somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাঁঠাল-পাচালি

১৮ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের দেশে সম্প্রতি ভাতের বদলে আলু খাওয়ার একটা শ্লোগান চলছে। সরকারের হোমরা-চোমড়া ব্যক্তিরা আলু খাওয়ার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। ক্ষমতাসীনরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে কী হবে, উপদেশ বিতরণ কিন্তু ঠিকই অব্যাহত রেখেছেন। মানুষের বয়স আর সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর অপকর্মের মতো চালের দাম কেবলই বাড়ছে। মোটা চালও এখন ৩৮/৪২ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে। সাধারণ মানুষ মোটা চাল কেনার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে। চালের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে এখন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু আলুর বাজারদরও এখন চড়া। তবু ভালো যে কর্তাব্যক্তিরা আমাদের ঘাস কিংবা অন্যকিছু খেতে বলেননি, আলু খেতে বলেছেন। আমরা যারা আমজনতা আছি, তারা তো বর্তমানে কলুর বলদ। প্রভুরা যা বলবেন আমাদের জন্য তাই সই। প্রভুরা যদি আমাদের প্রতিদিন এক আঁটি করে ঘাস খেতে বলতেন এবং দিনান্তে প্রত্যেককে অন্তত এক কেজি করে দুধ দিতে বলতেন তাহলেইবা আমাদের কী করার ছিল? কলুর বলদের কাছে প্রভুর উপদেশ-নির্দেশই তো আইন!
উৎপাদন বাড়ানো কিংবা দাম নিয়ন্ত্রণ না করে আমাদের ভাতের বদলে ঘাস খেতে বলা হবে, ফ্যান খেতে বলা হবে, আস্ত কাঁঠাল কিংবা ফুলকপি ট্যাবলেটের মতো গিলে খেতে বলা হবে- এ আর বিচিত্র কী? এরপর যদি প্রত্যেকের জন্য কাঁঠাল পাতা ও ভ্যাঁ ভ্যাঁ বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে (আমার স্যার সরদার ফজলুল করিমের ভাষায় ‘গণতন্ত্র অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম, তাই গণতন্ত্র’, সেই বিবেচনায় আমরা তো বর্তমানে ‘মহা-গণতন্ত্রের’ মধ্যেই আছি) যা খুশি বলার এবং করার ক্ষমতা সবারই রয়েছে।
আপাতত আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ ছাড়া অন্য কোনকিছু খেয়ে বাঁচার মতো অবস্থা বা ব্যবস্থা আমাদের নেই। বক্তৃতা আর উপদেশ ছাড়া কোনকিছুই এখন আর সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এভাবে বক্তৃতা খেয়ে আমরাই-বা কতদিন বাঁচব? আর বক্তৃতা খাইয়ে প্রভুরাই-বা কতদিন টিকবেন?
* * * * *
না, দেশে এখন কোনকিছুই আর সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে না। ভাতের বদলে যে আমরা কাঁঠাল খাবো, তারও জো নেই। কাঁঠালও বর্তমানে আমাদের কাছে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এই কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। এর অনেক গুণ রয়েছে। এর পুষ্টিমান যেমন উঁচু, তেমন ফলেও প্রচুর। একগাছেই শত শত কাঁঠাল। আর একটি কিনলেই পুরো পরিবার মনভরে খেতে পারে। এর কোনঅংশই ফেলনা নয়। মানুষ যে অংশটুকু খেতে পারে না, সেটুকু গরু-মহিষের প্রিয় খাবার। একটা সময় পর্যন্ত কাঁঠাল বেশ সস্তায় পাওয়া যেত। এখন অবশ্য অন্য সবকিছুর মতো কাঁঠালেরও দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। যে কাঁঠাল এক সময় ছিলো ফেলনা, অবহেলিত, সেই কাঁঠালও এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। এর গন্ধ আকর্ষণ করলেও দামের কারণে সবাই কাছে-ভেরার সুযোগ পায় না। আপেল বা আঙ্গুরের মতো কাঁঠালও এখন মহার্ঘ্য ফল। অল্প কিছু সৌভাগ্যবান টাকাওয়ালা মানুষই শুধু এর রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পান। বড়লোকের রূপসী মেয়ের প্রতি মধ্যবিত্ত কিশোরের দীর্ঘশ্বাসের মতো কাঁঠালও এখন সাধারণ মানুষের মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
অথচ এই কাঁঠাল কিন্তু মাত্র ১/২ বছর আগেও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। তখন বরং মানুষের মধ্যে কাঁঠাল সম্পর্কে এক ধরনের উপেক্ষার মনোভাব লক্ষ্য করা যেতে। এর অবশ্য কারণও ছিল। কাঁঠালের অনেক গুণ থাকলেও রূপের তেজ বলে কিছু ছিল না। কালো মেয়ের মতো কাঁঠালের রূপেও কোন আগুন খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং গুটি বসন্তের দাগের মতো শরীরজুড়ে কাঁঠালের অনাকর্ষণীয় ক্ষত আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই করে বেশি। এই বাহ্যিক রূপের কারণেই কাঁঠাল অনেক সময় অবজ্ঞা বা উপেক্ষার শিকার হয়েছে। এখন অবশ্য কাঁঠালের সেই দুর্দশা আর নেই। কাঁঠালও এখন মূল্যবান ফল। দামের গুণে তা এখন বড়লোকের অন্দরমহলে পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে যেতে পারছে। রূপ এ ক্ষেত্রে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কাঁঠালের এই উন্নতি বা উত্থানের পেছনে বিগত জোট সরকার ও বর্তমান সরকারের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। গত সাত বছরে আমাদের দেশে মানুষের জীবন ছাড়া সবকিছুরই দাম বেড়েছে। বেগুন, আনারস, কচু এবং কাঁঠালেরও দাম বেড়েছে। আর দামের সঙ্গে আমাদের সমাজে যে কোন বস্তুর ‘জাতে ওঠা’ নির্ভর করে। এ যুগে দামের ওপরই নির্ভর করে ওই বস্তুর মর্যাদা। যে জিনিসের দাম বেশি তা সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। তখন সেটা বড়লোকদের একচেটিয়া ব্যাপারে পরিণত হয়। কাঁঠালও তেমনিভাবে বড়লোকের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরিব বা ছোটলোকরা এখন শুধু চোখ দিয়েই কাঁঠাল দেখে; চেখে দেখার সুযোগ পায় না। একটি অবহেলিত দুর্দশাগ্রস্ত ফলকে এভাবে বড়লোকের হাতের মোয়াতে পরিণত করার জন্য সরকারকেই সাধুবাদ জানাতে হয়।
কাঁঠাল এখন হতাশার নাম, বঞ্চনার নাম। মানব সমাজে বুদ্ধিজীবীরা যে বৈশিষ্ট্য, ফল সমাজে কাঁঠালের অবস্থানও অনেকটা সেইরকম। বুদ্ধিজীবী যেমন যৌবনের চেয়ে বার্ধক্য পৌঁছে অধিক গুরুত্ব ও মর্যাদা পান, কাঁঠালও ঠিক তেমনি। ‘যৌবনে নাহিকো রস রসিক যুবতী, বৃদ্ধকালে হয় সে অতি রসবতী!’
আমাদের জীবনে কাঁঠালের ভূমিকা অপরিসীম। যদিও অধিকাংশ পাবলিকই কাঁঠাল খেতে পায় না। এখন ভাত খাওয়ার মতো কাঁঠাল খাওয়াও অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। আমরা বাঙালিরা কলা খাওয়ার চেয়ে যেমন কলা দেখেছি বেশি, কাঁঠালের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা। গাছের কাঁঠাল গাছেই থেকেছে, অথচ আমরা মিছেমিছে ঢোক গিলেছি, আঁঠার ভয়ে অস্থির হয়েছি। তবে কাঁঠালের চেয়ে এর আঠা অধিক ভয়ানক বা বিপজ্জনক। অধিক ক্ষমতাবানও। মন্ত্রীর চেয়ে যেমন আমলা। নেতার চেয়ে যেমন নেতার-হাতা। কাঁঠালের আঠা যদি একবার শরীরে, কাপড়ে বা গোঁফে লেগে যায় তাহলে সহজে তা ছাড়ানো যায় না (কিশোর-কিশোরীর নাছোরবান্দা প্রেমকে তাই বুঝি কাঁঠালের আঠার সাথে তুলনা করা হয়!)। এটি অনেকটা বিএনপির সঙ্গে জামাতের সম্পর্কের মতো। ক্ষমতার সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মতো। কিংবা বড়ো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোন্দলের মতো। একটির সঙ্গে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। একবার লাগলেই খেল খতম। যা সুপারগ্লুর চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
এই আঠার কারণে কাঁঠাল নিয়ে অনেক বিপত্তি ঘটে। গোঁফে একবার যদি আঠা লেগে যায় তাহলেই মহাসর্বনাশ। সাবধানীরা তাই কাঁঠাল খাওয়ার আগে গোঁফে ভালমতো তেল মেখে নেন। কেননা তৈলাক্ত গোঁফে আঠা খুব একটা সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় না। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাও এখন মুস্কিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশের মানুষ অবশ্য খুব একটা সাবধানী নয়। তারপরও কেন জানি অনেকে গাছে কাঁঠাল দেখলেই গোঁফে তেল মাখতে শুরু করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হাতে বা মুখে এসে পৌঁছায় না। তেল মাখাই সার হয়। অল্প কিছু লোক সব কাঁঠাল মজা করে খায়। তাদের তৈলাক্ত শরীরে আঠাও কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। এদেশের বঞ্চিত মানুষগুলো ভাগ্য বদলের জন্য কাঁঠালের স্বাদ পাওয়ার জন্য শুধু গোঁফে তেলই মেখে গেছে; কিন্তু কাক্সিক্ষত কাঁঠাল গাছ থেকে, মুষ্টিমেয়র হাত থেকে কখনোই তাদের নাগালের মধ্যে আসেনি।
ক্ষমতায় যেই গেছে, তারাই মহানন্দে মনের সাধ মিটিয়ে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে। নির্বোধ জনগণ উচ্ছিষ্টও ভাগে পায়নি। তারপরও তারা আশা ছাড়েনি। গোঁফে তেল মেখেই যাচ্ছে। এবার না হয় গাছের কাঁঠালগুলো হাতছাড়া হলো, আগামীবার নিশ্চয়ই মিলবে। কিন্তু হায়। সেই আগামী আর আসে না। সাধারণ মানুষ কাঁচকলা দেখার মতো শুধুই কাঁঠাল দেখে। আমাদের জীবনের এই অব্যাহত কাঁঠাল-বঞ্চনার বিরুদ্ধেও কী আমরা সবাই মিলে একবার রুখে দাঁড়াব না?

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেলা ব‌য়ে যায়

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩০


সূর্যটা বল‌ছে সকাল
অথছ আমার সন্ধ্যা
টের পেলামনা ক‌বে কখন
ফু‌টে‌ছে রজনীগন্ধ্যা।

বাতা‌সে ক‌বে মি‌লি‌য়ে গে‌ছে
গোলাপ গোলাপ গন্ধ
ছু‌টে‌ছি কেবল ছু‌টে‌ছি কোথায়?
পথ হা‌রি‌য়ে অন্ধ।

সূর্যটা কাল উঠ‌বে আবার
আবা‌রো হ‌বে সকাল
পাকা চু‌ল ধবল সকলি
দেখ‌ছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×