somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতি হিসাবে আমরা কি অকৃতজ্ঞ?

১৬ ই জুলাই, ২০১২ রাত ৯:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান সম্পর্কে ছোট বেলা থেকেই আমার একটা ইতিবাচক ধারনার ছিল। ভূগোলের অআকখ না জানলেও শুধু সূর্য ঐ দেশে প্রথম দেখা যায় এ জেনেই আমার কেন জানি মনে হত ওরা পৃথিবীতে অন্যসব কিছুতেও প্রথম। পরবর্তীতে বিটিভিতে জাপানী বেশ কিছু অনুষ্ঠান দেখে আমার জাপান প্রীতি আর বেড়ে যায়। একটু বড় হওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে “অশিন” নামে একটি জাপানী ধারাবাহিক অনুষ্ঠান দেখে জাপানিদের অন্য গ্রহের মানুষ মনে হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিতর্কিত সংশ্লিষ্টতা বা পার্ল হারবারের কাপুরুশচিত হামলাও ছোটবেলার জাপান প্রীতিতে একচুল পরিমাণও খাদ মিশাতে পারেনি। এক কথায় বলা যায় নিখাদ জাপান প্রেমী। বড় হয়েছি, অনেক কিছু দেখছি, এখন ভালোলাগা আর ভালবাসা অনেকটা “কজ অ্যান্ড ইফেক্ট রিলেসনশিপ” এর মারপ্যাঁচে তৈরি হয়। তারপরেও স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের প্রতি জাপান বা সে দেশের নাগরিকদের যে নিখাদ ভালবাসা তা দেখে ছোটবেলার সেই প্রীতিটা কেন জানি মাথাছাড়া দিয়ে উঠে। ৯০’র শেষের দিকের মন্দা, ২০১১’র ভূমিকম্প আর সুনামিতে বিপর্যস্ত অবস্থার পরও আমাদের প্রতি এই বন্ধুপ্রতিম দেশের হাত খুলে সহযোগিতার মনোভাব আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে। ১৯৭২ সালে নাড়ীর যে বন্ধন রচিত হয়েছিল তা আজও বলবৎ। বিদেশী সাহায্যের দিক থেকে এখন পর্যন্ত জাপানই আমাদেরকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে। তারপরেও তাদের দেশের কূটনীতিকদের আচরণ মার্জিত ও ভদ্রোচিত, তারা আমারিকা আর ইউরোপের দেশের মত আমাদের লিল্লাখোর আর ভুখা নাঙ্গা জাতি হিসাবে দেখে না, দেখে এক সহযোগী আর বন্ধু হিসাবে। কিন্তু তার বদলে আমরা জাপানি বন্ধুদের কি প্রতিদান দিয়েছে?

কয়েকদিন আগে জাপানি উপপ্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। একই সময় মিসেস ক্লিনটনও আমাদের দেশের মেহমান ছিলেন। অনেকেই বলেন হিলারিকে নাকি জোর করে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল! বিমান বন্দরে থেমে থাকা প্লেনের ভিতর বসে থেকে আমাদের প্রত্যুৎমতি(?) মন্ত্রী দিপু মনিকে ভি.আই.পি টারমাকে দাড় করিয়ে রেখে তার ভালই প্রতিদান দিয়েছেন। শুধু তাইনা, সরকারকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বের দুই নামকরা সুদখোরের সাথে তার একান্ত মোলাকাত বাংলাদেশ সরকারকে এ যাত্রায় দ্বিতীয় বারের মত লজ্জায় ফেলেছিল (তারা লজ্জা পেয়েছেন বলে মনে হয়নি)। আর পুঁজিবাদের নষ্ট টাকায় গড়ে উঠা টিভি স্টেশনগুলি দুই দিনত এক কথায় হিলারিতে বুঁদ ছিল। যারা যারা বিশিষ্ট (কু)সাংবাদিক মুন্নি সাহার সাথে তার ইটিশ পিটিস মার্কা সাক্ষাতকার দেখেছেন তাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। দুই অসম ক্ষমতার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই লীলাখেলায় কি অনাদরটাই পেলেন জাপানি উপ প্রধানমন্ত্রী। অথচ জাপানি মন্ত্রীর সফরটাই গুরুত্বপূর্ন হওয়ার কথা ছিল সেটা বন্ধুত্তের খাতিরেই হোক বা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে।

১১ই মার্চ, ২০১১, সকালে বেলা হাতে চা নিয়ে খবর দেখতে টিভি খুলেছি কিন্তু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা? জাপান ভাসছে, জাপান পুড়ছে, ভয়ার্ত মানুষগুলি প্রান ভয়ে ইতি উতি দৌড়ছে পিছনে তাদের ৮ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস! ১ ঘণ্টার তান্ডবে পুরো জাপান ছারখার। এক বছর পূর্তির পর জানা গেল ১৫,৮৬১ টি তাজা প্রান চিরতরে হারিয়ে গেছে, এখনও নিখোজ প্রায় ৩,০০০ জন আর আহতের সংখ্যা প্রায় ৬,০০০, অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় $২৩৫ বিলিয়ন ডলার (WB, ২০১১‘র পুরান হিসাব অনুযায়ী) যা আমাদের জিডিপির চেয়েও বেশী! ভুমিকম্পের কারনে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশাল বিস্ফোরণ হল। সবমিলিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থা, জাপানের এমন দুর্দিনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আজ তারা ক্ষয় ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে মোটামুটি থিতু হতে পেরেছে।

১৫ই মার্চ, ২০১১’তে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি তেজস্ক্রিয়তার ভয়ে টোকিওতে বাংলাদেশ মিশন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বিদেশী মিশনগুলির মাঝে বাংলাদেশই প্রথম (এমনকি পশ্চিমাদেরও আগে) এই ধরনের ঘোষণায়। কথায় আছে বিপদেই বন্ধুকে চেনা যায়, জাপান সরকার বা সে দেশের মানুষ সেদিন কি ভেবেছিল এটা ভেবেই আমি লজ্জা পাচ্ছি। ৭২’রে আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের স্বীকৃতি দেয়া জাপান আমাদের জন্য কি করেনি, কোন ব্রিজটাতে তাদের ঋণ বা অনুদান নেই, আমাদের কোন দুর্যোগে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়নি? একটি, মাত্র একটি উদাহরন চাচ্ছি আপনাদের কাছে কেউ কি আছেন?

ফুকুশিমাতে পারমানবিক দুর্ঘটনার জেরে টোকিওতে কি প্রভাব পরেছিল তা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই জানেন। স্কুল খোলা ছিল অফিসও হচ্ছিল নিয়মিত সেই পরিবেশে মিশন বন্ধ করার ঘোষণা কি ইঙ্গিত বহন করে তা পাঠকরা বুঝতে পারছেন বলে মনে হয়। জোর করে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেই কেউ দায়িত্ববান হয় না। “পজিটিভ ডিসক্রিমিনেসন” বলে একটা কেতাবি কথা আছে, যেখানে নারীদের এগিয়ে নেয়ার জন্য সামর্থের অধিক ক্ষমতা দেয়া হয়, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, শ্রম এই তিনটি মন্ত্রনালয়ের আজব কর্মকাণ্ডে “পজিটিভ ডিসক্রিমিনেসন” এর আর কোনও পজিটিভ উপাদান অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।

জাপান ভদ্রলোকদের দেশ, অভদ্রতার জবাব তারা ভদ্রভাবে দিয়ে থাকে। জাপানি উপ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষের আগে দেয়া বিবৃতিতে বলেছেন, জাপান বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, জাপানী জনগণ তাদের করের টাকায় বাংলাদেশী মানুষের উন্নতি দেখতে চায়। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক আর এডিবি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও জাপান এখন অব্দি আছে বাংলাদেশের মানুষের দিকে চেয়ে। জাপানি মেহমানকে কতটুকু সমাদর করা হয়েছে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে পারবে তবে মিডিয়া তাকে যে মোটেও পাত্তা দেয়নি তা বোঝা গেছে। পোশাক শিল্পে আমেরিকার বিকল্প বাজার হিসেবে জাপান সম্ভাবনাময়, জানিনা আমরা তার কাছ থেকে কি সুবিধা নিতে পেরেছি!

মিশন বন্ধ ঘোষণার পর এক জাপানি সাংবাদিক বলেছিলেন, “ওরা শুধু টোকিও কেন জাপান ছেড়েই চলে যাক” বন্ধু দেশের প্রতি এই খেদোক্তি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নিস্কর্মন্নতাকে ইঙ্গিত করে। দলীয় রাজনীতি করা ব্যাক্তিরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় আসেন, তখন কোন সিদ্ধান্ত কখন নিতে হয় তা বোঝার ক্ষমতা তাদের থাকা উচিত। কেননা, পুরা দেশের ভাগ্য অনেকটাই তখন তাঁদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাদের অপ্রয়োজনীয় প্রত্যৎমতিতা দেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আর এর প্রভাব হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি।

হিলারিকে প্রধান্য দিতে গিয়ে জাপানি উপ প্রধানমন্ত্রীকে পাত্তা না দেয়া বা মিশন বন্ধ ঘোষণার মত গর্হিত কাজ আমাদের বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিপরীত। আমরা জাতি হিসেবে অতিথিপরায়ন আর বন্ধুবৎসল তবে জাপানি সরকার আর তার দেশের মানুষদের প্রতি আমাদের সেকুলার সরকারের মনোভাব সাধারণ মানুষের মনোভাবকে প্রতিনিধিত্ব করেনা। বাংলাদেশিরা জাপানিদের আজীবন বন্ধু হয়ে থাকবে তবে বাংলাদেশ সরকার না, অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হয়।

[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১:০০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×