় নাই সাহিত্যাঙ্গনে। হুমায়ুনই ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।

শোকের সাগরে মুহ্যমান অগনিত হুমায়ুন ভক্তের একটাই দায়িত্ব, বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন বইয়ের বাজার বাংলাদেশী লেখকদের জন্য ধরে রাখা, নিজেদের স্বকীয় সাহিত্য জগত গড়ে তোলা, সেখানে বিজাতীয় বিদেশী আগ্রাসন অনুপ্রবেশ ঠেকানো। তাহলেই হুমায়ুনের প্রতি দেখানো হবে যথাযথ সম্মান, তাহলেই হুমায়ুন বেঁচে থাকবেন।

মূল লেখা: সাঈদ তারেক
Click This Link
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×