ইমদাদুল হক মিলন খুব সুন্দর করে কথা বলেন, এরকম সুন্দর করে তিনি যদি লিখতে পারতেন তাহলে হুমায়ুনের আহমেদের মহাপ্রয়াণের পর আমাদের সাহিত্য বা প্রকাশনা শিল্প নিয়ে এত আতঙ্কিত না হলেও চলত। তার অর্থ এই নয় যে ইমদাদুল হক মিলন খুব খারাপ লেখেন। যেমনটা হুমায়ুন স্যার নিজেই তার সম্পর্কে বলেছেন, লেখালেখিতে মিলনের অনেক প্রতিভা কিন্তু সে প্রতিভার অপব্যবহার করেছে। আমার যদি ভুল না হয় তবে আমি নিশ্চিত তিনি অপব্যবহার শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। এটাও হুমায়ুন আহমেদের বর্ণিল চরিত্রের একটি দিককে তুলে ধরেছে। ঘনিষ্ট বন্ধু ও প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক সম্পর্কে অকপটে এমন কথা আর কে বলতে পারে!
এমনি আরো কত গুণেই না গুণান্বিত ছিলেন আমাদের সাহিত্যের রাজপুত্র। তবে ইমদাদুল হক মিলনের প্রাপ্য প্রশংসা করতেও তিনি ভুলেননি। তিনি বলেছেন, মিলন যত বই পড়েছে তা আর কেউ পড়েছে বলে তার মনে হয় না। কখনো হয়ত তার কোন বইয়ের লাইন মনে পড়েছে কিন্তু মনে করতে পারছেন না কোন লেখকের বা কোন বইয়ের লাইন এটি।তাঁর ভাষায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে মিলনকে ফোন দিই। ও সাথে সাথে বলে দিতে পারে কোন লেখকের কোন বইয়ের লাইন এটা।
এবার একটু সিরিয়াস বিষয়ে আসি। একজন লেখক কার জন্য লেখেন? কেউ লেখেন পাঠকের জন্য। কেউ নিজের জন্য। কেউ আরো নানা কারণে লিখতে পারেন। হুমায়ুন আহমেদ লিখতেন তাঁর নিজের জন্য। যতটা মনে পড়ে তিনি বলেছেন আমি লিখতে গিয়ে নিজে খুব আনন্দ পাই। এরপর পাঠক পাঠিকারা যদি আনন্দ পায় তবে আনন্দ আরো বেড়ে যায়। তাঁর লেখালেখির এই আইডিওলজিটা আমি আদর্শ হিসেবে নিয়েছি। কেউ না ছাপুক আমার লেখা, কারো ভাল না লাগুক তবু আমি লিখে যাব। কারণ লিখে আমি অপার আনন্দ পাই। আর ব্লগ বা ফেসবুকে দু একজন মানুষেরও যদি ভাল লাগে আমার লেখা তবে তো কথাই নেই। আর যাদের ভাল লাগে না আমার লেখা তাদের উদ্দেশ্যে আমার কথা হল, কারো কারো কাছে আমার লেখা কোনদিনই ভাল লাগবে না এটা জেনেই আমি লিখে যাব।
হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত অনেক দেখা যাচ্ছে তবে তাঁর সমালোচকও কম নয়। এবং আমার দুর্ভাগ্য যে আমি তাঁর লেখার ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাকেও হয়ত তাঁর সমালোচক বলা হবে। কারণ আমি রম্য লিখতে চেষ্টা করি। প্রতিটা রম্য লেখকই একজন সমালোচক। সমালোচনা থেকে রস বের করাই তো রম্য লেখকদের লেখার প্রধান উপকরণ। তবে আমি কখনো হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যের সমালোচনা করিনি। কারণ সে যোগ্যতাই আমার নেই। তাঁর ব্যক্তিগত যে বিষয়টা নিয়ে অন্যরা সবচে বেশি সমালোচনা করেছে সেটা নিয়েও আমি সমালোচনা করিনি।
আমি সমালোচনা করেছিলাম তাঁর বহুত দিন হোয়ে কলামটা নিয়ে যেটা তিনি প্রতিবেশী দেশের সিনেমা আমদানীর পক্ষে লিখেছিলেন। সে ব্যাপারে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা অবস্থান থাকতে পারে... কিন্তু তাঁর অবস্থান আমার পছন্দ হয়নি সেসময়। আর তাঁর দু একটা সিনেমাও আমার অতটা ভাল লাগেনি। অর্থাত হুমায়ুন আহমেদ মানের হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে।
কিন্তু যারা তাঁকে বাজারী সাহিত্যিক বলে তাদের এই শব্দটা তাঁর সাহিত্যকর্মের সাথে বড় একটা অবিচার, অহেতুক সমালোচনা। আমার যতদূর মনে হয় যারা তাঁকে বাজারী সাহিত্যিক বলে তারাও লেখালেখি করেন। তো তারা এমন একটা লেখা লিখে দেখান না যে এমন একটা চরিত্র তৈরী করলেন তার ফাঁসি দিলেন বা মৃত্যু ঘটালেন তারপর তার প্রতিবাদে রাস্তায় বের হয়ে মানুষ মিছিল করেছে! পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট লোকদের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। সেরকম একটা লেখা আগে লিখেন তারপর আলোচনা করা যাবে তিনি সত্যিই বাজারী সাহিত্যিক ছিলেন কী না!
আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমার জানামতে পৃথিবীতে এরকম আর একটি মাত্র চরিত্র বাকের ভাইয়ের মত এত জীবন্ত হয়েছে সেটা হল শার্লক হোমস। তাকেও একবার মেরে ফেলা হয়েছিল। ভক্তদের চাপে কোনান ডয়েল আবার তাকে জীবিত করেছিলেন। শার্লক হোমসের বেকার স্ট্রীটের বাসার যে ঠিকানা তিনি বইতে উল্লেখ করেছিলেন সেই ঠিকানায় আজও শার্লক হোমসের নামে চিঠি আসে।
সুতরাং হুমায়ুন আহমেদ বিশ্বমানের লেখক ছিলেন। তাঁকে আমি তুলনা করি এভাবে তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের ম্যারাডোনা। বাংলা সাহিত্যে পেলে জিকো সক্রেটিস অনেক থাকতে পারে কিন্তু ম্যারাডোনা একজনই। আর্জেন্টিনাকে কয়জন চিনত? ম্যারাডোনা তাঁর পায়ের জাদুতে পুরো বিশ্বে নিজেকে এবং নিজের দেশকে পরিচিত করিয়েছেন। ঠিক তেমনি হুমায়ুন আহমেদও বাংলাদেশী সাহিত্যকে তাঁর কলমের জাদুতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, দিয়েছেন নিজস্ব পরিচয়। আমি নিশ্চিত তাঁর লেখা যত্ন নিয়ে অনুবাদ করলে তিনি অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হবেন। শুনেছি তাঁর কিছু লেখা অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে আরো ব্যপকভাবে হওয়া উচিত।
পরিশেষে বলি, বিদায় জাদুকর। আপনার বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করি।
পুনশ্চ- তাঁর জন্য অনেক শোকবই খোলা হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনটির কাছে নেই। থাকলে শোকবইতে লিখতাম...” খেলোয়াড ম্যারাডোনাকে আমরা বিশ্বের অগণিত অনুরাগী যে স্থান আমাদের অন্তরে দিয়েছি, সাহিত্যের সে জায়গাটা আপনার জন্য। আপনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের ম্যারাডোনা... যাদের হয়ত হাজার বছরে পেতেও কষ্ট হয়। আমাদের সৌভাগ্য আমরা দুজন ম্যারাডোনাকে একই সাথে দেখলাম”