somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কান্তজিউ মন্দির-দিনাজপুরঃ স্থাপত্য শৈলী ও পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ পৌরানিক কাহিনী (পর্ব-১০)

১৬ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সমসাময়িক জীবনচিত্র ও পৌরাণিক কাহিনী : উভয়বোলতা


কান্তজিউ মন্দিরের বিভিন্ন টেরাকোটায় মধ্য যুগের শেষ দিকে বাংলার সামাজিক জীবনের নানা কাহিনী বিবৃত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ধরলে বলা যায় যে, মন্দির গাত্রের দক্ষিণ পূর্ব কোণের ডান দিকে নিচে পোড়ামাটির ফলকে সমসাময়িক সমাজ জীবনের কাহিনী বর্ণিত আছে (ফলক চিত্র-২২)।


সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, একজন অভিজাত ব্যক্তি বা তাঁর অধস্তন ব্যক্তি অথবা একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী একটি সুসজ্জিত পালকি চড়ে সদলবলে ভ্রমণে যাচ্ছেন। পালকি বহন করছে ৬জন বেহারা। পালকী অনুসরণকারী লোকজনের নেতৃত্বে আছেন ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া একজন শান্তি রক্ষক। তাঁকে অনুসরণ করছে উট আরোহী ও পদচারী। পদচারীর হাতে আছে বর্শা। পালকীর নিচে একজন বংশীবাদককে দেখা যাচ্ছে, পেছনে একটি কুকুর ছুটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে পালকীর দৃশ্যাটি বেশ চমৎকার। পালকির আরোহী নকশাঙ্কিত বালিশের উপরে আলতোভাবে বাম হাতে হেলান দিয়ে আয়েসভরে হুঁকার নল টান দিচ্ছেন। তাঁর মুখে সুখী জীবনের ইংগিত হিসেবে মিষ্টি হাসি ফুটে আছে। এসব দৃশ্যের মানুষেরা মুঘল পোষাকে সজ্জিত যেমন পাগড়ি, আচকান, পায়জামা ও জুতা। তবে দেবতার মাথায় এক ধরণের মুকুট শোভা পাচ্ছে। বেহারাদের হাতে আছে তরবারি। ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া একজন লোক মনে হয় মশাল বহন করছে। দৃশ্যটি দেখে মনে হয় যেন এটি একটি রাতের বেলার ভ্রমণচিত্র।

পোড়ামাটির ফলকে যেসব সাধারণ মানুষ দেখা যায় তারা নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণীর। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে পদাতিক বাহিনী, পাহারাদার, সাহায্যকারী, নৌকার মাঝি, পালকির বেহারা ও দিনমজুর রয়েছে।

টেরাকোটার প্যানেলে শিল্পী যেসব পাখি এঁকেছেন- সেগুলির মধ্যে ময়ূর, মোরগ, হাঁস ইত্যাদি আছে। পশু ও অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে গণ্ডার, ঘোড়া, ছাগল, মহিষ, বন্য শূকর, কুকুর, সাপ, উট, হাতি, বানর, বড় শিংযুক্ত হরিণ, সাধারণ হরিণ, সিংহ ও গরু।

কান্তজিউ মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকে পরিবহণ ব্যবস্থার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। পশুচালিত পরিবহণ যেমন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ও মানষ চালিত নৌকা, পালকি ইত্যাদি সে সময়ে ব্যবহৃত হত। নৌকার মধ্যে ৩ ধরনের নৌকা দেখা যায়: ছিপ নৌকা বা দূরপাল্লার নৌকা, যোদ্ধার নৌকা বা সাম্পান নৌকা ও মালবাহী সাধারণ নৌকা। টেরাকোটায় দেখা যায় যে, দূরপাল্লার নৌকাগুলোকে আনন্দবিহারে যাবার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে (ফলকচিত্র-২৩)।

সাধারণ যাত্রীরা সমাজের সামান্য অধস্তন ব্যক্তিদের সাথে সারিবদ্ধভাবে বসে গান গাইতে গাইতে বা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে দ্রুত গতিতে ছিপ নৌকার দাড় বেয়ে চলছে। যুদ্ধের নৌকাগুলো সৈন্য সামন্ত ও যুদ্ধাস্ত্র বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে (ফলকচিত্র-২৪)। এটা সম্ভবত একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ জাহাজ। সৈন্যদের বহন করছে। অবশ্য এখানকার মানুষগুলো মুঘল পোষাক পরিহিত। সাধারণ নৌকাগুলো যাত্রী আনা নেওয়া করছে এবং পণ্য দ্রব্য বহণ করছে। সাধারণ গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি দেশের সাধারণ মানুষেরা যাতায়াত ও পরিবহণের কাজে ব্যবহার করত বলে মনে হয়। অভিজাত শ্রেণী যেগুলো ব্যবহার করত সেগুলো খুবই অলংকৃত থাকত এবং তাঁরা হুঁকার নল টানতে অভ্যস্থ ছিলেন।

কান্তজিউ মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকে শিকারের দৃশ্যাবলী থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবসর বিনোদন হিসেবে শিকার খুবই সমাদৃত ছিল। সাধারণ লোকেরা এতে আনন্দ উপভোগ করত। শিকারের দৃশ্যে হাতি, ঘোড়া বেশি দেখা যায়। এ ধরণের শিকার করার রীতি ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। (বাংলাদেশ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার দিনাজপুর ১৯৭৫) বাঘ শিকার করা ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার এছাড়া শিংযুক্ত হরিণ, সাধারণ হরিণ, শিংযুক্ত ছাগল, বন্য শূকর ও শিকার করা হতো বলে মনে হয়। শিকারে ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্রের মধ্যে লাঠি, তীর, ধনুক, তলোয়ার, বর্শা, মশাল ব্যবহৃত হত। কুকুর মানুষকে সাহায্য করত। অনেক সময় হাতি শুঁড়ের সাহায্যে হরিণ শিকার করে তুলে আনত। কোন কোন চিত্রে রাজকীয় শিকারীদের গায়ে মুঘল পোষাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায় (ফলকচিত্র-২৫)।

উত্তর ভারতীয় পোষাক পরিহিত মানুষের সমারোহ রয়েছে মন্দির ফলকে। আচকান, পায়জামা পরিহিত মানুষের সমারোহ রয়েছে মন্দির ফলকে। আচকান, পায়জামা পরিহিত পুরুষদের পাশে সালওয়ার কামিজ পরিহিত মহিলাদের চিহ্নিত করা খুবই সহজ। সবার মাথায় শিরস্ত্রাণ আছে। এসব পোষাক ও শিরস্ত্রাণ দেখে মনে হয় যে, দিনাজপুরের শাসকবর্গ ও অভিজাতরা মুঘল পোষাক পরতে অভ্যস্ত ছিলেন। অবশ্য মন্দির গাত্র ফলকে ইউরোপীয় পোশাক একটু সন্দেহের উদ্রেক করে। এক্ষেত্রে একটি ছবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে একজন ইউরোপীয় পোষাকে সজ্জিত মানুষকে মুঘল পোষাক পরিহিত অকজন পদাতিক সৈন্যের সাহায্য হাতিতে উঠতে দেখা যাচ্ছে।৪৬ মোটামুটি ভাবে বলা যায় যে, এর ফলকে উৎকীর্ণ মোটিফে, আঠার শতকের দিনাজপুর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি স্বচ্ছ জীবনালেখ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে লক্ষণীয় যে, মন্দিরটির প্রায় সর্বাংশে বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী উৎকীর্ণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে সমসাময়িক জীবন চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পরস্পর বিরোধী এ দুই ধারার সমাবেশ একে উভয়বোলতার দোষে দুষ্ট করেছে।


তথ্য নির্দেশনা:
৪৬. সিরাজুদ্দীন এম. “কান্তজিউ মন্দির: পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ সমসাময়িক জীবনচিত্র”, “দিনাজপুর: ইতিহাস ও ঐতিহ্য”, আহমেদ এস. ইউ সম্পাদিত, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, এশিয়াটিক সিভিল মিলিটারি প্রেস, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ: ৩৮০
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ভোর ৬:০৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×