somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা-কালী, মওলানা আর লোকমান ! /:)

২৮ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চারদিকে, মানুষের ঢল নেমেছে। রহিম বেপারীর উঠানে পা ফেলানো'র জায়গা নেই। লোকমানকে গত রাতে সাপে কেটেছে। উঠানের উপর একটা খেজুরের পাটিতে শোয়ায়ে রাখছে।

সবার চোখেমুখে উৎকন্টা। হিন্দুপাড়া'র বাসু ওঝা কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। বাসু নামকরা ওঝা। তবে, ওঝা ছিল বাসু'র বাপ- জুরান মালো। আশেপাশে দশ গ্রামের মানুষ, জুরান ওঝাকে এক ডাকে চিনত। কোথাও কাউকে সাপে কাটলে, সবার আগে ডাক পড়ত জুরান ওঝা'র। কাল জাইত, ক্ষইয়া জাইত, দাড়াশ, গোখরা সাপের বিষ জুরান ওঝা'র নাম শুনলেই পানি হয়ে যেত।

তিন দিনের মরা, সাপে কাটা রোগীকে ভাল করে ফেলত, জুরান ওঝা। গত বর্ষায় সন্ধ্যার দিকে, ধানক্ষেতে মাছ মারতে গিয়ে উনারে সাপে কাটে। রাতে একবার বউকে বলছিল শুধু। শুনেই বউ কান্নাকাটি শুরু করে দিল। একা একটা বাড়িতে থাকত, একটমাত্র ছেলেকে নিয়ে, বাসু। মা'য়ের কান্না শুনে ছোট বাসু কিছুক্ষণ জেগে ছিল। পরে আবার ঘুমিয়ে যায়। বউকে কড়া একটা ধমক দিয়ে কয়- চুপ কর মাগী। বেবাজনীগো মত মরা কান্না থামা।
বউ ধমক খেয়ে চুপ করে যায়। কইল, আপনে নিজের বিষ নিজে নামাইতে পারবেন না। ছামাদ ওঝারে খবর দেই।

জুরান ওঝা, আগুন চোখে তাকায় বউয়ের দিক। রাগে গরগর করতে করতে বলল- কি কইলি তুই ? কি কইলি ? ছামাদ কোন ওঝা হইল ?
দুই-একটা চিলিশ্সা পোড়া সাপে কাটা রোগী ভাল কইরাই, ছামাদ ওঝা হইয়া গেছে, না? আর জুরান ওঝা যাইবে ছামাদের কাছে- বিষ নামাইতে !
তুই চুপ কইরা বইয়া থাক। আমার কিচ্ছু ঐবোনা। শরীরের বিষরে বান-মাইরা রাখছি। কাল সকালেই কালি মন্দিরের শঙ্খপড়া জল খাইলেই ঠিক হইয়া যাবে।
বউ কিছু'টা আসস্থ হয়। ভাবে, এত বড় ওঝা। একসময় স্বামী'র পাশে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিনই জুরান ওঝা মারা যায়। সারা শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল।

বাপের মত বাসুও ওঝা হইছে। ভালই নাম ডাক হইছে। সেই বাসু যখন রোগী'র হাল ছাইড়া দিল। বেপারী বাড়ি'র সবাই চিন্তিত হয়ে গেল। মস্তফা বেপারী একবার বাসু'র কাছে আইসা বলল- ঐ মিয়া, আর একবার চেষ্টা চালাও। জান তো এখনও আছে।
বাসু রোগী'র দিকে তাকায়ে কইল, বিষ মাথায় উঠে গেছে। আপনারা কেউ একজন গৌরনদী চলে যান। গোপাল বাইদ্দ্যারে নিয়া আহেন। আমি এই রোগী'র কোন কুল পাইতাছি না।
কি সাপে কাটছে, ঠিক ঠাওর পাইতেছি না। কাল নাগ হইবার পারে মনে হয়। বলেই বাসু, আর একবার লোকমানের হাতে'র নখ দেখল, চোখের পাতা উল্টায়ে দেখল, নীল হইতাছে কিনা। বুকে হাত দিল, একবার। জান এখনো আছে। শরীর দ্রুত ঠান্ডা হইয়া যাইতেছে।

বাসু উইঠ্যা দাড়াইয়াই কইল, দেরী কইরেন না মিয়ারা। গোপাল বাইদ্দ্যারে নিয়া আহেন। উনি খবর পেয়ে গেছে। বইসা আছে।
সাপে কাটলে, ওঝা'রা টের পায়। সারা শরীরে একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। যত দূরেই থাকুক, বাড়িতে চলে আসে। রোগী'র বাড়ি থেকে লোক আসবে, এই জন্য। শুধু বুঝতে পারে না। কোন বাড়িত, কাকে কাটছে।

এরমধ্যে মসজিদ থেকে মওলানাকে ঢেকে আনা হইছে। এসে সবাইকে কলেমা পড়তে বলছে। লোকমানের পায়ে দোয়া পড়ে তিনবার থু থু দিয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে ঘোরালো।
একটু দূরে মুরুব্বীদের পাশে, একটা চেয়ারে বসতে বসতে জোর গলায় বলল, নবীজীকেও একবার সাপে কেটেছিল। পাহাড়ের গুহা থেকে। পাহাড়ী সাপ। দুনিয়ার সব থেকে বিষধর সাপ। দোয়া পড়ে থু থু দিয়ে কুন্ডলি করে দেয়ায়, বিষ পানি হয়ে গিয়েছিল।
আসেপাশের মুরুব্বীরা সবাই সোবানাল্লাহ বলে উঠল।

গোপাল বাইদ্দ্যা আর কিছক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। লোকজন এই জন্যই ভীড় করে আছে। এই অঞ্চলের সব থেকে বড় ওঝা- গোপাল বাইদ্দ্যা। কবরের থেকে লাশ উঠায়ে ভাল করছে, এমন কথাও শুনা যায় তার নামে।
ঘরের ভিতর মহিলা'রা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কে একজন চিৎকার রহিমাকে বলছে, মাদবরগো পান দিতে।

একজন গেছে ত্রীভাগদী। বেশ দূরের পথ। পায়ে হাটা পথ। মেলনী ফকিরের বাড়ি। বিস্কিট পড়া আনতে। সাপে কাটা রোগী যদি ঐ বিস্কিট খায়, তাহলে যত বিষধর সাপই হোক না কেন, রোগী এক লাফে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়াবে।
মাঝখানে একবার, মওলানা সাব উঠে দাড়িয়ে, সব মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বলল- বেগানা মেয়েছেলেরা সব ভিতর বাড়ী যান। এইখানে মচ্ছব বসায়েন না।

কে একজন দৌড়ে এসে বলল, গোপাল বাইদ্দ্যা আইতাছে। সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। অনেকেই গোপাল বাইদ্দ্যার নাম শুনেছে। কোনদিন চোখে দেখে নাই। সবার আগ্রহ এখন গোপাল বাইদ্দ্যা। কমবেশি সবাই গোপাল বাইদ্দ্যার কেরামতি'র গল্প জানে। একজন আর একজনকে বলতে লাগল।
একটু পরেই গোপাল বাইদ্দ্যা বেপারী বাড়ি'র উঠানে পা দিল।
লোকজনের মধ্যে হুরোহুরি শুরু হয়ে গেল। এক নজর দেখার জন্য। এক মধ্যে আছান বেপারী উঠে গিয়ে, চিৎকার করে, পোলাপানদের গালাগাল করতে লাগল- যাহ, রাস্তা ছাড়। উনারে আইতে দে।
ভিতর বাড়ি'র মহিলারাও কেউ কেউ উকিঝুকি দিতে লাগল।

গোপাল বাইদ্দ্যা, কাধের ঝোলা'টা থেকে সাপের মত বাকানো একটা লাটি বের করল। লোকমানের চারপাশে লাটি'টা দিয়ে একটা বৃত্ত টেনে দিল।
উপরের দিকে তাকিয়ে একটা হুংকার দিল- মা কালী রক্ষা করো। ভিতর বাড়ি'র দিকে চেয়ে বলল, মা বোনেরা সবাই চুলের বাধন খুলে দ্যান। কেউ চুলে বান রাখবেন না। তাইলে, এই রোগী আমি ভাল করতে পারব না।

ঝোলা থেকে কড়ি দেয়া একটা বীণ বার করতে করতে বলল,
একটু গরম পানি আর একটা গোল মরিচ নিয়ে আসেন কেউ একজন। আবার যেন সবার মাঝে একটা হুরোহুরি শুরু হয়ে গেল। এ ওকে বলে।

প্রায় সাথে সাথেই আরেকজন মুরুব্বী, ধমক দিয়ে বলল- মিয়া'রা সবাই একটু চুপ করেন। আপনেরা উনাকে কাজ করতে দ্যান, কথা কইয়েন না। একদম বিয়া বাড়ি বানায়ে ফেলছে।

চারদিকে কান্নাকাটির মাঝে গোপাল বাইদ্দ্যা মওলানা'র কাছে গিয়ে বলল, অনেক লেইট করে ফালাইছেন আপনারা। আরো আগেই আমার কাছে যাওন উচিত আছিল। আমি টের পেয়েই বাড়িতে ছিল। বড় লেইট হয়ে গেছে। আমি কোন টাকা পয়সা নেই না। শুধু মা'কালির মন্দিরে দুধকলা দিতে হয়। দুই'শ টাকা দিলেই হবে।
মওলানা, আবারো জোর গলায় বলল, কেউ ওঝারে দুই'শ টাকা দেও, কালী মন্দিরে দুধ-কলা দিতে হবে !

ঐদিন সন্ধ্যার সময়, লোকমান মারা গেল ! /:)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:২৩
৮টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×