somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জানোয়ারের থাবা

২৭ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা বাড়ির আঙিনায় সামিয়ানা টানিয়ে মাটিতে চট বিছিয়ে যাত্রাপালার মহড়া চলছে। সমাজিক কাহিনী নিয়ে একটি পালার মহড়া। মাস্টারদা'রঅনুরোধে মহড়া দেখতে না গিয়ে উপায় ছিল না। মাস্টারদা অ্যামেচার (সৌখিন) যাত্রা শিল্পী। কখনো নায়ক সাজেন, কখনো তবলা বাজান, কখনো বাজান ড্রামসেট। তবে হারমোনিয়ম মাস্টার হিসাবে যাত্রা জগতে তাঁর বেশ নাম ডাক আছে। তিনি মাঝে মাঝে পুরো দলের মালিক বনেও যান।
ছোটবেলা থেকে গান-বাজনা করি। এ কারণেই নিয়মিত এবং শৌখিন অনেক যাত্রা-শিল্পীর আমার সঙ্গে পরিচয়।
রোমান্টিক একটি দৃশ্যের মহড়া চলছিল। একই দৃশ্য বারবার দেখিয়ে দিচ্ছিলেন দলের পরিচালক। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিরতি দেওয়া হল। চা পানের বিরতি।
মাস্টারদা আমাকে বাড়ির একটি ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ভেতরে একটি কক্ষে মাদুর পেতে বসতে দিলেন। এর পরই গলা ছেড়ে ডাক পাড়লেন, 'সুবর্ণা... ওই সুবর্ণলতা......'
ঘরের বাইরে থেকে নারী কণ্ঠে টানা উত্তর এলো--- 'আসচি..... আসচি গো, আসচি।'
সুবর্ণলতা কাছে এলে মাস্টারদা আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'দেখো তো ইনি কে! চিনতে পারছো?'
ঘরের ভেতরে আবছা আলো। তা ছাড়া এখনই বাইরের ঝলমলে আলো থেকে এলেন। এ কারণেই হয়তো ভালো করে কিছু দেখছিলেন না সুবর্ণলতা। দুই পা সামনে এগিয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে ভালো করে দেখলেন। এর পরেই শিশুর মত চিৎকার করে উঠলেন, 'আই বাপ! আপনি!! দাদা, কেমন আছেন?'
এই বলেই আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে চাইলেন সুবর্ণলতা। আমি ওঁর দুই হাত ধরে বসলাম। বললাম, খবরদার। পায়ে হাত দিবেন না।
মাস্টারদা চা আনানোর ব্যবস্থা করালেন।
সুবর্ণলতার বাড়ি খুলনা অঞ্চলে। ভালো অভিনয় করেন তিনি। যাত্রাপালা করতে হলে অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গাইতে হয়। সে গুনটি তাঁর রয়েছে। চমৎকার গান করেন। বছর পাঁচেক আগে কোনো এক আসরে সুবর্ণলতার গান শুনেছিলাম। উনি নিজেই জানতে চেয়ে ছিলেন, তাঁর গাওয়া গান কেমন লেগেছে। আমি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলাম---- 'আমরা অভিভুত!' বলেছিলাম, 'আপনার নাম সুবর্ণা, সুবর্ণলতা দুটিই সার্থক। তবে সুকণ্ঠী বা সু হাসিনী হলেও কম সার্থক হত না।'
সামাজিক ও ঐতিহাসিক যাত্রাপালয় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন সুবর্ণলতা। কয়েকটি নিয়মিত যাত্রা দলে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। এর পর থেকে তিনিও সৌখিন-শিল্পী (অ্যামেচার) হিসাবে কাজ করছেন।
আমরা চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। এক ভদ্রলোক এক প্যাকেট সিগারেট ও একটা লাইটার নিয়ে আমাদের সামনে আসলেন। সুবর্ণলতা উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে বসার যায়গা করে দিলেন। এর পর নিজেও আবার বসলেন। আগন্তুকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে সুবর্ণলতা বললেন, 'দাদা, এঁর নাম দুলাল। আমার চতুর্থ স্বামী।'
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর (সুবর্ণলতার) মুখের দিকে। আমার দুই কানে যেন বারবার ধ্বনিত হতে লাগলো--- "চতুর্থ স্বামী"।
চা খাওয়া শেষে উঠে পরবো। ঠিক তখনই সুবর্ণলতা আমার দুই হাত ধরে বললেন, 'দাদা, এখন তো মহড়ার কাজ হচ্ছে। আপনাকে সময় দিতে পারলাম না। সন্ধ্যার পরে একবার আসুন। রাতে না হয় আমাদের সাথেই খাবেন।'
বললাম. আজ পারবো না। তবে একদিন আসবো।
দুদিন পরেই মাস্টারদা এসে ধরলেন 'আজ সন্ধ্যায় আপনাকে যেতে হবে। সুবর্ণলতা আপনাকে নিয়েই যেতে বলেছে।'
সন্ধ্যায় সুবর্ণলতার বেশ কয়েকটা গান শুনলাম। গাইলেন অন্যরাও। এরই মধ্যে রাতে খাওয়ার আয়োজন করতে চাইলেন সুবর্ণা। বললাম-- আজ মাফ করে দিন। পেটে গণ্ডগোল আছে। আরেকদিন খাবো। এই বলে ঘর থেকে, বেরুতে যাবো তখন সুবর্ণা বললেন, 'দাদা, আরেকটু যে বসতে হবে আপনাকে।'
আমি স্থির হলাম।
এক খিলি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'দাদা আজ একটা পান খান।'
আমি সুপারি বাদ দিয়ে একটু খালি পান ছিঁড়ে মুখে দিলাম। দুলাল বসে বসে সিগারেট টানছিলেন। মাস্টরিদা তখনও তবলার ডাইনায় তুন, তুন শব্দ তুলে যাচ্ছিলেন।
কথা তুললেন সুবর্ণলতা, 'দাদা, সেদিন আমি দুলালকে চতুর্থ স্বামী বলায় আপনি অবাক হয়েছেন, না? আসলেই ও আমার চার নম্বরের স্বামী।'
আমি চুপ করে বসে থাকি। মাস্টারদার তুন, তুন আওয়াজ তোলার লয় প্রলম্বিত হতে থাকে। নিজের, নিজের জীবনের কথা বলে যান সুবর্ণলতা-----
'আমার মনে হয় পাঁচ বছর আগে দেখা হয়েছিল আপনার সাথে। তখন আমি বড় দলের নায়িকা। মাঝে-মধ্যে নাচও করতাম। দল থেকে মোটা মাইনে পেতাম। আমার বাবার সংসারে খুব একটা টান ছিল না। বিয়ে করিনি। হাতে বেশ টাকাই জমে ছিল। ওই দলে থাকতেই এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় আমার। মৌসুমের শেষে বাবার অমতে বিয়ে করি আমরা। ভালোই যাচ্ছিল। তবে ভালোটা খুব বেশি দিন টেকেনি। বিয়ের চার মাসের মাথায় আমার গয়নাগাটি ও নগদ বেশ কিছু টাকা নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় আমার বর। শুধু তা-ই নয় আমাদের সাথে একই দলে কাজ করতো একটি মেয়ে, নাম কুসুম। আমার বর পালিয়ে যাওয়ার সময় কুসুমকেও ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে।
এরই মধ্যে আবার মৌসুম শুর হল। নতুন আরেকটি দলের সাথে আমার বায়না হল। ওই দলে কাজ করতে গিয়ে আবার আমাকে বিয়ে করতে হল। এবার বাবার সম্মতিতে। আমার দ্বিতীয় বর ব্যবসায়ী। বয়স একটু বেশি। সীমান্তের একটা জেলা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। উনিও আমার কাছ থেকে নগদ বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিলেন। বিয়ের দুই মাসের মাথায় আমি জানতে পারি আমার এবারের বরটি নিষিদ্ধ মাদক ব্যবসায় জড়িত। নারী পাচারেরও সুনির্দিষ্ট একাধিক অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত ছয়টি মামলার আসামী তিনি। তাঁকে সংশোধন করতে না পেরে আমি নিজেই বিয়ে ভাঙলাম।
দুবছর পর আবার আমার বিয়ে হয় একটি যাত্রা দলের মালিকে ছেলের সাথে, ঘটা করে। বিয়ের ২৬ দিনের মাথায় ও (তৃতীয় স্বামী) আমাকে বুঝিয়ে দিল, মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে, জানোয়ার হতে পারে।
মাস্টারদার তুন, তুন আওয়াজ তোলা বন্ধ হয়ে গেছে। দুলাল উঠে বাইরে চলে গেলেন।
সুবর্ণা কান্নায় ভেজা কণ্ঠে বললেন, দাদা, বেয়াদবি হলে মাফ করবেন। আমি আপনার ছোট বোন। দেখুন- হিংস্র জানোয়ারের থাবার চিহ্ন আজো আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। এই বলে ডান হাত দিয়ে সুবর্ণা তাঁর ব্লাউজের উপরের দিকটা ধরে এক টানে ব্লাউজটা ছিড়ে ফেললেন। দেখলাম, সুবর্ণার ডান স্তনের উপরিভাগের অর্ধেকটাই নেই। বাকি অংশ এবরোথেবরো কালো দাগে ভরা। দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ঝর-ঝর করে কাঁদতে থাকলেন সুবর্ণা।
সুবর্ণলতা বললেন, 'জানোয়ারটা নতুন একটি যাত্রার দল গড়ার জন্য আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। টাকা দেইনি। সে কারণে আমার ওপর শারীরিক-মানসিক অত্যচার শুরু করে। এক পর্যায়ে ওর ডান হাতের নখরযুক্ত থাবা আমাকে এভাবে রক্তাক্ত আহত করে। যার চিহ্ন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
আমরা চুপ-চাপ বসে....
সুবর্ণা শান্ত হলেন। উঠে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে আসলেন। বললেন, দাদা আরেকটু চা দিই? বললাম, হুম, দিন।
সুবর্ণলতা, মাস্টারদা আর আমি চা খাচ্ছি। দুলাল বাইরে কোথাও। চা খেতে খেতে সুবর্ণলতা বললেন, 'দাদা, দুলাল আসলে আমার স্বামী না। ও আমার সাথে থাকছে। ওকে প্রতি মাসে আমি বেতন দিই। আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে নিজেকে জানোয়ারের থাবা থেকে আগলে রাখতে আমাকে বলতে হয় দুলাল আমার স্বামী।'
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৫:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা শহর ইতিমধ্যে পচে গেছে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



স্থান: গুলিস্থান, ঢাকা।

ঢাকার মধ্যে গুলিস্থান কোন লেভেলের নোংড়া সেটার বিবরন আপনাদের দেয়া লাগবে না। সেটা আপনারা জানেন। যেখানে সেখানে প্রসাবের গন্ধ। কোথাও কোথাও গু/পায়খানার গন্ধ। ড্রেন থেকে আসছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×