somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পৌরসভা এবং নগর পরিকল্পনাবিদ: সম্ভাবনা ও অন্তরায়

১৮ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময়, চাহিদা এবং উপযোগিতার কথা ভেবেই সারা বিশ্বে আজ ‘নগর বা শহর পরিকল্পনা’ বিষয়টি সর্বজনবিদিত। সারা বিশ্বের সকল বড় শহর, সিটি কর্পোরেশন এবং মিউনিসিপালিটির জন্য ‘নগর পরিকল্পনা’র জন্য আলাদা বিভাগ এবং ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ রয়েছেন। বাংলাদেশেও যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে, ঢাকা সহ সকল সকল সিটি কর্পোরেশন এবং ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভার জন্য ‘নগর পরিকল্পনা’ শাখা চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশে পৌরসভা্ পর্যায়ে নগর পরিকল্পনার আইনানুগ দায়িত্ব যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে ‘আরবান ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইউডিডি) এর কিন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহরের মহাপরিকল্পনা করছে স্থানীয় সরকার এবং প্রকৌশল অধিদপ্তর বা এলজিইডি।যদি ও আইনানুসারে তাদের অবকাঠামো উন্নয়ন করবার কথা। তারা ভুমি ব্যাবহার পরিকল্পনা এবং মাস্টার প্লান এর কাজ দিয়েছেন বিভিন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কে।বেশিরভাগ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধামত ভুমি ব্যাবহার পরিকল্পনা এবং মাস্টার প্লান করছেন খুবই অল্প বাজেটে অথচ তা স্টান্ডার্ড ভূমি ব্যাবহার এর অন্তরায়। এসব ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনার চাইতে অবকাঠামো উন্নয়নেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অথচ অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন মানেই আরেকটি অপরিকল্পিত শহর তৈরি করা।একটি শহরে নগর কর্তৃপক্ষের (নগর পরিকল্পনাবিদ্দের) হাতে সাধারণত নগর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভার নিয়োজিত থাকে (উদাহরণঃ ভারত, ভুটান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ)এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (যেমনঃ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। সেখানে পৌরসভা্ পর্যায়ে ‘নগর পরিকল্পনা’ শাখা এখন পর্যন্ত ‘প্রকৌশল বিভাগ’এর অধীনে এবং মাত্র একজন পরিকল্পনাবিদ এর পদ রয়েছে যা ক্রমবর্ধমান জনসংখার দেশে খুবই অপ্রতুল। ফলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই পৌরসভা পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের এবং বিল্ডিং নিয়ন্ত্রণ ভার এলজিইডি এবং পৌরসভার ‘প্রকৌশল বিভাগ’ এর ‘প্রকৌশলী’দের হাতেই ন্যাস্ত। ২০০৫ সালে জারী করা পৌর কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কার্যাবলী অনুযায়ী পরিকল্পনা বিষয়ক সকল কাজের দায়িত্বভার ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ এর হলে ও কোনো পৌরসভা্তেই তা আদৌ কার্যকর করা হয় নাই।

মানুষ শহরে আসে সাধারণত কাজ, শিক্ষা, চিকিতসা, ব্যাবসা, উন্নত বাসস্থান এবং আরো নানাবিধ প্রয়োজনে।এর ফলে শহরে বাড়ছে মানুষের চাপ এবং বস্তির সংখা, পানিয় জলের অভাব, বাসস্থানের অভাব, যানযট, বর্জ্য নিষ্কাশনের অব্যাবস্থাপনা এবং অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা।নগরে জনসংখা বৃদ্ধির হার বেরেই চলেছে (বর্তমানে ৩০% লোক শহরে বসবাস করছেন এবং ২০৫০ সালের মাঝে ৫০% লোক শহরে বসবাস করবেন বলে ধারনা করে হয়েছে)। দাতা সংস্থাগুলো (যেমন, ADB, World Bank, JICA, GIZ, Water Aid, UN)শহর পরিকল্পনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার দিচ্ছে সেখানে পরিকল্পনা শাখা এবং পরিকল্পনাবিদগণ রয়েছেন উপেক্ষিত। ভূমি ব্যাবহার পরিকল্পনা এবং মাস্টার প্লান প্রকল্পের বেশিরভাগ পরিচালক ই ‘সিভিল ইঞ্জিনীয়ার’ অথচ দেশে এখন পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ নগর প্ররিকল্পনাবিদ রয়েছেন। বেশিরভাগ পৌর-প্রকৌশলীর নেই নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারনা। অনেক ক্ষেত্রেই ‘প্রকৌশল বিভাগ’ এর প্রধান একজন ‘ডিপ্লমা সিভিল ইঞ্জিনীয়ার’।যদিও ‘নগর পরিকল্পনা’র শাখার ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী এবং সেই সাথে পরিতাপের বিষয় এই যে সেটি একটি ব্লক পোস্ট অর্থাৎ কর্মজীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তাকে এই পদেই বহাল থাকতে হবে।

বর্তমানে মোট ৬০ টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা্য ৬০ জন নগর পরিকল্পনাবিদ কর্মরত আছেন যাদের ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩টি নিয়োগের মাধ্যমে নিযুক্ত করা হয়েছে।এই মুহূর্তে পৌরসভা্ পর্যায়ে সব চাইতে বেশি নগরপরিকল্পনাবিদ কর্মরত আছেন এবং তাদের সবাই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়েছেন সেই সাথে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা বিষয়ে সঠিক তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞান লাভ করেছেন। অনেকেই বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ফিরে এসে আবার কাজে যোগদান করছেন। সরকারি চাকুরিতে (বিশেষ করে BCS cadre হিসেবে) ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ পদ না থাকা, সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে স্বল্প সংখক ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ পদ এবং বিদেশে ভালো পড়াশোনা এবং চাকরির সুযোগ এর কারনে যেখানে অধিকাংশ মেধাবী পরিকল্পনাবিদ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বা দেশে অধিক বেতনে বেসরকারি চাকরি করছেন সেখানে পৌরসভা্ পর্যায়ে নিয়োগের কারনে অনেক মেধাবী তরুণ পরিকল্পনাবিদ কাজ করবার উতসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ, ভালো পরিবেশ, প্রমোশন না থাকা (কাজের স্বীকৃতির পুরষ্কার), অনিয়মিত বেতন, সরকারি চাকুরিতে অগ্রাধিকার না থাকার কারনে তরুন ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’গণ এই পেশায় থাকবার ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছেন পৌর-প্রকৌশলীবৃন্দ।

অন্যান্য আরো সমস্যার মাঝে যুক্ত আছে মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিয়োগদানের পরেও মেয়র কর্তৃক গৃহীত না হওয়া, এক ই পোস্ট এ একাধিক পরিকল্পনাবিদ এর মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিয়োগদান (যেখানে পোস্ট একটি), কার্যাবলী নির্দিষ্ট না হওয়া, চাকুরি পরবর্তী প্রশিক্ষণের অভাব, উন্নয়ন সংক্রান্ত মিটিং এ তাদের কে সংযুক্ত না রাখা বা মতামত অগ্রাহ্য করা, তথাকথিত ‘সিভিল ইঞ্জিনীয়ার’, ‘স্থপতি’ কিংবা ‘ভূগোলবিদ’ দের পরিকল্পনা ডিগ্রী ছাড়াই ‘পরিকল্পনাবিদ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ এমনকি অফিসে তাদের কে প্রশাসনিক সুবিধা (প্রথম শ্রেণির জন্য)থেকে বঞ্চিত করা।এ সকল বিষয় ই তাদের কাজের জন্য হুমকিস্বরুপ।

সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ‘নগর পরিকপল্পনা বিষয়টি’ গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হচ্ছে।বাংলাদেশেও যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ‘নগর এবং অঞ্চল পরিকল্পনা’ বিষয়ে মাষ্টার্স চালু হয় ১৯৬০ সালে বুয়েটে। কালের পরিক্রমায় ১৯৯১ সালে প্রথম ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ এই বিষয়ে ব্যাচলর কোর্স চালু হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালে বুয়েট এবং জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ব্যাচলর কোর্স চালু হয়। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এখন রুয়েট, কুয়েট এবং চুয়েট এও ‘নগর এবং অঞ্চল পরিকল্পনা’ ব্যাচলর কোর্স চালু করা হয়েছে।কিন্তু সময়োপযোগী কাজের পরিবেশ তৈরী করে না দিলে এইসব মেধাবী শিক্ষার্থীবৃন্দ বিদেশেই পাড়ি জমাবে যা মেধার অপচয় (Brain drain)। বাংলাদেশের মেধাবী পরিকল্পনাবিদগণ বিদেশে তাদের কাজের দক্ষতার মাধ্যমে সুনাম অর্জন করেছেন এবং সেখানে উন্নয়নের অংশিদার হয়েছেন অথচ দেশে তাদের কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছেনা।

পৌরসভা্ পর্যায়ে কাজের প্রতিবন্ধকতা গুলো নিরাসন করা হলে, ‘নগর পরিকল্পনা’ এর আলাদা বিভাগ করা হলে, কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ প্রমোশন দেয়া হলে, পৌরসভা্ ও সিটি কর্পোরেশন এর মধ্যে ট্রান্সফার এর ব্যবস্থা করা হলে, সরকারি চাকুরিতে (বিশেষ করে BCS cadre হিসেবে) ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’ পদ সৃস্টি করা, প্রশাসনিক ও জন সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের সম্পদ কাজে লাগানো যেতে পারে এবং শহরের সুন্দর, পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে সুষ্ঠ উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:২৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×